Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

সৃজন-স্পর্শ, ২০২২

Short Stories/ছোটগল্প

যখন সন্ধিক্ষণ

অজন্তা সিনহা


 

"কিছু রং-রূপ এমন আছে…/ সময় হার 

মানে যার কাছে…"

কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ক্যান্টিনের সিঁড়ি দিয়ে নামছিল ইরাবতী। জায়গাটা ঠিক বেরোবার মুখে---প্রায় ধাক্কা লাগা থেকে নিজেকে সামলে মুখ তুলে দেখে সমরেশকে। এদিক-ওদিক কেউ নেই। অর্থাৎ কথাটা তাকেই বলা হয়েছে। ইরাবতী মুচকি হেসে নিজের পথ ধরে। একঘন্টার মধ্যে পাতা ছাড়তে হবে। সমরেশের রসিকতা বা স্তুতি যা-ই হোক, জবাব দিতে গেলে দেরি হয়ে যাবে।

সমরেশ চলে যাওয়া ইরাবতীকে দেখতে দেখতে ভাবে, আস্ত একটি পাকাল মাছ। কিছুতেই ধরা দেয় না। একটি সংক্ষিপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যান্টিনে ঢুকে যায় সে।

শেষ মুহূর্তে পাতায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল ইরাবতী। চেষ্টা করছিল কিছুতেই যেন কোনও ভুল না থেকে যায়। যদিও জানে, সুকুমারদার কাছে পাতা গেলেই ঠিক একটা না একটা ভুল খুঁজে বের করবেন। কে বলবে, মানুষটার বয়স সত্তর ছুঁয়েছে। আড়ালে নতুনরা তাঁকে 'প্রাগৈতিহাসিক' বলে। কিন্তু ইরাবতীর মতো পুরোনোরা আজও সুকুমারদার ওপর চূড়ান্ত নির্ভরশীল। ওঁর কাছেই তাঁদের প্রজন্মের কাজে হাতেখড়ি। সুকুমার সেন যেদিন সম্পাদকের চেয়ারটা ছাড়বেন, সেদিন–নাহ, সেদিনটার কথা ভাবতে চায় না ইরাবতী। যদিও দিনটা যে খুব কাছে, আর হায়নার দল যে এই প্রাগৈতিহাসিক মানুষটার ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে তাঁকে উৎপাটিত করবার জন্য, সে খবর জানে সে। দলটির নেতৃত্বে যে নিউজ এডিটর সমরেশ দত্ত, সে তথ্যও অনেকেরই জানা। সম্পাদকের চেয়ারটার দিকে বহুদিন তাকিয়ে আছে সমরেশ। অথচ এই সমরেশকে সুকুমারদাই একদিন একেবারে ছোট একটি সংবাদপত্র থেকে তুলে এনে ঘষেমেজে তৈরি করেন। ঘরের কোনে, অলিন্দে, সিঁড়ির ধাপে ইদানীং চাপা গুঞ্জন বাড়ছে । গুঞ্জন পরিবর্তনের। সুকুমারদা বলেন, যুগ সন্ধিক্ষণ ! ইরাবতী হঠাৎ কেমন অসহায় বোধ করে। 

ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছিল আনন্দ। তার ডিউটি আওয়ার অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বেরোতে পারছে না। ডেস্ক খালি রেখে যাওয়া যায় না। আজ নাইটে সেই নতুন মেয়েটা আসবে, কি যেন নাম ? 

 

"কি রে বাড়ি যাবি না ?" রিপোর্টিং ডেস্ক থেকে বলে বিমান। বিমানের ডাকে ঘুরে তাকায় আনন্দ।

জবাবে, "আরে, যাবার জন্য তো রেডি হয়ে বসে আছি। নাইটে নাকি কে একটা নতুন মেয়ে আসছে। কালই জয়েন করেছে শুনলাম সমরেশদার কাছে। এলো না তো এখনও।"

"মেয়ে নয়, ওটা একটা মাল।" রিপোর্টিং ডেস্কের একটা কোন একেবারে অন্ধকার। সেখান থেকেই কেউ বলে ওঠে কথাটা ! 

"মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ তীর্থ ! এটা ভদ্রলোকের জায়গা!"

