Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

শারদীয়া ১৪২৮

Short Stories/ছোটগল্প

বয়স্ক

সঞ্জয় মজুমদার


চরিত্র ১: "মেনুতে গিয়ে মেসেজ তো সিলেক্ট করলাম, তারপর কি যেন বললি?"

চরিত্র ২: "Ok প্রেস করো। না হলে সব অপশন গুলো দেখতে পাবে কি করে?"

চরিত্র ১: "হ্যাঁ করলাম। এবার কোথায় যাব?"

চরিত্র ২: "ডিলিট অপশনে গিয়ে সিলেক্ট অল্ করো এবার"

চরিত্র ১: "কই? হচ্ছে না তো"

চরিত্র ২: "না: দাও, করে দিচ্ছি। এতবার বলি, কেন যে মনে রাখতে পারো না"

চরিত্র ১: কল্পনা মজুমদার, আমার মা। ২০২১এ বয়স ৮০ ছুঁই-ছুঁই। দীর্ঘ বছর স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।

চরিত্র ২: সঞ্জয় মজুমদার, মানে আমি।

আপাতত এই প্রশ্নোত্তর পর্বে, Stylus Pen সহ SAMSUNG GALAXYর দুটো মডেল, Galaxy Z Fold3 5G জল নিরোধক foldable phone, আর Galaxy Z Flip3 5Gর ভেতর-বাইরের সব বৈশিষ্ট্য গুলোয় চোখ বোলাচ্ছিলাম। মা পাশেই বসে আছে। মুঠোফোনে দেড়শো মতো জমে থাকা, অবান্তর মেসেজ একসাথে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কখনও মনে করে নিজে নিজেই ডিলিট করে, আবার ভুলেও যায়। যেমন আজকে, এখন। সংকোচ বোধ করে, বারবার জিজ্ঞেস করতে। বুঝতে পারি। দৃষ্টিশক্তি, স্মৃতিশক্তি দুটোই বিশ্বাসঘাতকতা করছে, এতটা বয়সে যা খুব স্বাভাবিক। যাইহোক মেসেজ ডিলিট হতেই পরের আদেশ, "মিষ্টির (মাসতুতো বোন) নম্বরটা একটু ধরে দে তো, কোথায় সেভ করেছি, খুঁজে পাচ্ছিনা"।

 

এর উল্টোটা আমার বাবা, সুশান্ত মজুমদার, বয়স ৮৫, রিটায়ার্ড সেইল এমপ্লয়ী। স্মৃতিশক্তি বয়সের তুলনায় বেশ ঝকঝকে, দৃষ্টিশক্তি প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।

 

জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার ফোনের মেসেজ গুলো ডিলিট করে দেবো?"

 

"না, একদম না", ঝাঁঝালো উত্তর। "এদিকে আয়। দ্যাখতো, মেডিক্লেমের পাঁচ হাজার সেভিংসে ক্রেডিট হলো কিনা? SMS এসছে? না হলে ব্যাটাদের ফোন করতে হবে"।

 

গতবছর চিত্তরঞ্জনে গেছি, দিদি জামাইবাবুর কাছে। বয়সের অনুপাতে তিনজনেই প্রৌড়ত্বের কাছাকাছি। বিকেলের দিকে একটা অটো ভাড়া করে, ছোটখাটো একটা জঙ্গল পেরিয়ে অজয়ের তীরে গিয়ে নেমেছি। জায়গাটা খুব সুন্দর। আগে অবশ্য বজরংবলী এবং শিব ঠাকুরের মন্দিরে দিদির ফ্লাইং ভিজিট। পেন্নাম ঠোকা তো পরে, আগে, "ভাই আমার একটা ছবি তোল", দিয়ে শুরু। তারপর একে-একে বাবা মহেশ্বর, ভক্ত হনুমান, হয়ে জঙ্গলের পথ ধরে ক্ষরস্রোতা অজয়ের ঠান্ডা জলে পা-ডোবানো পর্যন্ত স্মার্টফোনে অবিশ্রান্ত ছবি এবং নিজস্বীর ধারাপাত, ফেসবুকে আপলোড সহ চলতেই থাকলো। ভাগ্যিস সূর্য ডুবলো। না হলে যে কি হত সেদিন।

