Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

দ্বিতীয় বর্ষ

Others/অন্যান্য

হিন্দি-চিনি – ভাই ভাই; আম জনতার সাথে তাই (ধারাবাহিক রচনার চতুর্থ পর্ব)

তপন কুমার দাস


চীন সাইকেলে (২৭) :- জুঝু শহর থেকে সাত সকালেই বেড়িয়ে পরেছিলাম। শহর ছেড়ে ২৫০৩ নং স্টেট হাইওয়ে ধরে, সকাল থেকে চলেছি। হালকা মেঘলা আকাশ, আজ রোদের তেজ কম। নদী পাড় ঘিরে পার্ক, তারই ধার ধরে পথ চলে গেছে। সকাল থেকেই সেই আমার সঙ্গী। শহর পেরিয়ে আবার শহর, বাদিকে পথ পাশে নজরে এলো পাখি বাজার। রঙ বেরঙের অনেক পাখির সমাহার।গোটা কয়েক ছবি তুলে এগোচ্ছি, বা দিকে একটি বিরাট আকার মল আর তাকে ঘিরে,বড় একটি মার্কেট, কি নেই সেখানে। এক দুটো বড় বাজার তাতে ভরে যাবে। টেন্ট পাওয়ার আশায় ঢুকলাম বটে, কিন্তু নাকের বদলে নরুন, রাইস কুকার নিয়ে বেরোলাম। হোটেল গুলোতে সুযোগ পেলে রান্না করে নেওয়া যাবে। ভেতো বাঙ্গালি, ভাতের টান যাবে কোথায়? চলতে চলতে শহর ছাড়িয়ে পথ চলে গেছে পাহাড়ের গায়ে। পাহাড়ের গা বেয়ে পথ ক্রমশ উত্তরমুখি। পাহাড়ের খনিজ ভান্ডার যেন উকি দিয়ে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে চলেছে।
খনিজের ওপর ভর করেই হাইওয়ের পাশে গড়ে উঠেছে বিরাট ইন্ডাস্ট্রি, গরে উঠেছিল তারি লাগি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। ডাইনে সুবিশাল জাতীয় জলাশয়। দিনশেষে ফিরে এলাম গ্রামদেশে। চাষের মাঠ, বেলা পড়ে আসছে। কৃষক পরিবার, মা বাপ বেটা সব্জি ক্ষেতে ফসল তোলায় ব্যস্ত। তারি মাঝে কিছু আলোচনা। মাঠে ঢুকতেই কাজ ফেলে এগিয়ে এসে সম্ভাষন জানালো বাপ বেটা। কথায় সড়গড় ছেলেই বেশি, এখনকার প্রজন্ম। বললাম জমির মালিকানা কার?উত্তর আমাদের। অনেকটাই জমির। ওর মাকে দুরে, ক্যামেরার লেন্সে ধরা যাচ্ছিল না। জমি সরকার দিয়েছে না কিনেছো ? জবাব এলো সরকারের দেওয়া। ভাগ চাষি বা ক্ষেতমজুর ? নিজেরাই চাষ করি। ভালো লাগলো, ও গর্ব করেই বললোঅন্য ছেলেরা চাষের মাঠ ছেড়ে কারখানা মুখি হলেও ও কিন্তু মাঠেই রয়ে গেছে। ফসল বেচে লাভ হয়? বলল, লাভ হয়তো বটেই। ফসলের বেচা দাম ? পরে দেখেছিলাম মাঠের চাষির দামের সাথে বাজারের দামের বিরাট কোন ফারাক নেই। অর্থাৎ, মাঝখানের মুখগুলোর লুটের সুযোগ এদেশে কম। ভালো লাগলো অন্তত এদেশটায় সব্জি বা ফসল চাষ লাভজনক দেখে।

সাইকেলে চীন (২৮) ঃ- কৃষি ও কৃষকের অবস্থা :- জেনঝিয়াং এ রাতটুকু কাটিয়ে বেড়িয়ে পরলাম সকালে। বেলা কিছুটা বাড়তেই পথ চলতি বড় বাজার বলেন গতি রোধ করে দাড়ালো। টাটকা বড় মাপের সব্জি, মাঝারি সাইজের ড্রামে জলের মধ্যে ছটফট করা মাছ দেখতে দেখতে বাজার পরিক্রমা করছি। সাতসকালে এই ভিনদেশী কে দেখে একটু অবাক সবাই। কেউ কেউ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করছে, কি নেবেন ? মিষ্টি হেসে মাথা নেড়ে গোটা কয়েক ছবি তুলে এগিয়ে চলি।
কদিন ধরেই মাথায় ঘুরছে, গ্রাম চীনের গভীরে যেতে হবে। বাস্তবতাকে বুঝতে হবে। যদিও আমার স্বল্প পরিসরে সেই সুযোগ কম। তাও গুটি কয়েক শহর পেরিয়ে, হটাৎ ই বায়ে ধানক্ষেতের অমোঘ আকর্ষনে, হাইওয়ে ছেড়ে,খাল পাড় ধরে, ডাইনে পিচ রাস্তায় এগিয়ে চলি। নদী পাড়, পাকা রাস্তা পেছনে ফেলে মেঠো পথ স্বাগত জানায়। ভর দুপুর, দুপাশে সোনালী ধানের ক্ষেত, চাষের মাঠ পেছনে ফেলে চলছি। দুপাশের ছবি যেন মুক্তির আনন্দ এনে দিয়েছে। আসলে গ্রাম ভারতে সাথে আমাদের দেশবাসীর নারীর টান, চীনে এসেও সবুজের সেই আকর্ষণ, দুলকি চালের খোলা হাওয়া ভুলি কি করে?
ঘড়ঘড় আওয়াজ, দুর থেকেই কানে আসছিল, ডাইনে বিরাটাকার যন্ত্রযানকে ঘিরে, কিছু মানুষের ভীড়। আগেই বলেছি,শত শত বছরের সামন্ত তান্ত্রিক ভূস্বামী দের শোষনের শিকার কৃষিজীবী জনতা ছিল, চীন বিপ্লবের প্রধান শক্তি। দীর্ঘ বছরের জীবন যন্ত্রনা থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা। বিপ্লবের পর তাই মাও ও তার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান কাজই ছিল কৃষি বিপ্লব মানে কৃষকের হাতে জমি তুলে দেওয়া,পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার খাদ্যের সংস্থানের জন্য, খাদ্যশস্যের বিপুল উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মসূচি গ্রহণ করে তারা। ভূস্বামীদের জমি দখল নিয়ে তা গরীব কৃষকের মধ্যে বিলিয়ে দেবার যে কাজ গৃহযুদ্ধের সময়েই শুরু করেছিল তারা, বিপ্লবের পরে সেই কর্মসূচির সার্বিক রুপায়ন শুরু করে। সামন্ত প্রভুদের সমস্ত জমি বাজেয়াপ্ত করে, সব কৃষককে জমি দেওয়া হয়। ব্যপক গন উদ্যোগ তৈরি করে লাখো লাখো মানুষ কে সাথে নিয়ে কাটা হয় অসংখ্য খাল। জল নিয়ে যাওয়া তাদের চাষের জমিতে। কিন্তু যন্ত্রের ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য, পরে সমস্ত জমি নিয়ে যাওয়া হয় কমিউনের হাতে। সকলের একসাথে চাষ, একসাথে খাওয়া দাওয়া এক নতুন জীবন, নতুন উদ্দিপনা তৈরি করলো বটে, কিন্তু তা ছিল সাময়িক। এক দশকের মধ্যে উৎপাদনের অগ্রগতি থমকে গেলে, কমে গেলে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়, শেষে ব্যক্তিগত উৎসাহ বৃদ্ধি ও উদ্যোগ কে কাজে লাগানোর ভাবনা থেকেই জমি আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয় প্রতিটি কৃষকের হাতে। সেদিনের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিলোনা তারই ছবি দেখলাম চাষের মাঠে কৃষকের বিপুল উদ্দীপনায়।

চীন সাইকেলে (২৯) : কেমন আছে এ দেশের কৃষক :- ঘরঘর আওয়াজ শুনে ডাইনে মাঠের পানে চাইতেই নজরে এলো, বড় চাকা লাগানো ফসল কাটার যান্ত্রিক গাড়ি বা হারভেষ্টার। সোনালী ধান কেটে কেটে গলধকরণ করে এগিয়ে চলেছে মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।তারপর মাঠের এ প্রান্তে ফিরে এসে উগড়ে দিচ্ছে মাঠের ধারে জটলা করে থাকা কৃষক পরিবারের গাড়িতে। ধীরে ধীরে আমার সাইকেল এসে থামলো ঐ জটলার মাঝে। সবাই প্রথমে অবাক, আমি মুচকি হেসে এগিয়ে যেতে স্বাগত জানালো। ভারত থেকে আসছি শুনে হতবাক, বুঝলাম এই পথে সচরাচর ভারতীয় কোন সাইকেল আরোহীর পদচারণা ঘটেনি এখানে। সবাই ব‍্যস্ত, কাজের ফাকে কথা ঠিক জমছিল না, ভাষার কারনেও পিছিয়ে যাচ্ছিল। একটু পরেই টিফিন টাইম আসতে সবাই ডেকে নিল আমাকে। হাতে ওদের খাবারের একাংশ ধরিয়ে দিয়ে আমার পাশে এসে বসলো কৃষক রমনী শাসাঁ। অন‍্যরাও একেকজন একেকটি খাবার এগিয়ে দিলো। মুখে দিয়ে গল্প জুড়লাম শাসাঁর সাথে। ইংরেজিটা মোটামুটি জানে। হারভেষ্টার টা ওদেরই, ঘন্টা পিছু ভাড়া দেয়। বললাম জমি এখান সবার নিজস্ব ? সরকার থেকে পেয়েছে ? বললো হ‍্যা, আগের মাওয়ের (poor)সরকার আমাদের সবাইকে জমি দিয়ে গেছে। poor কথাটি কেনো বললেন বুঝলাম না। বললাম ভারতে তো কৃষি মোটেই লাভজনক নয়, মাঝে মধ‍্যেই কৃষকরা আত্মহত্যা করছে, আপনাদের কি খবর ? কি কি ফসল ফলান ? উত্তর এলো, ধান, গম, ভুট্টা, শীতের সবজি সব কিছুই।ফসল বিক্রি করে লাভ হয় ? গড়ে কত থাকে ? উত্তর এলো, একর প্রতি বারো থেকে তেরো হাজার, মানে ভারতীয় টাকায় এক লক্ষ কুড়ি থেকে ত্রিশ হাজার, প্রত‍্যেকের নূন‍্যতম পাচ একর জমি আছেই। সার বলতে জৈব সার, বীজ সরকার থেকেই পায়। এই ফসল কোথায় যাবে বাজারে ? আপনারা নিজেই বিক্রি করেন? শাসা জবাব দিলো, না, সাধারণ চাষীরা ফসল পৌঁছে দেয় বিজনেস পয়েন্টে। তারা বাজারে নিয়ে যায়। জমি তে ভূমি হীন ক্ষেতমজুর রয়েছে ? উত্তর এলো, না, পরিবারের লোকেরাই চাষ করে, তবে আজকাল যুব বয়সীরা আর জমি তে কাজ করতে চায়না, তারা কারখানায় চলে যায়। বললাম চাষের আয়ে তোমরা খুশি সকলে ? তোমরা সবাই হ্যাপি ? সমস্বরে সবাই বলে উঠলো, হ‍্যা আমরা সবাই হ্যাপি। সর্বত্র এটাই আমার শেষ প্রশ্ন থাকতো? উত্তরও আসতো একটাই। রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু জনগনকে সুখী রাখার উদ্যোগ এবং তার অগ্রগতি, এটাই বোধহয় চীনের কমিউনিস্ট সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

 

চীন সাইকেলে ( ৩০) : - শাসাকে এবং গায়ের কৃষক বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে গ্রামের পর গ্রাম অতিক্রম করে পৌছে গেলাম নদী পাড়ে। ওপারে যেন সুন্দরবনের আদল, এপারেও তার ছোঁয়া। নদী কিনারে স্বল্প দুরত্বে যেনো হাউসবোট গুলি কাস্মীরে নিয়ে যায় আমাকে। দাড়িয়ে থাকলে হবে না, বেলা তিনটে এখনো পথ চলতে হবে প্রায় পঞ্চাশ কিমি। ফাকা রাস্তা গাড়ি ঘোড়া নেই বললেই চলে, মাঝে মধ্যে এক আধটা গাড়ি টপকে চলে যাবার সময় অবাক নয়ন, তাদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি আমায় ছুয়ে যায়। মাঝে জনা দুয়েক কর্ম ফেরত যাত্রী আমার নারি নক্ষত্রের খবর নিয়ে যায়। তাদের একজন জিজ্ঞাসা করলো "আরে হাইওয়ে ছেড়ে আপনি এত ভেতরে ? বললাম ভেতরের মানুষ গুলোর ভেতরের কথাও তো জানা দরকার। না এলে তো আপনাদেরও তো মিস করতাম। শুনে খুশি হয়ে হ‍্যান্ডশেক করে বিদায় নিলে। আবার যেনো একা হয়ে পরলাম, একা ঠিক নয়, নদী আমার পাশে পাশেই রয়েছে, তাই বোধ হয় আনমনা। হাউসবোটগুলো ঘুরে আসতে মন চায়, কিন্তু বোট পাহাড়ায় থাকা কুকুর গুলোকে দেখে সে ইচ্ছে যেনো মিলিয়ে যায়। বিদেশে সবাই আমাকে বন্ধু করে নিতে পারলেও এরা যেনো ভীনদেশীই রয়ে গেলো আসলে শ্রীল়ংকায় কুকুরের কামরানোর স্মৃতি যেনো থ পিছু ছাড়েনা। চীনে বাঘা কুকুর ততো না থাকলেও যারা আছে তারা অচেনা লোকের জন‍্য দরজা হাট করে খুলে দিতে রাজি নয়। সন্ধ্যার পর তাই পারত পক্ষে গ্রামীণ বাড়িগুলোতে ঢোকার কথা ভাবতাম না।
যাই হোক ,অনেকক্ষন ধরে মানুষ জনের খোজে আমার চোখ এধার ওধার করছিল।পড়ন্ত বিকেলে নদীর পাড়েই এক জটলা দেখে নেমে পড়লাম। কৃষিজীবী।মানুষ হলেও মাছ ধরে জীবিকা চালান এমন মানুষও কম নয়। এক বুড়িমা নাতি নাতনী নিয়ে দাড়িয়ে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টিম কে জিজ্ঞেস করলাম, মাছ ধরে আয় কত ? উত্তর দিলো ঐ ভাবে ভাবিনি, তবে গড়ে মাসে আয় ছয় থেকে সাত হাজার, মানে 6ভারতীয় মুদ্রায় 66 হাজার থেকে আশি হাজার। গ্রামে শখানেক ঘর থাকলেও অবশ‍্য কৃষিজীবী মানুষই বেশি। ছবি তোলার কথা বলতে অনেকেই উৎসাহে এগিয়ে এলো। রাতটা তাদের গ্রামে থেকে যাবার আমন্ত্রন পেয়ে মনে ইচ্ছে ভাব জাগলেও দিনলিপি তাতে সায় দিলনা। সন্ধে নেমে আসছে, দেরি না করে,সবার কাছেে বিদায় নিলাম।গ্রামের ভেতর দিয়ে পথ চলতে চলতে অলক্ষেই কখন প্রায় অন্ধকার নেমে এলো। 
সন্ধ‍্যা নামতেই দৌড়, রোজকার অভ‍্যাসে পরিনত হয়েছে। আজও তার অন‍্যথা নয়।সন্ধ‍্যার প্রায় অন্ধকারে কয়েকটি ব‍্যারেজ পেড়িয়ে এসে পৌছালাম এসে জেটিঘাটে। সারি সারি লঞ্চ, স্পিডবোট দাড়িয়ে,না আমায় নিয়ে যাবার জন‍্য নয়। এখান থেকেই টুরিস্ট লঞ্চ যাত্রী নিয়ে চলেছে। বেড়িয়ে পরে, সারাদিন জলে জঙ্গলে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে, কেউবা দুরে কোন দ্বীপে যাত্রী নিয়ে যাবার অপেক্ষায় রয়েছে। সেদিন প্রায় অন্ধকার পথে, শুধু চুনের দাগ ধরে প্রায় ঘন্টা দুয়েক চলিয়ে তবে জিনিং শহরে পৌছেছিলাম।

চীন সাইকেলে (৩১) :- জিনিং শহর পৌছালাম যখন রাত প্রায় সাড়ে নটা। মাথা গোজার ঠাঁই পাই কোথায় ভাবতে ভাবতে, একটি জোমাটো বয় এর সন্ধান পেয়ে গেলাম। রাত বিরেতে এরাই ছিল আমার পরম বন্ধু। আয় ? শুনলে ভারতীয় জোমাটো বয়রা হিংসে করবে, এক জোমাটো যুবক জানিয়েছিল মাস গেলে তাদের আয় দাড়ায় ছয় থেকে দশ হাজার, ভারতীয় মুদ্রায় তা প্রায় এক লক্ষ টাকা। যাই হোক সে রাতেও ওরাই ছিল আমার পথ প্রদর্শক। এক যুবককে বলতেই ও আমার জিপিএস এ হোটেলের ঠিকানা লোড করে দিলো, কিন্তু তার পরেও হোটেলে পৌছে অনেক বলেও হাউস ফুল, জায়গা পাওয়া গেল না। । 
রাত সাড়ে দশটা, কি করবো ভাবছি, ‌সামনে একটু বড় দোকান।দোকানদার ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন । জিজ্ঞেস করলো, কিছু খুঁজজেন ? বললাম, হারাবারতো কিছু নেই, তবে রাতে আশ্রয়টা খুঁজে পাচ্ছিনা। সস্তায় কোথা থাকা যায় বলতে পারবেন ? ভদ্রলোক ইংরেজী শুনে এড়িয়ে গেলেন, মেয়েকে দিলেন এগিয়ে। সপ্তম শ্রেণির তে পড়ে, কিন্তু অনেকটাই ফরোয়ার্ড, ইংরেজি তে কিছুটা সরগর। বললাম, কাছাকাছি কোথাও কম পয়সায় থাকার হোটেল আছে ? দোভাষী মেয়ের কথা শুনে ভদ্রলোক ও তার মেয়ে, দুজনেই চিন্তায় পরে গেলো। কি করবে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেনা দেখে, এবার কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি তোমাদের সাথে রাত কাটাতে পারি ? সাথেই সাথেই জবাব কেনো নয় ? ঘাড় নাড়া সম্মতির লক্ষন বুঝেও, ভাষার কারনে যদি ভুল বুঝে থাকি, তাই আবার ও একই প্রশ্ন ছুড়লাম। এবার ও উত্তর এলো বললাম তো হ‍্যা। এবার দোকান ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো মেয়ের মা, বললো "তুমি ভাবছো কেনো তুমি একা, আমরা রয়েছি তো তোমার পাশে"। এই শীতের রাতে, এই ভালোবাসা যেনো উষ্ণতার ছোয়া দিয়ে গেলো।মনে মনে বললাম, তুমি ঠিকই বলেছো, কে বলে আমি একা ? ভুবনময় ছড়িয়ে আছো তোমরা, আমার ভালোবাসার জনেরা। কেউ কেউ প্রায়সই অবাক হয়,আরে ভাই তুমি একা একা কি করে দেশ বিদেশ চষে বেড়াচ্ছো ? কি করে আমি বোঝাই দুনিয়া জুড়েই রয়েছে মানবতার ছোয়া, ভালোবাসা র বন্ধন, শুধু তুমি মনের দুয়ার খুলে তাকে আহরণ করে নাও।
যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে, কাচের দরজা ঠেলে দোকান ঘরে এসে ঢুকলাম। 40/22 ফুটের দোকান, তার ধারে এক চিলতে ছোট ঘর। তার উপরেও খাট, নিচেও। স্বামী স্ত্রী র রাত্রি যাপনের ব‍্যবস্থা। ততক্ষনে মেয়ের সাথে গল্প জুড়ে, আমার জানা হয়ে গিয়েছে, ওরা মা বাবা দুই বোন। শহরেই ওদের একটি বাড়ি রয়েছে, ওখানে রয়েছে এখন ওর দিদি। ও রাতেই চলে যাবে বাড়িতে, সকাল হলেই ওর স্কুল। বলতে বলতেই ওর দিদির ফোন, ভিডিও কলেই আমায় স্বাগত জানালো। একাদশ শ্রেণিতে পড়ে, বিজ্ঞান বিভাগে। এদিকে আমার জন‍্য নুডলস আর স‍্যুপ চলে এসেছে। খেতে খেতে রাত বারোটা পর্যন্ত গল্প চললো। ওদের স্কুলে প্রায় 2000ছাত্র, পড়াশোনায় কোন টাকা লাগেনা, বই পত্র ও স্কুল থেকেই দেয়। রয়েছে খেলাধুলার ও সব রকম আয়োজন। বারোটার কাটা পেড়োতে, বিদায় নিয়ে, মেয়েকে নিয়ে মা বেড়িয়ে পড়লো বাড়ির উদ্দেশ্যে, সকালে স্কুল রয়েছে। ভোরে উঠে খাবার করে দিতে হবে।


