Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

সৃজন-স্পর্শ, ২০২২

Short Stories/ছোটগল্প

মায়া রোববার

সুরথ রায়


 

আমার আশংকাটাই শেষপর্যন্ত সত্যি হয়ে গেল। আজ আমার ভোরের স্বপ্নে টুকুন দেখা দিল। একটু দেরিতে দেখা দিল, এই যা। লাস্ট দু-বছর ধরেই ভাবছিলাম, একবার অন্তত ও আমার স্বপ্নে দেখা দেবে। অবশেষে আজ সেটা ঘটল। তবে আমার স্থির বিশ্বাস ছিল যে দেখা দিলেও টুকুন নিশ্চিতভাবে দুঃস্বপ্নে দেখা দেবে। সেটা অবশ্য মিলল না। 

      আমি দেখলাম একটা বড়ো ঝিলের ধারে ও নেচে নেচে গান গাইছে। মুখে হাসি। চোখে ঝিলিক। যাকে বলে বিলোল কটাক্ষ। একসময় ও আমার দিকে ওর একটা হাত বাড়িয়ে দিল। আমারও ইচ্ছে হল, ওর হাতটা ধরি। ধরতে গেলাম যেই, ফসকে গেল। আর ঝপাস করে টুকুন ওই ঝিলের জলে পড়ে গেল। বাঁচার জন্য হাত ছুড়ছিল। আমি ওর হাত ধরে জল থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। ও ভুস করে জলে ডুবে গেল। আমি তো সাঁতার জানি না। কী করব ঠিক করতে না পেরে যখন ফিরে আসছি, দেখি সামনের রাস্তায় একটা সাইকেল রিকশায় চেপে টুকুন চলে যাচ্ছে। আমাকে টা-টা করল। আমিও হাতটা টা-টা করার জন্য তুলতেই ঘুম ভেঙে গেল। 

      মায়ের গলা।

      ‘আমি বেরোচ্ছি। ফ্লাস্কে চা করা আছে। ডাল আর মাছের কালিয়া আছে ফ্রিজে। গরম করে খেয়ে নিস। আমার ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা হবে। রাতে দোকান থেকে রুটি-তড়কা কিনে আনিস। আমাদের দুজনের মতো।‘

      মায়ের ইদানিং নতুন এক বাতিক হয়েছে। রোববার এলেই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়ে। আজকের গন্তব্য পাইকপাড়ায় ছোটমাসির বাড়ি। সেখান থেকে নাকি যাবে দক্ষিণেশ্বর। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে রাতে ফিরবে। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। বাইরে থাকলে মন মেজাজও ভালো থাকে। খিটখিটে ভাবটা কমে।

    টুকুন তো অনেকদিন আগেই বলে দিয়েছিল, অমন খিটখিটে শাশুড়ির সঙ্গে ঘর করা সম্ভব নয়। অবশ্য শাশুড়ি খিটখিটে না হলেও ও ঘর করত বলে মনে হয় না।

    টুকুন আমার বউ। ভালো নাম সেঁজুতি। তবে দু’বছর হল আমাদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ নেই। ও থাকে ডুয়ার্সের বীরপাড়াতে। কলেজে পড়ায় আর চুটিয়ে সোশাল ওয়ার্ক করে। 

    আমরা আলাদা থাকলেও আমাদের ডিভোর্স হয়নি। যে কোনো দিনই হতে পারে। কিন্তু ডিভোর্স করতে গেলে অনেক হ্যাপা। অত হ্যাপা সামলানো আমার কম্মো নয়। আর টুকুনও খুব ব্যস্ত। ওইসব উকিলের কাছে দৌড়োদৌড়ি করার সময় ওর নেই। ফলে ডিভোর্স এর ব্যাপারটা বিশেষ এগোয়নি।

    মাসে অন্তত একবার হলেও টুকুন আমাকে ফোন করে। খবরাখবর নেয়। আমিও মাঝেমাঝে ফোন করি। তবে প্রত্যেকবারই ওর ফোন বিজি থাকে।

    ফোন করে টুকুন আমাদের বাড়ির সকলের খবর নেয়। মায়ের খবরও নেয়। তারপর বলে, ‘এবারে ট্রান্সফার নিয়ে বীরপাড়াতে চলে এসো।‘

