Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

দ্বিতীয় বর্ষ

Short Stories/ছোটগল্প

সাগর হয়ে ওঠা

অজন্তা সিনহা


"ঈশ্বর, ওঠ বাবা। উঠে পড়। হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খেয়ে নীলুপিসির বাড়ি একবার যা।" মায়ের ডাকে অবাক ঈশ্বর ঘর থেকে এসে কিছুক্ষণ দাওয়ায় বসে । এত সকালে নীলুপিসির বাড়ি ? সবে আলো ফুটেছে। সামনের রাস্তা দিয়ে লোকজনের চলাচল শুরু হয়নি এখনও। উল্টোদিকের বাড়ির ঠাকুমা আঁকশি দিয়ে ফুল পাড়ছেন। সেসব দেখতে দেখতে চোখ কচলাতে কচলাতে উঠোনের কোনায় কুয়োর পাড়ে যায় ঈশ্বর। মুখহাত ধুয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে সে।

 

"কেন মা ? এত সকালে নীলুপিসির বাড়ি কেন ?"

"বলছি। তুই আগে এই দুধমুড়িটুকু খেয়ে নে।"

 

একটু পরে মায়ের কথামতো নীলুপিসির বাড়ির পথ ধরে ঈশ্বর। তার কাঁধের ব্যাগে পাট করা কিছু পুরোনো কাপড়, সঙ্গে পুটুলিতে চালকিছু সবজি। মা বলছিল, 'আমাদের তো টাকাপয়সা দিয়ে নীলুপিসিকে সাহায্য করার সামর্থ্য নেই বাবা। আপাতত এগুলোই দিয়ে আয়। এক-দুটো দিন খেয়েপরে বাঁচুক মানুষটা। তারপর দেখছি কি করা যায়'নীলুপিসি তাঁর মাটির ঘরে একাই থাকেন, এটা খেয়াল করেছে ঈশ্বর। সেই ঘরের হাল খুব খারাপ, সেও তার দেখা। কিন্তু এর কারণ কি, তা নিয়ে কখনও ভাবেনি সে।  নীলুপিসিকে দেখার  কোনও লোক নেই। তাঁর স্বামী কয়েক বছর আগে কঠিন রোগে মারা যান। তারপর থেকেই একা নীলুপিসি । তার শিশুমন বড়ই ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। এমন এক সুন্দর প্রভাত। চারপাশের দৃশ্য অতি মনোরম। তবু, কিছুই ভালো লাগে না ঈশ্বরের। নীলুপিসির কত কষ্ট। মা না বললে সে তো জানতেই পারতো না।

 

গত ক'দিন ধরে অঝোরে বৃষ্টি। মাটির রাস্তা কর্দমাক্তচলাফেরায় বেজায় কষ্ট। তার মধ্যেই কাজের প্রয়োজনে এদিকওদিক যাচ্ছে গ্রামের মানুষ। বৃষ্টির জন্য চাষবাসের কাজেও ক্ষতি হচ্ছে। আর চাষের ক্ষতি মানেই অভাব আর একটু চেপে বসা। দক্ষিণবঙ্গের আর পাঁচটা গ্রামের মতোই বীরসিংহও বর্ষার জলোচ্ছ্বাসে ভিজে স্যাঁতসেঁতে। ঈশ্বরের বাবা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায়। গতকাল রাতেই কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন তিনি। এসে থেকেই কিছুটা চিন্তাচ্ছন্ন। ভগবতীর সামনে কি করে কথাটা পারবেন ভেবে পাচ্ছেন না কিছুতেই। ঈশ্বরকে এবার কলকাতায় নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। গ্রামের পাঠশালায় যতটুকু লেখাপড়া হওয়ার করেছে ঈশ্বর। এবার আর একটু উঁচুক্লাসের পড়া করতে হবে তাকে। ভগবতী এমনিতে ঈশ্বরের লেখাপড়া নিয়ে খুবই চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু তাকে একেবারে কাছছাড়া করতে চাইবেন কিনা সেটাই ভাবনার।

 

