Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

দ্বিতীয় বর্ষ

Others/অন্যান্য

যে উপাখ্যান লেখা হয়নি (ধারাবাহিক রচনার চতুর্থ পর্ব)

অজন্তা সিনহা


কঠিনে-কোমলে বর্ষার গাথাকাব্য 

পাহাড়ে বর্ষা মানেই পর্যটকের গতি অবরুদ্ধ করার এক প্রাকৃতিক ষড়যন্ত্র। মজাটুকু বাদ দিয়ে দার্শনিক অর্থে বলা যায়, এ যেন প্রকৃতিরই আর এক লীলাখেলা। আমরা পাহাড়প্রেমীরা অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্র নই। আমি নিজে বহুবার বর্ষায় উত্তরবঙ্গে গিয়েছি। আরও অনেককেই চিনি, তারাও এত ভাবে না। মন চাইলেই ছোটে, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা মানে না। তবে, বেড়াতে যাওয়া আর বসবাস করতে গিয়ে বর্ষার মুখোমুখি হওয়া, দুটো যে একেবারে পৃথক, সেই গল্পই এবার পাঠককে বলবো। 

চুইখিম বসবাসের পর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। শীত-বসন্ত-গ্রীষ্ম গিয়ে বর্ষা এসেছে। বস্তুত, পাহাড়ে গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ সমতলের মতো একেবারে নিখুঁত রূপে ভাগ করা বেশ কঠিন। বৈশাখে কালবৈশাখীর দাপট, সেই হিসেবে এপ্রিল-মে থেকেই আকাশে মেঘের দামামা বাজতে শুরু করে। দিনের যে কোনও সময় চরাচর কাঁপিয়ে ঝড়-বৃষ্টি তার অমোঘ নিয়মের খেলা খেলে। আর সেটা কতক্ষণ যাবৎ, সে শুধু প্রকৃতিই জানে। পর মুহূর্তে আকাশ পরিষ্কার হয়ে রোদ উঠে যায়। নাহ, এরও কোনও গ্যারান্টি নেই, অভিজ্ঞতায় দেখেছি। এরপর মোটামুটি জুন মাস থেকেই বর্ষা এসে পড়ে। সেটা আগস্টের শেষ পর্যন্ত তো চলবেই। তারপরেও থাকতে পারে। 

মনে পড়ছে এক অক্টোবরের কথা। বন্ধু ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পেডং যাচ্ছি। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পর এমন বৃষ্টি শুরু হলো যে গাড়ি আর এগোয় না। এরইমধ্যে খবর পেলাম সেবকে কালিঝোরার কাছে ধ্বস নেমেছে। বুঝলাম, পাহাড়ের বর্ষার কোনও গ্যারান্টি নেই। সারা বছরের যে কোনও সময় ভালোবাসা বর্ষণ করতে পারেন তিনি। পর্যটকদের প্রস্তুত থাকতে হবে, এটাই মূলকথা। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত এমন হলো, আমরা পেডং ক্যান্সেল করে বাতাবাড়ির এক রিসর্টে ছুটি কাটালাম। আমাদের গাড়ি সেবক ছেড়ে করোনেশন ব্রিজ পার হয়ে ৩১ নং জাতীয় সড়ক ধরলো। আগেই দেখেছি সেবক রোডের ওপর সবক'টি ঝর্না উপচে পড়ছে। এবার একের পর এক নদী, লীশ, ঘিস, চেল, মাল, নেওড়া, কুর্তি, মূর্তি প্রভৃতি সকলেই প্রায় বানভাসি। অথচ এসময় এমন হওয়ার কথা নয়। অক্টোবরে নদীর বুকে সচরাচর শুধুই বালি দেখার কথা এদিকে । 

আমাদের রিসর্টে বুকিং পেতেও কম হাঙ্গামা হলো না। পুজোর সময়। পাক্কা ছুটির মরসুম। প্রচুর পর্যটক উত্তরবঙ্গে। এদিকে অকাল বর্ষা আমাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে মজা দেখছে। যাই হোক, সেই সময় হেল্প ট্যুরিজমের দীপঙ্করের সাহায্যে ওই থাকার ব্যবস্থাটুকু হয়েছিল। এখানে একটা কথা বলে দেওয়া জরুরি, আমার পাহাড়ে থাকতে আসার স্বপ্ন যিনি পূরণ করেন, সেই রাজ বসুর কল্যাণেই হেল্প ট্যুরিজমের বাকি সদস্যদের সঙ্গে আমার পরিচয়। সকলেই ভাতৃসম। সময়ে-অসময়ে সকলেই নানাভাবে সাহায্য করেছেন, যা আমার উত্তরবঙ্গ বাসের আর এক অমল অভিজ্ঞতা হয়ে রয়েছে। 