এদিকে দোকানের মাঝখানের প‍্যাসেজে আমার জন‍্য বিছানা পেতে ফেলেছেন ভদ্রলোক, বললাম আরে আমার ম‍্যাট্রেস রয়েছে, স্লিপিং ব‍্যাগ রয়েছে। না না বাবা, তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে। বলে এক খানি লেপ পেতে দিয়ে জোড় করে আরেকখানি গায়ে চাপিয়ে দিলো। উষ্ণতার ওমে চোখ তখন বুঝে আসছে, বাড়ি ফিরে মেয়ের ফোন, তুমি শুয়েছো ? ওর দিদির গলায় উদ্বিগ্নতা, তুমি শুনছি বেজিং যাবে, ওখানে খুব ঠান্ডা, এই ঠান্ডায় তুমি থাকবে কি করে ? তোমার তেমন কোন গরম জামা নেই। অচেনা অদেখা মানুষটির জন‍্য এত উদ্বেগ, এতো ভালোবাসা ! চোখের কোনটা ভিজে ভিজে ঠেকলো। বললাম নারে মনা, যা আছে,চলে যাবে আমার, আর তোদের মত মানুষ তো রয়েছে এই দেশজোড়া, চিন্তা কি ? তুই অস্থির হোস না ঘুমিয়ে পড়। 
সেই রাতে ওদের ঘুম এসেছিল কিনা জানিনা, আমার কিন্তু ঘুম আসেনি। হিজিবিজি চিন্তার জট পাকাচ্ছিল, ভাবছিলাম, এই মানুষগুলোকে কেমন আমরা শত্রু বলে ধরে নেই, ফাক পেলে কত গালাগাল করি, উদ্দেশ্য প্রনোদিত ভাবে কিছু লোক করে আর আমরা ছাপোষা বাঙ্গালী কায়োক্লেশে গলা মেলাই। যদি পৃথিবীর মাঝখান থেকে দেশে দেশের বেড়াগুলো তুলে দেওয়া যেতো, তাতে শাসকের আর লুটে খাওয়া শ্রেনীর অসুবিধা হতো বটে, কিন্তু আমরা সত‍্যিই একটি মানবিক আর ভালোবাসার পৃথিবী পেতাম।


পরদিন সকালে দোকানদার স্বামী স্ত্রী,আশেপাশের লোকেরা আমায় বিদায় জানাতে এলো । ততক্ষণে আমার পরিচয়, ভোররাতে আমার লেখনীর কথা রাষ্ট্র করে দিয়েছে আমার রাতের আশ্রয় দাতা। সবাই মুগ্ধ চোখে, ভালোবাসার ডালি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। এদিকে ব‍্যাগ ভর্তি কেক, আগামী পাচ দিনের খাবার জল ভরে দিয়েছে তারা আমার সংকুলান হীন ব‍্যাগে। সকলের সাথে ছবি তুলে, ভারাক্রান্ত মনে আবার দিনের পথ চলা শুরু করলাম।

চীন সাইকেলে :(৩২) জিনিং শহরে রাত কাটিয়েছিলাম বটে,কিন্তু তা শহরের প্রান্ত মাত্র। সকালে শহরতলি ছেড়ে বেলা নটায় পৌছালাম জিনিং এর প্রানকেন্দ্রে। জমজমাট অফিস টাইমের ব‍্যস্ত শহর। শুরুতেই সত্তরের শ্রদ্ধা নিয়ে মাথা উচু করে দাড়িয়ে মাও অনেকটা জায়গা জুড়ে, এবং কোন সন্দেহ নেই মানুষের অনেকটা হৃদয় জুড়েও। দোকানে হাটে বাজারে সর্বত্র স্বমহিমায় রয়েছেন তিনি। ভালো লাগলো বর্তমান চীনা নেতৃত্ব মাও এর ভাবনা থেকে কিছুটা সরে এলেও, মাওকে তারা জনজীবন থেকে সরিয়ে দেননি।, বরং কোথাও তারা নিজেদের ছবি না টানিয়ে, এদেশের বিপ্লবের কান্ডারীকেই সসম্মানে জায়গা করে দিয়েছেন। যাই হোক, কর্মব‍্যস্ত জনজীবন ডিঙ্গিয়ে উত্তরমুখী এগোতে লাগলাম। গন্ডোগোলের কারণে পারমিট না মেলায়, হঙকঙ থেকে পথ চলা শুরু করতে পারিনি। শুরুতে চলতে চলতে ভাবছিলাম আরেকবার এদেশে এসে, ঐপথে বেজিং পৌছে, দেশটাকে বুঝে নিতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে চিত্র অনেকটাই পরিস্কার। আর আবার আসবো এত অর্থই বা কোথায় ? তাই আবার আসার ভাবনাকে সরিয়ে রেখে, এবারেই ভাল করে বুঝে নিতে মাঝে মাঝেই পথ বদল করছি।এতে পথ হয়তো অনেকটাই লম্বা হচ্ছে, সময়ে বেজিং পৌছাতে পারবো কিনা বুঝতে পারছি না, কিন্ত তা সত্ত্বেও ক্রস চেকিং করে বুঝে নিতে চাইছি। তাই কখনো জাতীয়, কখনো প্রাদেশিক কখনো বা আমার পরাণ যাহা চায়, তেমনি সড়ক ধরে চলেছি, দেশের সর্বাঙ্গে এবং মানুষের জীবনে উন্নয়নের কতটা ছোয়া পরেছে তা যাচাই করে নেবার জন‍্য।
শহরেই শেষ ‌প্রান্তে‍ কলেজে তখন ছুটির ঘন্টা, দলে দলে ছেলেমেয়ের দল কলরবে এগিয়ে চলেছে, তাদের উচ্ছাসে ভাসতে ভাসতে আমিও চলেছি। শহর পেড়িয়ে শহরতলি, মল, সব পেছনে ফেলে। বিকেলে এসে হাজির হলাম এক বড় সর সপিং মলের দ্বারে, ইতিমধ্যে ছবি তোলার সঙ্গী হয়েছে আমার নতুন ফোন। নতুন মেমোরি কার্ড ভরে যাত্রা শুরু করলাম।
রাতে এসে হাজির হলাম নতুন শহরে। এসে তো পরলাম, কিন্তু থাকি কোথায় ? পুলিশ আমায় নিয়ে গোটা কয়েক হোটেল ঘুরে রনে ভঙ্গ দিলো। অফিসার ভগ্ন হ়দয়ে বললেন আপনি হসপিটালে চলে যান, ওখানে আপনি নিশ্চিন্তে রাত কাটাতে পারেন। আমি বললাম সেকি! আমিতো অসুস্থ নই। ওখানে আমাকে রাত কাটাতে দেবে কেনো! বলল এদেশে রাত কাটানোর দুটো নিশ্চিন্ত জায়গা রয়েছে এক হসপিটাল অপরটি সাইবার কাফে। বাধ‍্য হয়ে হসপিটাল অভিমুখে এগোলাম। খাবারের সন্ধানে গিয়ে দেখা হয়ে গেলো এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে,বয়স প্রায় 65। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ঐ রাতেই আমায় নিয়ে বেড়িয়ে পরলেন। বিদেশী আমি এই বিদেশ বিভুইতে কোথায় রাতে থাকবো , আমার থেকে ওনার দুশ্চিন্তা যেনো বেশি। শেষ পর্যন্ত অবশ‍্য ওনার পরিশ্রমও ব‍্যর্থ হলো। আমায় শেষে হসপিটালের ঘরে গিয়েই বসিয়ে দিলেন। 2/2 বাসের সিটের মত হেলান দেওয়া চেয়ার। বূঝলাম রাত এখানেই কাটাতে হবে। মন্দ লাগলো না, এও এক অভিজ্ঞতা। ফিলিপিন্সের ম‍্যানিলাতে ফুটপাতে পুলিশের সাথে শুয়ে রাত কাটিয়েছিলাম, আর এখানেতো অনেক ভালো ব‍্যবস্থা। শুধু জিজ্ঞেস করলাম কেউ কিছু বলবে নাতো ? ভদ্রলোক আমায় আস্বস্ত করে বললো, না ,না, নার্স এসে যদি জিজ্ঞেস করে, তুমি বলবে তোমার কথা, দেখবে কোন সমস‍্যা হবে না। সত‍্যিই তাই, রোগী দের প্রাথমিক চিকিৎসার পর পর্যবেক্ষণ ঘর এটি। রুগী এসেছিল একজনই। নার্স তাকে দেখতে বারদুয়েকমএলেও আমায় নজর করার প্রয়োজন মনে করলেন না, দেখেই বোধহয় এই ভবঘুরের রোগ বৃত‍্যান্ত বুঝে গেলেন। যাইহোক, রোগী না হয়েও একাকী ঐ ঘরে রাত কাটিয়ে সকাল হতেই বেড়িয়ে পরলাম।

সাইকেলে চীন (৩৩) :- সকাল হতেই জি্য়ান জিং এর হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে পরলাম বটে,কিন্তু কয়েক কদম এগোতেই থমকে দাড়ালাম। বা দিকে রয়েছে স্তার ওপর বিরাট বাজার, পাইকারি বাজার ও বলা যেতে পারে। প্রায় আড়াই কিমি লম্বায পথের ওপর ডাইনে বায়ে চার লেনে সার দিয়ে বসেছে বিক্রেতার দল । শাক সব্জি মাছ থেকে মনিহারী কে নেই সেখানে। দাম ও বেশি নয়। একবার কিছুটা পাক মেরে আসতে ঘন্টাখানেক লেগে গেল। সকালে আজ এক্সারসাইজ করা হয়নি। পাশেই পার্ক পেয়ে ঢুকে পরলাম। মিনিট কুড়ি পরে বেড়িয়ে দেখি ও বাবা , ভোভা! এর মধ‍্যেই সব দোকান পাট ও সাফ, রাস্তাঘাট ও সাফ করার জন‍্য করপোরেশন কর্মীরা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করছে। সারে আটটা বাজতেই অফিস টাইম, চালু হয়ে গেলো বাস,ট্রাক, টেম্পো মটোর গাড়ি। সত‍্যিই দেখার মত, কে বলবে, আধঘন্টা আগের এই পথের ওপরই ছিলো বিরাট কর্মকান্ড, কত মানুষের জীবিকা। যাই হোক , মাঝখান দিয়ে আমার সস্তার জিনিস আর কেনা হলোনা।


টিফিন খেয়ে এগিয়ে চলছি। যতই উত্তরে এগোচ্ছি, ততই হাওয়া বাড়ছে। ঠিকই বলেছিল দোকানের সেই মেয়েটি। হাওয়ার সাথে যুদ্ধ করে এগোচ্ছি। চলতে চলতে পথ একসময় ইয়েলো নদীর প্রেমে পড়লো। পাশ যেনো ছাড়তেই চায়না। ইনিয়ে বিনিয়ে একে বেকে প্রান যেনো তারই কাছে যেতে চায়। এভাবেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পথ আমায় পৌছে দিলো আকাশ প্রমাণ উচ্চতায়, ইয়েলো নদীর ব্রিজে। বিরাটাাকার সেতু, তার গঠন শৈলী আমায় নির্বাক করে তুললো। না নির্মাতারা আমার মত যাত্রীদের কথা ভুলে যাননি। সাইকেলে আলাদা লেন রয়েছে তার মাঝেও। মাধ‍্যাকর্ষনের আকর্ষণ অস্বীকার ক‍রে পথ আগলে দাড়িয়ে পড়ি়। ছবি কিছু নিয়ে যখন ব্রীজের ওপরে এসে পৌছাই তখন ওপারে বড় শহর আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে।


নেমে আসছি বিপুল বেগে, হটাৎ ই বড় আকার লিমোজিন গাড়ি হাই করে ডাক দিয়ে বাক নিয়ে থেমে গেলো। অন্তরঙ্গ আহ্বানে থমকে গেলাম। কি জানি এই বিদেশ বিভুইয়ে কে আমায় ডেকে যায়। সাইকেলথেকে নামতেই ছুটে এলো। বলে উঠলো তুমি ভারতীয় না ? বললাম কি করে বুঝলেন ? বললো, এখানকার অধিবাসী হলেও ব‍্যবসার সুত্রে কিছুদিন দিল্লি জয়পুর বোম্বেতে কাটিয়েছি। ভীষন ভালো মানুষ ইন্ডিয়ানরা আমি তাদের সাথেই গভীর ভাবেই মিশেছি। বুঝলাম, ভারতবাসী দের কাছ থেকে দেখেছেন বলেই অন্তরের টান জন্মে গেছে। গাড়ি নিয়ে লঙ ড্রাইভে বেড়িয়েছেন দুই ফ‍্যামিলি, প্রায় সবাইকে টেনে নামিয়ে আনলেন আমার সাথে আলাপ করিয়ে দেবেন বলে। মেয়েকে নিয়ে এসে ছবি তুললেন। তারপর আমার দুহাত ফলমূল ভালোবাসার দানে ভরিয়ে দিয়ে, আবার বিদায় নিয়ে ছুটে গিয়ে গাড়িতে বসলেন গাড়ি আপন পথে চলে গেলেও আমার সম্বিৎ ফিরে এলো তার ও পরে। ওদের গাড়ির পানে তাকিয়ে ভাবছিলাম একেই বুঝি ভালোবাসা, আত্মার বন্ধন, আত্মীয়তা কয়।

 

চীন সাইকেলে :- (৩৪) : - সেদিন দুপুরের পর হাওয়া ঠেলতে ঠেলতে নিজের অজান্তেই রাস্তা ভুল করলাম। বেজিং এর সোজা পথ খুজছিলাম, কিন্তু বেখেয়ালে বাকা পথই ধরলো। পথ চলতে চলতে একসময় খানাখন্দে হারিয়ে গেলো। রাস্তা চওড়া হচ্ছে, মাটির পৃথিবী জেগে উঠেছে। পাশ দিয়ে ঢেউ ভেঙ্গে এগিয়ে চলেছি। এক জায়গায় এসে থমকাতে হলো। পথ সোজা ওপর পানেই হাতছানি দিয়ে চলেছে। যাবো কি যাবোনা করে উঠে পড়ি ওপরে। তারপর তস‍্য উপরে, তস‍্য উপরে। হাফ ধরে, দাতে দাত চেপে উঠে চলেছি। না জন প্রানী কেউ নেই, ঠিক যাচ্ছি কিনা তাও বলে দেবার কেউ নেই।ভাগ‍্যের ভরষায় নিজেকে ছেড়ে দিই। থামা চলবে না। এমন গোলকধাঁধা যে, জিপিএস ও দিকভ্রান্ত হয়ে কথা বলা থামিয়ে দিয়েছে। প্রায় পাকদন্ডী পথ ঠেলে যখন পাহাড়ের একেবারে ওপরে উঠে এলাম, চারিদিক যেনো মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আমায় যেনো স্বাগত জানালো। ওপরটা যেন মালভূমির উপরিভাগ, দিগন্ত বিস্তৃত রেখা যেনো ওপারের আঙ্গিনায় পা ফেলেছে। বেশি সময় দেখবো তার কাছে উপায় নেই, কোথায় কোন পথ দিয়ে কত পাহাড় টপকে , কখন গিয়ে পৌছাবো তাও জানা নেই।

 জলের বোতল ও ঠনঠন আওয়াজ করে তার শুন‍্যতা জানান দিয়ে চলেছে। রবি কিরণ বিলায়ে মিলায়ে যেতে বসেছে। আর দেরি করা ঠিক হবেনা। বালুকারাশি সাইকেলের পেছন টেনে ধরছে, তা স্বত্বেও উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিকেই পথ খোজার চেষ্টা করছি। যত অন্ধকার বাড়ছে, ততই টেনশন ও বাড়ছে। অবশেষে দেবদুতের মত রাস্তার তৈরির মাল নিয়ে হাজির হলো এক গাড়ি চালক, শেষে তার দেখানো পথে বালিয়ারি দিয়ে সাইকেল নিয়ে গড়াতে গড়াতে অবশেষে মর্ত্যে পদার্পন করলাম। থামলে হবে না , রাত গড়ানোর আগেই জিয়ানজিং শহরে পৌছাতে হবে। 


অবশেষে শহরে যখন পদার্পন করলাম ঘড়ির কাটা রাত নটা। ইউথ হোষ্টেল আছে বলে শুনেছিলাম কিন্তু জনগন হদিস দিতে পারলেনা। এক বড় মাত্রিক হোটেলে পদার্পণ করে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, সেই সময় হোটেলেই আড্ডারত এক মাঝ বয়সী ব‍্যাক্তি সাথে করে নিয়ে এক হোটেলে জায়গা শুধু করে দিলেন তা নয়, হোটেলের আশি টাকা মানে ভারতীয় মুদ্রায় আটশ টাকাও মিটিয়ে দিলেও। স্নান সেরে এসে গল্প হচ্ছিল ওনার সাথে, নাম ভূমি সংস্কার দপ্তরের কর্মী। বললাম ভূমি সংস্কারের কাজ তো অনেক টাই সেরে ফেলেছেন আপনারা, দেখলাম প্রায় সবাই জমিও পেয়েছে, তাহলে এখন কাজ কি আপনাদের। উত্তর দিলেন, ঠিকই বলছেনা সাধারণ মানুষ, কৃষককে জমি দেবার কাজ আমরা অনেকটাই করে ফেলেছি, কিন্তু তাই বলে কি আর কাজ নেই ? এখন আমরা ভূমির সর্বাধিক সদ্ব্যবহারের জন‍্য কাজ করছি। কম্পিউটারে তার তথ‍্য প্রস্তুত করা, সংরক্ষণ ও 

সদ্ব্যবহারের জন‍্য কর্মসূচির বেসিক পরিকল্পনা করাই আমাদের কাজ। বললাম চাকরি পায়নি এমন যুবক কি আছে ? বললেন আছে সামান‍্যই, কিন্তু তাদের ও ভাত যোগানোর জন‍্য চেষ্টা করছে সরকার। বললাম এই যে দেশের।র্তঢালাও প্রাইভেট ব‍্যবসার অনুমতি তাও কি জীবিকার ব‍্যব়স্থা করে দেবার জন‍্য ? বললো কোন সন্দেহ নেই। হোটেল ব‌‌ব‍্যবসার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রন ? দাম কি সরকার ঠিক করে ? উত্তর এলো না, ওটা হোটেল মালিকরা‌ই করে। রাতের খাবার খাইয়ে অবশেষে বিদায় নিলো সে।


চীন সাইকেলে :(৩৫) - একটু দেরি করেই বেরোলাম জিয়ানজিং শহর থেকে, ভেবেছিলাম রাতের বন্ধু এলে তার সাথে দেখা করে বেড়োই, কিন্তু না সারে আটটা বাজে, আর দেরি করা যাবেনা। পথ এখনো অনেক বাকি। সময়ে বেজিং পৌছানো এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। আজপৌছাতে হবে কেওনঝো। শহর পেছনে ফেলে চলেছি, দুপাশে কখনো কারখানার গেট , কখনও বা চাষের ক্ষেত, মনে পরে গেলো বুদ্ধ বাবুর বহু চর্চিত সেই কথা, কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ, এখানে শুধু বাস্তব রুপ নেয়নি, উভয়ের পাশাপাশি সহাবস্থান এখানে গড়ে উঠেছে। কারখানার সামনেই রাজপথে ডাই করে রোদে মেলে দেওয়া হয়েছে কোথাও ধান , কোথাও ভূট্টা। আমরা ভালো না থাকি, এই দেশের মানুষ গুলোতো ভালো আছে, ভালো লাগে একথা ভেবে। আর সে কথা আনমনে ভাবতে ভাবতে কতক্ষন এগিয়েছি খেয়াল নেই। আচমকাই হাক ডাক কানে আসতে চিন্তার তারগুলো কেটে যায়। ছোট্ট বাজার আর তার হৈ চৈ, হাকডাক। ভালোই লাগে এই পরিবেশ। মানুষ না থাকলে বোধহয় এই পৃথিবীটা অর্থহীন হয়ে যেতো।


রাস্তার ওপারে এক মহিলা গাড়িতে কি যেনো ভাজছে। যাই দেখে আসি, খাবার মত হলে খেয়ে নেওয়া যাবে। কাছে গিয়ে অবাক হলাম। যন্ত্র নির্ভর এই দেশে মহিলা গোলাকার ঘুর্নায়মান চাটুর ওপর ধোসা জাতীয় খাবার ভেজে , ডিম ভেঙে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এগ ধোসাই বলা যেতে পারে। চার টাকা দাম, নিলাম বটে, কিন্তু সব খাবার ই এখানে এত বড় যে একজনের পক্ষে গলধকরণ সম্ভব হয়না। অগত‍্যা কিছুটা ফেলেই এগোতে হলো।


বেড়িয়ে যাবার পথে হটাৎ ই এক বয়স্ক মানুষ এসে সেলুট করলো, বাজারের জ‍্যাকেট বিক্রেতা একটি জ‍্যাকেট বা কোট নিয়ে যাবার জন‍্য হাকডাক, হেসে সময় নেই বলে এগিয়ে চললাম। দুপুরের দিকে পরের বড় শহর Dezhou তে পৌছালাম।বড় বড় চৌমাথা, কিন্তু মজার বিষয় হলো এখানে এদেশে কিন্তু রাস্তা পাড়াপাড়ে সেই ব‍্যস্ততা নেই। কেউই এদেশে 60এর ওপর স্পিড তোলেনা। বিশেষ করে চারমাথার মোড়ে রাস্তা পেড়োনোর মুখে যদি সিগন্যাল লাল থেকে সবুজ ও হয়ে যায়, তাও ওরা হাসিমুখে অপেক্ষা করবে আপনার বেড়িয়ে যাবার জন‍্য। সবার ই যেনো সবার প্রতি সহমর্মিতার মনোভাব। 


শহরে ঢুকে খাবারের খোজেঁ এদিক ওদিক তাকাতেই কাছে এগিয়ে এলো ছেলে সাথে স্কুটিতে ঘুড়ে বেড়ানো এক কৌতূহলী ব‍্যাক্তি। আমার কাছ থেকে নানা বিষয়ে খোজ নিতে লাগলেন। ছেলেটি অবশ‍্য স্কুটির পাদানিতে লেপবন্দী হয়ে থাকতে রাজি নয়। বেড়িয়ে এসে আমার সাইকেল ধরে টানাটানি করতে লাগলো। এখানে উল্লেখ্য যে এখানকার শিশুদের বাইকে বসার জায়গা চালকের পা রাখার জায়গায়। আর এদেশের সবাই শীতকাতুরে, বাইক চালাবে শরীরের সামনের অংশ লেপে ঢেকে, আর সেই একই লেপে ঢাকা থাকে ছোট ছেলেমেয়েরাও। ওখান থেকে বসেই ওরা পথ চলতে চলতে আমার সাথে ঈশারায় কথা বলতো। হাসি পেতো লেপবন্দী বেচারাদের দেখে। একবস্ত্রে চলেছি দেখে আমাক দেখে ও ওরা অবাক হতো।

 যাই হোক ভদ্রলোক কে জিজ্ঞেস করলাম আজ ছুটি আপনার ? কোথায় কাজ করেন ? বেতন কত ? উত্তর দিলেন কাজ করি সেন্ট্রালাইজ এসি সেন্টারে, বেতন ছয় হাজার, মানে ভারতীয় টাকায় ছেষট্টি হাজার। এদেশে সবারই শনি ও রবি দুদিন ছুটি, কাজ আট ঘন্টা। ছুটির দিনে ছেলে বউকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে পরেন। চলতে চলতে ভাবছিলাম, হায়রে ! কত লক্ষ কোটি ভারতীয়র কাছে এটা আজ স্বপ্নই। রবিবার ছুটির দিনেও পিষে মারছে এদেশের মালিকরা। মুনাফা র লোভ যেনো তাদের অমানুষ করে তুলেছে। আর দেশের সরকার নির্বিকার। কবে যে এ ভারত বদলাবে, মানুষ একটু সুখের মুখ দেখবে কে জানে !

