শারদীয়া ১৪২৮
Poems/কবিতা
হোমো সেপিয়েন্স
সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়
ভালোই চলছিল দিনকাল,
হোমো সেপিয়েন্স হঠাৎ একদিন আনুধাবন করলেন যে,
তিনি বিবস্ত্র।
কোনও মতে বস্ত্র পরিধান করে তিনি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলেন।
প্রস্তর হাতে নিয়ে হলেন সসস্ত্র,
চেষ্টা করলেন আগুন জ্বেলে অন্ধকারকে দূর করতে।
তারপরে, নিজের অস্ত্রে নিজেরই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
কাটতে শুরু করলেন, হঠাৎ!
দেহের এক একটা টুকরোর এক একটা নাম দিলেন,
শাসক, পুরোহিত, সামন্ত, প্রজা এবং দাস।
তারপরে, টুকরো গুলো নিজেরাই নিজেদের টুকরো টুকরো করে দিতে চাইল।
হোমো সেপিয়েন্স বুঝলেন, তিনি নিরুপায়, নিরস্ত্র এবং পরাস্ত।
তাই, তিনি আবার জঙ্গলেই ফিরে গেলেন।
হোমো সেপিয়েন্স এর কিছুদিন পরে বুঝলেন,
যে, জঙ্গলে তাঁর মত উন্নত যেহেতু কেউ নেই,
তাই তিনি বেশ অসহায় রকমের একা।
তাই তিনি জঙ্গল থেকে আবার বেরলেন,
বনস্পতির মৃতদেহের উপরে সভ্যতার নির্মাণ করতে থাকলেন।
সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল ইত্যাদি রূপ ধরলেন।
সভ্যতার মাপকাঠি শেখাতে থাকলেন।
আলেকজান্ডার, সিজার ইত্যাদি রূপ ধরে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবধি সভ্যতার বিস্তার করতে থাকলেন।
বিষ্ণুগুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত রূপে তাকে স্থিতি দিতে চাইলেন।
একবার ক্লিওপেট্রা সাজলেন, একবার সাজলেন রাজিয়া সুলতানা।
একবার তুঘলকি কারবার করলেন, তো পরক্ষনেই হলেন আকবর শাহেনশাহ,
শেরশাহ সুরী থেকে হলেন আলমগীর বাদশাহ গাজি।
প্রথমে গড়তে গেলেন,
তারপরে, আবার নিজেই ভেঙ্গে দিলেন,
আবার গড়তে চেষ্টা করলেন,
এবার নিজে থেকেই ভেঙ্গে গেল।
দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হলেন,
চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক হতে চাইলেন,
অঙ্গুলিমাল থেকে হলেন সেবক ভিক্ষু।
কিন্তু, কিছুতেই কিছু কাজে এলো না।
সবাই চণ্ডাশোক, রত্নাকর, অঙ্গুলিমাল, আলমগীর
আর তুঘলকি রূপ গুলোকেই মনে রেখে দিলো।
অতএব,
ভগ্নমনোরথ হয়ে হোমো সেপিয়েন্স আবারও জঙ্গলে ফিরে গেলেন।
এবার হোমো সেপিয়েন্স পরিকল্পনা করলেন যে ভগ্নস্তুপের উপরে নতুন রূপে
নব নির্মাণ, নব জাগরন করবেন।
তাই, এবার তিনি পর পর রূপ নিতে থাকলেন,
বুদ্ধ, খ্রিস্ট, কবীর, নানক, মীরা, সুরদাস ইত্যাদি।
বলতে চাইলেন মানবধর্মের কেন্দ্রস্থলে বসে আছে, করুনা, সহমর্মিতা, প্রেম।
ইরাস্মাস থেকে হলেন কার্ল মার্ক্স,
কোপারনিকাস থেকে নিউটন,
মিলটন থেকে হলেন গালিলিও,
শেক্সপিয়ার থেকে ডারউইন,
তারপর সিগমন্ড ফ্রয়েড থেকে জাক লাঁকা,
বিদ্যাসাগর ও রামমোহন হলেন,
রামকৃষ্ণ থেকে বিবেকানন্দ হলেন,
কেশবচন্দ্র থেকে হলেন রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু,
নিজের কথা নিজেই শুনলেন না একদম,
হঠাৎ পাগলামো করে একদিন একটা জাহাজ ডুবিয়ে,
পরদিন দুটো বোম মারলেন।
ধোঁয়াময়, ধুলিকনাময় বাতাস কিছুটা স্বচ্ছ হতেই দেখলেন
যে ধরণী দ্বিধা হয়েছে।
হোমো সেপিয়েন্স বুঝলেন,
নিজের অজ্ঞতাবসত তিনি আরও একবার সেই জঙ্গলেই ফিরে গিয়েছেন।
একজায়গায় শান্ত হয়ে কতক্ষনই বা থাকতে পারেন?