ফিরে আসি চুইখিম বাস প্রসঙ্গে। বর্ষাকালের কথায় যাওয়ার আগে কিছুটা মুখবন্ধ হিসেবেই বলবো কালবৈশাখীর গপ্পো। উল্লেখযোগ্যতায়  সেও কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয় ! ঝড় উঠলে বাইরের বারান্দায় আর বসা যায় না, বাতাসের এমন দাপট। তবু, যতদূর সম্ভব বসে দেখি। তখন পাহাড়কে একেবারে এক বালিকার কৌতূহলে আবিষ্কারের পর্ব চলছে। দুপুর ফুরোতেই বেশিরভাগ দিন আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা পড়ে। পথঘাট শূন্য হয়ে যায়। গরু-ছাগল বাড়ি ফিরে আসে। কারণ, প্রকৃতির বুকে যা কিছু দোলাচল ঘটতে চলেছে, সে খবর ওরা আমাদের থেকে আগে পায়। হাওয়া জোরালো হতে না হতেই শুরু হয় শিলাবৃষ্টি। বিরাট বড় বড় শিলা। মাথায় পড়লে, মাথা ফাটবে এমন !

আমি সেই মেঘলা বিকেলে এক নির্জন প্রত্যন্ত পাহাড়ী গ্রামে বসে ঝড়ের ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ দেখি। উন্মত্ত মেঘের দল ছুটে আসছে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। বিকেল শেষ না হতেই সন্ধ্যা নেমেছে। দূরে কোথাও একটি বাছুর ডেকে ওঠে। আহা রে, সে বোধহয় তার মাকে খুঁজছে। শেষে ঝড় আমায় ঠেলে ঘরে পাঠায়। এরপরই নিয়ম মেনে কালবৈশাখীর কালে বিদ্যুতের তার ছেঁড়ে। লাইট পোস্ট উল্টে পড়ে। গাছ উপরোয়। এবং পাহাড়ের এদিক-ওদিক থেকে পাথরের দল বিচ্যুত হতে থাকে। সে পাথরের সাইজ নুড়ি থেকে শুরু হয়ে কত বড় যে হতে পারে, তা ধারণাতীত। এই সবকিছুর মারাত্মক প্রভাব পড়ে জনজীবনে। তখন সেই 'জন'-র দলে আমিও সম্পৃক্ত হয়েছি। শিখছি বেঁচে থাকার নতুন পাঠ। 

ঝড়ের উদ্দাম পর্ব শেষ হতেই বৃষ্টির উন্মাদ কাব্য লেখা শুরু । বস্তুত কালবৈশাখীর সঙ্গে মৌসুমী বায়ুর ফারাক করা বেশ মুশকিল এখানে। সারাদিন কাঠফাটা রোদ্দুর, তারপরই প্রবল ঝড়বৃষ্টি, আবার পরদিন মেঘ কেটে গিয়ে সূর্যালোকে বিচ্ছুরিত দিন। এমন চলতে চলতেই একটা সময় এসে যায়, যখন মেঘ আর পিছু ছাড়ে না। সারাদিন মেঘ। সারারাত মেঘ। দিনের পর দিন মেঘ। ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় দস্যু মেঘ। কত রকম রং তার। হালকা কালো, ঘন কালো, ধূসর ( তারও নানা শেড)। পরপর তিন-চার দিন সূর্যের মুখ দেখিনি এমনও হয়েছে। আর বৃষ্টি ? সেও অবিরাম ! কখনও ঝিরিঝিরি, কখনও টিপটিপ, কখনও একেবারে দামাল সুরে। সে একেবারে চরম অবস্থা ! এমন যে, ঘরের খাদ্যভাণ্ডারে টান পড়ে আর কি ! মনে আছে, চুইখিম থেকে গ্রামের একমাত্র সওয়ারি গাড়ি রিজার্ভ করে ওদলাবাড়ি এসে মাস দুয়েকের চাল-ডাল ইত্যাদি নিয়ে যেতাম। বর্ষায় রাস্তা বন্ধ। অর্থাৎ খাদ্যে টান। রোজই ডাল-আলু সেদ্ধ চলছে। কচিৎ গ্রামের কারও কাছ থেকে সংগ্রহ করা সবজি। 