গ্রামের পাঠশালার পড়া শেষ। তবু, মাঝে মাঝে গুরুমশাইয়ের ডাকে সেখানে যায় ঈশ্বর। বর্ষায় এদিক-ওদিক যাওয়ার জন্য মা সুন্দর এক বাঁশের টোকা বানিয়ে দিয়েছে, সেটাই মাথায় দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট বাজিয়ে চলেছে ঈশ্বর। যেতে যেতে পথের পাশে পুকুরঘাটে চোখ পড়ে তার। পাড়ার কাকী-জেঠির দল। তার বয়েসী কি তার থেকে ছোট মেয়েরাও আছে। নানা কাজে ব্যস্ত তারা। ওরা পাঠশালায় যায় না। কেন, কে জানে ? ভাবতে ভাবতে ঈশ্বর পথ চলতে থাকে। তার যদি একটা বোন থাকতো, তবে ঈশ্বর নিশ্চয়ই তাকে পাঠশালায় নিয়ে যেত। মেজভাইয়ের এখনও ভর্তির সময় হয়নি। আপাতত ঘরেই স্লেট-পেন্সিল নিয়ে কসরৎ করছে সে। ঈশ্বরই তার মাস্টার এখন। মাঝে মাঝে মা-ও সময় পেলে বসেন তাদের সঙ্গে। ছোটটি অবশ্য এক্কেবারে ছোট। তার স্কুলে যেতে অনেক দেরি। বৃষ্টি একটু ধরেছে। দূরে দেখা যায় পাঠশালার আটচালা। ঈশ্বর কাদা বাঁচিয়ে তাড়াতাড়ি চলার চেষ্টা করে।

 

টানাটানির সংসার। তবু, বাড়তি কিছু ব্যাঞ্জন রান্নার প্রস্তুতি নেন ভগবতী। অনেকদিন পর বাড়ি এসেছেন ঠাকুরদাস। কলকাতায় পরের বাড়িতে থাকেন। তাঁরা ধনী, আদরযত্নও করেন তাঁর স্বামীকে। তবু ঘরের মতো কি আর হয়? ঈশ্বর পাঠশালায় গেছে অনেকক্ষণ। এতক্ষণে ফেরা উচিত। এমনিতে যথেষ্ট বুদ্ধিমান সে। তবে, মাঝে মাঝে দুষ্টুবুদ্ধিও খেলে তার মাথায়। তখন আবার দলবলও জুটে যায় ঈশ্বরের সঙ্গে। এ গ্রামেরই ছেলেপিলে তারা । ঈশ্বর হলো দলপতি। চেহারায় ছোটখাটো হলে কি, বুদ্ধিতে সে সবার ওপরে। মাঝে মাঝে চিন্তায় পড়ে যান ভগবতী। গ্রামের পাঠশালায় যতটা পড়ার পড়ে ফেলেছে ঈশ্বর। এরপর তার পড়াশোনার কি হবে ? তার মেজ ছেলেরও পাঠশালায় দাখিলার সময় এগিয়ে এল। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কি করে ছেলেদের লেখাপড়া চালাবেন ভেবে মাঝে মাঝে দিশেহারা হন ভগবতী। কিন্তু তারপরই মন শক্ত করেন। লেখাপড়া তো শিখতেই হবে। দাওয়ায় টাঙানো দোলনায় ছোট্ট খোকা হাত-পা নাড়ে। ঠাকুরদাস-ভগবতীর তৃতীয় সন্তান। ঈশ্বরের দিকে তাকিয়েই আশায় বুক বাঁধেন ভগবতী। সে নিজের সঙ্গে সঙ্গে ভাইদের পড়াশোনার  ব্যাপারেও দেখবে নিশ্চয়ই।

 

ভগবতীর ভাবনার মধ্যেই রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ান ঠাকুরদাস, "ঈশ্বর কোথায়? এত বেলা হলো। আমার স্নান-আহ্নিক শেষ। ঈশ্বরকে দেখছি না। এই বৃষ্টিতে বেশিক্ষণ পুকুরঘাটে থাকলে...!" ঠাকুরদাসের কথা শেষ হওয়ার আগেই উঠোনের বাঁশের গেট ঠেলে বাড়িতে ঢোকে ঈশ্বর। তার ধুতির কোচর ঝুলে রয়েছে। নিশ্চয়ই মিত্রদের বাগান থেকে কাঁচা আম পেড়েছে ঈশ্বর। এবার একটা অশান্তি লাগলো বলে। ঠাকুরদাসের দিকে চেয়ে শঙ্কিত হন ভগবতী। আজ ঈশ্বরের কপালে দুঃখ আছে। যথারীতি ঈশ্বরের পিছু পিছু একটু পরেই রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করে মিত্রদের মালি হুকুম সিং। তার হাতে বৃহৎ এক মোটা লাঠি, যেটির ব্যবহার আজ অবধি করে উঠতে পারেনি বেচারা। ঈশ্বর ও তার দলবলকে হাতের নাগালে পাওয়া এত সহজ নাকি ! আজ তাই বাড়িতেই এসে হাজির সে।