 

উপরের গল্পগুলো শুধু আমাদের পরিবারে নয়, এই দেশের হাজার হাজার পরিবারেও সত্যি। ভারতে ২০১১র জনগণনা অনুযায়ী ষাটোর্ধ্ব নাগরিকের সংখ্যা ১০৩ লক্ষ, যা কিনা বার্ষিক ৩%  হারে বৃদ্ধি পেয়ে ২০৫০এ গিয়ে দাঁড়াবে ৩১৯ লক্ষে। এর  বারো আনাই প্রায়, এক বা একাধিক দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন, ৪০% কোনো না কোনো শারীরিক অক্ষমতায়, আর ২০ শতাংশের মতো একাকীত্ব আর মানসিক অসুস্থতার শিকার।

 

তা হঠাৎ এইসব প্রসঙ্গ? এর ঢের বেশি তথ্য তো এই লেখার পাঠকবর্গের কাছে অনায়াসলভ্য। তাঁরা বেশীরভাগ সচেতন এবং বুদ্ধিমানতাহলে কেন চর্বিত চর্বণ? কারণটা আমার বন্ধু শ্যামলেন্দুর পিতৃদেব, তিনুদা। একটু গুছিয়ে বলি।

 

১৮র দুরন্ত কোঠায় দুজনেই হাবুডুবু খাচ্ছি আর জীবনের যাবতীয় হতাশা সিগারেটের কাউন্টারে ফুঁকে উড়িয়ে দিচ্ছি। শ্যামবাজার থেকে 'মা'য়ের বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় শ্যামলেন্দুদের তিনতলা পৈত্রিক ভিটে। তিন ভাই শ্যামলেন্দু, অমলেন্দু, বিমলেন্দু। শ্রীযুক্ত তিনকড়ি চাটুজ্জের তিনটি রত্ন-সন্তান। অমলেন্দু, বিমলেন্দু দুজনেই এঞ্জিনিয়ার, আর শ্যামলেন্দু চার্টার্ড পড়ছে। ঘর সাজানোর শৌখিন জিনিসের আমদানি রপ্তানির পারিবারিক ব্যবসা তিন ভাইকেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে হয়। সেসব নিয়ে আমার কোনো হেলদোল ছিল না। নিছক বন্ধুত্ব ছাড়িয়ে চাটুজ্জে বাড়ির একজন হয়ে গেছি তখন। আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া সে এক হই-হই ব্যাপার।

 

সালটা ১৯৯৮ বা তার কিছু পরেই হবে। বছর তিনেক আগে '৯৫এর ১৫ই অগাষ্ট, MS-DOSএর খাঁচা থেকে বেরিয়ে বিল গেটস্-এর মাইক্রোসফট, MS-Windows '95, স্বয়ংসম্পূর্ণ Graphic User Interface(GUI) অপারেটিং সিস্টেম এনে  বাজার গরম করে ফেলেছে। আর ওই একই বছরের অগাষ্ট ১৫য়, Videsh Sanchar Nigam Limited (VSNL), সম্পূর্ণ সরকারি তত্ত্বাবধানে, ভারতে ইন্টারনেট পরিষেবা সাধারণের জন্য চালু করে দিয়েছে। আমরা তখন ১৮ থিতিয়ে ৩০এর কোঠায়। বেশ ক'বছর শ্যামলেন্দু চার্টার্ড পাশ করে পারিবারিক ব্যবসা পাকাপাকিভাবে দেখতে শুরু করেছে। আমি ব্যস্ত আমার কর্পোরেট ট্রেনিং নিয়ে। সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি, সর্বত্র আধসেদ্ধ ইংরেজি আর ভাঙাচোরা হিন্দি নিয়ে চুটিয়ে কম্পিউটার ট্রেনিং দিচ্ছি। রোজগার ভালো খারাপের মাঝামাঝি। তিনকড়ি চাটুজ্জের বাড়িতে গেলেই ওনাকে 'কাকু', 'মেসোমশাই' যখন যেরকম মনে হয়, ডাকি। এরকম একটা সময়ে ওনার ঘরে একদিন ডাকলেন।

"সঞ্জয়, একটু বোস আমার কাছে। তাড়া আছে?"