    আমি বলি, ‘সম্ভব নয়।‘

    তখন তেড়ে ঝগড়া করে। শেষে বলে, ‘সামনের মাসেই ডিভোর্সের নোটিশ পাঠাচ্ছি।‘

    তারপর আবার পরের মাসে ফোন করে।

    আমাদের বিয়েটা সম্বন্ধ করেই হয়েছিল। আমার সেজো পিসিমার ননদ থাকে জলপাইগুড়িতে। তার দেওরের মেয়ে হল টুকুন। বিয়ের সময় কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাস করে বসেছিল। তখনও চাকরিটা হয়নি। চাকরি হল বিয়ের ঠিক পাঁচ মাসের মাথায়। তাও আবার বীরপাড়া কলেজে। আমি ওখানে যেতে বারণ করলাম। ও রাজি হল না। উত্তরবঙ্গ ছেড়ে থাকার কথা নাকি ভাবতেই পারে না। উল্টে আমাকে বলেছিল, ‘তোমার তো ব্যাংকের চাকরি। চেষ্টা করলে কি ওইদিকে ট্রান্সফার নিতে পারো না?’

    সে হয়ত পারি। কিন্তু মা-কে ছেড়ে, এই বাড়ি, এই পাড়া, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে যাওয়া যায় না। 

     ততদিনে অবশ্য শাশুড়ি আর কলকাতা সম্পর্কে ওর মোহভঙ্গ হয়ে গেছে। ওর শাশুড়ি মানে আমার মা হল গিয়ে যাকে বলে দোর্দন্ডপ্রতাপ মহিলা। মায়ের শাশুড়িও তাই ছিল। মাকে যথেষ্ট জ্বালিয়েছে। মা-ও শাশুড়ি হয়ে তাকে ছাপিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমার স্বভাবটা আবার অনেকটা আমার বাবার মতো। একটু ম্যাদামারা টাইপ। বাবা দেখেছি ঝগড়াঝাটি বা তর্কবিতর্ক করার চাইতে চুপচাপ গালমন্দ হজম করতে বেশি ভালোবাসত। অবশ্য খুব বেশিদিন বাবাকে দেখিনি। আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বছরেই বাবা ওপরে চলে গেছে। 

    মা বেরিয়ে যেতে আমি বিছানার ওপর বাবু হয়ে বসে কোলের ওপর বালিশটা টেনে নিলাম। মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। স্বপ্নের রেশটা এখনও কাটেনি। মনে হল। এ খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার কিন্তু! একটানা দু’বছর আলাদা থাকার পর টুকুন স্বপ্নে দেখা দিল। এতদিন দেখা দেয়নি কেন? আর দেখাই যদি দিল তাহলে ঝগড়া করল না কেন? সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল।

     আর ওই হাত ফসকে জলে পড়ে যাওয়া অথবা আমাকে টা-টা করে রিকশায় চেপে চলে যাওয়ার অর্থ কী? ও কি কোনো বিপদে পড়েছে? নাকি অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে? কে জানে! একবার সুমন্তদা’র সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে।

   সুমন্তদা’ আমাদের পাড়াতেই থাকে। সাইকোলজির প্রফেসর। তবে মুশকিল আছে। ওকে এসব বললেই বলবে, ‘সন্ধেবেলা একটা হুইস্কির বোতল নিয়ে চলে আয়। হুইস্কি খেতে খেতে আলোচনা করা যাবে।‘

    আমার ফালতু কিছু টাকা খরচা হয়ে যাবে। আমি হুইস্কি খাই না। খুব গায়ে লাগে। 

    যাই হোক, সবার আগে টুকুনকে একটা ফোন করা দরকার। দেয়ালঘড়িতে দেখলাম, ছ’টা একচল্লিশ। কোনো মানে হয়! রোববার এত সকালে কেউ ঘুম থেকে ওঠে? নাঃ, মায়ের ওপর টুকুনের রাগটা যুক্তিসঙ্গত। আমারও রাগ হয়ে গেল।

            ২

    ব্রেকফাস্টে আজ আমার লালার দোকানের কচুরি খেতে ইচ্ছে করছে। সঙ্গে জিলিপি। কিন্তু বাড়ি থেকে লালার দোকান পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে কচুরি-জিলিপি কিনে নিয়ে আসার কথা ভাবতেই গায়ে জ্বর এল। লালার দোকানে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা নেই। থাকা উচিত ছিল।

    বাসি মুখেই চায়ে চুমুক দিলাম। মনে হল, রোববারটা নানাভাবে এনজয় করা যেতে পারে। কী কী করা যেতে পারে তার একটা লিস্ট বানানো দরকার। তার জন্য প্রয়োজন এক টুকরো কাগজ আর একটা পেন। কাগজ-পেন টেবিলের ওপরেই আছে। টেবিলটা খাট থেকে কিছুটা দূরে। আগে চা-টুকু খেয়ে নেওয়া যাক। তারপর লিস্ট করা যাবে। 