বর্ষা মানেই যে রোমান্টিসিজম আমাদের ঘিরে ধরে, তাদের বলি রবীন্দ্রনাথের যে ক'টি বর্ষার গান জানতাম, সবই ততদিনে প্রায় গাওয়া হয়ে গেছে বারকয়েক। ছবি আর ভিডিও তোলার প্র্যাকটিস, সেও একসময় শেষ। এখন শুধু বৃষ্টি। যখন জোরে পড়ে, তখন মানুষের মুখ প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। কি করে দেখা যাবে ? শুধু তো বৃষ্টি নয়, তার সঙ্গে হাড় হিম করা ঠান্ডা। আকাশের জল মাথায় পড়লেই জ্বর অবধারিত। তারমধ্যেই চলমান জীবন। বৃষ্টি একটু কমলেই গ্রামের মানুষ এদিক-ওদিক কাজে যাচ্ছেন। যাওয়ার পথে আমার খোঁজও নিচ্ছেন। তারপর এল সেই রাত !! 

আমার চুইখিমের আস্তানাটি ছিল গ্রামের প্রাচীনতম বাড়ি। তাকে কিছুটা পুনর্নির্মাণ করে যা দাঁড়ালো, নিচের তলাটি মাটির পুরু দেওয়াল। উপরের তলায় দেওয়াল ও মেঝে কাঠের, তার ওপরে টিনের চাল। যতটা সম্ভব পাকাপোক্ত ভাবে এই নির্মাণ পর্ব সমাধান করে আমি বসবাস শুরু করি। বাড়ির যাবতীয় কাজ গ্রামের লোকজনই করেছেন। ওঁরাই মিস্ত্রি, ওঁরাই লেবার। আমি নিশ্চিন্ত ওদের ভরসায়। কিন্তু পাহাড়ের বৃষ্টি এইসব ভরসা, আস্থা, নিশ্চিন্তির বেড়া যে এক লহমায় ভেঙে দিতে পারে বুঝলাম সেই রাতে।

কারেন্ট নেই। ঠাণ্ডাও জব্বর। তাড়াতাড়ি ডিনারের পাট সেরে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছি। একটু পরেই শুরু হলো বৃষ্টি। সঙ্গে প্রবল হাওয়া। এমনভাবে সব কাঁপতে শুরু করলো, যেন আজই সব ভেঙে পড়বে। আর টিনের চালে বৃষ্টি ? হে সমতলের মানুষ, ভুলে যান সেই মধুর কাব্যিক ছন্দ। এ একেবারে প্রলয়ের সংকেত। কোথাও কোনও কাব্য নেই। এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছি কখন ! হঠাৎ এক বিরাট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘোর কাটতেই টর্চ নিয়ে শোওয়ার ঘরের দরজা খুলে প্যাসেজে গেলাম। দেখলাম প্যাসেজের চালের একটি টিন উড়ে গেছে এবং সেই ফাঁক দিয়ে প্রবলবেগে জল পড়ছে। বাইরে নিবিড় অন্ধকার।  চেঁচিয়ে গলা ফাটালেও শুনতে পাবে, এমন একটি মানুষও আশেপাশে নেই। আমি একা দাঁড়িয়ে। মুহূর্তটি ছিল চরম অসহায় অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার, এমন যে ভয় বা আতংকও আর ছুঁতে পারছিল না আমায়। 

সেই রাতও একটা সময় ভোর হয়। আমার নিকটতম প্রতিবেশী মনি ছেত্রী আসেন। লোকজন ডেকে চাল সারাইয়ের ব্যবস্থা করেন। ভাগ্য ভালো, টিনটা উড়ে পাশেই পড়েছিল। অনেক দূরে, বিশেষত পাহাড়ের খাদে পড়লে সমস্যা হতো। তার চেয়েও বড় কথা মানুষগুলোকে পাশে পাওয়া। সবশেষে এটাই আসল প্রাপ্তি । মানুষ !! আজন্মের শহর ছেড়ে অনেক দূরে এসে অচেনা কিছু মানুষের বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত ! ঝড়-বৃষ্টি-তুফান তুচ্ছ হয়ে যায় যার কাছে। বর্ষার এই পাহাড়ী উপাখ্যানের এটাই পরম প্রাপ্তি। সেই না ভোলা রাতের মতোই সত্যি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত এক নতুন প্রভাতের আবিষ্কার। 