চীন সাইকেলে (৩৬) :- দেওঝু শহরের সেই বাবা ও ছেলেকেই বিদায় দিয়ে এগিয়ে চললাম বটে, তবে দুপুরের খাবার সেদিন জুটেছিল প্রায় বিকেলে এসে। খাবার শেষে আর অপেক্ষায় না থেকে কেওনঝো র দিকে গতি বাড়াই। মাঝে মাঝেই টা টা করে বেড়িয়ে যাচ্ছে সবুজ রঙ এর রেলগাড়ি, কখনো ভো-ও-ও ,এক ঝাক মৌমাছির মত আওয়াজ তুলে চোখের নিমিষে মিলিয়ে যায় বুলেট ট্রেন। ওদের বাড়তি আনাগোনা জানান দিয়ে যায় বেজিং এগিয়ে আসছে। তবে আজকের গন্তব্য কেওনঝো রাত আটটাতেও যথেষ্ট দুরে। এদিকে সাইকেলের আলো আমার উদাসীন, আকাশের দিকে তাকিয়েই পথ চলতে ভালোবাসে। কিন্তু এই আলোয় আর যাই হোক পথ চলা যায় না।


বাধ‍্য হয়ে নতুন শহরের শুরুতেই,ডাইনে বায়ে আমার নজর বাসস্থান খুঁজে বেড়ায়। হটাৎই বড় সড় একটি বাড়ি দেখে দাড়িয়ে পড়ি। কয়েকজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা সোফায় চেয়ারে আড্ডা জমিয়েছে। ঢুকেতো পরলাম, কিন্তু ধন্দে পরলাম, কিরে বাবা, এটা বৃদ্ধাশ্রম নয়তো ? পরে অবশ‍্য কথা বলতে বুঝলাম, একই পরিবারের বয়োজ‍্যষ্ঠ সদস‍্য তারা, জুনিয়র দের কাজে পাঠিয়ে হোটেল দায়িত্ব নিজেরাই কাধে তুলে নিয়েছে। ভালো লাগে এরা প্রায় আমৃত্যু, যতক্ষণ সম্ভব, নিজেদের উৎপাদনের কাজের সাথে যুক্ত রাখে, কাল্পনিক ঈশ্বর সন্ধানে নয়। এই বাড়ির প্রবীণ এই মানুষ গুলো কিন্তু যথেষ্টই ভালো । আমাকে সমাদর করে নিয়ে গিয়ে ত্রিশ টাকাতেই দারুণ ঘরে পৌছে দিল।ঘরেতো ঢুকলাম, ওদিকে রাতের তালা পড়ার আগেই রেষ্টুরেন্টে খাবারের পাট চুকিয়ে আসতে হবে।


স্নান সেরে কোনরকমে বড় দোকানে পৌছালাম বটে, কিন্ত ততক্ষনে এই শীতের রাতে অধিকাংশ দোকানেই তালা। একটি মাত্র বড় দোকান খোলা। দোকানে পা রাখতেই মালিক ঈশারায় অল্পবয়সী একটি ছেলে এগিয়ে এলো। ভাগ্নে তার, ক্লাস সেভেন এ পড়ে, ইংরেজী টা অল্প স্বল্প পারে। সব কথাতেই ওর নো নো উত্তর, ওটাই ও ভালো জানে। কি দরকার , কি নেবে বলে কলরব তুলে আমার পেছন পেছন ঘুরে চলেছে। খাবারের কথা বলতে আমায় সঙ্গে নিয়ে উল্টোদিকের রেষ্টুরেন্টে হাজির হলো কিন্তু তাদের ও বাসনপত্র মাজা হয়ে গেছে। অগত‍্যা ফিরে এসে ওর দোকান থেকেই গোটা দুই ডিম, কলা আর পাউরুটি নিলাম। এতক্ষণে ওরা আমার সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। ডিম কোথায় সেদ্দ করবো সেই দুশ্চিন্তায় ডিম নিয়ে চলে গেলো ঘরে, সেদ্দ করে আনবে। এদিকে ঘরেরে লোকেরা বিদেশীর সাথে আলাপ করতে বাইরে ভীড় জমিয়েছে। দোকানদার ভদ্রলোক, তার স্ত্রী কন‍্যা, বোন আর সেই শ্রীমান ভাগনে সবাই আমায় নিয়ে ব‍্যাতিব‍্যস্ত। আমি সেই ফাকে দোকানের জিনিসপত্র দরদাম দেখে চলেছি। চাল সাড়ে তিন থেকে পাচ, আটা ময়দা মসলাপাতি সবই ঐ পাচের মধ‍্যে, চিনি আট , আপেল ছয় সাত, তবে পোস্তোর দামটা একটু বেশি কুড়িটাকা কেজি। ভদ্রলোক কে বললাম, ভিয়েতনামে দেখেছিলাম দক্ষিণ থেকে উত্তর সব জায়গায় জিনিসের দাম এক, এখানেও কিছুটা তাই, কিন্তু এই দাম কে ঠিক করে আপনারা না সরকার ? উত্তর এলো, "না আমাদের স্টেট কিম্বা ডিষ্ট্রিক্ট ভিত্তিতে প্রাইজ বুর‍্যো রয়েছে তারাই দাম ঠিক করে দেয়"।বুঝলাম সেই কারণে গ্রাম শহরে দামের সামান্য হেরফের রয়েছে।বললাম ব‍্যবসা আপনার ? স্বাধীন ব‍্যবসা ? সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটা ? বললেন সরকারের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই কম, এমনকি কর পর্যন্ত দিতে হয়না। শুনে অবাকই হলাম। প্রায় দুহাজার স্কোয়ারফুটের দোকান ও ব‍্যবসা কর মুক্ত, ভাবা যায় ! বললাম সে নয় হলো কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ? বললেন না না, আমাদের সরকার আমাদের জন‍্য অনেকটাই করে। যা আয় আমাদের তা যথেষ্ট ই ভালো, তার ওপর আছে সকলের মেডিক্লেম ও পেনশণ। বললাম, এদেশেও এখন বিদেশী কোম্পানির আগমন ঘটছে, ব‍্যবসায় পা বাড়াচ্ছে। তোমাদের ব‍্যবসা ঝাড় হবে নাতো ? শুনে বলে উঠলো, "না না, আমাদের অর্থনীতির ভীত অনেকটাই পোক্ত, ওরা আমাদের কিছু করতে পারবেনা। আর দেখুন ওদের যদি আমরা ঢুকতে না দিই, তবে বিশ্ব বাজারে ওরাও আমাদের ঢুকতে দেবেনা। ক্ষতিটা হবে আমাদেরই"। বুঝলাম, অনেকটাই এবিষয়ে সচেতন ওরা। বললাম, জাপানে আমি জানতে চেয়েছিলাম আমেরিকার সাথে ওদের বন্ধুত্ব কেনো ? এক ভদ্রলোক উত্তর দিয়েছিলো "চীনে গনতন্ত্র নেই, আর তাদের প্রতি ভীতি থেকেই তারা আজ আ‌মেরিকা মুখী।" শুনেই যেনো ক্ষেপে উঠলেন ভদ্রলোক, বললেন, এই জন‍্য ই আমরা জাপানীদের দেখতে পারিনা। আর এ আমেরিকাকেতো নয়ই। ওরা দুনিয়া জুড়ে খবরদারি করে বেড়াচ্ছে। আমাদের এখানে যথেষ্ট গনতন্ত্র রয়েছে, রয়েছে মত প্রকাশের অধিকার। তার ছাপ অবশ‍্য ইতিমধ্যে আমি বাসে ট্রেনে পথে পথে দেখেছি। 


এদিকে পরিবারের মহিলা মহল ততক্ষনে ঘিরে ফেলেছে আমায়। ঘুরিয়ে প্রশ্ন এবার তাদের। ভারতে এখোনো অধিকাংশ মহিলা বাড়িতেই, উৎপাদনের সাথে জড়িয়ে নেই অনেক মহিলাই। আপনাদের অবস্থা ? আমার প্রশ্ন শুনে তারা হতবাক, বাড়িতে মহিলারা ? ভাবতেই পারেনা তারা। সব কাজেই এখানে মেয়েরা সমান তালে, বিতর্কে যেন আগেই। ব‍্যাথীত হলো নারীর লাঞ্চনার কথা শুনে, খানিকটা।উস্মা প্রকাশ ও বটে। মনটা একটু খারাপও হলো বটে, নিজ দেশের গঞ্জনা শুনতে কারই বা ভালো লাগে ?যাই হোক, ইতিমধ্যে আমার সেদ্দ ডিম, সাথে আমার জন‍্য হাতে করা রুটি হাজির। সবার সাথে একসাথে পারিবারিক ছবি তুলেছেন বিদায় নিলাম। রাতে বাড়ি ফিরেও ভাবছিলাম ওরা যেন এক ভিন বাসিন্দা,অনেকটাই পাল্টে নিয়েছে নিজেদের, আমাদেরই একটা লম্বা দৌড় চাই।

সাইকেলে চীন (৩৭) :- সাত সকালেই বেড়িয়ে পরলাম বৃদ্ধাবাস থেকে।, বৃদ্ধাবাসই বটে !বিদায় জানাতে এগিয়ে যারা এলো তারাও আশির উর্ধে। ভাষার দুস্তর ব‍্যবধান, কিন্তু ভালোবাসার প্রকাশে খামতি নেই। ওনাদের সাথে ট্রান্স্লেটে গিয়ে ও লাভ নেই, কানের জোর কমেছে। বেড়োনোর মুখে এগিয়ে এল সবাই। জলের বোতল, পথের খাবার ধরিয়ে দিয়ে, গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো, যেন কতকালের চেনা মানুষ আমি, এ বাড়িরই কেউ, বাইরে চলেছি প্রিয়জনকে ছেড়ে। ভালোলাগার অনুভুতি হ্রদয়ের দরজায় যেন পরশ রেখে যায়। মিছেই মোদের দেশভাগ, সীমান্তের কাটাতার । হৃদয়ের আবেগ, ভালোবাসার টান কোন কাটাতারের জালে আটকা পড়েনা।


হাত নেড়ে ওদের বিদায় জানিয়ে প‍্যাডেলে চাপ দিই। কিন্ত এগোব কি ! কদিন আগে থেকেই আবহাওয়ার রিপোর্ট মঙ্গোলিয় ক্লাউডের কথা বাইডু এ্যাপে জানান দিচ্ছিল, কিন্তু গুরুত্ব দিই নি। আজ কিন্তু সকাল থেকে গাছেদের ঘনঘন মাথা নাড়া আর আকাশের মুখ ভাড় দেখে মনে হচ্ছে মঙ্গেলিয় দস‍্যুরা এই প্রান্তে হাজির হয়েছে। উইনচীটার শুধু নয়, এই সাতসকালেই মাথায় ঘোমটাও দিতে হল, গা এ দিলাম কোরিয়ান পুলিশের দেওয়া সেই জ‍্যাকেট। সাইকেল ঠেলবো কি ? মাঞ্চুরিয়া ঘুরে আসা উত্তর মেরুর বাতাস আমাকেই ঠেলে নিয়ে যেতে চায়। চিরকালই স্রোতের বিপরীতে এগিয়েছি, এখানে বাতাসের এই প্রতিকুলতায় হাল ছাড়লে চলবে কেনো ? দাতে দাত চেপে তাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। বেজিং এখনো প্রায় 150কিমি বাকি। দুদিনে এই ঝড়ো বাতাস ঠেলে কতটা এগোতে পারবো তাই চিন্তা। প্রায় দুন্টার চেষ্টায় পরের শহর কেওনঝোতে পৌছাই।
কেওনঝো একটি সুন্দর শহর। লেকের ধারে চারপাশে মাথা উচু করে দাড়িয়ে সুন্দর সুন্দর মাল্টিপ্লেক্স, শপিংমল, সব মিলিয়ে সুন্দর ছবি। শহরের মাঝখানে একটি বড়সড় পাব্লিক হসপিটাল, ভীড় যথেষ্টই। প্রতিটি ছোট বড় শহরেই এদেশে রয়েছে বড় আকারের স্বাস্থ্য কেন্দ্র কিম্বা হসপিটাল। এই প্রথম কোন হসপিটালে ভীড়ের ছবি পেলাম।
শহরের শেষ প্রান্তে পথ আবার ছুয়েছে আমার নিত্য দিনের সঙ্গী 104 নং জাতীয় সড়কে।
জাতীয় সড়কে ওঠার আগে দীর্ঘ পথ জুড়ে সিনোপ‍্যাক, এখানকার সবচেয়ে বড় পেট্রোলিয়াম কম্পানি। গেটের মুখে গুটি কয়েক সিকিউরিটি ও অন‍্য স্টাফকে দেখা খে দাড়িয়ে গেলাম, প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে সাইকেলের সামনে "Stop ! Globa warming and Climate change, Save life" দেখে খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এলো।আলাপ জুড়লাম তাদের সাথে। প্রশ্ন ছুড়লাম, সরকারি সংস্থা ? উত্তর এলো হ‍্যা, স্টেট এন্টারপ্রাইজ। কতজন আছেন ? উত্তর : সব মিলিয়ে দশ হাজার। বেতন ? ইঞ্জিনিয়ার দশ হাজার মানে ভারতীয় মুদ্রায় এক লাখ দশ ,আর সাধারণ স্টাফ ছ'হাজার মানে ছেষট্টি। ডিউটি আওয়ার্স ? উত্তর এলো : দিনে আট ঘন্টা, শনি রবি ছুটি‌। বললাম ইউনিয়ন আছে ? অবশ‍্যই । কাদের পরিচালনায় চলে ? উত্তর : এলো, কমিউনিস্ট দে‌‍র। বললাম নির্বাচন হয়, আপনি ভোট দিয়েছেন ? বললো হ‍্যা, ভোট হয় ,ভোট দিয়েছি। এত প্রশ্ন ? এত কৌতুহল ওরা ঠিক ভালোভাবে নিচ্ছেনা। ওদের উসখুসানি দেখে বুঝলাম, আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে খানিকটা যেনো সন্দীহান হয়ে উঠছে। কথা শেষ করার লক্ষে তাই বললাম গনতন্ত্র আছে এখানে ? খুশি আপনারা ? হ‍্যা বলেই গম্ভীর মুখে এবার তার দের পাল্টা প্রশ্ন , কোন স্টুডিও, কোন চ‍্যানেলের লোক আপনি ? বুঝলাম আর কথা বাড়ানো ঠিক হবেনা। বললাম, কোন চ‍্যানেলের লোক নই আমি, দূষণমুক্ত শান্তির পৃথিবী গড়ার বার্তা নিয়ে সাইকেলে বিশ্বপরিক্রমায় বেড়িয়েছি, সব দেশ সম্পর্কে জানবার কৌতূহল, তাই এত প্রশ্ন। শুনে একটু ভরষা হলো ওদের, বললাম ছবি তুলবো একটা ? আইন বাচাতে সিকিউরিটি দ্বয় রইলেন মুখ ঘুড়িয়ে, ক‍্যামেরায় আলতো চাপ, হোক না মুখ ঘোরানো, লক্ষীন্দরের ফুল,বা হাতে হলেও কোন ক্ষতি নেই।

 