     মোবাইল ফোনটা নিয়ে শিবেন এর নম্বর বের করলাম। শিবেন আমার বন্ধু ছিল, ছেলেবেলায়। এখন আর বন্ধুত্ব নেই। বাড়িভাড়ার দালালি করে। দালালের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা ঠিক নয়। রাস্তাঘাটে দেখা হলে এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করি। সবসময় পারি না। দু’চারটে কথা বলতেই হয়। 

     দেখা হলেই শিবেন টাকা চায়। বেশি নয়। পঞ্চাশ-একশো-দুশো। ও বলে ধার নিচ্ছে। যদিও কখনোই ফেরত দিতে পারে না। শিবেনের বউও ওকে ছেড়ে চলে গেছে। সেই অর্থে আমরা দুজনেই স্ত্রী-পরিত্যক্ত। তবে ওর বউয়ের কেসটা টুকুনের মতো নয়। ওর বউ অন্য একটা লোকের সঙ্গে ভেগেছে।

    একবার রিং হতেই শিবেন ফোনটা ধরল। আমি বললাম, ‘শিবেন, কচুরি খাবি? লালার দোকানের কচুরি।‘

     শিবেন বলল, ‘কেন খাবো না? কী করতে হবে বল।‘

     ‘তোর কাছে পঞ্চাশটা টাকা হবে?’

     ‘কেন হবে না? আমাকে কী ভাবিস বল তো? ভিখিরি?’

     ‘আরে না না। খুচরো আছে কিনা জিজ্ঞেস করছিলাম। আমার কাছে সব পাঁচশো টাকার নোট। যাক, তুই বরং লালার দোকান থেকে আটখানা কচুরি আর দুটো জিলিপি কিনে আমাদের বাড়ি চলে আয়। দুজনে বসে খাবো।‘

    ‘তোদের বাড়ি? সেরেছে! তোদের বাড়ি যাব না। মাসিমা বড্ড জ্ঞান দেয়।‘

    ‘আরে মা বাড়ি নেই। তুই নির্ভয়ে চলে আয়।‘

    ‘সে যাচ্ছি। কিন্তু আজ আমার পাঁচশোটা টাকা দরকার। ধার দিবি বল!’

    একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা দেব। তুই দেরি না করে চলে আয়।‘

    শিবেন ফোন ছেড়ে দিল। লালার কচুরির কথা ভেবেই আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। আমি তোয়ালে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। এটুকু সুখ উপভোগ করার জন্য সাড়ে পাঁচশো টাকা খরচ করাই যায়।

 ## 

    বাথরুম থেকে বেরিয়ে মাথা মুছতে মুছতে শুনতে পেলাম জ্যাঠাইমা একতলা থেকে চেঁচাচ্ছে।

    ‘ বিনু, অ বিনু, শুনতে পাচ্চিস? শৈলেনবাবু এয়েচেন। তোর খোঁজ করচেন। ওপরে পাটিয়ে দেব?’

     জ্যাঠাইমার গলায় বিরক্তির ছোঁয়া। অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে? নাকি পুজো করতে বসেছিল? জ্যাঠাইমার সংসার একতলায়। সাংঘাতিক শুচিবাই। কিন্তু শৈলেনবাবু আমার খোঁজ করছেন কেন?

    বললাম, ‘পাঠিয়ে দাও।‘

     শৈলেনবাবু আমাদের পাশের পাড়ায় থাকেন। ওঁর ছেলে সৈকত আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। এখন ইউএসএ-তে থাকে। অনেকবছর ওকে দেখিনি। যোগাযোগ নেই।

     শৈলেনবাবুকে ডাইনিং স্পেসে বসালাম। একটু বেশিই বুড়ো দেখাচ্ছে। গাল দুটো তুবড়ে গেছে। মাথার চুল পাতলা, আর সাদা। পাজামার ওপরে হাফ পাঞ্জাবি পরে আছেন। চোখে মোটা কাচের চশমা। দৃষ্টি যেন একটু ঘোলাটে আর অন্যমনস্ক। 

     ‘বলুন কাকাবাবু কেমন আছেন।‘

     শৈলেনবাবুর দৃষ্টি ঘরের দেয়ালের দিকে। বললেন, ‘আছি, এই যেমন দেখছ।‘

     ‘সৈকতের খবর কী? কেমন আছে?’