প্রকৃতির কোলে পাখিদের পাঠশালায়

উত্তরবঙ্গে পাকাপাকি চলে আসার পর প্রথমে প্রত্যন্ত গ্রাম চুইখিমে বসবাসের অভিজ্ঞতা ছিল কলকাতা থেকে অনেকটাই আলাদা। তারপর কার্যকারণে শিলিগুড়িতে থাকতে শুরু করার পর থেকেই  দিনগুলি আবার পুরোমাত্রায় নাগরিক যাপনে পরিণত। ঘুম ভাঙে আশপাশের বাড়ির গৃহস্থালির রকমারি শব্দে অথবা বাড়ির পাশ দিয়ে দ্রুতগতিতে চলে যাওয়া বাইকের আস্ফালনে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা মোটামুটি একইরকম। একই কোলাহল। একই যান্ত্রিকতা।

এর মাঝে হঠাৎ আজ সকালে কিছুটা দূর থেকে ভেসে আসা কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙাটা ছিল চূড়ান্ত অপ্রত্যাশিত। এ যে না চাইতেই বসন্ত ! সূর্য তখনও উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেনি। জানালা খুলতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস, যেন দিনের প্রথম উপহার। এমন সকাল রোজ রোজ আসে না। শহরে তো মোটেই নয়। আত্মস্থ হয়ে প্রকৃতির দেওয়া অযাচিত উপহার নতমস্তকে গ্রহণ করি। বেশ অনেকটা সময় গানপাখির ডাকাডাকির পালা চলে। তারপর ঘড়ির কাঁটা ধরে পরিবেশ ব্যস্ত ও কোলাহলমুখর হয়ে উঠতেই সুখস্বপ্নের মতো মিলিয়ে যায় সেই সুরেলা ধ্বনি। গাড়ির কর্কশ যান্ত্রিক আওয়াজ, ফেরিওয়ালার হাঁকডাক ইত্যাদিতে ঢেকে যায় বসন্তের সংগীত।

এই অনুষঙ্গেই মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগের কথা, কলকাতা ছাড়ার ঠিক আগে। তখন গড়িয়া স্টেশন রোড অঞ্চলে থাকি। এক সকালে কোকিলের ডাকে এমনই বিস্ময়ে অভিভূত হই। কেন না, কোকিল দূর, অন্য কোনও পাখি চাক্ষুষ করা বা ডাক শোনা শহর কলকাতার বুকে তখন এক অসম্ভব ঘটনা। আমাদের রোজকার জীবনযাপনের সঙ্গী অতি চেনা কাকের দল পর্যন্ত উধাও শহরের পটভূমি থেকে। কাকের কর্কশ 'কা কা' ডাকও যেন তখন মধুর শোনায়, এতটাই বিরল তারাও। বেশ মনে পড়ছে একটি সংবাদপত্রে এই নিয়ে একটি প্রতিবেদনও পড়ি সেসময়, ওই কাকেদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নিয়ে। 

চুইখিমে আসার পর সে আক্ষেপ মিটলো। আমার বাড়ির পিছনদিকের বড় গাছটিতে শীতকাল বাদে সারা বছরই হাজির পাখিদের একটা বিরাট দল। 

সকাল থেকেই কর্মচঞ্চল তারা। যেন, ঘরের কাজ সেরে জীবিকার জন্য বেরিয়ে পড়া। আর সন্ধ্যার আগে ফিরে আসা। চুইখিমে থাকাকালীন ওদের নির্ভেজাল এই জাগতিক রুটিন দেখতাম নিজের কাজকর্ম ভুলে। ঘুম ভাঙাতো মুরগি ব্রিগেড। জানি, মুরগিকে কেউই ঠিক পক্ষীকুলের মর্যাদা দিতে চাইবেন না। তবে, প্রাণিবিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে ওনারা পক্ষীকুলেরই অন্তর্ভুক্ত। গ্রাম জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মুরগি ব্রিগেডকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম এই পাহাড়ী গ্রামে থাকতে আসার পর। রোজ সকাল-বিকেল আমার বাড়িতে মুড়ি খেতে চলে আসতো তারা।