"ভদ্রলোক ???" তীর্থ উঠে দাঁড়ায়। তার হা হা হাসিতে কেঁপে ওঠে গোটা হলঘর।

"বিপাশা...নাহ বিপস !! তোমার সমরেশদার ইয়ে ও। এখানে আগেও কাজ করেছে। নতুন নয়। বুঝেছ চাঁদু ? তোমার ওই মিশন কালচারে হবে না। উন্নতি করতে গেলে বিপাশার মতো হর্টিকালচার শিখতে হবে ! ফুল আর মধু !!" তারপরই আবার ধপ করে বসে টেবিলে মাথা রেখে নিস্তেজ হয়ে যায় তীর্থ। 

বিমান বোঝে, আজ নেশার মাত্রাটা একটু বেশিই হয়েছে তীর্থর। বিপাশা ফিরছে বলেই কি ?

অন্যদিকে আনন্দ বিরক্তি নিয়ে বসে থাকে। সে আক্ষরিক অর্থেই রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত সুসভ্য, সুসংস্কৃত একজন মানুষ। তীর্থ ঠিক উল্টো ! তার দিনের বেশিরভাগ সময় নানা নেশায় কালাতিপাত। মুখে অনবরত খিস্তিখেউর ! কতবার যে শো-কজের নোটিশ পেয়েছে !

"ওর চাকরিটা কী করে টিকে আছে বল তো বিমান ? এই রহস্যটা ঠিক বুঝি না আমি !" গলা নামিয়ে বলে আনন্দ।

"রহস্যের কিছু নেই। ওর কলমটার কথা ভেবে দেখ একবার। তাহলেই বুঝবি। জানি তুই ওকে পছন্দ করিস না। কিন্তু ওর লেখার প্রশংসা করতেই হবে তোকে। আমাদের জেনারেশনে সাংবাদিকতায় ওর ধারেকাছে কেউ নেই। বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার অভিমুখ পাল্টে দিয়েছে তীর্থ। যাই বলিস ওর গুণটা মানতেই হবে।"

সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে আনন্দ। তার মনে হয়, শুধু যদি নেশাটা কম করতো ! 

ঠিক এই সময় সিস্টেম থেকে ছুটে আসে 

সুমিতা আর অনিল। 

"ইরাবতী ম্যাডামের নতুন নম্বরটা নেই দেখলাম সিস্টেমে। পাতায় একটা সমস্যা হয়েছে। কথা বলা দরকার ওঁর সঙ্গে এখনই !" ছটফট করে বলে সুমিতা। ওদিকে অনিল ডেস্কে টাঙানো এডিটোরিয়াল স্টাফদের ফোন নম্বরের লিস্ট চেক করতে দৌড়োয়।

বিমান নিজের ফোনে খুঁজতে থাকে ইরাবতীর নম্বর। 

"ইরাবতী…কোথায় তুমি ?" অন্ধকার কোন থেকে তীর্থের গলাটা কেমন আর্ত শোনায়।

ভীষণ ক্লান্ত বোধ করছিল ইরাবতী। রাত ন'টায় বাড়ি ফিরে আবার বারোটায় ছুটতে ছুটতে আসা। তারপর যা ঝড় গেল ! শেষপর্যন্ত যে সামাল দেওয়া গেছে, সেটাই যথেষ্ট ! এটুকুও সম্ভব হলো সুমিতা আর অনিলের জন্য। ভাগ্যিস ওরা সমস্যাটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ! ইতিমধ্যে মর্নিং ও ডে শিফটের লোকজন এসে গেছে। ফ্লোরের বিশাল হলের সবক'টা কিউবিকল ভর্তি। একবার বাড়ি যেতে পারলে ভালো হতো, ভাবে ইরাবতী। কিন্তু সম্ভব নয়। একটু পরেই সমরেশের চেম্বারে মিটিং। একটু আগে জানিয়ে গেছে এই ফ্লোরের ফোর্থক্লাস স্টাফ রতন। কালকের ব্যাপারেই হবে। ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠলো ইরাবতীর। সমরেশ যে সুযোগটা চেয়েও পাচ্ছে না, তার শোধ প্রতিপদে তোলার চেষ্টা করে। খুব অবাক হবে না ইরাবতী, যদি সে একটা শো-কজ নোটিশ পায়। 