 

সামনে বাবা। পিছনে হুকুম সিং। ঈশ্বর বোঝে গতিক সুবিধের নয়। সে কোচড়ের আম হুকুম সিংয়ের সামনে ফেলে পগার পার। ভগবতী রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে আসতে পালায় ঈশ্বর। তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত ত্রিসীমানায় টিকি মেলে না তার। ঠাকুরদাস রাগ ও দুশ্চিন্তা যুগপৎ নিয়ে ঘরবার করেন। ভগবতীর তো শুধুই দুশ্চিন্তাশেষে প্রতিবেশী হারুর মা ধরে নিয়ে আসেন ঈশ্বরকে। তাঁদের গোয়ালের এক কোনে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে ছিল বেচারা। গরু রাখতে গিয়ে ঈশ্বরকে আবিষ্কার করেন তিনি। তারপর বুঝিয়েসুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন। ভগবতীর ছলছলে চোখ দেখে আপাতত নিজের রাগ সংবরণ করেন ঠাকুরদাস। ভগবতী বলেন, "সারাটা দিন না খেয়ে কাটিয়ে দিলি। আমরা সারা গ্রাম তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি !" ঈশ্বর হেসে বলে, "এখন দাও না খেতে। বড্ড খিদে পেয়েছে।"

ঠাকুরদাস একপলক দেখেন ঈশ্বরকে, তারপর ঘরে চলে যান। ভগবতী বলেন, "দেব বাবা। তবে, তার আগে হাত-মুখ ধুয়ে সন্ধ্যা-আহ্নিক।" 

 

ঈশ্বর ঘুমিয়ে পড়েছে । ভগবতী লণ্ঠনের আলোয় মাথা নামিয়ে ঈশ্বরের জামা সেলাই করছেন। খেলতে গিয়ে জামার একটা কোনা ছিঁড়ে এনেছে সে। ঈশ্বরের দুষ্টুমি কমার লক্ষণই নেই। তবে, লেখাপড়ায় ক্রমে আগ্রহ বাড়ছে তার। গুরুমশাই বলছিলেন একথা। ঈশ্বর নাকি নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে তাঁকে। বিশেষত সংস্কৃত ব্যাকরণ নিয়ে তার আগ্রহ তুঙ্গে। পাঠশালায় বাঁধাধরা পড়ার বইয়ের বাইরের বই যতটুকু গুরুমশাইয়ের কাছে আছে তিনি পড়তে দেন ঈশ্বরকে। ঈশ্বর খুব দ্রুত সেসব বই পড়ে শেষ করে ফেলছে। ভাবনার মধ্যেই খড়মের আওয়াজ শুনতে পান ভগবতী। ঠাকুরদাস বাড়ি ফিরেছেন। গ্রামে এলে এখনও বসে থাকেন না তিনি। এদিক-ওদিক যান। নানা সমস্যায় লোকজন ঠাকুরদাসের পরামর্শ নিয়ে থাকে। সেলাই গুছিয়ে উঠে পড়েন ভগবতী। খাবারের আয়োজন করতে হবে। কাল সকালেই কলকাতা ফিরবেন ঠাকুরদাস। তারও কিছু গোছগাছ আছে। 

 