"না মেসোমশাই, বলুন"

"আমার তিনটে ছেলেই অপগন্ড"

"মানে? কেন?"

"বছর ঘুরতে চললো, তিনটের একটাকেও পেলাম না, পাশে বসে একটু কম্পিউটার শিখিয়ে দেয়। বাপের পয়সা ধ্বংস করে এঞ্জিনিয়ার, চার্টার্ড, হয়েছে। এখন বাবুদের সময় নেই"।

আমি স্পিকটি নট্। একটাও বেফাঁস মন্তব্য আগুনে ঘি ঢালবে। বললাম, "এ ব্যাপারে আমাকে কি করতে হবে মেসোমশাই?"

"ইয়ার্কি রাখ। শোন। কম্পিউটার এই বয়সে যতটা দরকার, সেটা আমি নিজেই অন্ধকার হাতড়ে শিখে নিয়েছি। কিন্তু আমার বয়সী আর কাউকে যাতে এরকম অবস্থায় পড়তে না হয় তার জন্য আমার পুরনো অফিসে পাঁচটা কম্পিউটার নিয়ে একমাস হলো একটা সাইবারক্যাফে খুলেছি, উইথ্ ওয়েবক্যাম ইন্টারনেট। চেনা-পরিচিত, পাড়া-প্রতিবেশী বয়স্করা আসছেও। আমিই টুকটাক দেখিয়ে দি। নো ইনকাম বিজনেস।"

"বাহ্ খুব ভালো"

 

"একেবারেই না। শেখানো আমার কম্ম নয়। আর শরীরটাও রোজ জানান দিচ্ছে। কেউ যদি আমার পাশে থাকতো এই ট্রেনিং-এর ব্যাপারে। তুই সপ্তাহে দু'দিন, সন্ধ্যার দিকে এক ঘণ্টা সময় দিতে পারবি? এরাও শিখবে, আমিও মাঝেমধ্যে দেখে নেব"

 

"একটু ভেবে বলি?"

"ভাবার সময় নেই। এখানেই 'হ্যাঁ' বা 'না' বল"

অনুচ্চারিত আত্মীয়তায় বাঁধা পড়ে গেছি এই বাড়িতে। তাছাড়া এমনভাবে বললেন, ধাঁ করে 'হ্যাঁ' বলে দিলাম। যা হবে দেখা যাবে।

"ফাইন, শুধু কয়েকটা কথা। 'কাকু', 'মেসোমশাই' ছেড়ে আমাকে 'তিনুদা' বলে ডাকতে হবে, যে নামে এলাকার সবাই ডাকে। পড়ানোর জন্য এক পয়সাও পাবি না। তামাকের গন্ধ মুখ থেকে যেন না বেরোয়। রেগে যাওয়া চলবে না। রাজী হলে কাল থেকেই। এর ঠিক পাশের গলির শেষ বাড়িটা, একতলায়।"

তিন নম্বরটাই চাপের শর্ত। সুমন চাটুজ্জের 'তোমাকে চাই' ততদিনে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে মুখেমুখে চলছে। সাদাকাঠির জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। কিন্তু এখন আর ফেরার রাস্তা নেই।  বললাম, "ঠিক আছে, কাল থেকে।"

এদিকে শ্যামলেন্দুর কাছে আসল ঘটনা কিছুই জানলাম না। ‌নিজেও সময় বার করতে পারবো কিনা বুঝতে পারছিনা। কপালে সেকেন্ড ব্র্যাকেট নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছি, পেছন থেকে ডাকলেন, "থ্যাঙ্ক ইউ। বুড়ো তিনুদা যেদিন থাকবে না, সেদিন পেমেন্ট পাবি। জব্বর রিটার্ন। মিলিয়ে নিস"