চীন সাইকেলে (৩৮) :-চীনের পেট্রোলিয়াম জগতে একচ্ছত্র আধিপত্যের অধিকারী সরকারি কোম্পানি সিনোপ‍্যাক, যত পেট্রোল পাম্প তার 90% এদেরই । তেলের দাম সর্বত্র 5-50 টাকার মধ্যে। সরকার নিজের কোম্পানি লাটে তুলে দিয়ে রিলায়েন্স এর মত কাউকে তুলে আনেনি এখানে। ভালো লাগলো, সরকার টা এখানে জনগণের, কোন করপোরেট গোষ্ঠীর নয়।  যাই হোক, তার বিশাল বাউন্ডারি এলাকা পেরিয়ে প্রাদেশিক সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছি, হটাৎ ই কি মনে হল ঢুকে পরি গ্রামে বলে ডাইনে মোড় নিলাম। ডান থেকে বায়ে সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছি, বেশ কয়েকজন প্রায় বৃদ্ধ মানুষ বসে আছে পড়ন্ত বেলায়। সূর্যের সাথে তাদের জীবনের তেজও যেন কমছে। আলাপ করবো বলে সাইকেল ঘুড়িয়ে নিয়ে তাদের সামনে দাড়ালাম। তাচ্ছিল্লের দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে সবাই আবার আলোচনায় ডুবে গেলো। ভারত থেকে আসছি বলে নিজের পরিচয় দিতে এবার একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। বললো, একেবারে ভারত থেকে ? বললাম না আপাতত সাংহাই থেকে সাইকেল চালিয়ে আসছি। একজন বলে উঠলো বেজিং পর্যন্ত যাবে, তাতেই বা কম কি ? কিন্তু তুমি চালাচ্ছো কেনো ? টাকা পয়স পাবে ? বললাম না, বরং নিজের পয়সা খরচ করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতের জন‍্য মানুষের বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার আবেদন নিয়ে বেড়িয়েছি। বললো, তা ভালো, বলেই আবার নিজেদের জগতে ঢুকে পড়লো। একটু কম বয়েস এমন একজনকে পাকরাও করলাম। বললাম, আচ্ছা এখানে কি সবাই আশির ওপরে, সবাই অবসরপ্রাপ্ত ? বললো হ‍্যা, তবে আমার 76, বললাম এখানে পথে পথে দেখলাম, অনেক বয়স পর্যন্ত মানুষ কাজ করে, কেনো ? অভাব আছে আপনাদের ? বললো, না না, আসলে আমরা শরীরটাকে সক্রিয় রাখতে চাই, তার সাথে ছেলে মেয়েদের ওপর যাতে বোঝা কম চাপে সেই চেষ্টা করি আমরা। ভদ্রলোক কানে একটু খাটো, তাই আর কথা না বাড়িয়ে রনে ভঙ্গ দিয়ে এগিয়ে চললাম। 
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার মুখে হাইওয়ে এসে দুভাগ, বায়ের পথ সোজা বেজিং 130কিমি এর কিছু বেশি, আর ডাইনে পথ ত্রিয়ানজিন অভিমুখে। দ্বিতীয় পথ সময়েই দিক থেকে একটু চাপের হলেও সে পথই ধরি। চীনের এই বিখ্যাত শহরটিকে বাদ দিয়ে আর যাই কেনো ? সন্ধ‍্যা আগত , দুপুরের খাবার তেমন জোটেনি। রেষ্টুরেন্ট পেয়ে ঢুকে পরলাম, এগ ফ্রাইরাইস এদেশে মন্দ নয়, ভাতের দুঃখ ঘোচে, অগত‍্যা তাই দিয়ে চলার শক্তি যোগাই, কিন্তু পরে যে অত দুর্ভোগ রয়েছে কেই বা জানতো ? রেষ্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গোলক ধাধায় পরলাম। রেষ্টুরেন্ট এর গা দিয়ে সোজা পূর্বমুখী পথ গিয়েছে ত্রিয়ানজিন শহরে, দুরত্ব 45কিমি, পৌছাতে রাত হবে।পথে এখানে লাইট আছে , কিন্তু আগে আছে কিনা কে জানে ! আর একটু আগে বাদিকে চলে যাওয়া পথ দুরত্ব কম 30কিমি কিন্তু ম‍্যাপ বলছে জনবসতি কম, মাঠ ঘাট পেড়িয়ে চলতে হবে। যা আছে কপালে বলে বেড়িয়ে পড়লাম এতেই। কিন্তু কিছুটা দুর এগিয়ে গ্রাম পেরোতেই পথ সরু হয়ে মাঠ মুখী। গ্রাম ও শেষ, আলোও শেষ। একটি গাড়ি এসে আলো রেখায় বুঝিয়ে দিয়ে গেলো পথের প্রসস্ততা। একটি গাড়ির পাশ দিয়ে বড় জোর একটি সাইকেল যাবার পথ। গাড়ির আলোর সাথে সাথে পথও বিদায় নিলো। অন্ধকার মাঠের মাঝখানে উচু নিচু জমিতে ঠোক্কর খেতে খেতে এপারের রাস্তায় এসে উডলাম। বেজিং এর ঠান্ডা নিয়ে সবাই সতর্ক করলেও গুরুত্ব দিইনি, এখন বুঝতে পারছি। গেঞ্জির ওপরে চাপানো উইনচিটার নিজেই বোধহয় কাবু। হাত পা যেনো কাজ করতে চাইছেনা। এপারের গ্রামের রাস্তায় ঢুকে পরেছি, সব বাড়ির দরজা বন্ধ, পথঘাট জনমানব শূন‍্য, কাউকে জিজ্ঞেস করে পথের খবর নেবো তারো উপায় নেই। কুকুরের হাকডাকে কারো বাড়ির সামনে দাড়ানোরও জো নেই। পেছবো তার ইচ্ছে নেই, আবার এগিয়ে যাবার দিশাও দেখছিনা। বাইডু জিপিএস সামনে শুধুই ধান ক্ষেত আর বড় বড় জলাশয়ের ছবি দিয়ে চলেছে। এই ঠান্ডায় যদি ঐ জলাশয়ের ধারে থাকতে হয়, তাহলে ওপরে যাবার জন‍্য বেশি পরিশ্রম কযতে হবেনা। কি করবো ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি, হটাৎ ই তিন রাস্তার মোড়ের গ্রাম‍্য বাড়ি থেকে আলো বেড়িৎ খসতে দেখে ভরসা জগলো। আলোর সামনে যেতেই বুঝলাম, ছোটখাটো গ্রাম‍্য রেষ্টুরেন্ট, ভেতরে তখনো কিছু লোকের চায়ের কাপে শেষ চুমুকের জটলা। ঢুকে পরলাম ভেতরে, জিজ্ঞেস করলাম রাতে থাকা যাবে ? দোকানদার না না করে ঊঠলো, বললো এটিতো হোটেল নয়। বললাম তা হলে ? বললো হোটেলে রয়েছে 5কিমি পেছন হাইওয়ের ধারে। পেছনে ? পেছুতে হবে আমাকে? না বাবা না ! বললো তাহলে আর কি করবেন এই অন্ধকারে চল্লিশ কিমি এগিয়ে যান। বুঝলাম তাও অসম্ভভ। এই অবস্থায় অগতির গতি হয়ে এগিয়ে এলো রেষ্টুরেন্টে কর্মরত মহিলা। ছেলেকে বললো বাবাকে বল, বাইকটা নিয়ে আসতে। খবর পেয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই ওর বাবা বাইক নিয়ে পোছে গেলো। শেষ পর্যন্ত।ঐ বাইকেই ওনার ছেলে ও তার বন্ধু পথ দেখিয়ে পাচ কিমি পেথনে 104নং জাতীয় সরকের পাশের হোটেল টিতে আমায় নিয়ে এলো। কথাবার্তা বলে মাত্র চল্লিশ টাকায় ঘর ও ঠিক করে দিয়ে আমায় শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদা‌য় নিল।

 

চীন সাইকেলে :- (৩৯) চীনের মানুষের খাদ‍্যাভ‍্যাস :- কিছু দিন ধরেই করোনা ভাইরাস কে কেন্দ্র করে ইউটিউবে বিভ্রান্তিকর প্রচার চলছে, যা অনেকটাই সত‍্য নয়। চীনের এক কোটির কিছু বেশি দরিদ্র মানুষ কে (যাদের মাসিক আয় তিন হাজার, মানে ভারতীয় টাকায় ৩৩হাজারের নিচে, তাদের দরিদ্র ধরা হয়) বাদ দিলে, বেশিরভাগ মানুষই মধ‍্যবিত্ত, ব‍্যক্তিগত ব‍্যবসার দৌলতে উচ্চবিত্তদের সংখ‍্যাও দ্রুত বাড়ছে। ওদের বেশভূষা ও খাবার দাবার ইওরোপীয়দের মত অনেক উন্নত ধরনের, ইদুর বাদুর খাবার মত আর্থিক দুরাবস্থায় ওরা নেই। এটা অনেকটা কিছুদিন আগে কেরালায় বন‍্যার পর কারন হিসেবে অজস্র কুকুর হত‍্যার এডিট ছবি দেখানোর মত। চীনের প্রায় 1750কিমি পথ সাইকেলে পরিক্রমা করে সাংহাই থেকে বিভিন্ন পথ ঘুরে বেজিং পৌছেছি, এই দীর্ঘ পথে ওদের বাজার,রেষ্টুরেন্টে গেছি অসংখ‍্যবার।মানুষের সাথে গভীর ভাবে মেশবার ও তাদেরকে জীবনযাত্রাকে উপলব্ধির চেষ্টা করেছি। 
সত্যি কথা বলতে কি চাওমিন, থুকপা জাতীয় খাবার তাদের প্রধান খাদ‍্য হলেও, এদেশের চীনের খাদ‍্যাভাস এর সাথে আমাদের ভারতীয় দের, বিশেষত বাঙ্গালীদের অনেকটাই মিল রয়েছে। মাছে ভাতে বাঙ্গালি র জীবন, চীনারা পাতে ভাতের পরিমান কমিয়ে দিলেও মাছের ঝোল ভাত ওদের অন‍্যতম খাদ‍্যের একটি। খালগুলোর দৌলতে প্রচুর পরিমাণ মাছ চাষ তাদের হয়, বাজারে বড় বড় ড্রামে জল খেলিয়ে বড় বড় জ‍্যান্ত মাছ বিক্রি হয়। তবে মাছ ভাজা খেলেও ,ওদের তেল মসলা কমে রান্না শুক্ত মাছের ঝোল, স্বাস্থের জন‍্য ভালো হলেও, আমার মনের স্বাস্থ্য মোটেই খুশি ,হতো না। হোটেলে মাছ ভাত 15 টাকার মধ‍্যেই।

 

২) শাক সব্জির প্রমান সাইজের, চাষ ও প্রচুর, ভাত কিম্বা চাউমিনের সাথে ওনারা রান্না করা সব্জি খানও প্রচুর, যদিও একদিন এক বাজারে এগরোলের আদলে রুটির মধ‍্যে সেলাডের আকারে কাচা শাক গলধকরন করতে হবে আমার খুবই কষ্ট হয়েছিল। সব্জি ভাত বা চাউ এর দাম 10-12টাকার মধ‍্যে। 


৩) মাংস জাতীয় খাবার বলতে চিকেনের ব‍্যবহারই সর্বাধিক। চিকেন ফ্রাই, তন্দুরি, চিকেন কারিই ওনারা বেশি খান, আমিও ওটাই বেশি খেতাম। তবে বাজার কিম্বা দোকানে পক, বিফ, ভেড়ার মাংস ও রয়েছে। চিকেন বা মটন জাতীয় খাবারের দাম 15-16 টাকা। ওদের এক বাটি খাবার মানে আমাদের দুজনের খাবার। খাবার পর ফল খাওয়া টা ওদের খাবারের একটি অংশ। তবে বাংলার মোটা মুড়ি পেয়েছি একটি গ্রাম‍্য বাজারে, কিন্তু আমার প্রিয় খাবার মিষ্টি কোথাও পাইনি।


প্রতিটি রান্নাই স্বাস্থ সম্মত, প্রতিটি দেশের মত এদেশেও পাতে নুনের ব‍্যবহার নেই। এই জন‍্য আমার একটু অসুবিধাই হতো। সব সময় তারা হাড়ি গরম খাবার খান। অনেক রেষ্টুরেন্টে খাবার টেবিলেই আমাদের বুফেতে খাবার গরমের মত ব‍্যবস্থা রয়েছে। ওদের অনেক রেষ্টুরেন্টই এতটা জাকজমক, যে আমি অনেক সময়তেই ঢুকতে ইতস্তত করতাম।
কাজেই তাদের বিরুদ্ধে ইদুর বাদুর খাবার গল্প ঠিক নয়, এরকম খাবার বা বাজার আমি কোথাও দেখিনি। তবে মুরগির পা বেশন দিয়ে সুস্বাদু করে ভেজে কড়মড় করে চিবিয়ে খেতে দেখেছি। উচ্চ-মধ‍্য- নিন্মবিত্ত সবাই সেটা খায়। সাপের স‍্যুপ বরং ভিয়েতনামে আমি দেখেছি, কিন্তু এখানে নজরে পরেনি। খাবারের বিষয়ে আমি একটু খুতখুতেই, খাবারের অর্ডার দেবার আগে খুজে খুঁজে দেখে নিতাম কি আছে, কি দাম, সেরকম কিছু অস্বাভাবিক থাকলে নজরে পরতো।


চীন সাইকেলে (৪০) :- গনতন্ত্র আদৌ আছে কি :- 104নং আর পিছু ছাড়েনা। ঘুরে ফিরে সেই রাস্তাতেই এসে হোটেল উঠলাম। স্নান টান সেরে আগে কিছু হালকা খাবারের খোজে বেরোলাম। পাশেই পেট্রোলপাম্প, মাঝারি সাইজের দোকান, বসে আছে বছর ২৬এর ছেলে, নাম লিউ চি, বিবাহিত। পরিবারের একাই উপার্জনশীল। পাচজনের পরিবার , বেতন হাজার পাচেক। বললাম, এই বেতনে সংসারের খরচ সামলাও কিভাবে ? বললো, বাড়িতে একটি পারিবারিক ব‍্যবসা রয়েছে, চলে যায়। বললাম, বাইরে থেকে বহুজাতিক সংস্থা আসছে, মল বানাচ্ছে, অসুবিধা হবে না ? একই জবাব, সেই দোকান দারের মতো, "না আমাদের অর্থনীতির ভিত অনেকটাই শক্ত। তা ছাড়া আমরা অন‍্যদেশে ব‍্যবসার জন‍্য যাবো, এদেশে যদি আমরা জায়গা না দিই তারাইবা ছাড়বে কেনো ? ঠিক কথা, এর কোন প্রত‍্যুত্তর চলেনা। বললাম, তোমাদের বেতন তো বুঝলাম, কোন ম‍্যাডিকেল ট্রিটমেন্ট বেনিফিট আছে ? উত্তর য, তা আছে, সরকার আংশিক ব‍্যয়ভার বহন করে। বললাম বাইরে একটা কথা বহুল প্রচারিত, এখানে গনতন্ত্র নেই , তুমিও কি তাই বলো ?ভোট হয় তোমাদের ? ভোট দাও তোমরা ? গ্রামে কি ভিলেজ কমিটি ব কমিউন আছে ? ইলেকশন হয় তার ? বললো "হ‍্যা হয়, তবে আমি গ্রামে থাকিনা বটে, কিন্তু গ্রামে যেমন ইলেকশন হয় তেমনি শহরেও পাচ বছর অন্তর ভোট হয়। আমি সব ভোটেই অংশ নিয়েছি। আর মত প্রকাশ ? পূর্ন স্বাধীনতা রয়েছে আমাদের। জাপান , কোরিয়া কিম্বা অন‍্য অনেক দেশেই দেখেছি, ওর বয়সী ছেলেদের কিম্বা মেয়েরা দেশের কোন খবরই রাখেনা। সেই তুলনায় এদেশের ছেলে মেয়েরা কিন্তু দেশের অনেক বিষয় নিয়েই ওয়াকিবহাল। ভালো লাগলো সাধারণ এক দোকানের সেলস বয় হয়েও দেশের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত দেওয়ায়। ওকে ধন‍্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেবো ভাবছি, ও রাত্রিকালীন শুভেচ্ছা জানিয়ে হাতে এক জলের বোতল, হেলথ ড্রিংকস ও সকালের টিফিন ধরিয়ে দিলো।

চীন সাইকেলে (৪১) :- সকাল হতে লেখালেখির কাজ সেরে বেড়িয়ে পরলাম। কাল অনেকটাই পিছিয়ে ছিলাম, ত্রিয়ানজিন এখনো 47কিমি, বেজিং আরো 130কিমি। দুদিনে পৌছানো চাপ হয়ে যাবে। একটু পা চালিয়েই চলতে হবে। এদিকে কাল রাতে গ্রামের পথ দিয়ে এলেও ঐ অন্ধকারে ছবি তোলার সুযোগ ছিল না। আজ তাই গ্রামের পথ ধরেই এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলাম। দশ।কিমি পথ এগিয়ে 104কে বিদায় জানিয়ে গ্রাম‍্য পথ ধরলাম। আরো কিছুটা এগোতে নজরে এলো পথের পাড়ে একদল লোক, নালার জলের গতি রুদ্ধ যাতে না হয়, তাই ফাইবার বোটে চেপে নালায় শ‍্যাওলা পরিস্কার করে চলেছে। সুপারভাইজার গোছের একজন লোক পাড়ে দাড়ি তদারকি করছে ? বললাম, আপনারা কি সরকারি স্টাফ ? জবাব দিলেন, হ‍্যা , পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার দায় আমাদের, তাই নালা পরিস্কার করাচ্ছি। জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি সুপার ভাইজার ? বললেন, না। আমি ওদের মধ‍্যে সিনিয়র, তাই কাজ পরিচালনার দায়িত্ব ও আমার। বললাম বেতন, উত্তর এলো দিন প্রতি একশ টাকার মত(ভারতীয় টাকায় এগারোশ। বাড়িতে কি অসুবিধা আছে ? এখনো এই বয়সে কাজ করছেন ? বললো না না, অসুবিধা নেই।ছেলে তোমার মত হাইস্কুলের টীচার। বেতন ছয় থেকে সাতহাজার। কাজ করি সুস্থ থাকার জন‍্য। বললাম গ্রাম আর আপনাদের গ্রামীণ জীবন দেখতে বেড়িয়েছি। আচ্ছা গ্রাম কমিটি বা কমিউন আছে আপনাদের ? নির্বাচন হয় ? বললেন হ‍্যা, পাচঁ অন্তর নির্বাচন হয়। সবাই কমিউনিষ্ট ক‍্যান্ডিডেট, তার মধ‍্যে থেকেই প্রার্থী বেছে নিই আমরা। বললাম শেষ প্রশ্ন, সবাই সুখী আপনারা? বললেন, "অবশ‍্যই"। সবাইকে জল থেকে তোলা সম্ভব নয়, যারা ওপরে কাজ করছিলেন, তাদের সাথেই ছবি তুলে কয়েক পা এগিয়েছি হটাৎ ই ডাইনে চাষের মাঠে ভটভট আওয়াজ শুনে চোখ তুলে তাকালাম। বিরাটের দুই, যন্ত্র দানব, বড় বড় চাকা লাগিয়ে মাঠে নেমে ফসল কাটায় ব‍্যস্ত। হা করে গোগ্রাসে গিলে তার পর সেই ফসল উগড়ে দিচ্ছে মাঠের পাশে রাখা কৃষকের গাড়িতে। বাস্তবে চীনের কৃষিতে মানুষের কায়িক শ্রমের নির্ভরতা সামান‍্যে নামিয়ে যন্ত্রনির্ভর সমাজে পরিনত হয়েছে। চীনের মত একটি জনবহুল দেশে একাজ বড় কঠিন, কিন্তু তা সম্ভব হয়েছে সকলের কাজের সংস্থানকে তারা সম্ভব করে তুলতে পেরেছে বলেই। আমাদের বিপুল বেকারত্বের দেশে কিন্তু এটা একেবারেই বেমানান। মানুষের উন্নতিই বড় কথা। চীন সেটা করতে পেরেছে বলেই তারা উন্নয়নের পরের ধাপে চলছে। তবে যন্ত্রের এই বিপুল ব‍্যবহারের ছাপ কিন্তু পড়েছে ওদের দেহে। বিপুল খাওয়া দাওয়া আর কম পরিশ্রম ওদের দেহে মেদ ডেকে এনেছে। জাপানের তুলনায় এদেশে শরীর চর্চার বহরও কম। এই নতুন কৃষক বন্ধুদের সাথে আলাপ হতেই তারখ কিন্তু উদ্বেগ প্রকাশ করলো আমার গরম জামা পড়া নেই বলছ। বুঝলাম ওদের মানবিকতা বোধ যথেষ্ট। কিছুটা এগোতে আরো প্রমাণ পেলাম তার।

চীন সাইকেলে :- ( ৪২) কিছুটা গিয়েই পথ গিয়েছে বাম মুখী। চলতে চলতে এগিয়ে এলো গ্রাম। ঢুকে পরলাম তার জীবনটাকে উপলব্দি র তরে। ৫০-৬০ঘরের গ্রাম, এখানে বাড়িগুলো একেক জায়গায় তার কৃষ্টিতে ভর দিয়ে একেক ধরনের বাড়ি ঘর, এখানেও তার ব‍্যাতিক্রম নেই। বেশিরভাগ ভাগ বাড়িতেই ঢালাই করা টালির ছাচের চাল বা ছাদ। ঘ‍রের গা বেয়ে উঠে গেছে গৃহস্থের বাড়ির গাছপালা। কোথাও বা সব্জির চাষ। বাড়ির গায়ে ল‍্যাম্পপোষ্টে সৌরবাতি। গ্রামের প্রায় ঘরের সামনে ল‍্যাম্পপোষ্টে রয়েছে একটি করে মাইক, তাতে কোন বক্তব‍্য বা প্রচার চলছে চীনা ভাষায়। বিন্দুমাত্র বুঝে উঠতে পারলাম না। খুব বেশি মানুষ দেখছি না গ্রামটিতে। এখন প্রায় দুপুর সম্ভবত বেশিরভাগই চাষের মাঠে কিম্বা কাজে কম্মে। নবাগতকে দেখে কুকুরের সম্ভাষন হাকডাকে, গাঁয়ের বেশি ভেতরে যাবার সাহস হলোনা কিন্তু মাইক বাজছে কেনো কোন পার্বন না অন‍্য কিছু ? কৌতুহলী মন মানুষ খুজে বেড়ায়। সামনে মোড় ঘুড়তেই নজরে এলো আতা গাছে আকশিঁ দিয়ে আতা পাড়তে ব‍্যস্ত বৃদ্ধা মা ও তার ছেলে, পাশে আমগাছ ও রয়েছে। ডাকলাম বুড়িমাকে, জিজ্ঞেস করলাম কত ঘর আছে গ্রামে ? উত্তর দিলো তা প্রায় আশি। বললাম বেশিরভাগের জীবিকা চাষবাস ? বললো না, অন‍্য পেশাও আছে। বললাম , ঠাকুমা, মাইকে কিসের আওয়াজ ? বললেন ওটা ব্রডকাস্টিং হচ্ছে। তাও ভালো, আমি ভাবছিলাম,কোন ধর্মানুষ্ঠানের প্রচার চলছে। বুঝলাম, এদেশে সরকার নিজেদের কথা ভাবনাকে ঘরে ঘরে পৌছে দেবার বিকল্প ব‍্যবস্থা করে নিয়েছে। তাই এখোন বহুমূখী আক্রমনের মোকবিলা করে ,নিজস্ব ব‍্যবস্থাকে অক্ষুন্ন রাখতে পারছে। ইতিমধ্যে আওয়াজ পেয়ে কাজ ছেড়ে সামনের বাড়ির মাঝবয়সী মহিলাও এগিয়ে এলো। আমার আদ‍্যপ্রান্ত বিবরন দিয়ে বেজিং যাবার কথা বলতেই কিছুটা হতবাক। আমার হাতে কয়েকটা ফল ধরিয়ে দিলে ঐ মহিলা। কথা শেষ প্রান্তে, হটাৎ ই বুড়িমা কাছে এসে আমার পায়ে চাপর মেরে বললো, তোর ফুলপ‍্যান্ট নেই কেনো ? এ্যা ! এই ঠান্ডায় তোর ফুলপ‍্যান্ট নেই ? অন‍্যরা বুড়ির আদুরে ঢংএ স্নেহের চাপড় মারা দেখে হেসে ঊঠলো, আমিও না হেসে পারলাম না। বললাম, ফুল প‍্যান্ট আছে,।তবে হাফ প‍্যান্টে চালাতে সুবিধা। তবে বুড়ি মায়ের ঐ উদ্বেগ আর ভালোবাসায় মন ভরে গেলো।
গ্রাম ছাড়িয়ে আবার এগিয়ে চলা। দুপুর ছাড়িয়ে বিকেল নাগাদ পৌছালাম ত্রিয়ানজিন শহরে । বিরাট শহর, বেজিং এর বাইরে এটাই বোধ হয় বড় শহর , একই সাথে বড় ট‍্যুরিষ্ট প্লেস ও বটে। অনেকক্ষণ আগেই শহর শুরু হয়ে গেছে। বড় বড় চওড়া রাস্তা , আধুনিক সুসজ্জিত অট‍্যালিকা ছড়িয়ে রয়েছে শহরময়। বিকেলের দিকে খিদেও পেয়েছে, মোবাইল এর চার্জও দেহ রাখবে রাখবে করছে। অগত‍্যা কে এফ সির এক দোকান দেখে সটান ঢুকে পরলাম। অল্প বয়স্ক কয়েকজনের মেয়ে চালাচ্ছে, তাদেরই একজনকে চার্জের কথা বলতেই শুনিয়ে দিলো পয়সা‍ লাগবে। বললাম ঠিক আছে, কিন্তু মজার ব‍্যাপার হলো, চার্জ হতে হতে আমার উষ্ঞায়ন রোধে এনভায়রনমেন্টাল এমারজেন্সি জারি কর ও সম্প্রীতির পৃথিবী গড়ার আবেদন নিয়ে ভারত থেকে আসছি শুনে ও আর পয়সাই নিতে রাজি হলনা।