ঠাকুরদাস যাওয়ার পর কয়েকটা দিন কেটেছে। যাওয়ার আগে তিনি জানিয়ে গেছেন পরের বার ঈশ্বরকে নিয়ে যাবেন কলকাতায়। এখন থেকে সেখানেই লেখাপড়া করবে ঈশ্বর। ভগবতীর মনটা কিছু খারাপ ক'দিন। তাই বলে তেমন মা নন তিনি যে ঈশ্বরের লেখাপড়া বন্ধ রেখে তাকে স্নেহডোরে  বেঁধে রাখবেন। ঈশ্বরকে অনেক বড় হতে হবে। সমাজের জন্য অনেক কাজ করার আছে তার। গ্রামে একটা অবৈতনিক স্কুল হওয়া দরকার। পাঠশালার পড়া শেষ করে গ্রামের ছেলেমেয়েরা কোথায় যাবে ? ফলে, অনেকেরই পড়া মাঝপথে থেমে যায়। গ্রামে একটা মেয়েদের স্কুল হলেও ভালো হয়। গ্রামের পাঠশালায় ছেলেরা পড়ে। সেখানে মেয়েদের যাওয়ার অনুমতি নেই। কেন বাপু, মেয়েদেরও তো লেখাপড়া শেখা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। 

 

বর্ষা গিয়ে শরৎ এসেছে। বাড়ির সামনের শিউলি গাছটায় ঝাপিয়ে ফুল এসেছে। কি অপূর্ব সুবাস তার। আকাশ এখন একেবারে পরিষ্কার। তাঁদের গ্রামে একটাই পুজো হয় মিত্রদের বাড়িতে। একদা তারা গ্রামের জমিদার ছিল। এখন জমিদারি অবলুপ্ত। সেই ঠাঁটবাট আর নেই। তবে, পুজোটা হয়।  গ্রামের সব মানুষ সেখানেই শামিল। আনন্দময় পরিবেশ প্রকৃতির সর্বত্র জুড়ে। কিন্তু সমাজ যে প্রকৃতির অনুসারী নয়। সেখানে বড্ড ভেদাভেদ। গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলির কথা ভেবে চোখে জল আসে ভগবতীর। তাঁদের পরিবারের টানাটানি কিছুটা তবু কমেছে ঠাকুরদাস কলকাতায় কাজ করতে যাওয়ার পর। তবে, শুরুতেই সেটা হয়নি। প্রথম দিকে তাঁর স্বামী চরম কষ্টে দিন যাপন করেছেন। ঈশ্বরকে ইচ্ছে করেই সেসব গল্প শোনান ভগবতী। তার নিজের পরিবারের অবস্থা জানা দরকার ঈশ্বরের। তার সঙ্গে গ্রামের মানুষের দুর্দশা নিয়েও আলোচনা করেন। সব কথা ঈশ্বর এখনই না বুঝলেও, তার মনটা তো তৈরি হবে। মানুষের কষ্ট না বুঝলে কিসের মানুষ ?

 

গতকালই বাড়ি এসেছেন বাবা। এবার যাওয়ার সময় তিনি ঈশ্বরকে কলকাতায় নিয়ে যাবেন। অজান্তেই কিছু উদাস হয়ে পড়ে ঈশ্বর। মায়ের কাছছাড়া হওয়াটা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না তার। আর তার খেলার সাথীরা! তার ছোট দুই ভাই। গ্রামের গাছপালা, পুকুর, পশুপাখি সকলেই তো তার আত্মীয়। দু-একবার মাকে সেটা বলার চেষ্টাও করে সে। কিন্তু মা যখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝান কোনও কথা, তখন আর ঈশ্বরের কিছু করার থাকে না। বাবার সঙ্গে জেদ করে দুষ্টুমি করলেও, মায়ের আদরমাখা কথার সামনে একেবারে দুর্বল সে। মা সবার জন্য কত ভাবেন। তাকেও মায়ের কথা রাখতে হবে। তবে, কলকাতার প্রতি একটা আকর্ষণও তার জন্মেছে। বাবা যে বাড়িতে থাকেন , তার অনেক গল্প শুনেছে সে বাবার কাছে। আর বাবা এটাও বলেছেন, কলকাতা হলো এমন এক জায়গা, যেখানে ইস্কুল-কলেজের ছড়াছড়ি। আর কত যে বিদ্বান মানুষ ! ঈশ্বর সব মায়া ভুলে বাবার সঙ্গে সেই বিদ্যার পীঠস্থানে পা রাখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতা পাড়ি। ঈশ্বরের জীবনের নতুন পর্ব শুরু । ঠাকুরদাস কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলে বিখ্যাত ধনী ভগবতচরণের বাড়িতে আগে থেকেই বসবাস করছিলেন। এখানেই ঠাঁই হলো ঈশ্বরেরও। বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়ি। অনেক মানুষ থাকে সেখানে। পরিবারের সদস্যরা তো বটেই, তাদের মতো আশ্রিতর সংখ্যাও কম নয়। বালক ঈশ্বর ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে মানিয়ে নেয় নিজেকে। গ্রামের কথা মনে পড়ে মাঝে মাঝেই। মন বিষন্নও হয়। মনকে বোঝায় মায়ের কথা ভেবে। মাকে দেওয়া কথা যে রাখতেই হবে তাকে।