যদিও পুরোটাই টেকনিক্যাল এরর। কেউই সেই অর্থে দোষী নয়। ইরাবতীর দায়িত্ব মেয়েদের পাতা 'মনোরমা'-র দেখভাল করা। মূল কাগজের সঙ্গে প্রতি শুক্রবার থাকে এই চার পাতার বিশেষ উপহার। যার বিভিন্ন পাতায় থাকে ফ্যাশন, বিকিকিনি, রেসিপি, সামাজিক সমস্যা, আইনি পরামর্শ, সেলেব্রিটি সাক্ষাতকার ইত্যাদি। প্রথম পাতাতে একটা ব্লো-আপ ছবি যায়। দেখা গেল সেই ছবিটিতেই কোনও কারণে সমস্যা হচ্ছে। রাতারাতি রাতের ফটোগ্রাফারকে ধরে স্টক ছবি থেকে নতুন ছবি নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয় ইরাবতী। লেখাটাও পাল্টাতে হয়। সে ব্যাপারে তাকে নিশ্চিন্ত রাখে তীর্থ। সচরাচর তীর্থর মুখোমুখি হতে চায় না ইরাবতী। কিন্তু কাল কোনও উপায় ছিল না। এই হাউসে রাতারাতি যে কোনও বিষয়ে কভার স্টোরি দ্রুততম গতিতে লেখার মতো দক্ষ আর কে আছে ? তীর্থ লিখেছে, অনিল কম্পোজ করেছে। সে পাতা ভেঙে নতুন করে পাতা বানিয়েছে। এতকিছুর পরও ঘন্টা দুয়েকের লেট আটকানো যায়নি। সমরেশ সেটাকে ইস্যু না করে ছাড়ে ?

বীরভূমের এক ছোট গ্রাম থেকে ট্রেনে ফিরছিল তীর্থ। স্কুপ নিউজ, তারই সোর্স, একজন বৃদ্ধা তাঁর মৃত স্বামীর শেষ ইচ্ছে পূরণে জমা সমস্ত পুঁজি দিয়ে একটি স্কুল খুলেছেন। প্রত্যন্ত গ্রামটির প্রথম স্কুল। গতকাল ছিল তার উদ্বোধন। ফিতে কাটলেন স্থানীয় এক অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে বৃদ্ধার আলো আলো মুখটা মনে পড়ছিল তীর্থর। এইসব মানবিক খবর যতদিন সুকুমার সেন আছেন, ততদিনই গুরুত্ব পাবে। সমরেশ জমানায় এসব ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে যাবে, জানা কথা। 

লেখাটা খবর হিসেবে ডেইলির অ্যাঙ্কারে যাবে, যা সে কালই পাঠিয়ে দিয়েছে। এলাকার ফটোগ্রাফার ছেলেটি খুব সাহায্য করেছে তাকে। তারই বাইকে করে গ্রাম থেকে কয়েকমাইল দূরের শহরে এসে চিফ রিপোর্টার মৃণাল নস্করকে লেখাটা মেল করেছে তীর্থ। সেই তরুণ অর্থাৎ জীবেশ সরকার দারুন খুশি, তার তোলা ছবি খবরের কাগজে ছাপা হবে জেনে। বৃদ্ধাকে নিয়ে একটা আলাদা বড় স্টোরি যাবে মনোরমা'য়। আজ অফিসে ফিরে ইরাবতীকে পাবে কিনা জানে না তীর্থ। ফোন করেছিল। কিন্তু ইরাবতী যথারীতি ধরেনি। কতদিন এভাবে তাকে এড়িয়ে চলবে ইরাবতী ? কেনই বা ! 