ঝোঁকের মাথায় অসাধ্যসাধন শুরু হলো আমার। কর্পোরেট ট্রেনিং-এর সুবাদে পড়ানোর ধৈর্য্য ততদিনে একটু হলেও তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেটা যে কিছুই না, টের পেলাম পরদিন। সন্ধ্যা ছ'টায় তিনুদার সাইবার ক্যাফেতে পৌঁছে দেখি, ঘোলাটে চোখে, তিন বুড়ো আর দুই বুড়ি, পাঁচটা কম্পিউটার জুড়ে বসে আছেন। বয়স ৬৪ থেকে ৭৯র মধ্যে। দরজায় তিনুদা বাঁকা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে। "এসছিস?"

নিরুত্তর ভাবলেশহীন হয়ে ক্যাফে কাম ক্লাস-ঘরে ঢুকলাম। তারপরেই চমক, মানে, ৬৪ থেকে ৭৯ বছরের ছাত্র-ছাত্রীদের সমবেত কণ্ঠ, "গুড ইভিনিং স্যার"।

এর পরেই তিনুদার হাই ভোল্টেজ ধমক, "এ্যই, স্যার আবার কি?সঞ্জয়, স্রেফ সঞ্জয়। আর ওকেও বলেছি, তোমাদের নামের পরে একটা করে দাদা বা দিদি বসিয়ে ডাকবে। প্রতি মঙ্গলবার, সন্ধ্যে ছটা থেকে সাতটা, এক ঘন্টা করে ও তোমাদের ক্লাস নেবে। ঠেকা দেওয়ার কাজটা আমার। প্র্যাকটিস করতে হবে তো, নাকি। আরেকটা কথা, তোমরা শুরু করেছো ষাটের উপর থেকে, আর সঞ্জয় হোঁচট খেয়ে সবে একত্রিশ এখন। কাজেই বয়স নিয়ে খুব বেশি কন্সার্ন হয়ে গেলে শেখানো আর শেখা দুটোরই বারোটা বেজে যাবে। আমি কিন্তু সেটা চাইনা। তোমরাও চাও না নিশ্চয়ই। ব্যস শুরু করে দাও। খাওয়া-দাওয়া, ক্লাসের খরচা সব তিনুদার"

বাইরে এসে বললাম, "তবে যে বললেন দু'দিন?"

"ভেবে চিনতেই বলেছি। আগে দেখি এদের আরেকদিন লাগে কিনা, আর তুইও বিনি পয়সার সময়, বুড়োদের জন্য বার করতে পারিস কিনা। নে লেগে পড়, আমি একটু আসছি। আর হ্যাঁ, কোনো আলাপ পরিচয়ের দরকার নেই। সোজা নিজের মতো করে শেখাতে শুরু করবি"

"যাব্বাবা, নামধাম, কে কি করতেন একটু জানবো না? প্রথম দিন বলে কথা"

ব্যাস আর যায় কোথায়, অরিজিনাল তিনুদা, তিনকড়ি চাটুজ্জের মেজাজ বেরোলো, "কোন তীরটা মারবি জেনে? বাঁ দিক থেকে আমিই বলে দিচ্ছি। শুনে যা। এক নম্বরে ধীরাজ সরকার। বয়স ৭১। SBI জোনাল ম্যানেজার পোস্টে রিটায়ার করেছেন। দুই, নিরুপমা মন্ডল। বয়স ৬৮। স্কুলের হেডমিস্ট্রেস ছিলেন। খুব জাঁদরেল। তিনে কেয়া রায়। বয়স ৭৪। জামা কাপড়ের বিরাট ব্যবসা। চার, জোসেফ। বয়স ৬৪। ছিলেন চিফ্ এঞ্জিনিয়ার। DVCআর পাঁচে সবচেয়ে বুড়ো, সতীশ যোগী। বয়স‌ ৭৯। রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। সার্ভিস লাইফের বেশিরভাগ অরুণাচল বর্ডারে কাটিয়েছেন। আর কিছু? এই ব্যাচের ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর আরো পাঁচজন আসবেন, তারপর আরো পাঁচ, এভাবে চলতেই থাকবে। পয়সার অভাব থাক বা না থাক আসল সমস্যা কম্পিউটার চালাতে শেখার। সেখানে বায়োডেটা জেনে কি হবে? কাউকে তো আমি চাকরি দিচ্ছি না। কাজেই, যা বললাম তার মধ্যেই থাক‌। তোর সময়ের দাম আছে। ফাল্তু সময় নষ্ট হোক আমি চাইনা। মেশিন গুলো চালানো, বন্ধ করা, টাইপ করা, ইমেইল, আর ইন্টারনেটে ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনির সাথে ভিডিও কল। এটুকু শেখালেই যথেষ্ট। রপ্ত হলে পরে ভেবে দেখা যাবে। বোঝা গেল? শুরু কর, খাবার নিয়ে আসছি।"