 


চীন সাইকেলে (৪৩) :- ত্রিয়ানজিন শহরে ঢুকে ফোনে চার্জ দিয়ে যখন বেরোলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। ইতিহাস বিজরিত কিছু বিখ‍্যাত জায়গা রয়ে গেছে কয়েক কিমি দুরত্বে। যতটা পারি ছুয়ে আসি, নিয়ে আসি যতটা পারি, এই মনোভাব থেকে বেড়িয়ে পরলাম। বাইডুর জি.পি স যখন শহরতলী ছাড়িয়ে, শহরের প্রানকেন্দ্রের হাওড়া ব্রিজের আদলে, এক ব্রিজের ওপর হাজির করলো তখন আমি বিস্ময়ে হতবাক। নদীকে ঘিরে পুরো শহর যেনো আলোক মালায় প্রজ্জলিত। রঙ্গের আলোয় রঙিন। কিছুটা পথ ঘুরে এসে দাড়ালাম মূল কেন্দ্রে। সামনেই ওদের প্রশাসনিক ভবন, আইনসভা আর তাকে ঘিরেই বলয়বৃত্তে একাধারে সব প্রশাসনিক ভবন আর নদীর অপর পাড়ে গা থেকেই উঠে গেছে চোখ ধাধাঁনো হোটেল, পর্যটন তীর্থই বটে ! ভর সন্ধ্যা থেকে রাত যত গড়ায়, এই আলোক মালায় নিজেকে রাঙিয়ে নিতে, ভীড় ততই বাড়ে। চারিদিকের ছবি তুলে, মানুষের রকম সকম দেখতে দেখতে কখন সাড়ে আটটা বেজে গেছে খেয়াল করিনি। হটাৎ খেয়াল হতেই আবার শহরতলির দিকে রওনা হলাম,রাতের আস্তানা খুজে বার করতে হবে যে। 


শহরে এসেও মুসকিল, নামী শহর , তাই হোটেলও দামী। কম দামি ডর্মেটরি হোটেল গুলো বিদেশী দের জন‍্য নয়, তাদের জন‍্য আরো সাজানো গোছানো আরো দামী হোটেল। আমি যে দামী মানুষ নই, তাদের বোঝাতে পারলেও তাদের আইন , সরকারি নির্দেশনামাকে বোঝাই কি করে! একের পর এক হোটেল ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, সবারই এক কথা। পাশেই বিদেশীদের থাকার হোটেলও রয়েছে, কিন্তু কোনটাই ওদের দের'শ- দুশ'মানে আমাদের দেড়-দুহাজার টাকার নিচে রাজি নয়। পথে ঘাটে থাকা মানুষ আমি, এত টাকায় থাকলে চলবে কি করে ? রাত সাড়ে নটা, ততক্ষনে বুঝে গেছি, আর অপেক্ষা নয়,এই শহরের প্রান কেন্দ্র ছেড়ে বেড়িয়ে পড়তে হবে। বাইডু (ওদের গুগল) আমায় জানান দিলো, তিন কিমির মধ‍্যেই কমের হোটেল পাওয়া যেতে পারে, সেই অনুযায়ী এগিয়ে গিয়েও শেষ রক্ষা হলোনা। যেতে যেতে ফোন আমার, চার্জ হারিয়ে দেহ রাখলো। কোন পথে এগিয়ে হোটেলের হদিশ পাবো তাও বুঝে উঠতে পারছিনা।
অফিস কাচারি অনেক আগেই বন্ধ হয়েছে। এবার রাতের খাবার হোটেল গুলোতেও মানুষ পাট চুকিয়ে বাড়ি ফিরছে। কি করবো ভাবছি ! সামনে একটি বড় আকার সপিংমল দেখে তার সামনে দাড়ালাম। হটাৎ কি মনে হলো, সিকিউরিটি গার্ড ভদ্রলোক কে জিজ্ঞেস করলাম, ধারে কাছে কোন হোটেল আছে ? বললো কেনো নয়, সামনেই তো ওয়েষ্টার্ন হোটেল রয়েছে। বললাম, ওরে বাবা ! ওতো গলা কাটবে ? আমার কাছে অত পয়সা নেই, তুমি কম পয়সায় কিছু থাকলে বলো। এক ঝলক কি ভেবে নিয়ে বললো, তুমি ভেতরে আসো,বাইরে খুব ঠান্ডা। সত‍্যিই তাই, নদীর কাছাকাছি বলে পনপন হাওয়ায় দাড়ানো যাচ্ছিল না। ছোট্ট কাঠের গুমটি ঘর। ভেতরে ঢুকে স্বস্তি পেলাম। ভদ্রলোক আমার হাতে জলের বোতল, সাথে এই রাত দুপুরে আপেল আর কমলালেবু খাবার জন‍্য ধরিয়ে দিলো। আপেল মুখে দিতেই উনি বললেন, তুমি একটু বসো, আমি আসছি। আপেল শেষ , উনিও এসে হাজির, বললো, চলো আমার সাথে। কোথায় যাবো জানিনা, কিছু একটা হবে আশায়,ফোনটা ওনার ওখানে চার্জে দিয়ে, ওনার পিছু নিলাম।

 
মলের গেটে ঢোকার আগে বললেন, সাইকেলটা নিয়েই চলো। একতলায় সিড়ির গোড়ায় সাইকেল রেখে চলমান লিফ্টে ওনার পিছু পিছু তিনতলায় উঠে এলাম। ঘড়ির কাটা এগারোটার পথে, দোকান গুলোতেও তালা পড়েছে। খদ্দের নেই বটে, কিন্তু তাদের বিশ্রামের জন‍্য বসার সোফাগুলোতো আছে। এরকমই একটা সোফা দেখিয়ে বললো নাও এইখানে শুয়ে পড়ো তুমি। মন্দ নয়, বাইরে ঠান্ডায় কোথাও রাত কাটানোর চেয়ে ভালো। বললাম, থাকবো যে কেউ কিছু বলবেনা ? বললো ,না না, আমি বাকি গার্ডদের বলে দিয়েছি। ধন‍্যবাদ জানাতে উনি হাসিমুখে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলেন‌। 
আমিও হাত মুখ ধুয়ে হালকা খাবার খেয়ে,সোফায় বসে লেখার কাজে হাত দিলাম। রাত বারোটা, তখনও দুচারটে দোকান ও এক দুটো বার খোলা,হয়তো সারা রাতই খোলা থাকবে। না,তবে তাতে নাচা গানা হৈ হুল্লোড় নেই। এক ভদ্রলোকের নেশাটা বোধহয় বেশিই হয়ে গিয়েছিল, বারে কর্মরত মহিলা তাকে ধমক দিয়ে নিচে নামিয়ে গাড়িতে তুলে দিলেন। সাত পাচ ভাবতে ভাবতে শুয়ে পরলাম বটে, কিন্তু ঠান্ডায় ঘুম আসছিল না। আলসেমি করে স্লিপিং ব‍্যাগটাও বার করিনি। বেশ ঠান্ডা, কাত হয়ে কুকড়েই শুয়েছিলাম, কতক্ষন ছিলাম জানি না, রাত দেড়টা কি দুটো হবে। হটাৎ ডান হাতের ওপর দিকে আলতো এক হাতের ছোয়া। ব‍্যাগগুলো পাশেই বয়েছে, কি জানি কেউ ব‍্যাগ নিয়ে চলছে নাতো ? আলতো করে চাদরটা মুখ থেকে সরিয়ে হতবাক আমি ! বছ‍র ষাটের সৌম‍্য দর্শন রোগা ছিপছিপে সুন্দরী ভদ্রমহিলা, এই শীতে তার গায়ের কোটটি খুলে আমার গায়ে চাপিয়ে দিচ্ছে ! আ হাহা ! দেখেই আমার মন অভিভুত হয়ে গেলো।
এও তো পৃথিবী! এক অচেনা অজানা মানুষের জন‍্য এই গভীর রাতে এমন দরদ ! মানবিকতার কোন স্তরে পৌছালে, এমন দরদীয়া মন পাওয়া যায়। ধন‍্য চীন ও তার বিপ্লব, অন‍্য বস্ত্র বাসস্থানের ব‍্যবস্থাই শুধু নয় ,একটি মানবিক দেশও যে তারা গড়ে তুলতে পেরেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। জানি, বর্তমানের বিদ্ধেষময় প্রচারের যুগে আমার এই অভিজ্ঞতাকে অনেকেই নিতে পারবেননা, কিন্তু সত‍্য যা তা সত‍্যই। কারো গ্রহন করতে পারা না পারার জন‍্য তা পাল্টে যেতে পারেনা। চীন এখন অনেকটাই উদার, এখানে আসাও অনেক সহজ। আশা করি অদুর ভবিষ্যতে চীনে এলে আপনাদেরও একই অভিজ্ঞতা হবে।


চীন সাইকেলে :- (৪৪) ত্রিয়ানজিন শহর ছেড়ে বেড়িয়ে পরেছি। কাল রাতে ঠিক ঠাক খাওয়া হয়নি। এই সাত সকালে পথের মাঝেই ছোট্ট বাজার দেখে দাড়িয়ে গেলাম। গরম হাতে করা রুটি আর চিনি দেয়ে ছোটবেলার মত জলখাবার সারলাম। তারপর শহর ছেড়ে বেড়িয়েছি বটে কিন্তু শহর যেনো পিছু ছাড়েনা। ছাড়বে কি ? গোটা দেশেইতো আধুনিকতার ছোয়া পেয়েছে। দেশটাই ক্রমশ শহরময় হয়ে পরছে। বেলা দশটা নাগাদ হাজির হলাম শহরের উপকন্ঠে। এখানে দুটি জিনিস নজর কাড়লো। প্রথমেই বায়ে প্রায় পাচশ মিটার পথ বরাবর পার্ক, তার মাঝেই নজরে এলো এই বড় মসজিদ। আগে পথে বৌদ্ধ মন্দির, বড় গুম্ফা নজরে এসেছে, গীর্জা ও দেখেছি, মুসলিম মানুষ জন ও কিছু দেখেছি কিন্তু মসজিদ নজরে এলো এই প্রথম। প্রায় হাফ কিমি পথ ঘুরে মসজিদে এসে ঢুকলাম,বেশ স্থাপত‍্যের কিছু প্রত‍্যয়ও রয়েছে, কিন্তু কপাল মন্দ,এই সকাল দশটা সাড়ে দশটায় মসজিদে কথা বলার মত কাউকে পেলাম না। পাবার কথাও নয়। মসজিদের নোটিশ বোর্ডে বড় বড় করে দিনে চারবার প্রার্থনার সময় দেওয়া রয়েছে, তাতে ১২টার সময় থাকলে ও সাড়ে দশটায় কিছু নেই। অগত‍্যা কিছু ছবি তুলে আবার পথে নামি। কিছুটা এগোনোর পরেই বড় আকারের মুসলিম অতিথি নিবাস চোখে পড়লো ডানদিকে। সম্ভবত যারা বাইরে থেকে এই মসজিদে আসেন দেখতে, তাদের রাত্রীবাসের জন‍্যই গড়ে তোলা হয়েছে সরকারি গেষ্ট হাউসের আদলে। সরকারি সহযোগিতা আছে কিনা জানার সুযোগ পাইনি বটে, কিন্তু সরকার দ্বারা যে সুরক্ষিত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আরোকিছুটা এগোতেই ডাইনেয় নজরে এলো কাস্তে হাতুরি খচিত রক্ত পতাকা, চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির ত্রিয়ানজিন শহর কমিটির অফিস বলেই মনে হলো। পথে কিন্তু লাল পতাকায় সজ্জিত বড় বড় সরকারী অফিস একটু পরপরেই নজরে এসেছে। যদিও সেই পতাকা শুধুই তারকাখচিত, অর্থাৎ এদেশের রাষ্ট্রপতাকা। জাতীয় পতাকাতে কিন্তু কাস্তে হাতুড়ি কে স্থান না দিয়ে শুধু শান্তির প্রতীক তারাকেই স্থান দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র সকলের - এই বার্তাই বোধ হয় তারা দিতে চেয়েছে, ভিয়েতনামের মতোই। অফিসে ঢুকলাম বটে, কিন্তু কথা বলার মত কাউকে তেমন পেলাম না। সাধারণ যে দুয়েকজন ছিলেন , তারাও ইংরেজির কারনে এড়িয়ে গেলেন। এ এক সমস‍্যা, এদেশ শুধু কেনো, অষ্ট্রেলিয়া, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা বাদ দিলে বাকি দঃপূর্ব এশিয়ায় সব দেশেই প্রায় সাধারণ মানুষ ইংরেজি কে এড়িয়ে যায়। আর কমিউনিষ্ট পার্টিতে যেহেতু শ্রমজীবী মানুষই বেশি, ফলে ইংরেজিকে এড়ানোর প্রবনতাও বেশি। ভিয়েতনামেও এজিনিষ কিছুটা দেখেছি। কথা বলতে গেলে দোভাষীর ব‍্যবহার লাগে। যদিও আমি বাইডু ট্রানস্লেট কাজে লাগাতে চাইলাম, কিন্তু অপরপ্রান্ত সাড়া না দেওয়ায় ব‍্যর্থ হলাম।  যাইহোক, বেজিং এখনো একশ কিমির কিছু বেশি আর দেরি করা যাবেনা বলে আবার নিজের পথ ধরলাম। সেইদিন গোটা দুপুর প্রায় পয়ত্রিশ কিমি দীর্ঘ বনাঞ্চল পেরিয়েই আমাকে এগোতে হলো। যদিও গোটা চীনকে সবুজে মুড়ে ফেলার কাজ অনেকটাই সম্পন্ন করে ফেলেছে তারা, রাজধানী বেজিং ও তার বাইরে নয়। তাও কেন যেনো মনে হলো, এই সবুজ পরিকল্পিত বনানী বেজিং এক ধারের ফুসফুসই বটে । 


বেজিং যত এগিয়ে আসছে, পুলিশ প্রশাসনের কড়াকড়ি, পথের চেকিং ও তত বাড়ছে। শহরের আইন শৃংখলা যে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় তা মালুম হলো। গার্ড রেলিং বসিয়ে রাজপথকে ছোট করে প্রতিটি গাড়িকে চেকিং করে, তবেই ছাড়া হচ্ছে। যদিও আমাকে তারা হাসিমুখেই ছেড়েই দিতো। এমনকি সেলুট করে স্বাগতও জানাতো। আমিও প্রত‍্যুত্বরে মাথা ঝুকিয়ে নমস্কারের ভঙ্গিতে এগোতে থাকলাম।

চিন সাইকেলে :- আজ বেজিং :- আজ বেজিং (৩১শে অক্টোবর২০১৯) :- সকাল হতেই ভদ্রমহিলা কে ধন‍্যবাদ জানিয়ে বেড়িয়ে পরেছিলাম। এই বাজারে বিনা মূল‍্যে সাইক্লিষ্ট দের থাকতে দেওয়া- কজনই বা এই নীতি আকড়ে ধরে থাকতে পারে। পথে বেড়িয়ে একটু এগোতেই দেখা হয়ে গেলো সেই পুলিশ বাহিনীর সাথে যারা গতকাল আমায় পোছে দিয়েছিলেন রাতের আস্তানায়। না, ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, সবই নতুন মুখ। ছুটি হয়ে গেছে তাদের। অচেনা কিন্তু তাতে কি , আমায় দেখে মিষ্টি হাসিতে মাথা দুলিয়ে অভিনন্দন জানাতে ভুললেননা। চলতে চলতে চেনা নামের শহর দেখে বাদিকে তাকাতে মনে পড়লো, ও কাল রাত এই শহরেই থাকার কথা ছিল। এটিও একটি এয়ারপোর্ট শহর। দশটা এগারোটা টানা দু ঘন্টা এগিয়ে চলছি ডাইনে বায়ে বনাঞ্চলকে দুপাশে সরিয়ে রেখে। বেজিং এর ফুসফুসই বলা যেতে পারে। কাল।আর না এগিয়ে ভালোই করেছি। মাঝের এই দীর্ঘ পথে সেভাবে বসতি বা হোটেল চোখে পড়লোনা। রাজপথ ব‍্যাপি ওভারব্রিজ, পথের মাঝবরাবর চলতে থাকা মেট্রোরেল জানান দিয়ে চলেছে, যদি রাজধানী সমাগত। দুপুরের চড়া রোদ গায়ে একটু লাগলেও সন্ধ্যার আগে শহরে ঢুকে পরার বাসনায় বিশ্রামের কথা মনে জায়গা দিলাম না। C:UsersKLICKDocumentsT.Kejjimg 1b.jpg

শহরতলীর এক গলিতে দুপুরের সামান‍্য আহার সেরেই এগোবো ভাবছি। এ স্মৃতি, এতো ঘটনা, মানুষের মস্তিষ্ক ধর্ম রাখতে পারেনা, আমার ক‍্যামেরার মেমোরি যে ফুল হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী ? এক স্বল্প বয়সী দোকানদার আমার অভাব পুরণ করে দিলেন সামান‍্য পয়সা নিয়েই। ব‍্যাক্তিগত ব‍্যবসা শুরু হয়েছে চিনে, কোথাও কোথাও একটু বেশি নেবার প্রবনতা যে কারো কারো মধ‍্যে একেবারে নেই, তাও নয়। তবে মাত্রাছাড়া কেউই নয়। এ যেনো তার থেকে একটু কমই নিলো। লম্বা ওভার ব্রিজগুলো দুপুরের রোদে আড়াল টেনে দিচ্ছে অনেকটাই। ওপরে ওভারব্রিজ বা ওভার রোড, নিচে আধঘন্টা ধরে একটা আন্ডারপাস পেড়িয়ে সাইকেল নিয়ে যখন শহরের প্রবেশ করলাম তখন বেলা তিনটে। রাজপথের প্রায় বেশিরভাগ টাই বড় বড় এসি বাস, প্রাইভেট কারের দখলে। পথের ধারে সাইকেল আর ব‍্যাটারি বাইকের পর ধরে আমরা। সূর্য হালকাভাবে হেলে পশ্চিমমুখো, রোদের ঝলমলানি থাকলেও শহরেরে বড় বড় অফিস বিল্ডিং যেনো আড়াল দিয়ে রেখেছে আমায়। আর তার যেনো শেষ নেই। আর হবে নাইবা কেনো, গোটা দুনিয়ায় রপ্তানি বানিজ্যের যাদের দখলে, তাদের রাজধানী শহরে সব সংস্থার অফিস ও যে জায়গা নিতে চাইবে তাতে আশ্চর্য কি ?

