Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

সৃজন-স্পর্শ, ২০২২

Short Stories/ছোটগল্প

সংক্রমণকালের দিনলিপি

মানসী মন্ডল


 

ঘুম ভেঙে চোখ মেলে খোলা দরজার বাইরে চোখ রেখেই দেখি, বাইরে বাসন্তীরঙা রোদ। আন্দাজে বুঝি বেলা প্রায় সাতটা। আলসেমি ছাড়তে চায় না চোখ থেকে। বালিশ আঁকড়ে আর একবার চোখ বন্ধ করি । বাবুর স্কুল নেই, আমারও নেই। এটুকু আলসেমি আমার হকের। তাছাড়া বাড়তি ঘুমটুকু সারাদিনের রসদও। বাবুর ধমকে উঠতেই হয়, মা, ওঠো, খিদে পেয়েছে আমার। 

মুখ ধুয়ে বাসি জামাকাপড় বদলে গায়ে চড়াই নতুন ঝকঝকে সকালের মত পরিষ্কার ধোয়া জামা। সকালের প্রথম আলোয় ছাদে যাওয়া আমার বরাবরের বিলাসিতা। সে যদি বর্ষাকাল হয় তাহলে তো কথাই নেই। প্রতিদিন কোনো না কোনো গাছ আমায় সারপ্রাইজ দেয়। তুলসী গাছে জল দিই। শুকনো মঞ্জরি ভেঙে ফেলি। তাতে গাছের জরা পিছিয়ে যায়, নতুন সবুজ পাতা গজায়।   আজ এডেনিয়ামে ফুল এল প্রথম। এই এডেনিয়াম গাছটা আমার নয়। ছোট্ট চারা গাছ চেয়ে নিয়েছিলাম এই শর্তে যে, প্রথম ফুল ফুটলে ফেরৎ দেব। গাছ আমার চাই না, শুধু ওই প্রথম ফুল ফোটানোর আনন্দ আমার থাক। একফালি শতরঞ্জি পেতে সূর্য প্রণাম সেরে নিই ।

ছাদ থেকে যখন রান্নাঘরে আসি ততক্ষণে সূর্য আরো একটু মাথার উপরে। একটা পাতলা নেশা উঁকিঝুঁকি মারে।  চায়ের জল বসাই, বাবুর ওটস ।

রান্নার মাসি, কাজের মাসিকে ছুটি দিয়েছি লকডাউনের দুদিন আগেই। এখন সংসার আমার, ঝক্কিও আমার ।অবশ্য বাবু সাহায্য করে কিছু, কিছু কাজে। বালিশ রোদ্দুরে দেয়, ভেজা জামাকাপড়ও, ফিল্টার থেকে বোতলে জল ভরে, খাওয়ার থালা বাইরে বেসিনে রেখে আসে, বিছানা ঝাড়ে ।

কাজ, বিশ্রাম, আবার কাজ । রান্না একপদ, দুপদ, তিনপদ ।মাছ, মাংসের ঝক্কি নেই। বাবুর ডিম আমার যা হোক কিছু। রান্না শেষে খুব যত্নে গ্যাসটেবিল, ঘরের মেঝে মুছি তকতকে করে।স্টিলের বেসিনটাও বেশ করে মাজি ।লকডাউনের এই কদিনেই রান্নাঘরে গৃহিণীর হাতের ছাপ চোখে পড়ে।

কাজ খানিকটা নেশার মত, করতে শুরু করলে থামা যায় না। অথচ এই আমিই স্কুলের দিনগুলোতে বাবুকে আর নিজেকে স্কুলে পাঠাতে ব্যস্ত থাকি। সন্ধ্যাবেলা যখন ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরি, ইচ্ছে করে না ঘরের কোনদিকে তাকাতে। দুবেলা রান্নাঘরের দখল একমাসির আর বাকি কাজকর্মেরও। সত্যি বলতে কি তেমনভাবে তাকানোর সময়ও পাই না। রান্নাঘরের আগুনকে প্রজ্জ্বলিত রাখা যে অনেক বড় দায়িত্ব।

এখন সকাল থেকে রাত সমস্ত সময়ের ব্যক্তিগত অধিকার একান্তই আমার। চলার পথ সদর দরজাতেই শেষ হয়ে গেছে। দিনের সব কাজ শেষে হাত পাতি রাতের আকাশের কাছে। সেখানে আকাশ গঙ্গায় ভাসে ক্ষয়াটে পাটাতনের চাঁদ।নিজের জ্যোৎস্না- জলে ভারি হতে হতে ডুবে যাবে একসময়। কালপুরুষ পশ্চিম আকাশে, ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মিথুন রাশির দুই পুনর্বসু নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। মাঝ আকাশের দখল নিয়েছে কর্কট রাশি। উত্তর পুবে সপ্তর্ষি অথচ অনেক অনেক দূরে পশ্চিমের দিগন্ত ঘেঁষে কৃত্তিকা, বশিষ্ঠ বাদে বাকি ছয় ঋষির স্ত্রী দল। যে সামাজিক দূরত্ব জমিতে, সেই দূরত্ব আকাশে, কোন অনাদিকাল থেকে ।কী বলছে নক্ষত্রদল? দূরে থাকো কিন্তু অমোঘ মহাকর্ষে ধরে থেকো একে অপরকে। তবে কি এই দূরত্ব সংক্রামিত হল মাটিতেও? 

রাতের অনুষঙ্গে কন্যাকুমারী মনে পড়ে। সেই বাসি পূর্ণিমা আর তিন অগাধ জলরাশি।

রাতের অনুষঙ্গে মরুভূমি মনে পড়ে।  তারা ভরা আকাশের গায়ে মৃতবৎসা মেঘ থেকে চুঁইয়ে পড়া হিম ঠাণ্ডা উত্তপ্ত বালির বুকে। এক অনুচ্চ প্রাচীন পাহাড়ের পাদদেশে এক বাংলো। গাছে গাছে জ্বলছে জোনাকি। হরিতকি ঝরে পড়ছে দুটো একটা। বড় বড় গাছেরা পাতার তালু মেলে দিয়ে মাটিতে ঝরে পড়ার আগেই রুখে দিচ্ছে আকাশের কান্না-শিশির। হঠাৎ একটা ছটফটানি টের পাই ভিতরে ভিতরে। আর ঠিক সেই সময় আমাকে অবাক করে দিয়ে মুঠোফোনে বেজে ওঠে রিংটোন,

'এখনো কিছুটা আলো ফোটা বাকি আছে আকাশে, নিঃসঙ্গতা দূরে ফেলে রেখে আজ পালাব তোমার হাত ধরে। যত দূরে যাই তোমাকে বুকের গভীরে বয়ে নিয়ে বেড়াই।'