আর কিছু বলার নেই, ভাবার তো নেইই। শাসনে সোহাগে বোল্ড আউট করে তিনকড়ি চাটুজ্জে রওনা হলেন। পেছন থেকে, অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই তো, কি দরকার ছিল তিনুদার, নিজের সময় পয়সা এনার্জি খরচা করে এই ঝক্কির সাইবার ক্যাফে খোলার? নামডাকওয়ালা যথেষ্ট সফল ব্যবসায়ী। তিন ছেলেই প্রতিষ্ঠিত। আয়েশ করে বাকি জীবনটা দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু চেনা পথে হাঁটলেন না। আমি রাজি না হলেও আরেকজন কাউকে ট্রেনার হিসেবে ঠিক জুটিয়ে নিতেন। উদ্দেশ্য সৎ এবং সুস্পষ্ট। এমন একটা মানুষের শুভ উদ্যোগে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে আমার অসুবিধা কোথায়? সমাজ সেবা করার অনেক রাস্তা খোলা আছে, এটাও না হয় একটা। তিনুদা তো জোর করেননি আমাকে। বড়লোক মানেই নিজেরটুকু ভাবেন, এমন ভাবা ঠিক নয়। হাতের পাঁচটা আঙ্গুল এক রকম হয় না ভাগ্যিস। যা থাকে কপালে। ঠিক দিকেই যাচ্ছি।

Windows system boot করা, আর কিবোর্ড বেসিকস্, মানে কোন অক্ষর কোথায় আছে এই দিয়ে পা টিপে টিপে শুরু করলাম। প্রথম দিন নির্বিঘ্নে কাটলো। পরের মঙ্গলবার প্রথম প্রশ্ন জোসেফের, "Sanjoy, instead of Constant Voltage Transformer, CVT, why should we use Uninterrupted Power Supply, UPS?"

"CVT is not a safeguard from abnormal Shutdown of the system, but UPS can. Proper shutdown is necessary for Windows System" বুঝিয়ে বললাম। পরের প্রশ্ন, "then tell me, how many times this system can tolerate abnormal shutdown, in absence of UPS?" এর উত্তর আমি কেন MicroSoft-এরও জানা নেই। কিন্তু তিনুদা বলে দিয়েছেন, রেগে যাওয়া চলবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে উত্তর দেওয়ার আগেই নিরুপমাদির প্রশ্ন, "কিবোর্ডে অক্ষরগুলো ABCD এই অর্ডারে না থেকে, QWERTY হয়ে আছে কেন?" কেলেঙ্কারি করেছে। কিবোর্ডের লেকচারগুলো কোনটা কার পরে থাকে, দেদার শিখিয়েছি, কিন্তু QWERTY অর্ডারে কেন সাজানো? এ ব্যাপারটা তো ভেবে দেখিনি। রেগে যাওয়া তো চলবে না, ভুল উত্তর তো দেওয়াই যাবে না। এখানে একটা নিখুঁত অভিনয়ের দরকার হয়ে পড়ল। সতীশ যোগীর দিকে ব্যস্ত হয়ে হাঁটা দিয়ে, বললাম, "আপনি টাইপ করুন, বলছি পরে"। সেই সন্ধ্যায় নিরুপমাদিকে উত্তরটা কিন্তু দিতে পারিনি। উনিও আর জিজ্ঞেস করেননি।