 

সাইকেলে চিন, বেজিং (২) তিয়ান মিন স্কোয়ার। দীর্ঘ দুকিমি পথের গার্ড রেলিং দিয়ে ঘেরা। ডান দিকে চওড়া ফুটপাত ধরে এগিয়ে চলেছে হাজার হাজার দর্শনার্থী। তিয়েন মান স্কোয়ার ঐতিহাসিক স্থল, প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানেই চারদিকে প্রায় বৃত্তাকারে রয়েছে মাও এর স্মৃতি বিজড়িত চিন বিপ্লবের আখ‍্যান সম্বলিত মিউজিয়াম, রয়েছে এদেশের পার্লামেন্ট, রাষ্ট্রপতি ভবন, অর্থদপ্তর, প্রতিরক্ষা ভবন বিরাটাকার শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ সব কিছু। ফলে এই স্থলের গুরুত্ব অনুযায়ী নিরাপত্তা বেষ্টনীও সর্বোচ্চ। বিশেষ করে ১৯৮৯ সালের এই প্রাঙ্গণে বিক্ষোভের ঘটনার পর সরকার এবং প্রশাসন ও এখানে সদা সতর্ক, যদিও তারপরে দীর্ঘ ত্রিশ বছরে এই ধরনের ঘটনা এখানে আর ঘটেনি, কিন্তু তা স্বত্বেও তারা সতর্কতায় এতটুকুই ফাক রাখতে রাজি নয়। তখনো জানিনা গোটা পথে পুলিশের অভিবাদন কুড়োতে কুড়োতে আসা এই অধমকেও এই সতর্কতার ফেরে পড়তে হবে।

 

ফুটপাথ জুড়ে তখন কোলকাতার দূর্গাপূজার ঠাকুর দেখার মত চলমান কিন্তু সুশৃঙ্খল জনস্রোত, আবালো বৃদ্ধ বনিতা এগিয়ে চলেছেন, মাঝে চেকিং গেট, নিরাপত্তা যন্র কাম স্ক‍্যানার সারা দেহে নজর বুলিয়ে যাবার সম্মতি দিয়ে দিচ্ছে, তারপর নিরাপত্তা কর্মীরা ঘাড় নেড়ে এগিয়ে যাবার সম্মতি দিচ্ছে। পিঠে বড় জোর একটি ন‍্যাপসেক গোছের ব‍্যাগ নিয়ে যাবার ছাড়পত্র আছে, তার বেশি কিছু নয়। সত‍্যিকথা বলতে কি কাশ্মীরে বা ভারতের অনেক জায়গাতেই এর মত বা এর চেয়ে বেশি কড়াকড়ি রয়েছে, কিন্তু এদেশে এই দীর্ঘপথে এই প্রথম এরকম কড়াকড়ি নজরে এলো।

 

যাইহোক, আমার তখন ভীড় দেখার বেশি সময় নেই। মাথায় ঘুরছে, সন্ধি হবার আগেই ভেতরে ঢুকে আমার ব‍্যানার ও পতাকা সহ ছবি তোলার কাজ শেষ করতে হবে। কারণ চিনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গাতেই আমার চিনের সাইকেল যাত্রার সমাপ্তি টানার কথা। আমার ভাবনা এগিয়ে চললেও খুব একটা পিছিয়ে নেই আমি । সাইকেল চলছে পুরো গতিতে। কোথা দিয়ে ঢুকবো বুঝতে পারছিনা, সবই তো ঘেরা। একটু এগোতেই সামনের কম বয়সী নিরাপত্তা রক্ষী আমার সাইকেলের লেখা নজর করে, ঝুকে অভিবাদন জানাতেই ভরসা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম ঢুকবো কোথা দিয়ে ? আমাকে ও ইশারায় পশ্চিম দিকের গেটে এগিয়ে যেতে বললো। ডাইনে তখন তিয়েন মানের স্মৃতি সৌধ ও মিউজিয়াম গেট। আমি আর চোখে দেখতে দেখতে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছি। এখানে আগে পিছে দুকিমি পথে কোন গাড়ির দাড়ানোর অনুমতি নেই, আমি থামি কোন ভরসায় ? দাড়িয়ে ছবি তোলার ইচ্ছাটা দমিয়ে রেখেই এগোতে হচ্ছে।

 

যাইহোক শেষ পর্যন্ত পশ্চিম গেট এলো। সাইকেল নিয়ে ওদের চেকিং গেটের এধারে রাস্তার ওপর দাড়িয়ে থাকা পুলিশ কর্মীদের জিজ্ঞাসা করলাম, আমি ভারত থেকে আসছি, সাইকেল নিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে কি ? উত্তর এলো না, সাইকেল ভেতরে যাবার অনুমতি নেই। অগত‍্যা সাইকেল থেকে নেমে ডানদিকের গলিতে পুলিশের নিরাপত্তা অফিসের সামনেই ওদের লাইনেই সাইকেল খানি দাড় করিয়ে ব‍্যাগপত্র রেখে, শুধুমাত্র ব‍্যানারখানি আর আমার পরিচয় পত্র, আবেদন পত্র একটি প্লাস্টিক ক‍্যারিবেগে নিয়ে এগিয়ে চলি। যেই না, চেকিং গেটের আগে, পুলিশের ঘেরাটোপের কাছে পৌছালাম, হটাৎ নজরে এলো এক মাঝবয়সী পুলিশ কর্মচারী তার অফিসারকে ডেকে কিছু একটা বলে আমার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন। অফিসার আমায় ঈশারায় কাছে ডাকলেন। আমি মনে মনে খুশি হলাম, ভাবলাম যাক, ওনাকে বলে আমার সাইকেল খানি ওনাদের জিম্মাতেই রেখে যাবো। ও বাবা ! অফিসার দেখি আমার নাম ধাম আদি বৃত‍্যান্ত, এখানে আসার কারণ সব কিছুই একে একে জিজ্ঞাসা শুরু করলেন। বুঝলাম ঐ পুলিশ কর্মচারী সাধারণ নয়, গোয়েন্দা বিভাগের, তিনিই অফিসারের মাথায় সন্দেহের ভুত কিছুটা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন। অফিসার আমায় হটাৎ করে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা আপনাদের ভারতে কি দূষণ নেই ? আমি বললাম হ‍্যা, আছে । পরের প্রশ্ন , তাহলে আপনি এদেশে আপনার বার্তা নিয়ে কেনো ? বললাম দেখুন, গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে আমার বার্তা নিয়ে চলেছি। আমাদের আহ্বান, উষ্ঞায়ন মুক্ত শান্তি ও সম্প্রীতির পৃথিবী গড়ো। এই তো আপনাদের চিনা ভাষাতেই লেখা, পড়ে নিন। ভালো করে সাইকেলের সামনের ও গেঞ্জিতে চিনা ভাষায় লেখা গুলো পড়লেন। ব‍্যানারখানি খানি অন‍্য এক নিরাপত্তা রক্ষীকে পড়তে দিলো বটে, কিন্তু ওটা ইংরেজিতে লেখা থাকার কারণে খুব একটা বুঝে উঠতে না পেরে ওটা আমার হাতে ফেরত দিলো। মনে মনে ভাবলাম রেহাই মিললো, কিন্তু ও বাবা মিললো আর কোথায় ? অফিসারের মনে তখন সন্দেহ দানা বেধেছে। বললো, আপনি এখানে কেনো এসেছেন ? ডেমোন্ষ্ট্রেশন প্রোগ্রাম করতে ? আপনি কি জানেন না যে এই অন‍্য দেশে গিয়ে এই ধরণের প্রোগ্রাম করা যায়না ? আমি বললাম হ‍্যা আমি জানি। ওনার আবার প্রশ্ন ? তাহলে কেনো এসেছেন ? এবার আস্তে আস্তে আমার ও মেজাজ চড়া হতে শুরু করেছে। বললাম দেখুন, গোটা পথে সর্বত্র পুলিশ আমায় সহযোগিতা করেছে আর আপনিই উল্টোসুরে কথা বলছেন। ভুল বুঝছেন, এখানে কোন প্রতিবাদ সভা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি আমার বিশ্ব পরিক্রমার চিনের অংশের অভিযান শুরু করেছি সাংহাই থেকে, বেজিং এর ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গাতেই এদেশে আমার অভিযান পর্ব শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমি এখানে ব‍্যানার সহ ছবি তুললেই আমার কর্মসূচি সমাপ্ত করবো । ব‍্যাস ! ভদ্রলোক এবার আরো উল্টো বুঝলেন, এ্যা, আপনি ছবি তুলবেন ? মিডিয়া কে খবর দিয়েছেন ? বলেই উনি শহরের নিরাপত্তা কমিশনারের অফিসে উচ্চ পদস্থ অফিসার কে ফোন করে সবটা জানিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তারপর বললেন শুনুন, আপনাকে যদি এখানে কোন কর্মসূচি করতে হয় তবে নগর কাউন্সিলের অনুমতি আনতে হবে। আপনি সেই অনুমতি নিয়ে আসুন, তবে আপনি এখানে প্রবেশের অনুমতি পাবেন । সত‍্যি সত‍্যি এবার আমরাও এবার গলা চড়লো। বললাম দেখুন আপনি অহেতুক ছোট বিষয়টিকে বড় করে তুললেন। আমি শুধুমাত্র ছবিখানি তুলেই আমার কাজ শেষ করবো। এই দেখুন জাপানে রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে আমার ছবি, কমিউনিস্ট রাষ্ট্র লাওসের রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনের ছবি, আর আপনিই শুধু এখানে আপত্তি তুলছেন। আবার এক দফায় তর্কাতর্কি, চারদিকে তখন আমাদের ঘিড়ে উৎসুক জনতার ভীড়, আমার দিকেই সবার নজর। নিজেকে যেনো খানিকটা অপমানিতই মনে হলো। ফলে বিতর্কেও তার ঝাজঁ। উনি আমায় আবার আমায় বললেন, আপনি এইভাবে বলছেন কেনো ? আপনি দেখেছেন, এখানে কেউ আপনার মত করে পুলিশের সাথে ঝগড়া করতে। আমি বললাম, আমি কোন অন‍্যায় বলছি না, অন‍্যায় করিনি যে আমি ভয় পাবো। শেষপর্যন্ত ভদ্রলোক বললেন দেখুন, আপনায় আমি যেতে দিতে পারি, কিন্তু তার আগে হোটেলে গিয়ে ড্রেস পাল্টে আসতে হবে। এই শ্লোগান লেখা গেঞ্জি পরে কোন রকম প্রদর্শনী মূলক প্রোগ্রাম আমরা এলাউ করবোনা। আমার ও তখন জেদ চেপে গেছে, বললাম , শুনুন,।এই গেঞ্জি পরেই আমি যাবো, আর যদি সে অনুমতি না দেন, আমি যাবই না। বলে রাগ দেখিয়ে বেড়িয়ে সাইকেল নিয়ে পশ্চিম পথে পাড়ি জমালাম।

চিন সাইকেলে :- বেজিং (৩) :- আগেই শুনেছিলাম ইউথ হোষ্টেলটা এই পশ্চিম পথেই আছে। রাগ করেতো চলতে শুরু করলাম, কিন্তু থামবো কোথায় ? খিদেও পেয়েছে। এদিকে তো সবই অফিস আর হাউসিং কমপ্লেক্স। অবশেষে একটি মিনিমলে খাবার খেয়ে প্রায় চার পাঁচ কিমি পথ ঘুরপাক খেলাম। হোটেলের ভাড়াও এখানে বড্ড বেশি। বিদেশী যাত্রীদের জন‍্য সবই প্রায় কুড়ি ডলার মানে আমাদের চোদ্দশো টাকার ওপরে। ইতিমধ্যে ফোনের চার্জ গেছে। এক হোষ্টেল চার্জ দিলো , চা খাওয়ালো, শেষে কম পয়সার আস্তানা হিসেবে ইউথ হোষ্টেলের পথ ধরিয়ে দিলো। কিন্তু কম কিছু হলোনা। প্রায় আশি ইয়েনে মানে দিন প্রতি আটশ টাকা ভাড়ায় ডর্মেটরি পাওয়া গেলো।

রাতেই পরিকল্পনা বদলে দিলাম। ঠিক করলাম, আমার চিন যাত্রার কর্মসূচি শেষ করবো চিনের ঐতিহাসিক প্রাচীরে। পরদিন খুব ভোরে বেড়িয়ে পরলাম বেজিং শহরের এই পশ্চিম প্রান্ত থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিমি দুরত্বে ঐতিহাসিক চিনের প্রাচীর। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। চাঁদ থেকে দেখা পৃথিবীর একমাত্র স্থাপত‍্যের কাঠামো। সাম্রাজ্যের সীমানাকে সুরক্ষিত করার প্রয়োজনে শান রাজাদের সময়ে পর্যায়ক্রমে তৈরী হওয়া এই প্রাচীর আজ ও পৃথিবীর অন‍্যতম আকর্ষণ বিন্দু। যদিও আমার প্রোগ্রাম, কোন ট‍্যুর প্রোগ্রাম নয়। আমার পরিকল্পনায় সে দেশের গ্রাম শহর রাজধানী , প্রধান প্রধান জনবসতি ছুয়েই আমার প্রচার যাত্রা। তার মাঝে কোন ঐতিহাসিক বা দ্রষ্টব্য স্থান থাকলে ছুয়ে যাবার চেষ্টা করি। সময়ের অভাবে অবশ‍্য অনেক কিছুই বাদ রেখে যেতে হয়। কিন্তু তার জন‍্য আমার কোন আফসোস নেই, তবে, চিনের প্রাচীরের গুরুত্ব আলাদা। আগে থেকেই তার জন‍্য একটি দিন ধরে রেখে ছিলাম। যাই হোক, দিনটা আজ মেঘ রোদের খেলায় চলছে। প্রায় দেড়হাজার কিমি দীর্ঘ এই প্রাচীরের আট থেকে দশ কিমি পর্যটকদের জন‍্য উন্মুক্ত। পর্যটকদের মধ‍্য অবশ‍্যই এদেশের মানুষরাই বেশি। প্রাচীরে আসার আগে সিকিউরিটি চেকিং টপকে, কিলোমিটার খানেক হেটে, প্রাচীরে ওঠার দুই সিড়ি পথ, দুদিকে ধাপে ধাপে পৌছেছে প্রাচীরে। ওপরে চলার পথ এপাহাড়ের ওপাহাড় বেয়ে, পথ চলে গেছে দুরের পাহাড়ে। একসাথে চারজন পাশাপাশি হাটতে পারে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আমি অবশ‍্য একাই চারপাশের অমোঘ দৃশ‍্য, প্রাচীরের পাশে‌ রঙিন পাতাবাহারী গাছ, যেনো রঙ মাখিয়ে দিয়েছে হিমালয়ের উত্তরের এইদেশটিতে। ঘন্টা তিনেক এপাহাড়ে ও পাহাড় টপকে, বিকেল পাচটা নাগাদ তৃপ্তির মন নিয়ে ফিরে এলাম আবার বেজিং এ।

রাগ অনেকটাই কমে এসেছে। আপন মনে ভাবছি, দেশটার যা বোঝার বোঝা হয়ে।গেছে,শুধু তিয়েনমেন স্কয়ারের জন‍্য কি আবার পয়সা খরচ করে এদেশে আসবো ? না দেখার আফশোষ রয়ে যাবে ? এই সব সাতপাচ ভাবতে ভাবতে রওনা হলাম তিয়েনমেন স্কয়ারে। আজ গেঞ্জিটা গায়ে ছিল না ঠিকই, তবে টুপি ব‍্যানার ছিল সাথেই। আজ কিন্তু কেউ ভুলেও একবার জিজ্ঞেস করলোনা এসে যে, কে আপনি ? কোথা থেকে এসেছেন ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি। চারপাশ ঘুরে ছবি তুলে ফিরে আসার সময় ভাবছি গতকাল ঐ ফচকে গোয়েন্দাই পুরো প্রোগ্রামের ছন্দ নষ্ট করে দিয়েছিলো। মানুষের সন্দেহ প্রবনতা যে অনেক সমস‍্যা সৃষ্টি করে, বিশেষ করে দেশ বিদেশের সম্পর্কে, এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই প্রবনতার বাইরে বেড়োতে না পারলে সম্পর্ক জটিল হয় , স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট করে । নষ্ট করে দেশে দেশের সম্পর্ককেও।

 

সাইকেলে চিন ( বেজিং :- ৪) আজ ২রা নভেম্বর, বেজিং থেকে ঘরে মানে ভারতে ফেরার দিন। সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার, কিন্তু উপায় নেই। যাবার আগে একবার বেজিং এ অবস্থিত ভারতীয় দুতাবাসে যোগাযোগ করে , গোটা প্রোগ্রামটির একটি রিপোর্ট জমা দিয়ে যেতে হবে, সাথে দুতাবাসের কিছু ছবিও নিয়ে নিতে হবে। শহরের আরেক প্রান্তে পনেরো কিমি দূরে সেই দূতাবাস।

ভোরের রেষ্টুরেন্ট, সাত সকালেই অনেকে হাজির। এখান থেকে ব্রেকফাস্ট করেই হয়তো কাজে বেড়িয়ে পরবে। আমি ও চা খেয়েই আর দেরি না করেই গন্তব্যে রওনা দিলাম। বড় রাজপথ ধরে সাপের মত একে বেকে এপথ ওপথ করতে করতে বাইডু ম‍্যাপ আমায় পৌছে দিলো বিদেশি দুতাবাস পাড়ায়। আমেরিকা ইংল্যান্ড ফ্রান্স পাকিস্তান কে নেই সেখানে। আসলে তাই হয় , নিরাপত্তার একই বেষ্টনী তে রাখবার সুবিধার্থে যতটা সম্ভব এক জায়গাতেই রাখা হয় দূতাবাস গুলোকে। কিন্তু কপাল মন্দ, খেয়াল ছিলোনা, আজ রবিবার, ভারতীয় দুতাবাস বন্ধ। এ এক সমস্যা বটে, বেশ কিছু দেশে এই একই ফেরে পরতে হলো। সময়ের অভাব হেতু অতিরিক্ত একটা দিন যে দূতাবাসে দেখা করার জন‍্য থেকে যাবো, তাও সম্ভব নয়। ফেরার টিকিট তো আজকেরই। যাইহোক চীনা সিকিউরিটি স্টাফটি ভেতরে গিয়ে একজন ভারতীয় অফিসার কে ডেকে নিয়ে এলেন। সম্ভবত , দিল্লি কিম্বা হরিয়ানার মানুষ। খুশিই হলেন আমাকে দেখে,উৎসাহ নিয়ে আমার কর্মসূচী জানতে চাইলেন। শেষে বললেন আজ রবিবার, আপনাকে ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানাতে পারছিনা। তবে আপনার চিঠিখানা আমি অফিসে কাল দিয়ে দেবো। ভদ্রলোক কে ধন‍্যবাদ জানিয়ে আবার ঐপথেই হোষ্টেলে ফিরে এলাম। 

সময় কম, আজই ফিরতে হবে, তার আগে দোকান খুঁজে সাইকেল খানি প‍্যাকিং করা কম চাপের নয়। দ্রুত স্নান খাওয়া সেরে ব‍্যাগপত্র গুছিয়ে রওনা হলাম‌। ঝিরঝিরে বৃষ্টি, তার মাঝেই দোকান খুজেঁ চলেছি এমাথা ওমাথায়। আজ রবিবার, তাই দোকান ও বেশিরভাগ বন্ধ। শেষে এক জোমাটো যুবকের সহায়তায় কোম্পানির নিজস্ব দোকানেই পৌছালাম। অল্পবয়স্ক সেলসম্যান, কিন্তু চৌকস, সার্ভিস চার্জটা একটু বেশিই নিলো, কিন্তু শেষপর্যন্ত প‍্যাকিংটা সম্পুর্ন করে দিলো। তারপর হাতে সময় আছে দেখে, শহর ঘুরে তিয়েন মেন স্কয়ারে আরেকবার চক্কর মেরে, সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলাম ওর দোকানে। গাড়িখানি ওই বুক করে দিলো। তাতে চেপে সময়ের একটু আগের পৌছালাম বেজিং এয়ারপোর্টে। 

বিশালাকার ঝকঝকে এয়ারপোর্ট, অসংখ্য বিমান সারি সারি দাড়িয়ে। বেশিরভাগই এয়ার চায়না সরকারের নিজস্ব, অন‍্যদেশের কিছু আছে। সময় কাটাতে এপাশ ওপাশ ঘুরছি হটাৎ নজরে এলো একটি এয়ারলাইন্সের এয়ারস্টাফরা ফ্লাইটে ওঠার আগে, মিলিটারি কায়দায় সারিবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে, চিফ কমান্ডারের নির্দেশের অপেক্ষায়। খানিকটা শরীর চর্চা করে কাজের শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিচ্ছেন। এ আমি অন‍্যদেশে দেখিনি। ভালো লাগলো এই শৃংখলাবোধ , এটাই বোধ হয় ওদের এগিয়ে যাবার বড় মন্ত্র। জাপান আর চিনের কাছ থেকে শৃংখলার পাঠ বোধ হয় সব জাতিকেই নেওয়া উচিৎ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সাইকেলে চীন ( মূল‍্যায়ন (১) : - 

কেমন দেখলাম দেশটা ? কেমন আছে সে দেশের মানুষ :-

শ্রীলঙ্কা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট, ছাড়লো সঠিক সময়েই। ধীরে ধীরে চিনের মাটি ছাড়িয়ে মাথা উচুঁ করে আকাশ ছুলো। বিদায় চীন,ভবিষ্যতে আর আসা হবে কিনা জানিনা, তবে চীনের এই তাক লাগানো দুরন্ত অগ্রগতি আর সেদেশের সমাজের বিপুলায়তন রুপান্তর, ভাবনার জগতে নতুন রসদ যোগাবে অনেককাল। প্রথমেই বলি, কেমন দেখলাম চীন, সবই কি ঠিক ঠাক চলছে এখানে ? মানুষের জীবনের অগ্রগতি ঘটলো কতটা ? সমাজেরবা অগ্রগতি কতটা ? অগ্রগতির যে পথ তা কতটা সমর্থন যোগ্য ? চীনের আগামী ভবিষ্যৎ কোন পথে ? 

