Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

শারদীয়, ১৪২৯

Short Stories/ছোটগল্প

সংযোগ

মানসী মন্ডল


সকাল আটটা বাজার আগেই রান্নাঘর থেকে কানে এল কুকারের সিটি আর নাকে এল কারিপাতা ফোড়নের গন্ধ। তার মানে রানী এসে গেছে রান্না করতে।রানী প্রায় আমারই বয়সী একটি মেয়ে। মাস ছয়েক হল আমার রান্নার কাজে লেগেছে। 
সকাল সাতটার আগেই লিকার চা নিয়ে এঘরে বসে গেছি লেখার প্রুফ দেখতে। তারপর রানী কখন ওদিকে রান্নাঘরে এসেছে খেয়াল করিনি। ও সাধারণত আটটার আগে আসে না। আজ একটু তাড়াতাড়ি মনে হল। মরুকগে, ও নিয়ে ভাবার সময় নেই। আবার প্রুফ দেখায় মন দিই।

বৌদি, চা খেয়েছেন?

ঘরের দরজায় রানীর মুখ। 

লিকার চা খেয়েছি ।
আর একবার খাবেন না?
করছো?
হ্যাঁ ।
তাহলে আমারও জল নিও।
আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছো মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, বৌদি, চলে এলাম। বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছিল না। 

আবার প্রুফে চোখ। চোখের পাশ দিয়ে খেয়াল হল রানী দাঁড়িয়েই আছে। মুখটা থমথমে। 
কী হল, কিছু বলবে?
না, এমনিই।
রানীর চোখটা ছলছলে।
খুব নরম করে জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে রানী, শরীর খারাপ?
না, বৌদি, শরীর ঠিক আছে ।আমার মেয়ে আমাকে আজ যা তা বলেছে।

রানীর একমাত্র মেয়ের বয়স প্রায় ঊনিশ - কুড়ি।
বিয়ে হয়ে গেছে। পাড়ার ছেলে। প্রেম করে বিয়ে। ছেলেটির কাজকর্মে করার চেষ্টার চেয়ে ঘরে বসে থাকাই বেশি পছন্দ। মাস খানেক আগে রানীর নাতি হয়েছে। 

কেন? কী বলেছে?
আমি ভালো না, দেখতে বিশ্রী,রোগা, মা বলে পরিচয় দিতে ওর লজ্জা হয়।
টপটপ করে চোখ থেকে জল পড়ে। আমি ওর চোখের জলকে পাত্তা দিই না। 
ও এই কথা? আমি হাসি। আরে আমার ছেলেও তো বলে, মা, তুমি কত মোটা। দেখতে বাজে।
 বাদ দাও ওসব কথা,  ধোরো না।
না বৌদি, প্রায়ই বলে। বলে, তোমাকে মা বলে পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। যাই বৌদি, কড়াই বসিয়ে এসেছি।  রানী রান্নাঘরে চলে যায় 
রানী বছরখানেকের মেয়ে নিয়ে বাপেরবাড়ি চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল। তারপর আর স্বামীর মুখ দেখে নি। এর বাড়ি ওর বাড়ি রান্না করে মেয়েকে বড় করেছে। রানী যখন প্রথম কাজ করতে আসে পাড়াতুতো এক ননদ বলেছিল, বৌদি, ওকে কাজে রাখলে তুমি। বাজারে দুর্নাম আছে।
রানীকে কখনো সিঁদুর পরতে দেখিনি। স্বামীর গল্পও করেনা কোনদিন। আমিও  ওসব প্রসঙ্গ তুলি না।
রানীর মেয়ে রানীকে বলছে তার মায়ের পরিচয় দিতে লজ্জা হয়।আমি ভাবতে থাকি, কেন কেন?

আবার রানীকে ডাকি। রানী গ্যাস অফ করে এসে বসে।
আমি বলতে থাকি। ও শুনতে থাকে।
মেয়ের কথায় রাগ কোরো না। নিশ্চয়ই ওর কোথাও কিছু একটা হয়েছে যার জন্য ও তোমাকে রাগ দেখাচ্ছে। ওর বর, ওর শাশুড়ি কেউ কিছু বলেছে। সেসব ঝাল তোমার উপর।
না, বৌদি, ও আমাকে ইচ্ছে করেই বলছে।
বলুক, পাত্তা দিও না। ওতো এখন মা। ও বুঝবে একটা শিশুকে মানুষ করতে মাকে কত কষ্ট করতে হয়।
বুঝলে, বুঝবে, না বুঝলে না বুঝবে। কেউ কারো না। স্বামী, যে ঘটা করে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ে করল সে ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিল না।
সেই রাগেই সিঁদুর পরিনা, বৌদি।
একদম ঠিক করো। 
তুমি তো গতরে খেটে খাও ।আমি চাকরি করি। তোমার মেয়ে তোমাকে দেখবে না, আমার ছেলেও আমাকে দেখবে না। দরকার কী আছে দেখার। আমার চাকরি আছে, তোমার গতর আছে।  আমরা যতদিন বাঁচব নিজের ভাতের জোগাড় নিজেই করে নেব। তুমি চাইলে সারাজীবন আমার কাছেই থাকতে পারো, কাজ করতে পারো। আমার একটা দারুণ প্ল্যান আছে।ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়ালে ওর বিয়ে দেব। ওর তখন আলাদা সংসার। তোমার আমার মত যেসব মেয়েরা আছে, বেশ কয়েকজন  মিলে একসঙ্গে খুব হৈ হৈ করে থাকব। চাইলে তুমিও থাকতে পারো আমাদের সঙ্গে। অনেক কিছু ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়াবে। শুধু আনন্দ আর আনন্দ। কোনো ছেলে মেয়েকে পাত্তাই দেব না।আমরাই আমাদের দেখব। একদম নিজেদের মত করে বাঁচব।যেখানে খুশি ঘুরব, গান করব, নাচব ।একদম বাঁচার মত করে বাঁচব। এই পৃথিবীটা কত্তো সুন্দর। আমরাও সুন্দর ।কেন অন্যের কথায় কষ্ট পাব। যে তোমাকে ভালবাসে না সে তোমার কেউ নয়।রানীর চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। কিছু একটা ভাবনা চোখের পাতায় নিয়ে রান্নাঘরে যায়। 

চায়ের কাপ আমার সামনে রেখে রানী বলে, 
বলে, বৌদি, আমার সঙ্গে একদিন বিকেলে অজয়ের বাঁধ দিয়ে ঘুরতে যাবেন? নদীর ধারে দারুণ সিন সিনারি। ছবি তুলে ফেসবুকে ছেড়ে দেবেন।
রানীর কোথাও হয়তো মনে হচ্ছে ওর সঙ্গে আমি বেড়াতে যাব না। তাই আমাকে ছবির কথা বলে আমার ইচ্ছেকে উস্কে দিচ্ছে। 

আমি খুব উৎসাহ নিয়ে বলি, নিশ্চয়ই যাব, নিয়ে যেও।ওখান থেকে দিগন্ত দেখা যায়। নদীর ওপারে আকাশের দিগন্তে আগামীকাল বিকেলে সূর্য ডোবার ঠিক আগের মুহূর্তে মঙ্গল আর শুক্রগ্রহ এক সরলরেখায় আসবে। একে বলে সংযোগ। এমন ঘটনা যদিও খুব বিরল তবুও ঘটে। আমরা সাক্ষী থাকব।