পরদিন বুধবার, CESCতে ট্রেনিং করিয়ে সোজা কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস। দোতলায় কোণের একটা টেবিলে চিকেন কাটলেট্ আর চায়ের অর্ডার দিয়ে ফিল্টার উইলস্ ঠোঁটে ঝুলিয়ে বসলাম। জোসেফ আর নিরুপমাদির প্রশ্নগুলো সিগারেটের ধোঁয়ার মতো মাথার মধ্যে পাক খেতে লাগলো।

"কি বস্, মুড অফ্ মনে হচ্ছে"। শুভব্রত। কখন ব্যাটা চুপি চুপি চেয়ারে এসে বসেছে খেয়ালই করিনি। এরমধ্যে কাটলেট্ আর চা এসে গেছে। হতভাগা কাটলেটে একটা কামড় দিয়ে চায়ের কাপ আমার দিকে ঠেলে দিয়ে, মুচকি হেসে বলল, "হেল্পলাইন খোলা আছে, বলে ফেল"। বললাম। ব্যাটারছেলে আমার পকেট থেকে সিগারেট নিয়ে, আরো দুটো চায়ের অর্ডার আমার খাতায় লিখে বললো, "সিম্পল, QWERTYতো international type writer setup. ওটায় কম্পিউটার কোম্পানিগুলো হাত দেয়নি। একই রেখে দিয়েছে। কারণ ভেবে দ্যাখ, অফিসের টাইপিস্টকে কম্পিউটারে বসাতে হলে, ওই একই কিবোর্ড সেটআপে লাগবে। তাই না। না হলে অফিস গুলোতো লাটে উঠে যাবে। আর জোসেফের প্রশ্নটার কোন উত্তর নেই। স্রেফ বলে দিবি, abnormal shutdownএ প্রথমেই system crash হতে পারে।‌ এবার বল, আর কি খবর?"

 

আর কোন খবর দেওয়া নেওয়ার মধ্যেই যাইনি। কাটলেটের কাউন্টারে কামড় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "তুই এত সব জানলি কি করে?" উত্তর এলো, "পরশুদিন জেনেছি। পুরোনো বইয়ের দোকানে বই ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। সেখান থেকে। আজকে তোর উপর নবলব্ধ জ্ঞান ঝেড়ে দিলাম"

শুভব্রত কি করে কোথা থেকে জানলো সেটা বড় নয়, আসলে পয়সা নিয়ে কর্পোরেট ট্রেনিং আর বিনি পয়সায় তিনুদার সাইবার ক্যাফের ট্রেনিং, সবমিলিয়ে আমাকে যে বিস্তর পড়াশোনা আর পরিশ্রম করতে হবে এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনকড়ি চাটুজ্জে যেন একটানে আমাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। শুরু হলো ট্রেনার হিসেবে নিজেকে ঘষে-মেজে তোলার আরেক অধ্যায়, যার উৎস কিন্তু তিনুদা আর তাঁর বয়স্ক শিক্ষার সাইবার ক্যাফে। তিনুদার সামনে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া 'হ্যাঁ' থেকে সরে আসিনি। নিজের বুদ্ধি বিবেচনা বলতে এটুকুই।

যাইহোক, ফল হাতেনাতে মিললো। শেখাতে গেলে, আগে যে নিজেকে তৈরী করতে হয়, আর সেটা গতানুগতিক প্রথাগত শিক্ষার মধ্যে হয়ে ওঠেনা, আলাদা করে নিজেকে তৈরী করতে হয়, সেটা সবার আগে শিখলাম। দু-তিনটে লাইব্রেরীতে নিয়মিত হাজিরা, বই পাড়া, সাবজেক্ট এক্সপার্টদের সাথে আলোচনা, এসব করতে করতে শেখানোর মান বেশ উন্নত হলো। এখনও এই অভ্যাস থেকে সরে আসিনি।

 

