সৃজন-স্পর্শ, ২০২২
Short Stories/ছোটগল্প
খোঁজ
দেবাশিষ সেনগুপ্ত
পটাশপুরে আমার কোনো বাড়ি নেই। আত্মীয়বন্ধু কেউ যে থাকে তাও নয়। তবু সপ্তাহে দুদিন আমি পটাশপুর যাই।
বাসস্ট্যান্ড থেকে তেমাথিনী রোড ধরে সোজা মিনিটদশেক। তারপর সত্যময়ী বালিকা বিদ্যালয় থেকে ডানদিকে ঘুরে ব্রজলালপুর। দূর থেকে দেখা যায় ক্ষুদিরাম স্মৃতি পাঠাগার। ছোট্ট একচিলতে ঘর। তিনদেওয়াল জোড়া বইয়ের আলমারি। মাঝখানে চারটে বেঞ্চিতে জনা পনেরো ছেলেমেয়ের তুমুল কলকল।
- 'মাস্টারকাকু! আজ একটা গল্প বলবে?' সামনের বেঞ্চের মেয়েটা টরটরি। সবসময় কিছু না কিছু বলা চাই!
- 'আগে পড়া বল দেখি!'
- 'আমি বলবো কাকু?' পাশের ছেলেটা উৎসাহে হাত তোলে। বাইরে ঘন হয়ে সন্ধে নামে।
খুব যে সমাজসেবা করছি তা নয়! খানিকটা দায়ে পড়েই।মারোয়াড়ী মালিকের শখের এনজিও। কাঁথি থেকে দেড়'ঘন্টার পথ বাসে। তারপর ভ্যানে বিশমিনিট। অবৈতনিক স্কুল। আমার ভাগে দুদিন, মঙ্গল আর শনি।
বাড়ী ফিরতে এগারোটা বেজে যায়। অপর্ণা অপেক্ষা করে।
প্রশ্ন করে না। এমনিতেই কথা বলে কম। এজন্য সুনামও আছে। মা মাঝেমাঝেই শোনায়। পাঁচবছর পরেও।
- 'কেমন পছন্দ করে এনেছিলাম বল! এমন শান্ত, লক্ষ্ণীমন্ত বৌ! মুরোদ ছিল তোর? নিজে তো একবার হাত পোড়ালি!'
আমি জবাব দিই না। এই বিয়েতে সায় ছিল না আমার। নেড়া বুঝদার হলে বার বার বেলতলায় যেতে চায় না। শোনেনি মা।
- 'ডিভোর্স কি আর কারো হয় না? তা বলে বাকী জীবন এমন ছন্নছাড়া হয়ে থাকবি?'
- 'বেশ তো আছি নির্ঝঞ্ঝাট মায়েপোয়ে! এই আধবুড়ো বয়েসে ......' আমি মরিয়া চেষ্টা করেছিলাম।
- 'আমি তো আর চিরকাল থাকবো না! তাছাড়া মেয়ের বয়সও তো কম না! মামামামী তো সময়ে বিয়েটাও দেয়নি! ভারী দু:খী। আপত্তি করিস না আর।'
আমি আপত্তি করি না। যে যার মত পড়া বলে যায়। কেবল সেকেন্ড বেঞ্চের কোণে বসা একজন, কিছুতেই মুখ খোলে না। তাকে আলাদা করে নিয়ে কোলে বসাতে হয়। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে পড়া ধরতে হয়।
না করলেও চলে এসব। আসলে কেমন মায়া পড়ে গেছে! বাপ'মা নেই।
ইদানীং ক্লাসশেষে বেরোনোর সময় ছেলেটা এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। কিছু বলে না, শুধু ছুঁয়ে থাকে। আমিও কথার ছলে কয়েকমিনিট দাঁড়িয়ে যাই। আনমনে মাথায় বিলি কেটে দিই। তারপর হঠাৎ হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসি। লাস্টবাস ছাড়ে ন'টায়। ভ্যান না পেলে ছুট লাগাতে হবে।
রোজকার মত আজও অপর্ণা নি:শব্দে ভাত বেড়ে দেয়। আওয়াজ না করে জলের গ্লাস এগিয়ে দেয়। আধোঅন্ধকারে চোখের নীচের কালি বা কপালের কাছে রূপোলি রেখা ঢাকা পড়ে থাকে। পাশের ঘরে মা ঘুমে কাদা।
আমি খেয়েদেয়ে সোজা বিছানায় উঠে পড়ি। সপ্তাহে অন্তত: দুটো দিন একেবারে অন্যরকম। রাতও। মঙ্গল আর শনি!
আলো নিভিয়ে অপর্ণা সরে আসে কাছে। বরফশীতল মেয়েটা কেমন বদলে যায়! শরীরজুড়ে আদরের ঝড় তোলে। তন্নতন্ন করে হাতড়ায় কিছু!
প্রথম প্রথম বুঝতাম না। আমোদ নিতাম। এখন লজ্জায় কাঁটা হয়ে থাকি! শুধু বুঝি না কী খোঁজে! হারানো শৈশব নাকি অধরা মাতৃত্ব!