     ‘সে-ও ভালোই আছে।‘

     একটু থেমে বললেন, ‘তোমার কাছে একটা দরকারে এলাম। একটু আলোচনা করা দরকার।‘

     সর্বনাশ! শৈলেনবাবুর আবার কী দরকার? সৈকত টাকা-ফাকা পাঠাচ্ছে না নাকি!

     আমি একটা টুলের ওপর বসে বললাম, ‘বলুন, কী ব্যাপার?’

     ‘কাল রাতে আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। ঘুম ভাঙার পর থেকে অনেক ভেবেও কুলকিনারা করতে পারলাম না। তাই তোমার কাছে ছুটে এলাম।‘

     বোঝো কান্ড! আমি নিজেই একটা স্বপ্ন দেখে হাবুডুবু খাচ্ছি, আর উনি এসেছেন আমার কাছে স্বপ্নের সমস্যা নিয়ে। 

    একটু হেসে বললাম, ‘স্বপ্নের আমি কী বুঝি কাকাবাবু?”

    ‘পুরো বিষয়টা শুনলে হয়ত তুমি কিছু আইডিয়া দিতে পারবে।‘

    আমার খুব বিরক্ত লাগলেও কিছু করার নেই। চুপ করে বসে রইলাম।

    শৈলেনবাবু বললেন, ‘ বাড়িতে পুরোনো একটা তক্তপোষ আছে। একসময় সৈকত ওই তক্তপোষটায় ঘুমোত। আমি দেখলাম কি জানো, সৈকতের তক্তপোষটা মাথায় নিয়ে আমি কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি।‘

    আমি খুব জোরে হেসে উঠতে গিয়েও সামলে নিলাম। বললাম, ‘স্বপ্ন তো এমন আজগুবিই হয় কাকাবাবু। আপনার প্রেসার ঠিক আছে তো? সুগার? রাতে ঘুম হয়?’

    আমার কথাগুলো যেন উনি শুনতেই পেলেন না। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে চললেন, ‘ছেলের তক্তপোষ মাথায় নিয়ে আমি একটার পর একটা গলি পেরিয়ে যাচ্ছি। আর একটা বাড়ি খুঁজছি ভাড়া নেওয়ার জন্য। কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না।‘

     শৈলেনবাবু থামলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এরকম স্বপ্ন কেন দেখলাম বলো দেখি? আমি কি সত্যিই কোনো দিন ছেলের জন্য ঘরভাড়া খুঁজতে বেরিয়েছিলাম? নাকি আমার নিজের জন্যই আমাকে ঘর খুঁজতে বেরোতে হবে?’

    আমি কিছুই বুঝতে না পেরে বললাম, ‘কিন্তু আপনার এই স্বপ্নের মানে আমি কী করে বলব?’

    ‘সেটাই তো আসল রহস্য বিনু। প্রত্যেকটা বাড়ি থেকে বেরিয়েই স্বপ্নে দেখতে পেলাম সামনের মোড়ে তুমি দাঁড়িয়ে আছ, আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছ।‘

    আমি ভয়ংকর অবাক হয়ে বললাম, ‘আমি?’

     ‘হ্যাঁ, তুমি। আমি স্পষ্ট দেখেছি।‘

     একটু ভেবে আমি বললাম, ‘কাকাবাবু, আপনার সঙ্গে সৈকতের লাস্ট কবে কথা হয়েছে?’

     ‘গত রোববার! ও তো প্রত্যেক রোববার সন্ধেবেলা ফোন করে।‘

     ‘গত রোববার বিশেষ কোনো কথা হয়েছে? মানে ওর আসার ব্যাপারে! অনেক বছর হল আসেনি তো!’

     ‘ছ’বছর আগে এসেছিল। নাঃ, তেমন কোনো কথা তো হয়নি। ফোন করলেই ওর মা আসার কথা জিজ্ঞেস করে বটে। কিন্তু আসবে বললেই কি আর আসা যায়? অত বড়ো চাকরি। তার ওপর নিজের সংসার---বউ, ছেলে, মেয়ে।‘

    আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘কাকাবাবু, যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

    উনি আমার দিকে তাকালেন।

    আমি বললাম, ‘সৈকত ওখান থেকে আপনাদের টাকাকড়ি পাঠায় তো?’