নিজের আত্মবিশ্বাস তখন তুঙ্গে। কর্পোরেট ট্রেনিংয়ের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। আর এদিকে, সপ্তাহে একদিনের জায়গায় দুদিন করে বয়স্ক মানুষ গুলোর কাছে যেতে শুরু করলাম। প্রথম দিনের পাঁচ জোড়া ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি, এখন অনেক উজ্জ্বল। মেশিন চালানো, বন্ধ করা, টাইপ করা, ফাইল সেভ, প্রিন্ট, ইমেইল, ইন্টারনেটে ভিডিও কল, মানে তিনুদার বিনে পয়সার প্রেসক্রিপশনে যা যা বলা ছিল, সবটুকু যত্ন করে শেষ করলাম। রেগে না গিয়ে, ধৈর্য্য ধরে, সময় নিয়ে, ডিজিটাল দুনিয়ায় হঠাৎ একা হয়ে যাওয়া, বয়স্ক, সংসারে কোণঠাসা মানুষগুলোকে একটু হলেও আশ্বস্ত করা গেলো, "আপনারাও পারছেন, পারবেন"।

কিন্তু তিনুদা আর আমি মিলে কজনের জন্য করতে পারলাম, পারবো? পাঁচ, দশ, পঁচিশ, বড়জোর একশো। এর বেশী তো নয়। ইতিমধ্যে আমাদের দেশে, ২০১১র জনগণনার সেই ১০৩ লক্ষ্য ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা, ২০২১এ, দশ বছরে নিশ্চয়ই বেশ কয়েক লক্ষ বেড়ে গেছে। প্রাকৃতিক নিয়মে শারীরিক-মানসিক শক্তিক্ষয়ের সাথে সাথে, ডিজিটাল প্রযুক্তির গুঁতোয় এঁরা তো নতুন করে অপাংক্তেয় হয়ে উঠেছেন। সন্ধ্যা হতে না হতেই বিভিন্ন ভাষাভাষীর অন্তহীন এপিসোড সমৃদ্ধ টেলিভিশন সিরিয়ালের আলোয় নিজেদের একাকীত্ব লুকিয়ে রাখেন। এর একটা বড় অংশ আবার আধুনিক প্রযুক্তির টেলিভিশন সেট চালাতেও পারেন না ঠিক করে। অথচ এই মানুষগুলোই বয়স কালে দেশের আর্থসামাজিক  উন্নতিতে অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের সেসব ভুলে গেলে ভবিষ্যতের ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে কি?

যাইহোক, তিনুদা এখন বেজায় খুশী। আরো খুশী ছাত্রছাত্রীরা। সংখ্যাটা পাঁচের জায়গায় এখন পঁচিশ। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, এবং চতুর্থ পাঁচের ট্রেনিং শেষ করে আমি তখন পঞ্চম পাঁচে মশগুল। সপ্তাহে দুদিন। এক ঘন্টা করে। মাঝখানে একদিন উজিয়ে গিয়ে তিনুদাকে বলে এলাম, "তুমি থাকতে থাকতেই আমার পেমেন্ট, রিটার্ন সব পেয়ে গেছি, in kindহিসেব মিলে গেছে"।

এরপর বছর তিনেক কেটে গেছে। ২০০১এর শুরু। কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের বাজার সবে Y2k সমস্যা কাটিয়ে উঠছে। প্রথম ব্যাচের ধীরাজ সরকার, কেয়া রায় আর আমাদের মাথার উপরে থাকা তিনকড়ি চাটুজ্জে, তিনুদা খুব অসুস্থ। ক্যাফে তে আসতে পারেন না। আমি নিজেও খুব একটা নিয়মিত নই। দুই সপ্তাহে একবার করে যাই। তাতে কি? ক্যাফের দায়িত্বে তখন নতুন তিনজন। জোসেফ, নিরুপমাদি, আর সতীশ যোগী। মানে সিনিয়র সিটিজেনরাই বয়স্কদের দায়িত্বে। পরের বছর শুরুতেই তিনুদা আকাশের তারা হয়ে গেলেন।

