Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

শারদীয়, ১৪২৯

Others/অন্যান্য

বিশ্বকর্মা এখানে কোনওদিন আর আসবেন না...

শুভদীপ রায়


হঠাৎ ইচ্ছে করল সাইকেল নিয়ে শহরটা চষে আসি। কটা ছবি তুললাম। বিশ্বকর্মা সেই যে গেলেন, আর এলেন না। ফাউলাই দিয়ে পুজো হয়, আবার পুজো শেষে ফাউলাই। সবাই মেনেই নিয়েছে, রেলগেট কমিটি, রিক্সা ইউনিয়নের পুজোগুলো বাদে বিশ্বকর্মা আর আসবেন না অভিশপ্ত ওই ফ্যাক্টরিগুলোতে। 

শিল্পাঞ্চলেই বড় হয়ে ওঠা। বাবা চাকরি করত হিন্দমোটরে। তারপর তো ডিজাস্টার। সবাই জানি। তখন‌ চুঁচুড়া চন্দননগর শ্রীরামপুর রিষড়া থেকে গলদঘর্ম হয়ে বাদুড়ঝোলা লোকাল ট্রেনে ছুটতে হত না সেক্টর ফাইভ, ডালহৌসি। রেলের আয় হতো উল্টো পথে। ঝাড়খন্ড , বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে শর্মা, প্রসাদ, তিওয়ারি কাকুরা স্লিপার কোচে চেপে পরিবার নিয়ে আসত শিল্পাঞ্চলে। কলকাতা কোথায়! হুঁ!

দিল্লি রোড তখন সরু ওয়ান লেনের। দুপাশের কারখানাগুলোর বিশ্বকর্মা পূজা ছিল তাক লাগানোর মত। দুর্গাপূজোর আগে যেন মহড়া হচ্ছে। ঢাকের আওয়াজ, নিপুণ হাতে গড়া মণ্ডপ, সাত দিন আগে থেকে প্রস্তুতি, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শ্রমিকদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা, মিষ্টি বিতরণ আরও কত কী। শিল্পাঞ্চলের বুক চিরে গেছে রেললাইন। ওদিকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে, এদিকে জিটি রোড। ছোট যানবাহন বেড়েছে, ব্যস্ততার ধরন বদলেছে। ৯-৬টার ব্যস্ততা এখন কলকাতামুখী। বাকি সময় নিস্তেজ ঠিক যেন পঞ্চাশের দশকে মার্কিন মুলুকের 'রুট ৬৬'। পুজোর নামমাত্র আয়োজনই জানান দেয় শিল্পাঞ্চলের রুগ্নতা। বদান্যতার বেড়ি, ভাতা পলিটিক্সের ধ্বসা রোগে আক্রান্ত সয়ে সয় কর্ম-চঞ্চল মানুষ।

নয়াবস্তি, প্রভাসনগর, বিহারী পল্লি, তেলেনিপাড়া, গোন্দলপাড়া, হিন্দমোটর নিয়ে যারা খোট্টা খোট্টা করে, নাক সিঁটকায়, তারা ভুলে গেছে হুগলি শিল্পাঞ্চলের মেরুদন্ড ছিল এই বস্তিগুলোতে। বসতি গেড়ে ওরাও ভাবেনি এত দুর্দিন আসবে, পেটে লাথি পড়বে, উগ্র বাঙালিদের আগ্রাসনে কোণঠাসা হতে হবে। আমার বাবাদের মতো, যারা সহকর্মী ছিল, তারাও ভাবেনি। উগ্র এলিটরা তো হালে এল, 'উন্নয়ন'-র সিঁড়ি বেয়ে।

শুধু রিষড়ার কথা বললে হাতে গোনা একদিকে আদিত্য বিড়লার জয়শ্রী টেক্সটাইল, গ্লাস ফ্যাক্টরি, ওদিকে ন্যালকো, বার্জার পেইন্টস ছাড়া বাকি সবই ধুঁকছে। এক সময়ের নামকরা জে কে স্টিল (মাঝের ছবি) হার মানাবে অভয়ারণ্যকেও। লেহ, লাদাখে রমরমিয়ে ব্যবসা করছে তারা। ফসফেট কোম্পানিতে একেবারে ছোট্ট করে পুজো হয়েছে। কেয়ারটেকার জানাল, যখন তখন ঝাঁপ ফেলে দেয় কর্তৃপক্ষ। গুটিকয়েক শ্রমিকরা সবাই কন্ট্রাকচুয়াল। 

ভূগোলের সিলেবাসে জ্বলজ্বল করছে হুগলি শিল্পাঞ্চল। বাগদেবী জানেনই না, বিশ্বকর্মার আনাগোনা এখন এই চত্বরে নেই। প্রথম পাটকল স্থাপনের গরিমা বইয়ের পাতাতেই।  ওয়েলিংটন, হেস্টিংস, ওদিকে ইন্ডিয়া, ভিক্টোরিয়া, নর্থব্রুক, গোন্দলপাড়া জুট মিলে 'সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক' যন্ত্রণা, যন্ত্রদেবের আরাধনা দূর কী বাত। হিন্দমোটর শ্রমিকদের দুর্দশা, বেহাল শ্রমিক আবাসন, সাহাগঞ্জের ডানলপ চলে যাওয়া, ওসব তো বাদই দিলাম। আর গঙ্গার ওপারে? পানিহাটি-টিটাগড়ে, খুন হয় বোম পড়ে। 

তবে একটা কথা বুঝে নিয়েছি, 'মজদুর মজবুর হোতা হে'.. তাই ৫০০ টাকার বিনিময়ে আমরা একটা গোটা দিন মাননীয়ার বক্তব্যের জাস্টিফিকেশনে যুবনেতার করা কাশবালিশ-কচুরিপানা পোস্ট গিলে গিলে খাই। এপ্রিলের বাণিজ্য সম্মেলন, সেপ্টেম্বরে এসে শুনতে হয়, "ভিতরে ভিতরে শিল্প হয়ে গিয়েছে। টের পাননি।" যদিও BGBS এর অর্থ 'বেঙ্গল ঘুগনি বিজনেস সামিট' ছিল কিনা বলতে পারব না।