"এই যে মহান রিপোর্টার তীর্থ মুখুজ্যে", অফিসে ঢুকতেই সমরেশের মুখোমুখি হওয়াটা মোটেই কাম্য ছিল না তীর্থর। কিন্তু হতে হলো। কবেই বা তার ইচ্ছেমতো কিছু হয়! একটা অনিচ্ছার জীবনই তো টেনে বেড়াচ্ছে সে ! কিন্তু না। এখন এসব ভাবার সময় নয়। সমরেশের খোঁচার জবাবে তীর্থ খুব আলগা গলায় বলে, "সে আর হতে পারলাম কই সমরেশদা ? যাবতীয় মহত্ব তো তোমার সিন্দুকে...একেবারে তালাবন্দি। ছিটেফোঁটাও জুটলো না কপালে কোনওদিন !"

সমরেশের পিত্তি জ্বালানো হাসিটা দেখতে দেখতে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তীর্থ শুনতে পেল, "স্পয়েল্ড চাইল্ড। সুকুমারদাই ওর মাথাটা খেয়েছে। আমার হাতে পড়লে…!" 

সমরেশ কথা শেষ করার আগেই বিমান হাসতে হাসতে বলে,"আমরা কিন্তু সব তোমার হাতে সমরেশদা। দেখো খেয়েপরে যেন থাকতে পারি।" সকলে হেসে ওঠে। সমরেশ একটু গম্ভীর হতে গিয়েও হেসে বিমানের পিঠ চাপড়ে বলে, "চিন্তা করিস না। শুধু তোর প্রাণের বন্ধুটাকে সামলাস!" হালকা পরিবেশ মুহূর্তে ভারী হয়ে যায়। সমরেশ সেটা বুঝেই বলে, "চল চা খাওয়া যাক। চলো মৃণালদা। এরপর আর সময় পাবো না।" মৃণাল অনুগত ভৃত্যের মতোই সমরেশের আদেশ পালন করে। জুনিয়রদের অনেকেই তাকে আড়ালে 'চিফ পাপেট' বলে, এই কারণেই। দলটা সমরেশের পিছু পিছু রাস্তার মোড়ের দিকে যায়। বিমানও...তাকেও যে যেতেই হবে। সমরেশের সঙ্গে শত্রুতা করে চাকরি খোয়াবার সাহস তীর্থর আছে। তার নেই।

সেদিনের মিটিংয়ে যে কোনও কারণেই হোক ইরাবতীর প্রতি কিছুটা লঘুই ছিল সমরেশ। আদতে সেদিনের বিষয় মোটেই মনোরমা'র লেট সংক্রান্ত ছিল না। বিপাশা ফিরেছে। তাই নিয়েই যত কথা সমরেশের। যদিও মিটিংয়ে বিপাশা নিজে ছিল না। নাইট ডিউটি করে বাড়ি গেছে সে। পাতা নিয়ে ঝামেলার মধ্যে নাইটে বিপাশার আসা-যাওয়া, কিছুই সেভাবে খেয়াল করেনি ইরাবতী। তার করার কথাও নয়। শুধু একবার তীর্থর গজগজানি শুনে বুঝেছিল, রঙ্গমঞ্চে নায়িকার আবির্ভাব ঘটে গেছে। এহ, এটা একেবারে তীর্থসুলভ ডায়ালগ হয়ে গেল। মনে মনে হেসে ফেলে ইরাবতী। ঠিক তখনই…"তোমাকে মিটিংয়ে ডাকার একটা বিশেষ কারণ আছে", সমরেশের কথায় সচকিত হয় ইরাবতী। বাকিদের যেতে বলে, গলার স্বর নামিয়ে আনে সমরেশ। তারপর, "তোমায় একটা কাজের ভার নিতে হবে ইরাবতী। বিপাশাকে একটু তৈরি করো। তোমার রিটায়ারমেন্টের পর ওকেই মনোরমা'র দায়িত্ব দিতে চাই।" রিটায়ারমেন্ট ? তার তো এখনও বছর দশেক চাকরি আছে। বলে কি সমরেশ ? 

সুকুমার সেনের সামনে বসে তীর্থ তার পুরো অভিজ্ঞতার গল্প বলছিল। সুকুমার দেখছিলেন ওকে। এ একেবারে অন্য তীর্থ ! 