আগের প্যারাগ্রাফেই বয়স্ক শিক্ষার আসর শেষ হতে পারতো, কিন্তু হলো না। কারণটা, সতীশ যোগী। তিনুদার সাইবার ক্যাফেতে বয়স্ক ব্যাচের প্রথম সদস্য।  রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। শ্যামলেন্দুর পাড়ার বাসিন্দা। স্ত্রী গত হয়েছেন অনেক আগেই। এক ছেলে, রনি, আমাদের সাথেই আড্ডা মারতো। বাপের খুব ন্যাওটা। আর্কিটেকচার নিয়ে বেজায় পড়াশোনা করে কলেজেরই বন্ধু রিনাকে বিয়ে করে সুদূর আমেরিকায় উড়ে গিয়ে জুড়ে বসেছে। একটাই মেয়ে, টিনা। রনি, রিনা, টিনা তিনজনেই সতীশ যোগীকে খুব ভালোবাসে। শত ঝামেলাতেও বছরে একবার মাসখানেকের জন্য কলকাতায় আসা চাই। বছরের বাকি সময়টা ইন্টারনেট ভিডিও কল, মানে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটতো।

সেদিন গুরু পূর্ণিমা। সারাদিনের কাজকর্ম সেরে রাত আটটা নাগাদ শ্যামলেন্দুর অফিসে আড্ডা মারতে যাব বলি বেরিয়েছি। আকাশে মেঘ। একটাও তারা দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি আসছে।‌ পূর্ণিমার চাঁদ কালো মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে। হঠাৎ কি মনে হলো ক্যাফেতে ঘুরে যাই। গলিটা অন্ধকার হয়ে আছে। কেন কে জানে। ক্যাফের সামনে পৌঁছে দেখি ভেতরে কেউ নেই। একটাই আলো জ্বলছে। ঢুকতে গিয়ে ভেতরের দৃশ্য দেখে বাইরের অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, পাছে সতীশ যোগী টের পেয়ে যান। শেষের কম্পিউটারে বসেছেন। দাদু আর নাতনির ভিডিও কল চলছে। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। তারপরের দৃশ্য আমার কাছে অভাবনীয়। দাদুর আবদার, "give me your hand" এখন স্ক্রীন জুড়ে টিনার ছোট্ট হাত। দাদুর হাতও ধরার জন্য এগিয়ে স্ক্রীন ছুঁলো। পারলো কই। এ তো ভার্চুয়াল পৃথিবী। এখানে যে শত চেষ্টাতেও নাতনির হাতের স্পর্শ দাদু পাবে না। টিনার হাত সরেনি এখনও। সতীশদা এবার হাত সরিয়ে নিজের গাল কম্পিউটার স্ক্রিনে লাগিয়ে রেখেছেন। পাক্কা ছ'ফুটের অত বড় ফৌজি শরীরটা নিঃশব্দে কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছে। আমি অপলক তাকিয়ে আছি। পা ভারী হয়ে পাথর হয়ে গেছে আমার। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভিজছি, কিন্তু নড়ছি না। ঐভাবে কতক্ষণ, খেয়াল নেই। একটা সময় খেয়াল হল সতীশদা উঠেছেন। মেশিন শাটডাউন করে আলো নিভিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছেন। আমায় দেখেছেন এবার। দুজনের কারো কথা বলার ক্ষমতা নেই। জীবনের কিছু মুহূর্তে নিঃশব্দ থাকাই ভালো। ক্যাফের চাবি আমার হাতে ধরিয়ে বাঁ-কাঁধে জোরে চাপ দিলেন। চুরাশি বছরের বৃদ্ধ সৈনিকের কব্জির জোর কতটা হতে পারে মোক্ষম টের পেলাম। বৃষ্টিও কমেনি, মেঘও সরেনি। কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ক্লান্ত আর্মি অফিসারের বৃষ্টিভেজা শরীরটা গলির মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। দুজনেই ভিজছি। অবিরাম অবিশ্রান্ত‌। বৃষ্টির জল, চোখের জল, এক হয়ে গেছে। চ্যাপলিনের সেই বিখ্যাত উক্তি, "I always like walking in the rain so no one can see me crying".