    শৈলেনবাবু একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সে আর কী বলব! টাকা তো পাঠায়ই, বড্ডো বেশি পরিমাণে পাঠায়। অত টাকা নিয়ে আমরা বুড়োবুড়িতে কী করব? আমাদের প্রয়োজনই বা কতটুকু! তবু শোনে না। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কেবল জমা হয়ে চলেছে। সবই রেখে দিয়েছি। ও এলে ওকেই দিয়ে দেব।‘

    এমন সমস্যায় পড়ে আমার মাথাটা পুরো ঘুলিয়ে যাচ্ছিল। শিবেন এসে বাঁচিয়ে দিল।

           ৩ 

    ‘কাকাবাবু, কচুরি খাবেন? লালার দোকানের কচুরি।‘

    আমার কথা শুনে শৈলেনবাবুর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমি স্পষ্ট দেখলাম, শিবেনের মুখে ব্যাজার ভাব। 

     শৈলেনবাবু বললেন, ‘লালার দোকানের কচুরি? আহা, কতকাল খাইনি! তোমার কাকিমা শুনলেই রাগারাগি করবে। যাক গে, কে আর দেখতে আসছে? দাও দু’খানা।‘

     শিবেনকে অখুশি না করে আমার ভাগ থেকে দু’খানা কচুরি একটা কাচের প্লেটে তুলে শৈলেনবাবুকে দিলাম। সঙ্গে তরকারি। জিলিপিটাও দিলাম। শিবেনের চারখানা। আমার দু পিস।

    শিবেন নির্লজ্জের মতো বলল, ‘তুই জিলিপি খাবি না?’

    ‘না রে, সামান্য একটু সুগার ধরা পড়েছে। মিষ্টিটা কন্ট্রোল করছি।‘

    নড়বড়ে দাঁতে কচুরি চিবোতে চিবোতে শৈলেনবাবু বললেন, ‘ভালো করেছ। এখন থেকেই কন্ট্রোল করা ভালো। তোমার বাপ-জ্যাঠা দু’জনেই তো সুগারে গেছেন।‘

    আমি উত্তর না দিয়ে কচুরি খেতে লাগলাম।

    শৈলেনবাবু বললেন, ‘তোমাকে দেখে ভারি ভালো লাগে বিনু। তোমার বাবা যখন গেলেন তখন তোমার কতই বা বয়স! তুমি যে নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে লেখাপড়া শেষ করলে এবং ব্যাংকে এত ভালো চাকরি জোটালে, এ কি কম কথা? তুমি মানুষ না হলে তোমার মা যে ভেসে যেতেন!’

     আমার হাসি পেল। স্কুলে পড়ার সময় শৈলেনবাবু আমাদের মতো ছেলেদের পাত্তা দিতেন না। সৈকত ফার্স্ট বয় বলে ওকে আমাদের সঙ্গে মিশতেও দিতেন না। হাসি পেলেও হাসতে পারলাম না। তার বদলে বললাম, ‘ওইসব স্বপ্ন-টপ্ন নিয়ে একদম দুশ্চিন্তা করবেন না। বয়সের কারণে এসব হয়েই থাকে। আজ সন্ধেবেলা সৈকত ফোন করলে এসব কথা বলার দরকার নেই। ও আবার দুশ্চিন্তা করতে পারে।‘

    শৈলেনবাবু ঘাড় নাড়লেন, ‘ঠিক ঠিক।‘

     উনি চলে যেতেই শিবেন বলল, ‘ভাই, পাঁচশো টাকাটা দে।!’

    বললাম, ‘দিচ্ছি দাঁড়া।‘

    ভেতরের ঘরে ড্রয়ার থেকে পার্সটা বের করেছি এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল। 

    ‘হ্যালো, কে বিনু? আমি দোলা কাকিমা বলছি।‘

    আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, বলুন।‘

    ‘আর বলিস না বাবা। সাতসকালে বাড়ির ট্রান্সফরমার টা উড়ে গিয়েছে। কিছু একটা কর। পাম্প চালানো যাচ্ছে না। ট্যাঙ্কিতে এক ফোঁটা জল নেই। পায়খানা-বাথরুম যাওয়া যাচ্ছে না।‘

     দোলা কাকিমা আমাদের পাড়ারই লোক। বাবু কাকার বউ। ওদের বাড়িটার বয়স কম করেও দেড়শো বছর হবে। ওই বাড়িতে অন্তত চোদ্দ-পনেরো ঘর ভাড়াটে থাকে। তবে তারা নিজেরা তো নয়ই, পাড়ার লোকেও আর তাদের ভাড়াটে বলে মনে করে না। 

     বাবু কাকা বলে, ওরা নাকি এককালে অর্ধেক কলকাতার মালিক ছিল। সুতরাং যতই ভাঙাচোরা হোক, ওদের বাড়িতে ট্রান্সফরমার থাকা আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। তবে ট্রান্সফার সারাতে পারে এমন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি তো আমার জানা নেই!