হোমো সেপিয়েন্স আবার জঙ্গল থেকে বের হলেন,
নতুন ফন্দি, থুড়ি, অভিসন্ধি নিয়ে।
এবার তিনি ঠিক করলেন রং এর কারবার করবেন।
প্রথমে নিজে রং মেখে সং সাজলেন,
তারপর বারবার নিজেকেই সং সাজতে বললেন।
একজন কিম্বা দুজন বিক্রেতা সেজে রং বিক্রি করলেন।
হাজার হাজার ক্রেতা সেজে রং কিনতে থাকলেন।
বিক্রেতা হয়ে কুবের হলেন, ক্রেতা হয়ে হলেন কুরূপ।
ক্রমশঃ নির্ধন, নিঃস্ব হতে থাকলেন।
এই রং কেনা-বেচার জায়গাটার একটা চমৎকার নাম দিলেন, “বাজার”।
রং মাখতে পারলেন বেশ ভালই,কিন্তু যেই খেতে গেলেন,
অমনি বিষক্রিয়ায় মূর্ছা গেলেন, কখনো বা মারা ও গেলেন!
এই ভাবে চললো কয়েক দশক,
তারপর, একদিন বিষক্রিয়া বিরাট আকার ধারন করলো,
নিজে অনেকবার, অনেক জায়গায় মরলেন।
খালি যেখানে যেখানে বেঁচে রইলেন, সেখানে সেখানে আর রং মেখে
কোনও রকমের সান্ত্বনা লাভ করলেন না,
কারন, সব রং হয় সাদা, নয় কালো হয়ে গিয়েছিল।
হোমো সেপিয়েন্স বুঝলেন, আবার তাকে সেখানেই ফিরে যেতে হবে,
যেখান থেকে তিনি এসেছিলেন।
সেই জঙ্গলে।
কিন্তু, এবার দেখলেন, সেটাও তো ছোট হয়ে এসেছে।
অনেক জঙ্গল কেটে তিনি রং এর কারখানা গুলি বসিয়েছেন,
যে দিকে তাকাচ্ছেন, সেই দিকেই রং এর কারখানা আর রং বিক্রির বাজার।
জঙ্গল কই?
খুঁজতে খুঁজতে বুঝতে পারলেন
নিজের সাথে সাথে তাঁর অন্যান্য শরিকদের
সাধের আদিম পুরাতন আরামদায়ক বাসস্থানটিকে,
তিনি নিজে সেই কবেই নষ্ট করে ফেলেছেন।
হোমো সেপিয়েন্স এখন বুঝতে শুরু করেছেন যে,
ধরাধামে তাঁর জীবনকালের মেয়াদ এবার ফুরালো বলে।
কিংকর্তব্য বিমুঢ় তিনি এখন টিভি, সংবাদপত্র,
সোশাল মিডিয়া, নেট ফ্লিক্স, আমাজন, এইসব জায়গায় যেটুকু আর রং অবশিষ্ট আছে
তাই মেখে জংলি নাচ নেচে নেচে রংবাজি দেখে, আর দেখিয়ে চলেছেন।
প্রতিবার জঙ্গলে আসা যাওয়ার মাঝে এরকমই কিছু কাণ্ড করে এসেছেন।
বিনাশ কালে বিপরীত বুদ্ধি,
- হোমো সেপিয়েন্স!