"মাঝে মাঝে এই রুটিনের বাইরে যাওয়া, শহরের মধ্যে ঘুরেফিরে নিজের বিটের বাঁধাধরা গতে কাজ থেকে সরে অন্য ধরনের কাজ করাটা একজন সাংবাদিকের জন্য আবশ্যিক বলে, মনে করি আমি", সুকুমার সেনের কথায় প্রবল উৎসাহে মাথা নাড়ে তীর্থ।

তারপরই বলে, "আপনার অনুমোদন না থাকলে কাজটা করতে পারতাম না আমি। শুধু এটা কেন, আমার অনেক মনে রাখা কাজই আপনার উৎসাহে ও অনুমতিতে সম্ভব হয়েছে। না হলে…" কথা অসমাপ্ত রেখে থেমে যায় সে। সমরেশ ঢুকেছে ঘরে। 

তীর্থ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়, "চলি সুকুমারদা। ক্যান্টিনে যাব। খুব খিদে পেয়েছে। তারপর দেখি থানাগুলোকে ফোন করে।" এটাই তার বিট। তীর্থ মূলত একজন ক্রাইম রিপোর্টার। 

যেতে যেতে তীর্থ শোনে, "তোমার ট্রাভেল ও অন্যান্য বিলগুলো সাবমিট করে দিও তীর্থ ! প্রতিবার একাউন্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে কমপ্লেন করে ওরা।"

"দিয়ে দেব। চিন্তা করবেন না। তবে, এবার আর তেমন বিল কিসের সমরেশদা ? এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট আর রিকশা ভাড়া !" হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় তীর্থ।

"আপনার আস্কারাতেই বড্ড বেড়েছে ছেলেটা", সমরেশের কোথায় সুকুমার সেন হেসে বলেন, "ছাড়ো ওর কথা। তুমি কেন এসেছ বলো?"

"আপনি একটু এইচ আর ডিপার্টমেন্টকে বলে দিন। ওরা বিপাশার চিঠিটা দেয়নি এখনও। গেলেই বলছে, আপনার গ্রিন সিগন্যাল না পেলে…!" থেমে যায় সমরেশ। এই লোকটার পিছনে যাই বলুক বা করুক সে, সামনে বসলে এখনও পা কাঁপে তার।

সুকুমার সেন ভাবেন, কি নির্লজ্জ হয়ে পড়েছে সমরেশ। এই মেয়েটির জন্য একদা চাকরি খোয়াতে বসেছিল সে। তারপর হাত নেড়ে মন থেকে ময়লা ঝেড়ে ফেলার মতো স্মৃতি উড়িয়ে তিনি ইন্টারকমে এইচ আর-এ ফোন করেন ও প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। তারপর ইন্টারকমে রতনকে ডেকে চা দিতে বলেন। মাথাটা ব্যাথা করছে। সমরেশ আজকাল যতবার তাঁর সামনে এসে বসে, নিজের বিদায়ঘণ্টা শুনতে পান সুকুমার। মনে মনে প্রস্তুত হন তিনি।

ক্যান্টিনে পৌঁছে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা খালি টেবিল খোঁজার চেষ্টা করে তীর্থ। চোখ পড়ে একেবারে পিছনের দিকে। ওখানে একা বসে ইরাবতী। পাশের কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে। আকাশ দেখছে। পরনে একটা চওড়া কালো পাড় সাদা তাঁত। কাঁচাপাকা চুলে আলগা খোঁপা। মুখে প্রসাধনী বলতে একটা বড় কালো টিপ। কালো ফ্রেমের আড়ালে একজোড়া বিষাদমাখা চোখ। এটাই ইরাবতীর সিগনেচার সাজ। চোখ বুজলে এভাবেই তাকে দেখতে পায় তীর্থ সবসময়। চারপাশে লোকজনের কোলাহল। সন্ধ্যার ক্যান্টিন। চা আর স্ন্যাকস, সিগারেটের লুকনো ধোঁয়া…এলার্ম বাজলো বলে। হেসে ফেলে তীর্থ। তারপর চেঁচিয়ে বলে, "সাবধান সাবধান। শো-কজের চিঠিগুলো কিন্তু টাইপ হচ্ছে দেখে এলাম এইচ আর-এর ঘরে।" শুনে অন্যরাও হাসে। অফিসের মধ্যে সিগারেট খেয়ে নিয়মভাঙ্গার কাজটি সবচেয়ে বেশি তীর্থই করে। সমবেত হাসিতে চমকে তাকায় ইরাবতী। আর তখনই আচমকা আকাশ কালো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। 

বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল তীর্থ, আনন্দ,  অনিল আর বিমান। হঠাৎ পিছন থেকে বিপাশার গলা,"অত ধোঁয়া ছাড়লে নিজেই একদিন ধোঁয়া হয়ে যাবে।" বলতে বলতে দ্রুত অফিসের দিকে এগিয়ে যায় সে। বিমান রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তীর্থ থামিয়ে দেয়। ধুর !!! কি দরকার ? মনে মনে হাসে তীর্থ। এই মেয়েটা তাকে যেচে পড়ে উত্যক্ত করে সেদিন থেকে। দিন নয় রাত ছিল সেটা । সমরেশদার সঙ্গে একটা বিশ্ৰী তর্কাতর্কি হওয়ার পর অফিস থেকে বেরিয়ে এক চেনা ঠেকে গিয়ে প্রচুর মদ খেয়েছিল সে। সঙ্গে আরও কী কী যেন ছিল। ঠেকেরই বন্ধু বিশু কি একটা ট্যাবলেট দিয়েছিল তাকে। সেখান থেকে বেরিয়ে কী হলো, আর মনে নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে নিজেকে আবিষ্কার করলো বিপাশার ফ্ল্যাটে। সে নাকি রাস্তায় পড়ে ছিল। বিপাশা তুলে নিয়ে এসেছে। এরপর থেকেই বিপাশা হঠাৎ করে তাকে নিয়ে টানাহ্যাচড়া শুরু করলো। কাজকর্ম মাথায় উঠলো। তারপর তো ওই সমরেশদার সঙ্গে কেচ্ছা এবং চাকরি থেকে বিপাশার বরখাস্ত হওয়া। তীর্থ অবশ্য জানতো, সমরেশদা ক্ষমতার পাখাটা বিস্তার করলেই বিপাশা ফিরবে। ফিরবে এবং সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে তাকে। কেন না, বিপাশার ইচ্ছে পূর্ণ করেনি তীর্থ।

কয়েকটা দিন গতানুগতিক যায়। বড় কিছু ঘটে না। ইরাবতী টেবিলে মুখ গুঁজে কাজ করে । চারপাশে লোকজন কথা বলে। আজকাল কিছুই ভালো লাগে না ইরাবতীর। সমরেশের কথামতো বিপাশাকে কাজ শেখাবার ব্যর্থ চেষ্টা হতাশ করে তাকে। বিপাশা কেন কাজ শিখবে ? তার জীবনের সমীকরণটাই যে ইরাবতীর কর্ম সংস্কৃতির বিপরীত ! আপাতত ভাবনার গতি থামিয়ে হাতের কাজ দ্রুত সেরে নেবার চেষ্টা করে সে। তখনই খেয়াল হয়, অনেকক্ষণ থেকে তার আশপাশে ঘুরঘুর করছে রূপসা। রূপসা ডেস্কের স্টাফ। দ্বিতীয় পাতা মেকআপের দায়িত্ব তার। খুব সাদামাটা একটি মেয়ে। কাজটা যত্নে করে। মোটের ওপর রূপসা কিছুটা অক্সিজেন ইরাবতীর জন্য।

"কি রে কিছু বলবি ?"

"বাব্বা, এতক্ষণে দেখলে তাহলে ! ব্যস্ত দেখে ভয় পাচ্ছিলাম ডাকতে !" ইরাবতীর প্রশ্নের জবাবে জানায় রূপসা।

ইরাবতী হেসে, "আরে বল না ! ব্যস্ত আবার কি ?"

"আজ তোমার সঙ্গে ফিরবো। মায়ের কাছে যাব। কথা আছে। আমায় ফেলে যেও না কিন্তু !" 