     সেকথা বলাতে দোলা কাকিমা কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘দ্যাখ বাবু, কিছু একটা কর। তুই চাইলে সব করতে পারিস।‘

    আমি নিরুপায় হয়ে বললাম, ‘দেখছি কী করা যায়।‘

    দুজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে আমি চিনি। তাদের মধ্যে যে একটু এক্সপার্ট গোছের সেই রোহিতদা’কে ফোন করলাম। ব্যাপারটা শুনে পাত্তাই দিল না। বলল, ‘শোন ভাই, এখন আমি গড়িয়াতে ফ্ল্যাটবাড়ির কন্ট্র্যাক্ট নিয়েছি। প্রোমোটারদের সঙ্গে কাজ করছি। ওইসব ফাউ কাজ আর করি না।‘

    দ্বিতীয় জন হল গোতে। টুকটাক সারাইয়ের কাজ করে। ও কি পারবে? বাবু কাকাদের বাড়ির ট্রান্সফারমার তো, মনে হয় পেরে যাবে। ওকেই ফোন লাগালাম।

    গোতে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। বলল পঞ্চাশ টাকা মজুরি নেবে। কাজ না দেখে মজুরি বলে দেয় বলেই গোতেকে আমার এত ভালো লাগে। 

   খবরটা দোলা কাকিমাকে ফোন করে জানাতে উনি আমাকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। 

    শিবেনকে পাঁচশো টাকার একটা নোট দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার রে, আজ একেবারে পাঁচশো টাকার দরকার পড়ল কেন?’

    ‘আর বলিস না মাইরি। সোনারপুর থেকে বোন-ভগ্নিপতি আসবে। মা বলল বাজার থেকে চিকেন আর মাছের মুড়ো নিয়ে আয়। সঙ্গে একটু দই-মিষ্টি। জামাই বলে কথা। এটুকু না করলে ইজ্জত থাকে না। তা সাতসকালে মাসিমা কোথায় গেলেন?’

    ‘দক্ষিণেশ্বর। ছোট মাসির সঙ্গে। রাতে ফিরবে।‘

     ‘সে কি রে, তাহলে তোর খাওয়াদাওয়ার কী হবে?’

      আমি হেসে বললাম, ‘মা কিছু না কিছু রান্না করে রেখে গেছে। গরম করে নিলেই হবে। আমি শুধু ভাতটা করে নেব।‘

     শিবেন যেন খুব লজ্জা পেয়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘কী যে বলিস মাইরি! হাত পুড়িয়ে খাবি? তার চেয়ে আজ আমার বাড়িতে খেয়ে নিস।‘

    আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘আরে না না, তোর বাড়িতে আজ গেস্ট আসবে। ওখানে খাব কী?’

    ‘তাতে কী হয়েছে? ওরা ওদের মতো আসবে। তুই আমার গেস্ট হিসেবে যাবি। কোনো কথা শুনব না। একটা-দেড়টা নাগাদ চলে যাস।‘ 

     আমার কোনো আপত্তি না শুনে শিবেন হনহন করে বেরিয়ে গেল। আমি আবার একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম। কারো বাড়ি খেতে যাওয়া মানেই হাজার ফ্যাকড়া। শিবেনের মা খেতে দিয়ে নির্ঘাত টুকুনের কথা জিজ্ঞেস করবে। তারপরেই নিজের বউমার গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করবে। এইসব বিষয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্যই আমি লোকের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

   কচুরি খাওয়ার পরে চা না খেলে চলে না। ফ্লাস্ক থেকে আর এক কাপ চা ঢেলে নিয়ে সবে চুমুক দিয়েছি, ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে গোতের নাম।

    ফোন ধরে বললাম, ‘বল।‘

    ‘কাজ হয়ে গেছে বিনুদা।‘

   ‘ট্রান্সফরমার সারিয়েছিস? কত বড়ো ট্রান্সফরমার?’

    ‘দূর, ট্রান্সফরমার আবার কী? মেইন ফিউজটা উড়ে গেছিল। কাকিমা পঞ্চাশ টাকা দিতে চাইছিল। আমি কুড়ি টাকা নিয়েছি।‘

    ‘সে ভালোই করেছিস। ভগবান তোর ভালো করবে।‘

    ‘বিনুদা’, কাকিমা তোমাকে বলতে বলল আইনক্সে দুটো সিনেমার টিকিট কেটে দিতে। ওই যে, অনির্বাণ না কার যেন সিনেমা।‘

    আমি তাজ্জব হয়ে বললাম, ‘মামারবাড়ির আবদার? উনি সিনেমা যাবেন আর আমাকে তার টিকিট কাটতে যেতে হবে?’