শিলিগুড়ি প্রায় কলকাতার মিনিয়েচার। একই ক্যানভাস, শুধু বড় আর ছোটর তফাৎ। এই ক্যানভাসে শুধুই আকাশচুম্বী ঘরবাড়ি, রাস্তাময় গাড়ি, আর প্রচুর মানুষ। যাকে বলে ধাক্কাধাক্কি করে চলাফেরা। এখানে পাখি থাকবে কি করে ? তাদের বাসা বাঁধার জন্য দরকারি গাছের ডালটাই যে আর নেই এখানে। কিছুদিন আগে পর্যন্তও যখন শুধু বেড়ানোর জন্য উত্তরবঙ্গে আসি, তখন শহরের ওপর দিয়ে সেবক রোড ধরে যেতে যেতে দু'পাশে দেখেতাম সারি সারি মহীরুহ। কত যে বয়স তাদের ! বিশাল মোটা মোটা গুঁড়ি। বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ডালপালা। সেখানে পাখিদের কোলাহল শোনা যেত গাড়ির আওয়াজ ছাপিয়ে।

ধীরে ধীরে ছবিটা বদলালো। গাছ কাটা পড়লো। কোথাও ঝড়ে উপড়ে গেল। গত প্রায় চার বছর বসবাসের অভিজ্ঞতায় রাজপথ তো বটেই, অলিগলিতেও গাছের সংখ্যা কমতে দেখলাম। গাছ নেই, তাই, পাখিরাও নেই। নগরজীবনের এই নিষ্ঠুর গাথা আজ সর্বত্র, কমবেশি। শিশুরা বইয়ের পাতায় পাখির ছবি দেখে অথবা বাড়িতে খাঁচায় পোষা বন্দি পাখি। পাখির ডাক, তাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-খুনসুটি, মা পাখির খাবার এনে বাসায় অপেক্ষারত বাচ্চাকে খাওয়ানো, কাঠকুটো দিয়ে ঘর বানানো---এসব হয়তো তারা ইউটিউব ভিডিওতে বা পশুপাখি বিষয়ে নির্দিষ্ট টিভি চ্যানেলে দেখবে। কদাচিৎ প্রকৃতির কাছে বা গ্রাম পর্যটনে গেলে।

এই প্রকৃতির ডাক কিন্তু কান পাতলেই শোনা যায়। শুধু একটু কষ্ট করে গন্ডির বাইরে পা ফেলতে হয়। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে কিছুদূর গেলেই বদলে যায় ছবিটা। এই তো, শিলিগুড়ি শহর ছাড়িয়ে একটু বাইরে গেলেই কানে আসে পাখিদের কলকাকলি । গজলডোবা, তিস্তার বিস্তৃত নয়নাভিরাম ক্যানভাসে জঙ্গলের যতটুকু আঁকিবুকি, সেখানে নানাজাতের পাখির বসবাস, সমাবেশ। উত্তরবঙ্গের লোকজন সেখানে টুকটাক চটজলদি ছোটখাটো ট্রিপে প্রায়ই যায়। আর গেলেই পাখিদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ। এদিকে মহানন্দা ফরেস্ট রেঞ্জেও প্রচুর পাখি। সেখানেও রাজ্য সরকারের বেঙ্গল সাফারি রয়েছে। অভিভাবকগণ বাড়ির বাচ্চাদের নিয়ে যেতেই পারেন। স্কুলগুলিও এই উদ্যোগ নিতে পারে। আসলে যেখানেই গাছ, সেখানেই পাখিদের দিনযাপন। 

আজন্ম শহরবাসী হওয়ার ফলে খুব বেশি পাখি চেনার সুযোগ হয়নি আমার। শিলিগুড়ির এদিকওদিক গিয়ে প্রচুর অচেনা পাখি দেখেছি। তিস্তা পার হয়ে মংপং অরণ্য। সেখানে একবার দিনদুয়েক ছিলাম। জঙ্গলের মধ্যে বনবিভাগের অতিথিশালা। পাখিরা সেখানে পুরো সহজ ও স্বচ্ছন্দ ! গাছের ডাল ছেড়ে সিমেন্টের বাঁধানো উঠোন, উঠোন পেরিয়ে রোয়াক, তারপর বারান্দায় তাদের বিচরণ। কখনও একেবারে ঘরের ভিতরে ঢুকে ওড়াউড়ি। এগুলো মূলত একেবারে খুদে সাইজের। বড়দের গতিবিধি বারান্দা পর্যন্ত। মোদ্দা কথা, ওই দু'টি দিন আশ মিটিয়ে পাখি-দর্শন হয়েছিল। 

একটা কথা এখানে বলার, আমি ঠিক তথাকথিত পক্ষীপ্রেমী নই, যাঁরা পাখি চেনেন। পাখির টানেই তাঁরা দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করেন। আমার অনুভূতি এক্ষেত্রে কিছুটা আলাদা। পাখি সম্পর্কিত তথ্য আমাকে তেমন টানে না। যাঁরা এই খবরাখবর রাখায় উৎসাহী, তাঁদের আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আমার ওই চেনাচেনি নয়, ওদের দেখেই সুখ। পাখিরা যেন অসীম আনন্দময় এক স্বাধীন জীবনের প্রতীক। পাহাড়ের কোণে কোণে, জঙ্গলে, নদীর পাড়ে আপন ছন্দে বিচরণকারী পক্ষীকুলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ একেবারে শুধু অকারণ পুলক ও উচ্ছাসের কথামালা ! 