রূপসা চলে যায়। ঠিক তখনই আসে খবরটা।

এম ডি তথাগত মিত্র সেরিব্রালে আক্রান্ত। সিরিয়াস কন্ডিশন। বাঁচবে কিনা সন্দেহ। এক মুহূর্তের জন্য পুরো অফিস স্তব্ধ হয়ে যায়। ইরাবতী চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পায় অশনি সংকেত। 

ওলা বুক করার আগে ইন্টারকমে রূপসাকে নিচে নামার নির্দেশ দিয়ে টেবিল গোছাতে শুরু করে ইরাবতী। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। তার মধ্যে রূপসা আবার কী বার্তা শোনাবে কে জানে ? অফিসের হাঁড়ির খবরে বরাবর বেজায় আগ্রহ তার। সেসব খবরে আগ্রহ না থাকলেও শোনে ইরাবতী। শোনার দরকার হয়। টিকে থাকার লড়াইয়ে অফিসের ভিতরকার খবর জানাটা যে প্রচন্ড জরুরি, এত বছরে সেটা বুঝে গেছে সে। তার পজিশনে একে-তাকে জিজ্ঞেস করে খবর সংগ্রহ ভালো দেখায় না। অগত্যা রূপসাই ভরসা। ওলা কিছুটা পথ এগিয়েছে। যথারীতি চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ে লম্বা লাইন ট্রাফিকের। 

এরই মধ্যে কথা শুরু হয়ে যায় রূপসার,"সুকুমারদা এই মেয়েটাকে কেন ফেরালো বল তো ইরাদি ?" 

"সুকুমারদা কি করবেন রূপসা ? সমরেশ এখন অনেকবেশি ম্যানেজমেন্টের প্রিয় হয়ে উঠেছে। তথাগত মিত্র আর আগের মতো আসতে পারেন না বলেই", বিষণ্ন ইরাবতী। 

"জানি।  ওঁর হয়ে এখন কাজটা দেখছেন বিনয় ভদ্র। উনি নাকি এখানকার একজন পার্টনার। তুমি চিনতে ওঁকে ইরাদি?"

"ভদ্রলোককে এত বছরের মধ্যে আগে তেমন দেখেছি বলে মনে পড়ে না রূপসা। গত দু'তিন বছরে প্রায় সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন। সমরেশ সুযোগ বুঝে ওঁর পায়ে পড়ে গেছে, বোঝাই যাচ্ছে। আর এবার যা হলো, তথাগত মিত্র বেঁচে ফিরলেও কাজ করতে পারবেন বলে আর মনে হয় না। সমরেশের পোয়াবারো। সঙ্গে সঙ্গে ওর অনুগামীদের। বিপাশা তো…!" থেমে যায় ইরাবতী। 

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ ! বিপাশার প্রধান সিঁড়ি যে সমরেশ, সেকথা অফিসের টেবিল-চেয়ারগুলো পর্যন্ত জানে। এরই সঙ্গে অনাগত দিনের আশঙ্কা বুকে চেপে বসতে চায় দুজনেরই। তথাগত কঠিন মানুষ ছিলেন। কিন্তু কাজের কদর করতেন। কাগজের প্রতি ভালোবাসা ছিল তাঁর। এখন কী হবে ? একটাই মেয়ে তাঁর, ডিভোর্সি। শোনা যায়, দারুন মুডি। 

কথা ঘোরাবার জন্যই কিনা কে জানে, রূপসা অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। 

"তীর্থকে একটু বলো ইরাদি। তোমার কথা শোনে ও। বড্ড বাড়াবাড়ি করছে, সেদিন বিমান বলছিল ও নাকি আজকাল ড্রাগ নিচ্ছে !" 

এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে যায় ইরাবতী। কী বলবে সে রূপসার কথার জবাবে ? তারপর এলোমেলো গলায় বলে, "কেউ বাচ্চা নয় রূপসা। নিজের ভালো না বুঝলে আমি কি করবো ? একটা সময় অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি। ও নিজের সর্বনাশ না করে ছাড়বে না ঠিক করেছে।" শেষের দিকে গলাটা ভেজা শোনায় ইরাবতীর। এমনকী রূপসাকেও বলতে পারবে না সে। তীর্থর ডাকে সাড়া দেওয়ার সামর্থ নেই তার। এটা তীর্থকে বুঝিয়ে উঠতে অক্ষম হয়েছে ইরাবতী। আজকাল তীর্থকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে সে। কিন্তু কষ্টটা যে কিছুতেই যায় না। 