 

আগেই বলেছি, চীন বিপ্লবের পথম দুদশকের অগ্রগতি বেশ কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিল সেদেশের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়। বিশৃংখলার এই পর্বে উৎপাদন, অগ্রগতি থমকে গিয়েছিল। মাও এর মৃত্যুর পর নতুন পথে যাত্রা শুরু করে নতুন চীন সরকার। কৃষি শিল্প কাজ শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিবেশ সর্বক্ষেত্রে যেনো বিপুল বেগে ছুটে চলেছে এই দেশ। ব‍্যাক্তিগত উদ‍্যোগ, ও ব‍্যবসা তার এগিয়ে চলার পথে, পালে বাতাস দিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, করপোরেটরাও জায়গা করে নিতে চাইছে, একশ চল্লিশ কোটির মার্কেট তাদের ও টেনে এনেছে এদেশে, কিন্তু তাই বলে খামতি কী নেই এদেশে ? নেই ফাক, নেই কোন প্রশ্ন ? নিশ্চয়ই আছে। 

যদিও আমি রাজনৈতিক বা অর্থনীতির কোন বিশেষজ্ঞ নই, সে যোগ‍্যতাও আমার নেই‌। এই বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। সাদা চোখে যে বিষয়গুলো নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে বলে মনে হয়, সেগুলো হলো :--

১) এতটা এগিয়েছে দেশটা উৎপাদন এর জগতে, তাও যেনো এখানকার মানুষের, শ্রমজীবীদের বেতন তুলনায় কম। জিনিসের দাম কম থাকায় তাদের জীবন চলে যায় ঠিকই, হয়তো কিছু সঞ্চয় ও হয়, তাও কি ওদের বেতন আরো বাড়ানো যায়না ? ছয় থেকে দশহাজার মানে ভারতীয় অর্থে ষাট হাজার থেকে একলাখ, ওদের গড় বেতন, বাড়ির প্রায় সবাই কাজ করে, তাই অভাব হয়তো নেই। তবুও আরেকটু বেশি দিতে অসুবিধা কোথায় ? রাষ্ট্রটা যখন শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র। 

২) গ্রামগুলোতে এলাকা ভিত্তিতে নিজস্ব মডেলে বাড়ি, ঠিকই আছে, কিন্তু এখনো কিছু বাড়ি ছাদ ঢালা নয়। সিমেন্টের টালি। সরকারি খরচে ছাদ দিয়ে দেওয়া হবেনা কেনো ? 

৩) দারিদ্র সীমার নীচে এখনো এক কোটি মানুষ, যদিও তাদের আয় মাসিক তিনহাজার মানে আমাদের ত্রিশ হাজার বা তার নিচে। এই মানুষ দের অবস্থা অগ্রগতি তে আরো গতি দরকার। 

৪) স্বাস্থ্য ব‍্যবস্থায় কমিউনিটি হসপিটালে সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষ রা নিঃখরচায় চিকিৎসার সুযোগ পায় ঠিকই কিন্তু শহরের বড় হসপিটাল গুলোতে বড়মাপের অসুখে ব‍্যাক্তিগত খরচের ব‍্যয়ভার পয়ত্রিশ ভাগ, বাকিটা সরকার দেয়। এটা আরো কমানো যায়না কি ? 

৫) পরিবেশে বিশেষত গাছ লাগানোর কর্মসূচিতে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলছে তারা, কিন্তু পাশাপাশি প্লাস্টিক এর এই বিপুল ব‍্যবহার বড্ড চোখে লাগে। এটা কমানো যায়না কি ? যদিও রিসাইক্লিং প্লাস্টিক, সঙ্গে সঙ্গে করপোরেশনের লোকেরা পরিস্কার করে দেয়, তবুও পথে ঘাটে যখন তখন সাধারণ মানুষের প্লাস্টিক ফেলে দেবার প্রবনতা রয়েছে যথেষ্ঠ, এটা বন্ধ হওয়া উচিৎ। 

৬) জাপানের কে পেছনে ফেলে চিন এখন অনেকটাই এগিয়ে, কিন্তু শৃংখলায় জাপান এখনো সেরা। 

৭) বর্তমানে সর্বক্ষেত্রে যান্ত্রিক নির্ভরতায় চলে গেছে চিন, সাইকেলের বদল দুতিন চার চাকা, হাটা হয় খুব কম।ছাপ পড়ছে তার চেহারায়। ভোজনের আয়তন ও অনেকটাই, ফলে চেহারায় স্থুলতা বেড়ে গেছে অনেকটাই। সেই তুলনায় শরীর চর্চা কম। মহিলারা সাধারণত সন্ধ‍্যায় মলে পার্কে নাচের তালে সেই কাজ সারে, কিন্তু বয়স্ক পুরুষ দের অংশগ্রহণ কম। 

৮) পুজির আগমনের সাথে সাথে ভোগবাদী সমাজের কিছু রোগ ও এই সমাজে ছোট আকারে হলেও জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষ করে সাংহাইতে তা নজর এড়ায়না‌।

সাইকেলে চীন ( মূল‍্যায়ন -২) :-

তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তার চিরায়ত মার্কসীয় ভাবনা থেকে কিছুটা ভিন্ন পথে হাটা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ মানে ব‍্যাক্তি মালিকানার অবসান। উৎপাদন ব‍্যবস্থায় সামাজিক অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় মালিকানা। যদিও এদেশে মূল ও প্রধান প্রধান শিল্পগুলোএখনো সরকারের হাতেই রয়েছে।উৎপাদন ব‍্যবস্থায় সরকারের আধিপত্য। পথে প্রায়ই দেখতাম সিনোপেকের পেট্রোল পাম্প। শেষে পথের ধারে চার কিমি জুড়ে ওদের এটি বড় শোধনাগারে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম এটি একটি সরকারি সংস্থা। তৈল শোধনাগার থেকে ডিস্ট্রিবিউশন, গোটা তেলক্ষেত্রের আশিভাগই সিনোপেকের দখলে। শিক্ষা স্বাস্থ্য জনগণের পরিসেবার জায়গা গুলোতেও সরকারি ব‍্যবস্থাপনা‌। কিন্তু তা সত্বেও চীনের কমিউনিষ্ট পার্টির অনুমোদনেই এখানে ব‍্যাক্তি ও গোষ্ঠীগত উদ‍্যোগ প্রতিষ্ঠিত। উৎপাদন জগতে তাদের অংশীদারিত্ব অবহেলার বিষয় নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেনো এই ব‍্যাক্তি ও গোষ্ঠী উদ‍্যোগকে স্বীকৃতি ?

আমরা জানি, সমাজতান্ত্রিক সমাজ মানে, একজন মানুষ তার সাধ‍্য অনুযায়ী শ্রম দেবে, আর শ্রমের পরিমাণ অনুযায়ী প্রকৃত মজুরি সে পাবে, যা পাওয়া এথেকে বুর্জোয়া ব‍্যবস্থা শ্রমজীবীদের বঞ্চিত ও প্রতারিত করে থাকে। চীনের পার্টির বক্তব্য, সমাজ তান্ত্রিক সমাজের এই বিপুল মজুরি ও জীবনমানের চাহিদা মেটাতে গেলে, উৎপাদন ব‍্যবস্থা ও অর্থনীতির বিপুল অগ্রগতি র প্রয়োজন। সেই লক্ষ্য পূরণের জন‍্য , তারা ব‍্যাক্তি পুঁজি থেকে মাঝারি বা বড় উদ‍্যোগপতিদের উৎপাদন ব‍্যবস্থায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন। উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাদের প্রকৌশল, তাদের সর্বাঙ্গীন উদ‍্যোগকে কে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। কোন সন্দেহ নেই, তাদের এই বিশেষ ভাবনা, উৎপাদনের জগতে তাদের বিরাট অগ্রগতি বললে কম বলা হয়, উল্লম্ফনের সুযোগ করে দিয়েছে।

কিন্তু এই ব‍্যাক্তিগত ব‍্যবসা বা ব‍্যাক্তিগত উদ‍্যোগ নিঃসন্দেহে একটি লোভের ও জন্ম দেয়। রাত তখন আটটা,জিনান শহরে ঢোকার কিছু আগে সাইকেলটা খারাপ হলো। উপায় নেই, বাদিকে শহরতলীর শুরুতেই থাকার জায়গা খুজতেই একটি হোটেল পেলাম। পথে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ ইয়েনে ঘর পাওয়া গেলেও মহিলা মালকিন দুম করে একশ ত্রিশ ইয়েন চেয়ে বসলেন।যদিও শেষপর্যন্ত পুলিশের হস্তক্ষেপে ত্রিশ ইয়েনেই থাকতে দিলেন। আমার বুঝতে অসুবিধা হলোনা, যে, ত্রিশ চল্লিশ পঞ্চাশই দাম, মহিলা আমার কাছ থেকে একশ ইয়েন বেশিই নিতে চেয়েছেন। এটা ব‍্যাক্তিগত ব‍্যবসার অবধারিত ফলশ্রুতি। 

একজন উদ‍্যোগপতি যখন তার উদ্যোগ কে কাজে লাগাবেন, তখন তিনি চাইবেনই সেখান থেকে তার লাভকে সর্বোতভাবে ঘরে তুলতে, তা সে শ্রমিকের মজুরির বিনিময়ে হোক, কিম্বা উৎপাদিত পন‍্য অধিক মূল‍্যের বিনিময়ে হোক। শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল‍্যের তত্ব এই ক্ষেত্রে উল্টোপথে হাটতে পারেনা। নিশ্চয় তারাও এখানে একটা নিয়ম ও নিয়ন্ত্রনের মধ‍্যেই এখানে থাকেন, কিন্তু তার পরেও তাদের বৈভব বৃদ্ধি চোখ এড়ায়না। বাস্তবিক, অত‍্যন্ত দ্রুতগতিতেই কিন্তু সেদেশে মধ‍্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ হচ্ছে, এবং তারা আরো ওপরের দিকে উঠে চলেছে। গোটা চিনে এখন বিপুল পরিমানে বাইশ চব্বিশ তলা বিরাট বিরাট মাল্টিপ্লেক্স বিল্ডিং গড়ে উঠেছে ও উঠছে। শহরের ষাট শতাংশই তাই। প্রথমদিকে ভেবেছিলাম, সরকার বোধহয়, বিপুল জনসমষ্ঠির প্রয়োজন মেটাতেই এই বহুতলের দিকে হেটেছেন, কিন্তু না, চলতে চলতে বুঝেছিলাম, এই বিরাট নির্মিয়মান মাল্টিকমপ্লেক্স গুলোর দখল নিচ্ছেনা এই নব উদ‍্যোগপতিরাই। যেভাবে বড় উৎপাদন গোষ্ঠী গুলো উৎপাদন ব‍্যবস্থার সাথে জড়িয়ে গেছেন, এখন অবধি তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আগামী দিনে তারাই যে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবেনা, তার নিশ্চয়তা কিছু আছে কী ? 

বিশেষ করে বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলো, যারা চিনের সস্তার কাচামাল, এবং ১৩৯ কোটির বাজার ধরার উদ‍্যেশ‍্য সেদেশের ভেতরে জায়গা করে নিয়েছে, হয়তো বিশ্ব ব‍্যবসা ধরার উদ‍্যেশ‍্যেই চিনের সরকারও তাদের জায়গা করে দিয়েছে, কিন্তু সুযোগ পেলে তারাও সে দেশের নিয়ন্ত্রণ পেতে ছোবল যে মারবেনা, এমন গ‍্যারান্টি যে নেই, তাতো সাম্প্রতিক সময়েই কিছুটা ছাপ দেখেই মালুম হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো , যে বোঝা তারা সাথে নিয়ে চলছেই, তাই আগামী দিনে তাদের ঘাড়ে চেপে তাদেরই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ব‍্যবস্থাটাই উল্টে দিতে চাইবেনা,তার নিশ্চয়তা আছে কী ? বরং সেই সম্ভাবনাই আগামী দিনে প্রতিমুহূর্তে তাদের তাড়া করে ফিরতে পারে। চিনের কমিউনিষ্ট পার্টি অবশ্য এই সব বিষয় ভাবনায় নেই তা মোটেই নয়, বরং তারা এবিষয়ে সচেতন হয়েই এগোচ্ছেন। আগামী দিন উত্তর দেবে কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে ?

সাইকেলে চীন ( মূল‍্যায়ন -৩ ) 

চীনে গনতন্ত্রের প্রশ্নটি নিয়ে পশ্চিমী দুনিয়া শুধু নয়, বর্তমান পুজিবাদী দুনিয়ায় এটা একটা আলোচনা ও বহুল সমালোচনার ও বিষয়। জাপানের অধিবাসীদের যখন জিজ্ঞেস করতাম,চিনের সাথে তাদের বিবাদের কারণ কী ? কেনো তারা আমেরিকার সাথে চলছে ? অনেকেই উত্তর না দিতে পারলেও এক দুজন কিন্তু বলতেন, চিনের গনতন্ত্র হীনতার জন‍্য সে দেশকে তাদের পছন্দ নয়। যদিও তারা কখনোই চিনে যাননি। বুঝতে অসুবিধা হয়না, গোটা বিশ্বের মার্কিন প্রভাবিত করপোরেট গোষ্ঠী পরিচালিত প্রচার মাধ‍্যম, যে ধারনার পরিমন্ডল সযত্নে গড়ে তুলেছেন, যে পরিমন্ডল আমাদের সাদ্দাম হোসেন কে ভয়ংকর স্বৈরাচারীতে পরিগণিত করে, তার হাতে পারমানবিক বোমা রয়েছে, যখন তখন যে কারো বিরুদ্ধে ব‍্যবহৃত হতে পারে , তা আমাদের বিশ্বাস করিয়ে দেয়, সেই প্রচার মাধ‍্যমই কিন্তু চিনে ভয়ংকর অগনতান্ত্রিক ব‍্যবস্থার একটি অতিকল্পিত ধারনার জন্ম দিয়েছে। 

একথা ঠিক যে মাও এর শাসনের শেষ দিকে মাওকে ব‍্যবহার করে, চার চক্রীর শাসনে, চিনে সাধারণ মানুষের একটা অংশ এবং পার্টিতে বিপরীত ভাবনার লোকেরা বেশ ভালো সংখ‍্যায়, নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। কিন্তু মাও জীবদ্দশাতেই সেই ভুল অনুভব করেছিলেন, এবং চিনের কমিউনিস্ট পার্টি সেই সময়কালকে নিন্দাজনক অধ‍্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছে সেই আশির দশকেই। চিন বিপ্লবের আগে ও পরে মাও এর অবিস্মরণীয় অবদানের কথা যেমন তারা বিস্মৃত হতে চাননা, তেমনি এই সময়কালের কথাও তারা স্মৃতিতে রাখতে চাননা।

সেই অভিজ্ঞতা থেকেই চিনের পার্টি পরবর্তী কালে পার্টির অভ‍্যন্তরে এবং সমাজে অনেকটাই গনতন্ত্রের আবহাওয়া ফিরিয়ে এনেছেন।

১) পার্টির ভেতরের কথা আমি বলতে পারবোনা, তবে, জনগণের বাক স্বাধীনতা যে যথেষ্ট রকম রয়েছে, তারা যে তর্ক প্রবন, রাষ্ট্রীয় জীবনের ভালো মন্দ নিয়ে তারা সোচ্চার বিতর্কে অংশ নেন, এবং ভালো লেগেছে যে মহিলারাও এই বিতর্কে সমান তালে অংশ নেন, এসব দৃশ‍্য আমি পথে ঘাটে, আড্ডা খানায়,ট্রেনে বাসে প্রতিনিয়ত ই দেখেছি। সাংহাই থেকে তখন সবে সাইক্লিং শুরু করেছি। গলি পেরিয়ে একটি ছোটখাটো রাজপথে পরতেই কিছু লোকের জটলায় সাইকেল থামিয়ে দিতে হলো। সাইকেল থেকে নেমে একটু উকি দিয়ে তেই দেখি সামনের বড় মাপের হেলথ কমিউনিটি সেন্টার, তার সামনে বসে বেশ কিছু মানুষ। সম্ভবত খুললে তারা ডাক্তার দেখাবে। সেখানে বসে থাকা দুই বুড়োর বিতর্ক এমন জায়গায় পৌছে গেছে যে প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে। বাকি সবাই তা থামানোর চেষ্টা করছে। যেনো আমাদের পাড়ার চায়ের দোকানগুলো, তবে হ‍্যা, এখানে বিতর্ক কিন্তু অনেক তথ‍্য ভিত্তিক, জ্ঞান গর্ভ। আমাদের চায়ের দোকানের গাল গল্প নয়। 

২) পথে চলতে চলতে দেখলাম বিরাটাকার হুন্ডাই কারখানার গেটে শ্রমিক নেতার বক্তব্যের পরে, যেভাবে ইউনিয়নের অপর উপস্থিত সদস‍্য তার বিরোধিতা করে পাল্টা প্রকাশ‍্যে বক্তব্য রাখতে দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে, গনসংগঠন গুলোর অভ‍্যন্তরেও যে যথেষ্ট গনতন্ত্র রয়েছে। 

৩) গ্রাম বা শহরে আমি বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছি, যে সেখানকার জনগন নির্বাচনের সমস্ত রকম অধিকার ই ভোগ করেন। প্রতি পাচ বছর অন্তর তাদের গ্রামীণ ক্ষেত্র ও শহরেরে নগর কাউন্সিলর এর ভোট হয়। নগর কাউন্সিল বা গ্রামের কমিউনগুলো নিজ নিজ অঞ্চলে অনেকটাই স্বাধিকার ভোগ করেন। অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে নিজ নিজ অঞ্চলের উন্নয়ন অগ্রগতি ও অন‍্যান‍্য কাজ তারা পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে তাদের সাংবিধানিক অধিকার তারা পূর্ণমাত্রায় ভোগ করেন। আমাদের এখানকার মত অযাচিত হস্তক্ষেপ হয়না বলেই মনে হলো।

৪) আমাদের বন্ধুরা প্রায়শই বলে থাকেন, ওখান কার নাগরিকদের কোনরকম স্বাধীনতা নেই, পারলে তাদের হাতে পায়ে শেকল দিয়ে বেধে রাখা হয় এরকম ও প্রচার। কিন্তু এটা আজকের চিন সম্পর্কে নেহাতই কষ্টকল্পিত হাস‍্যকর প্রচার। সাংহাই থেকে বেজিং আমার প্রায় ১৮০০ কিমি যাত্রাপথে জনগনের কন্ঠরোধের এরকম কোন ঘটনাই দেখিনি। থাকলে নিশ্চয় আমার প্রশ্নোত্তরের পর্বে তাদের আচরনেই প্রকাশ ঘটতো। বা কেউ না কেউ একবারের জন‍্য ও আমার কাছে কথায় কথায় অনুযোগ করতেন। বরং তারা সোৎসাহে সমস্ত বিষয়ে মত প্রকাশ করেন। 

আমাকে রাত্রীবাসের কারনে প্রায়শই থানায় যেতে হতো। কোন থানাতেই কিন্তু এক আধটা এ্যাক্সিডেন্ট কেস ছাড়া আর কোন অভিযোগ নিয়ে যেতে ও দেখিনি। থানাতেও চার পাচঁ জন পুলিশ স্টাফ ছাড়া অন‍্য কোন ধরে আনা আসামীকে লক আপে তেমন দেখিনি। থানাগুলো বেশিরভাগ ই নিশ্তব্ধ, অফিসিয়াল কাজ হয়তো করছেন, কিন্তু বিশেষ কোন হৈ চৈ নেই। আমি কোথাও কোথাও ওদের জিজ্ঞেস করেছি, "আপনাদের এখানে কি চুরি ডাকাতি কম, তেমন কোন আসামি কে দেখছি না।" তার উত্তরে তারা জানাতেন, না আমাদের এখানে সেই ঝামেলা নেই খুব একটা। তবে থানা গুলোতে একই পরিবেশ কিন্তু দেখেছি, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায়। ভিয়েতনামে তো হ‍্যানয় ছাড়া গোটা পথে পুলিশ ই তেমন চোখে পড়েনি। এখানে পুলিশ রয়েছে, তবে শহরে যান নিয়ন্ত্রণে এবং মানুষের সহায়তা ও প্রশাসনিক দেখভালেই ব‍্যস্ত। তবে বেজিং যত এগিয়ে এসেছে, ততই কিন্তু পুলিশের তৎপরতা চোখে পরেছে। তিয়েনমান স্কয়ারে অতিমাত্রায় সেই সতর্কতারই ফলশ্রুতি আমার সাথে বিবাদের ঘটনা। 

তবে এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কি সেখানে সরকার বিরোধী কোন বিক্ষোভ বা সরকার পাল্টে দেবার কোন উদ‍্যোগ সংগঠিত হতে দেবে সরকার ? এক্ষেত্রে কিন্তু চিনের পার্টি শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের ধারনাতেই অবিচল আস্থা রেখেছেন। বিশ্বের অনেক দেশের কমিউনিস্ট পার্টি, এমনকি আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো যেমন তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচিতে যেমন বহুদলীয় রাজনৈতিক ব‍্যবস্থার উপস্থিতি মেনে নিয়েছেন, চিনের পার্টি কিন্তু পুরনো ধারনাতেই রয়েছেন। শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব । ওরা বলছেন জনগণের একনায়কত্ব।

প্রশ্ন আসতে পারে, শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব কী ? সহজ কথায় বলতে গেলে, পুজিবাদী সমাজে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বা সামর্থ না থাকায়, গনতন্ত্রের পূর্ণ ও যথাযথ অধিকার সংখ‍্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোগ করতে পারেনা। মার্কসবাদীদের মতে, আসলে এই সমাজে চলে পাচ ভাগের গনতন্ত্র, ৯৫ভাগের নয়। তারা তার শোষন বঞ্চনা আর নিষ্পেষনের শিকার হয়। আর সমাজতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় সেই ৯৫ভাগ মানুষের স্বার্থে পাচ ভাগ মানুষ, পুরোনো আমলের শোষকের যারা উত্তরাধিকার, তাদের সমস্ত রকম রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তারা পুরোনো শোষণের ব্যবস্থা যাতে ফিরিয়ে আনতে না পারে, তার জন‍্যই চলে নজরদারি, চলে সেই অনুযায়ী কড়া শাসন। সেই কারণেই যেমন সরকার বিরোধী কোন আন্দোলন, যা পুরোন শোষনের ব‍্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জমি তৈরী করতে পারে, তার কোন সুযোগ তারা দিতে চাননা।