যে কারণে, ওদের খাঁচায় বন্দি করাটাও আমার রীতিবিরুদ্ধ । মনে পড়ছে চুইখিমের বাড়িতে এক বিকেলে ওপরতলার ঘরের জানালা দিয়ে একটি অচেনা পাখি ঢুকে পড়েছিল বেখেয়ালে। তারপর বাইরে যাওয়ার জন্য তার কি ছটফটানি। বহুক্ষণ ওড়াউড়ি করে ক্লান্ত হয়ে ঘরের এক কোনে বসে যখন বিশ্রাম নিচ্ছে সে, তখনই ফোন ক্যামেরায় ধরে রাখি তাকে। তারপর ঘরের সব জানালা খুলে দিয়ে নিচের তলায় চলে আসি। বেশ কিছুক্ষণ পর ওপরে গিয়ে দেখি সে উড়ে গেছে। এতে আমিও যেন মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলি। 

মংপং থেকে আর একটু এগোলেই ওদলাবাড়ি। সেখানে আমার এক পাতানো বোনের বাড়ি। সুযোগ পেলেই তার আতিথ্য গ্রহণে চলে যাই। সেই বোনটির আবার খুব বাগান করার সখ। বাড়ির ছাদ, ব্যালকনি সর্বত্র টবে ফুলের গাছ। কোথাও সেসব গাছেরা টবেই ডালপালা মেলে। কোথাও বা মাচার আশ্রয়ে লতিয়ে ছড়ায় নিজেদের। সেইসব গাছেদের আশপাশে সকাল-সন্ধ্যায় কত যে চেনা-অচেনা পাখি ! সেও এক মন ভালো করা বিস্ময়। অনাবিল আনন্দের অভিজ্ঞতা। 

এদের বাড়িটা ৩১নং জাতীয় সড়কের পাশে। এই সড়ক ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলে চালসা। এখান থেকে পথ গিয়েছে গরুমারা, লাটাগুড়ি ইত্যাদি জঙ্গলের দিকে। আশপাশে গরুবাথান, চেল নদীর অববাহিকা, ঝান্ডি, আবার ডামডিং হয়ে যাওয়া যায় লাভা, লোলেগাঁও, খোলাখাম। আছে নেওড়া ভ্যালি। ওদিকে মূর্তি নদীকে ঘিরেও বড় বড় গাছ। সব মিলিয়ে বিস্তৃত অপরূপ এক ক্যানভাস। আর এমন ক্যানভাসেই তো উড়ন্ত পাখির দল রচনা করে প্রভাত ও সন্ধ্যার জীবনকাব্য। পাহাড়ে আসা-যাওয়া-থাকার সূত্রে সেই কাব্যের উপভোক্তা হয়েছি আমি বারবার।

কয়েকদিন আগেই এক বিকেলে চুইখিমে আমার বাড়ির বারান্দায় বসে আছি। আকাশ গোধূলির লাল আলোয় মাখামাখি। চারপাশের পাহাড়শ্রেণি সন্ধ্যা নামার অপেক্ষায়। শান্ত নির্জন সেই চরাচরকে হঠাৎ একেবারে মুখর করে বাসায় ফিরলো একদল পাখি। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। সার বেঁধে আকাশের শরীর ছুঁয়ে সূর্যকে বিদায় জানিয়ে দিনান্তের সুর বাজিয়ে বাসায় ফিরছে তারা। কি যে অপার্থিব এক অনুভূতি। কেমন যেন এক অন্য ভুবনে নিয়ে যায় এই দৃশ্য। হারিয়ে যাওয়া মানুষ, হারিয়ে যাওয়া জীবন যেন ফিরে ফিরে আসে এমন গোধূলি বেলাতেই। পাখিদের কথা হলো। এর পরের পর্বে বলবো মিনির গল্প। আমার চুইখিম বাসের অভিজ্ঞতা মিনি ছাড়া অসম্পূর্ণ।