পুজোর আর অল্প ক'দিন বাকি। এই সময়টায় ব্যস্ততা বহুগুণ বেড়ে যায় সংবাদপত্র অফিসে। তারই মধ্যে পরপর দুটি মৃত্যু ! তথাগত মিত্রর যাওয়াটা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু তীর্থ ? অত্যাচার করে করে শরীরটাকে ঝাঁঝরা করে ফেলেছিল সে। এতটাই যে হাসপাতালের টানাপোড়েনটাও তিন/চারদিনের বেশি স্থায়ী হয়নি।  বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে স্তব্ধ হয়ে যায় এই সংবাদে। আর ইরাবতী ? সে জানে, অনেকগুলো চোখ তাকেই দেখবে এখন কিছুদিন। তীর্থকে নিয়ে তার আবেগকে প্রথম দিনেই তালাবন্ধ সিন্দুকে পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। কিন্তু তীর্থ তো সেটা করেনি ! সে জানান দিয়েছে। বারবার। বরাবর। ইরাবতী জোর করে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু চশমাটা ঝাপসা হয়ে যাওয়া রোধ করতে পারে না কিছুতেই।

তথাগতর মৃত্যু এবং তাঁর মেয়ে সুনয়নার এম ডি-র চেয়ারে বসা ঠিক একমাসের ব্যবধানে ঘটে। অফিসের খোলনলচে বদলাতে থাকে দ্রুত। কনফারেন্স রুমে নতুন এম ডি-র ডাকা মিটিংয়ে সব ডিপার্টমেন্ট হেডরা আসেন। সেদিনই সকলের উপস্থিতিতে সুকুমার সেন তার ইস্তফাপত্র পেশ করেন। ব্যাপারটা খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবু, অনেকেরই মেতে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু সে তো তাদের মনের তোলপাড়। বাইরে সব স্বাভাবিক। 

অবশেষে এল সেই সকাল। সুকুমার গত বিশ বছরের অভ্যাস মতো এসে দাঁড়ালেন গেটের সামনে। সার্কুলেশন থেকে বান্ডিল বাঁধা কাগজ গাড়িতে লোড হচ্ছে আর একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে। শেষ গাড়িটা চলে যাওয়া পর্যন্ত স্মিতমুখে অপেক্ষা করলেন তিনি। তারপর লিফটে তিনতলায়। হলঘরে তাঁর বিদায় উপলক্ষে এক ছোট আয়োজন ছিল। ছোটই… সিনিয়রদের মধ্যে ইরাবতী ছাড়া ছিলেন সার্কুলেশন ম্যানেজার আর সিস্টেম হেড। এঁরা কেউই এডিটোরিয়াল স্টাফ নন। কিন্তু, শুরু থেকেই সুকুমারের সঙ্গে কাজ করেছেন, সেই আবেগের তাগিদেই না থেকে পারেননি। আর কিছু জুনিয়র রিপোর্টার, সিস্টেমের এক-দু'জন ছেলেমেয়ে আর রতন। সে বেচারা কেঁদে একাকার। শেষে সুকুমারের বকুনি খেয়ে থামে আর ইরাবতীর নির্দেশে সবাইকে চা বানিয়ে খাওয়ায়। 

পর্ব চুকলে ইরাবতীকে নিয়ে নিচে নামেন সুকুমার। বাকিরা যে যার মতো কাজে বা ঘরে ফেরার পথে। সুকুমার গাড়িতে উঠে ইরাবতীকে বলেন, "যোগাযোগ রেখো।" একবার তাকান অফিস বাড়িটার দিকে। তারপর সোজা হয়ে বসেন গাড়িতে। তাঁর মুখের অদ্ভুত নিরাসক্তি কোনও দিন ভুলবে না ইরাবতী। সেও ধীর পায়ে রাস্তায় এসে একটা ওলা বুক করে। গতকাল আর বাড়ি ফেরেনি সে। সুকুমারদার যাওয়ার সময় থাকতেই হতো তাকে। এবার ফিরতে হবে। আবার অফিসে আসা তারপর। এই আসাটা কতদিনের জানে না ইরাবতী। মনে মনে সে উচ্চারণ করে 'সন্ধিক্ষণ'!