যদিও এদেশে ও অন‍্য কিছু রাজনৈতিক দল রয়েছে, যারা দেশের নতুন সংবিধান মেনে কাজ করার সম্মতি দিয়েছেন। মূলত,সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দান, কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দায়িত্ব এমনকি বিচারপতির দায়িত্ব ও পালন করে থাকেন তারা। স্থানীয় থেকে গনকংগ্রেস অল্পকিছু হলেও তাদের প্রতিনিধি ও রয়েছে। তবে সন্দেহ নেই গোটা ব‍্যবস্থায় কমিউনিষ্ট পার্টিরই একছত্র আধিপত্য রয়েছে।

নির্বাচন ব‍্যবস্থা :-

মার্কসবাদীরা মনে করে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো, সমাজের একেকটি অংশের স্বার্থের প্রতিভূ। দ্বি বা বহুদলীয় শাসনের ফাক গলে যাতে দেশে বুর্জোয়া ধনীদের স্বার্থবাহী রাজনৈতিক দলগুলোর পুনরায় শাসন ক্ষমতায় চলে আসতে না পারে, তার জন‍্য চিনের পার্টি সেদেশের বহুদলীয় নির্বাচন ব‍্যবস্থার বদলে নিজেদের ই একাধিপত্য রেখেছেন। সেদেশের নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করে তারা প্রায় সকলেই প্রায় কমিউনিস্ট ভাবনার অনুসারী। তাদেরই একাধিক প্রার্থী ভোটে দাড়ায়। জনগণ তাদের মধ‍্যে থেকে সর্বাধিক যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করে। 

ওপরের স্তরে যারা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন, তার সিলেক্ট করার আগে বিগত দিনগুলোতে জাতীয় আয় বৃদ্ধি, কাজের সুযোগ বৃদ্ধি, সামাজিক কাজে তাদের অবদান , বিভিন্ন প্রদেশে বা দপ্তরে তাদের কাজের পারফরম‍্যান্স বিচার এবং তাদের পেছনে জনগনের সমর্থনের বিষয়টি ও বিবেচনায় রাখা হয়। এভাবেই তারা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরে একদল শিক্ষিত,প্রশিক্ষিত,ও প্রত‍্যুৎপন‍্যমতিত্ব নেতৃত্ব তুলে আনার প্রক্রিয়ায় সফলতাও দেখিয়েছেন। এটাকে তারা বলছেন, মেরিটোক্রেসি। 

গোটা দেশের বিভিন্ন প্রদেশে, কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল, এমনকি সামরিক বাহিনী থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই গনকংগ্রেস হাজির হয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাাসনিক নেতৃত্ব নির্বাচন করে। গনকংগ্রেসই ওদের পার্লামেন্ট, সেদেশে মূল শক্তি র আধার। সমস্ত আইন কানুন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, যুদ্ধ ঘোষণা কিম্বা শান্তি স্থাপন, সব সিদ্ধান্তই এখান থেকেই গৃহীত ও অনুমোদিত হয়। সর্বোচ্চ পদাধিকারীদের প্রয়োজনে অপসারণের সিদ্ধান্ত ও গনকংগ্রেস নিতে পারে।

 

 

চীন সাইকেলে :- মূল‍্যায়ন ( ৪):-

চীন নিয়ে বিতর্ক, বিরোধ বা মতপার্থক্য চলতেই থাকবে, কারণ সমাজতন্ত্রের এক অজানা পথে হেটে চলেছে তারা। ভুল ত্রুটি পরীক্ষা নিরিক্ষা, অভিজ্ঞতা নিশ্চয় পথ চলতে সাহায্য করবে তাদের, চিনতে সাহায্য করবে আমাদেরও। তবে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, পথ যাই হোক না কেনো, মানুষের নূন্যতম প্রয়োজন মেটানোকেই ওরা পাখীর চোখ করেছে। মানুষও এই কারনেই ওদের সরকারের পাশে রয়েছেন। 

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, যে, 

১) আমাদের দেশে যখন কৃষক থেকে ভূমিহীন ক্ষেত মজুররা সংকটে, আত্মহত্যার মিছিলে, তখন ওদের দেশ সত্তর বছর আগেই বিপ্লবের উষা লগ্নে সমস্ত কৃষকের হাতে জমির অধিকার তুলে দিয়েছিল, পরে কমিউনের হাত ঘুরে এখন তা আবার কৃষকর হাতে। কৃষক পরিবারগুলো আলোচনায় আমায় বলেছেন, চাষ থেকে তারা ভালোই আয় ক‍রেন।। ফসল বাজার জাত বা দাম পাওয়া র সমস‍্যা তাদের নেই। ভিয়েতনামে দেখেছি, বাইক নিয়ে চাষী মাঠে যায়, আর এখানে সবাই চারচাকা র ছোট টেম্পো।

২) সেদেশে সরকারি, বেসরকারি কারখানা ও অন‍্য সংস্থায় কর্মরত শ্রমিক কর্মচারী, সিনোপেক কম্পানির শ্রমিকরাও জানিয়েছেন, শনি ও রবি,তাদের সপ্তাহে দুদিন ছুটি, অন‍্যদিন কাজ আটঘন্টা। শ্রমিক শ্রেণী, ও শ্রমের সময়কে মর্যাদা দিয়ে চলেছে সে দেশ।

৩) সব স্তরের মানুষের গড় বেতন ছয় থেকে দশ হাজার ইয়েন, মানে ভারতীয় টাকায় ষাট হাজার থেকে এক লাখ। আসার দিনে বেজিং এর জোমাটো ছেলেটিও জানালো, মাস গেলে ভারতীয় টাকায় এক লাখ টাকা ওর আয়। এদেশে জোমাটো ছেলেরা বোধহয় ভাবতেই পারেনা। সবথেকে ভালো লাগলো, বেতনের স্তরে খেটে খাওয়া মানুষের সাথে বুদ্ধিজীবী বা সরকারি কর্মচারীদের খুব একটা পার্থক্য নেই। একজন মাষ্টার মশাই পথ চলতে চলতে বলেছিলেন, ওনাদের ও শুরুতে ষাট হাজার শেষে একলাখ বেতন। বেতন দানে সাম‍্যের চেহারা রয়েছে। ভিয়েতনামেও এ জিনিষ দেখেছি। কিছুটা হলেও জাপান কিম্বা দক্ষিন কোরিয়ায় এটা রয়েছে।

৪) মানুষ কে স্বল্পমূল্যে খাদ‍্য যোগান দিতে ওদেশের কমিউনিষ্ট সরকার বদ্ধপরিকর। তাই ব‍্যবসায়ীদের ব‍্যবসার সমস্ত সুবিধা দিলেও লুটের পুরোপুরি সুযোগ দিতে রাজি হননি। চাল ডাল নিত‍্য প্রয়োজনীয় সব জিনিষের দাম সরকারি প্রাইস ব‍্যুরো থেকে ঠিক করে দেওয়া। প্রায় সব কিছুরই কেজি পাচঁ ইয়েনের মধ‍্যে। ফলে বেতন বিরাট কিছু না হলেও চালিয়ে নিতে অসুবিধা হয়না।

৫) ব‍্যাপক কৃষি কাজ, ব‍্যবসা বানিজ‍্য শিল্প কলকারখানা, সব কিছুর মূলে বেকার যুবকের কর্মসংস্থানই সেদেশের সরকারের লক্ষ্য। বহুমুখী কর্মসংস্থানের ব‍্যবস্থা করেছে‌ তারা। বেকার নিশ্চয় কিছু আছে, কিন্তু নজরে পরেনি। প্রায় জায়গাতেই জনতাকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছি, "বেকার সেরকম নেই, সবাই প্রায় কাজ করেন‌"। এক শহরে রাত কাটালাম, এক পরিবারের হোম স্টে তে। সকাল হলেই কর্তা গিন্নি চললেন কাজে। বুড়ি মাকে রেখে গেলেন আমার দেখভালে। এরকমই বাড়ির কর্মক্ষম সবাই কাজে যান। ফলে দারিদ্র্য থেকে অনেকেই দুরে, স্বচ্ছলই আছেন তারা।

৬) শিক্ষা , স্বাস্থ্য জরুরী পরিসেবা তারা রাষ্টের হাতেই রেখেছেন।। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিনা বেতনে শিক্ষা। সকলের শিক্ষা গ্রহন বাধ‍্যতা মূলক। শিক্ষায় যুক্তি, প্রযুক্তি নির্ভরতা যেমন অঙ্গ ,তেমনি সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও বিশ্বব‍্যবস্থা সম্পর্কে ও তাদের ধারণা দেওয়া। এতধরনের যে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, শিক্ষার বিশেষীকরণ যে আছে, তা জানা ছিল না। রাস্তা, ব্রিজ তৈরিরওপরেও তাদের একাধিক রকমের প্রযুক্তি গত বিশ্ববিদ‍্যালয় রয়েছে। সাংহাইয়ের থেকে ষাট কিমি দুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেক ও তিনঘন্টায় ঘুরে শেষ করতে পারিনি।

৭)স্বাস্থ্য পরিসেবাতেও সরকারের ই সর্বব‍্যাপী । গ্রামীণ বা ছোট শহরেই কমিউনিটি হসপিটাল গুলোও আমাদের বড় হসপিটালের সমান। সরকারি ও কমিউনিটি হসপিটাল বেশিরভাগই বিনামূল্যে। বেসরকারি কিছু হসপিটাল আছে শুনেছি, তবে ভিয়তেনামের মত এখানে ও ঝোক সরকারি হসপিটালে। এক রাত হসপিটালে থাকার দৌলতে তাদের পরিকাঠামোর উন্নতি আরো ভালোভাবে অনুভব করেছিলাম।

৮) মহিলাদের দের অগ্রগতি অসাধারণ। লজ্জা জড়তা কে অনেক পেছনে ফেলেই এগিয়ে চলেছে তারা। ভীষন রকমই প্রতিবাদী তারা ,মানবিক ও বটে। বিতর্কের আসরে পুরুষের সমান, কিম্বা তার থেকে এগিয়ে। কর্মসংস্থান , মর্যাদায় তারা অনেক এগিয়ে। এক পাহাড়ি শহরে গেষ্ট হাউসের মালিক অল্প বয়সী যুবক, কথার ফাকেঁ হটাৎ করে ভিডিও খুলে এক ভারতীয় নারীর অমানবিক লাঞ্ছনার চিত্র তুলে ধরে বললেন, তোমাদের দেশে এরকম হয়? সত‍্য যে এতটা লজ্জাস্কর, তা হারে হারে অনুভব করেছিলাম।

 

চীন সাইকেলে ,মূল‍্যায়ন -৫,( সমাপ্ত) :- 

৯) বৃদ্ধ বয়সে পেনশন এদেশে সবার। কিন্তু তারপরেও প্রায় আশির ঘরে পৌছেও তারা পরিশ্রমের পাশাপাশি উপার্জনেও ব‍্যস্ত। সব সময় নিজেকে ব‍্যাপিত রেখেছে কাজে। আমার ভারতে ষাট পেরোলেই দিনগত পাপক্ষয়ের আশায় দিনগুনে চলি বেশিরভাগ, তখন ওরা আরো পনেরো বিশ বছর পরিবার ও রাষ্ট্রকে পরিসেবা দিয়ে চলেছে, উৎপাদন মূলক কাজে যুক্ত থেকে রাষ্ট্রের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে, এটাও কম বড় বিষয় নয়।

এখানে সরকার যেমন রয়েছে মানুষের পাশে,তেমনি মানুষ ও রয়েছে সরকারের পাশে। প্রায় সর্বত্র, সব প্রশ্নের পরে আমার শেষ প্রশ্ন থাকতো, আপনারা কি সুখী ? সরকারের কাজকর্মে আপনারা খুশি ? সকলের উত্তর আসতো একটাই, "হ‍্যা,আমরা খুশি, আমরা হ‍্যাপি"।

আসলে তাদের নূন্যতম চাহিদা গুলো অনেকটাই মেটাতে পেড়েছে বলেই বোধ হয়, তারা প্রায় সবাই তাদের সরকারের কাজকর্মে খুশি‌, সুখীও বটে।

১০) আমার সাইকেল যাত্রার মুখ‍্য বার্তা, " Stop. Global warming & Climate change,." উষ্ণায়ন ঠেকাতে দেশে দেশে এনভায়রনমেন্টাল এমারজেন্সী চালু করো‌। সন্দেহ নেই বিগত কয়েক বছর জলবায়ু সম্মেলন গুলোতে এই বিষয়ে ফ্রান্স, ভারতের সাথে চীনও, বরং আমেরিকার বিরোধিতা সত্বেও বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা কে দু ডিগ্রি নামিয়ে আনার জন‍্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। চলছে তার জোরদার কর্মতৎপরতা এখানে। অন‍্যত্র কিভাবে কতটা কাজ চলছে বলতে পারবোনা, চীন কিন্তু একাজকে আন্তরিক ভাবেই নিয়েছে। যুদ্ধের গতিতে চলছে গাছে গাছে দেশটাকে ছেয়ে ফেলার কাজ , তেমনি, কার্বন নির্গমনের পরিমান বড় মাত্রায় কমিয়ে আনতে গোটা দেশে তারা ইলেকট্রিক কিম্বা ব‍্যাটারি চালিত যানকেই সঙ্গী করেছে। ১৪০০ - ১৯০০ ইয়েন এ ভরতুকি দেওয়া ব‍্যাটারি বাইক, কিম্বা ৪০০০-৮০০০ ইয়েনে ভরতুকি দেওয়া চারচাকার ছোট হাতি মার্কা গাড়িগুলো প্রায় সবার বাড়িতে। কাঁকড়া ধরে পথের ধারে বিক্রি করছে যে বুড়িমা সেও এই গাড়িতে। সাথে সাথে সোলার এর ব‍্যবহারেও তারা জোড় দিয়েছে। তবে জাপান কিন্তু সোলারের ব‍্যাপারে এগিয়ে। জনতার প্লাস্টিক যত্রতত্র ফেলে দেবার প্রবনতা আছে ঠিকই, কিন্তু সেই জনতাই আবার আমার উষ্ণায়ন রোধের আহ্বান কে দুহাত তুলে সমর্থন জানিয়েছে। প্রথমেই তারা আমার সাইকেলের সামনে চীনা ভাষায় লেখা আবেদন খানি পড়ে খুশিতে হ‍্যান্ডশেক করতো বা সেলুট জানাতো, তারপরই আমার জন‍্য কি করতে পারে, সেই কাজে লেগে যেতো। সত‍্যি কথা বলতে কী, আমার বার্তা আর আমার সাইকেল যাত্রাই ছিল আমার প্রতি তাদের ভালোবাসার ও বড় একটি কারণ।

সবশেষে বলবো, যে কোন দেশে বিপ্লবী রুপান্তর আনতে গেলে উন্নত চেতনাশীল মানুষ গড়া প্রয়োজন, যারা রুপান্তর কে বয়ে আনবে। আমরা এদেশের বামপন্থীরা অনেকটাই ব‍্যার্থ একাজে। বিপ্লবোত্তর চীন কিন্তু সেই কাজটাই দীর্ঘ ঘাত প্রতিঘাতে গড়ে তুলতে পেরেছে। প্রায় প্রতিটি চীনা নাগরিক সুশিক্ষিত, শৃংখলা পরায়ন এবং রাজনৈতিক ভাবে সচেতন। সরকারের প্রতিটি কর্মকাণ্ড প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই দেখেছি, আজকের তরুণ প্রজন্ম দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে উৎসাহী নন, তারা গুগল আর ফেসবুকে ই আটকে রয়েছে। হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরাও বলতে পারেনি, কেনো জাপানে জিনিসের দাম বেশি বা কেনো তারা আমেরিকার সাথে চলেছে। চীনে কিন্তু তার উলটো ছবিই দেখলাম। এক সপিং মলের বছর ছাব্বিশের ছোটখাটো চেহারার যুবককে উসকে দিতে প্রশ্ন ছুড়েছিলাম, আচ্ছা, এই যে বিদেশী বহুজাতিক সংস্থা গুলোকে ঢুকতে দিচ্ছে তোমাদের সরকার, এতে কি তোমাদের ব‍্যবসা ঝাড় হবে না ? আমাকে অবাক করে উত্তর দিয়েছিলো, "নাহবে না, আমাদের অর্থনীতির ভিত এতটাই শক্ত যে ওরা আমাদের বেশি কিছু ক্ষতি করতে পারবেনা। আর আমরা যদি ওদের ঢুকতে না দিই, তবে বিশ্ববাজারে ওরা আমাদের জায়গা দেবেনা, এতে আমাদের জীবন জীবিকা সমস‍্যায় পড়বে।" 

রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন, কিম্বা তিয়েনমান এর ঘটনা এদেশের কমিউনিষ্টদের আরো সতর্ক করেছে। সব মানুষের কাছে ,বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে সরকারের লক্ষ‍্য উদ্দেশ্য ও আদর্শ ও পদক্ষেপ এর কার্যকারণ বার্তা পৌছে দিতে বহুমুখী পথ তারা ধরেছে। তাই তারা আমেরিকার গুগলের বিকল্প গড়ে তুলেছে বাইডু ও অন্যান্য এ্যাপ।

তবে শুধু সচেতন মানুষ তারা গড়েননি, এক মানবিক জাতি গোষ্ঠী ও তারা গড়ে তুলেছেন সন্দেহ নেই। সাধারণত মধ‍্য ও উচ্চবিত্ত মানুষের মধ‍্যে অন‍্যকে নিয়ে ভাবনা কম হয়, কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে তার ব‍্যাতিক্রমই দেখলাম। 

টেন্টে থাকার সুযোগ নেই বলে প্রথম প্রথম প্রতি রাতে আমি দুশ্চিন্তায় থাকতাম, কোন হোটেলে থাকবো, কি দাম নেবে ? কিন্ত চলতে চলতে বুঝে গিয়েছিলাম যে, এদেশে যেহেতু সবার ঘরবাড়ি আছে,খোলা আকাশের নিচে কেউ রাত কাটাবে,এটা তারা ভাবতেই পারেনা। তাই পুলিশ থেকে সাধারণ নাগরিক, আমাকে নিয়ে আমার থেকে, ওদের দুশ্চিন্তাই ছিল বেশি। রাত বারোটা একটা পর্যন্ত আমায় নিয়ে তারা ছোটাছুটি করতেন, কোথায় আমায় থাকতে দেবেন, তার ব‍্যবস্থা ক‍রার জন‍্য। আমি ভারতীয় বলে একবার ও কেউ মুখ ফিরিয়ে নেননি, বরং হৃদয় দিয়ে আগলে রেখেছেন। 

আমি কি করে ভুলবো হুইয়ান শহরের শহরতলীতে থাকা সেই মানুষটিকে, যিনি আমায় সাথে নিয়ে ছটফট করছেন, কেনো ? না , উনি আমায় সেই রাতে হোটেলে থাকার জন‍্য দুশো ইয়েন দিতে চান, কিন্তু ডিজিটাল দেশে তার কাছে ফোন পে আছে, কিন্তু ক‍্যাস টাকা নেই। তাই এমন করছেন যেনো এই তার হার্ট এ্যাটাক হয়ে যাবে। শেষে তিনটে দোকান ঘুরে এক দোকান থেকে ধার করে নিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিয়ে তবে স্বস্তি পেলেন। 

আমার এখনো চোখে ভাসে ত্রিয়ানজিন শহর সেই রাতের মলের ঘটনা। আমি শীতে চাদর মুড়ি দিয়ে কুকঁড়ে শুয়ে আছি মলের সোফায়। এত ঠান্ডা ঘুম আসছে না। হঠাৎ বা হাতের কনুইএর ওপর দিকে কার আলতো ছোঁয়া। ধড়পড়িয়ে চাদর সরিয়ে উঠে বসতে গিয়ে আমি হতবাক, বয়স আটান্নর এক ফর্সা ছিপছিপে চেহারার সুন্দরী ভদ্রমহিলা, তার গায়ের হাজার দুয়েক টাকা দামের কোটখানি পরম স্নেহে চাপিয়ে দিচ্ছেন আমার কুঁকড়ে যাওয়া শরীরে। সে এক স্বর্গীয় দৃশ‍্য! কোনদিনই ভোলার নয়। এই বিরাট দেশের বিরাট মানুষগুলোকে যদি তাদের উপযুক্ত সম্মাননা দিতে অপারগ হই, তাহলে সেই মানুষ গুলোর কাছে সারা জীবন অকৃতজ্ঞ বনে যাবো আমি। সেইরাতে আমি অনুভব করেছিলাম, যে বিপ্লবী চীন শুধু সচেতন মানুষই সৃষ্টি করেনি, মানবিক হৃদয় দিয়েও তাদের মুড়ে দিয়েছেন। যে মানুষ খুঁজে ফিরি আমি দেশে দেশে, গেয়ে বেড়াই সম্প্রীতির গান‌।