    গোতে খুব নরম গলায় বলল, ‘আরে বাবা, তুমি তো ফোনে টিকিট কেটে দেবে। আসলে আমাকেই বলেছিল। আমার কাজ আছে। তাই তোমার কথা বললাম। কেটে দাও না মাইরি!বুড়ো-বুড়িতে রোববার সিনেমা দেখতে যাবে। কে কেটে দেবে বলো?’

    আমি বললাম, ‘তুই ছাড়। আমি দেখছি কী করা যায়।‘

    কথাটা খুব একটা ভুল বলেনি গোতে। বাবু কাকা আর দোলা কাকিমার ছেলেমেয়ে নেই। পাড়ার লোকে বলে বাঁজা আর বাঁজানি। তবু রোববার বিকেলের শোয়ে সিনেমা দেখার নেশাটা ছাড়তে পারেনি। টিকিটটা কেটে দিলে মনে হয় ভগবান আমারও মঙ্গলই করবে।

           ৪

   রোববার এলেই আমার মাথার মধ্যে থেকে নানারকম প্ল্যান বুদবুদের মতো উঠে আসে। কোনো দিন মনে হয় গ্যালিফ স্ট্রিটের হাটে গিয়ে একটা কুকুরছানা কিনে আনি। নয়ত দু-চারটে মুনিয়া। কখনও মনে হয় দুপুরে ভাত খেয়ে সিনেমা দেখতে যাই, নয়ত বিকেলের দিকে একাডেমিতে থিয়েটার। এইসব আর কি। কিন্তু কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না। বাড়িতে খেয়ে-শুয়ে-বসেই রোববারগুলো ভুস করে উবে যায়।

    আজ একটা ঝামেলার উদয় হয়েছে। শিবেনের বাড়ি খেতে যেতে হবে। এতে অবশ্য শিবেনের কোনো দোষ নেই। আমার কচুরি খাওয়ার লোভ দেখা না দিলে পিকচারে শিবেন আসেই না।

     এই মুহূর্তে আমার অন্য কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। ভোরবেলা দেখা স্বপ্নটা আবার মনের মধ্যে ভেসে উঠল। খুব মিষ্টি স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নে দেখা টুকুনের মুখটা কি আগের থেকে বদলে গেছে? ঠিক ধরতে পারছি না। চুলগুলো তো একই রকম আছে। স্টেপ কাট। হাসছিল যখন বাঁ দিকের গজ দাঁতটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তাহলে? মনে হয় ওর গালে অতিরিক্তি একটু মাংসের ছোঁয়া লেগেছে। তাই কিছুটা ভরন্ত মনে হচ্ছিল। 

     ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়, ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি। যত্ত সব ফালতু কথা। কোনো স্বপ্নই সত্যি হয় না। তবে আজকের স্বপ্নটা সত্যি হলে কিন্তু মন্দ হত না। অনেকদিন পরে টুকুনের সঙ্গে একবার দেখা হয়ে যেত।

     মনস্থির করেই ফেললাম। নাঃ, আজ টুকুনকে একটা ফোন করতে হবে। আজ নয়, এক্ষুনি। 

      মোবাইল ফোনে ‘টুকুন’ টাইপ করতেই ওর নাম্বারটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল। সঙ্গে ওর হাসি মুখের ছবি।

    “আপনি যে ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন তিনি এখন অন্য কলে ব্যস্ত আছেন”

    জঘন্য এক ন্যাকা ন্যাকা গলায় মেয়েটা তিনবার বলল। তারপর লাইনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল।  

    প্রত্যেকবার এমনই কিছু না কিছু ঘটে। খুব বিরক্ত লাগল আমার। স্বপ্নের রেশটা একটু পরেই মিলিয়ে যাবে। তখন আর ছবিগুলো ভেসেও উঠবে না। মিঠে মিঠে ভাবটা তেতো হয়ে যাবে। কিন্তু কী আর করা যায়!

    ফোনে সবসময় এত কী যে কথা বলে ও! কাদের সঙ্গেই বা কথা বলে? ওর ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে, নাকি ওই সোশ্যাল ওয়ার্কারদের সঙ্গে? নাকি কোনো প্রেমিকপ্রবর! জানি না। আমার কপালে আজ শিবেনের বাড়ির লাঞ্চ নাচছে। মাছের মাথা আর চিকেন।

     বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। ফোনটা বাজতে লাগল। বাজুক। মেজাজটা খিঁচড়ে গেছে। বাজতে বাজতে থেমেও গেল। আমার মজা লাগল। যে ফোন করেছে সে নিশ্চয়ই খিস্তি করছে আমাকে! আমিও তো করি, কেউ ফোন না ধরলে।

      ফোনটা আবার বাজতে লাগল। ওঃ, জ্বালাবে মনে হচ্ছে। চকিতে মনে হল, টুকুন নয়ত! হয়ত কলব্যাক করছে!

      ধড়মড় করে উঠে বসে ফোনটা তুলে নিলাম। হ্যাঁ, টুকুনই তো। ওর মুখ আর নাম্বার ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে।

      ‘হ্যালো!’

      ‘কী ব্যাপার, ফোন ধরেছিলে না কেন?’

       টুকুনের গলায় চেনা তিরস্কার।

      বললাম, ‘বাথরুমে ছিলাম।‘

      ‘বাথরুমে? এত বেলায় বাথরুমে? রোববারে আজকাল দেরি করে উঠছ নাকি?’

      ‘না না, তেমন কিছু নয়। আমি তো একটু আগেই তোমাকে কল করেছিলাম।‘

      ‘আমাকে? কখন?’

       ফোনের মধ্যে গাড়িঘোড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। টুকুন মনে হয় বাড়ির বাইরে রয়েছে। বললাম, ‘এই তো মিনিট পাঁচেক আগেই।‘

      ‘কেন?’

      এই রে, কী বলি এখন! ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি একথা তো কিছুতেই বলা যায় না। বিশ্বাসই করবে না। একবার ভাবলাম বলি, ভাবছি তোমার ওখানে যাব, বীরপাড়ায়। কিন্তু তার আগেই টুকুন বলল, ‘শোনো, একটু আগেই আমি ট্রেন থেকে নামলাম শেয়ালদায়। এখন যাচ্ছি বালিগঞ্জে।‘

     ‘তুমি কলকাতায় এসেছ? আগে বলোনি তো!’

     ‘এই তো বললাম। আগে বললে কী করতে? আমাকে রিসিভ করতে আসতে?’

     আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম।

     টুকুন বলল, ‘শোনো, আজ সন্ধে ছ’টায় একটা এওয়ার্ড সেরিমনি আছে রবীন্দ্র সদনে। আমি একটা এওয়ার্ড পাচ্ছি। তারপর আজকের রাতের ট্রেনেই ব্যাক করব।‘

    আমি বললাম, ‘আমি কি যাব রবীন্দ্র সদনে?’

    ‘সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমি তার আগেই তোমার সঙ্গে মিট করতে চাই। আজ আমার সঙ্গে লাঞ্চ করো। কিছু কথা আছে। খেতে খেতে আলোচনা করা যাবে।‘

     আমার ভেতরটা পুলকিত হয়ে উঠল। বললাম, ‘কোথায় মিট করব বলো? কটার সময়?’

     কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে টুকুন বলল, ‘জায়গা তুমি ঠিক করো। ঠিক একটার সময়। দেরি করবে না কিন্তু।‘

     আমি বললাম, ‘পার্ক স্ট্রিট?’

     ‘নো প্রবলেম। আমি দাঁড়িয়ে থাকব অক্সফোর্ড বুক স্টোরের সামনে।‘

     আমার মনটা কেন জানি না আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠছে। দু’বছর পরে টুকুনের সঙ্গে দেখা হবে। পাশাপাশি বসে খাওয়া। অনেক গল্প। 

     ‘কী হল, চুপ করে গেলে কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?’

      আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘না না, কোনো সমস্যা নেই। ভাবছিলাম কোন রেস্তোরাঁয় যাওয়া যায়। তুমি তো চাইনিজ ভালোবাসো, তাই।‘

       ‘সে দেখা যাবে। আগে তুমি এসো তো! আর হ্যাঁ, আর একটা কথা। আমি মিউচুয়াল ডিভোর্সের ড্রাফট তৈরি করিয়ে এনেছি। সইসাবুদগুলো আজই সেরে ফেলতে হবে। ছাড়ছি।‘

      ফোনটা ছেড়ে দিল টুকুন। আমার মনটা দমে গেল। তবে আনন্দটা ফিরেও এল তক্ষুনি। যতই হোক, দু’বছর পরে ওর সঙ্গে দেখা হবে আবার। আজ ওকে খুব ভালো একটা চাইনিজ লাঞ্চ খাওয়াতে হবে।