 

এরই মধ্যে তার লেখাপড়ার পর্বও শুরু হয়ে গেছে।  গ্রামের পাঠশালায় পড়াকালীনই তার সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে নিবিড় পরিচয় ঘটেছে। । কলকাতা আসার পর ইংরেজি ভাষার প্রতিও আগ্রহ জন্মায় ঈশ্বরের। মেধাবী ঈশ্বর খুব তাড়াতাড়ি সব কিছু শিখে নেয়। আবার মৌলিক রচনার দিকেও তার প্রতিভা প্রকাশিত হতে থাকে। অতি সীমিত ক্ষমতার মধ্যে ঠাকুরদাসও যথা সম্ভব চেষ্টা করেন। ঈশ্বরের লেখাপড়াটা যাতে নির্বিঘ্নে ঘটে, তার জন্য দিবারাত্র ব্যস্ততা, অক্লান্ত পরিশ্রমের মাঝেও খোঁজখবর নেন তিনি। বাহ্যিকভাবে স্বভাবেও বেশ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে ঈশ্বরের। সে এখন অনেক শান্ত ও ধীরস্থির।

বাবা বহুবছর একা কষ্ট করেছেন কলকাতায়। মায়ের কাছে শোনা সেসব গল্প ভোলেনি ঈশ্বর। সংসারের কাজে তাই সেও হাত লাগায়। দিনের বেলাটায় তাই পঠনপাঠনের সময় হয় না। এদিকে রাতে প্রদীপ বা কেরোসিনের বাতি জ্বালালে বাড়তি অর্থব্যয়। ঈশ্বর বইপত্র নিয়ে ঘরের সামনের ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়াশোনা শুরু করে। এভাবেই বালক বয়স থেকে সংসারের বোঝা কাঁধে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে সে। তার এই আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি, ইতিহাস তার সাক্ষী। পরমেশ্বর ওপর থেকে দেখেছেন তার বিদ্যার প্রতি একান্ত অনুরাগ, তার সততা ও মনুষ্যত্ব, তার মরমি মন। কলকাতার পন্ডিত সমাজ থেকে সাধারণ মানুষ, সকলের কাছেই ক্রমশ শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠেছেন একদিন। একদিন সারা বাংলা প্রনাম করেছে তাঁকে। তবে, সে তো অনেক পরের কথা। এখন বালক ঈশ্বরের দিনলিপি। বালক ঈশ্বরের দিনযাপনের কষ্ট আরেকজনও প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করে যাচ্ছে। সে হলো ভগবতচরণের কনিষ্ঠ কন্যা রাইমনি।

 

রাইমনি বালিকা হলে কি হবে ? সে সাংসারিক দায়িত্ব, কর্তব্যে একেবারে নিপুণ। সবার ভালমন্দের দিকে নজর তার। ঠাকুরদাসকে সে জ্যাঠামশাই বলে। ঈশ্বর তাঁর ছেলে। দু'জনেই তার আপনজন, এমনই মনে করে রাইমনি। বিশেষত বালক ঈশ্বরের দিবারাত্র পরিশ্রম দেখে রাইমনির কোমল হৃদয় বড়ই বিচলিত হয়ে ওঠে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করে, ঈশ্বরের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়। ইস্কুল থেকে ফিরে আবার ঘরের রান্নাবান্না। রাইমনি ভাবে, উপায় থাকলে সে-ই ঈশ্বরের সব কাজ করে দিত। কিন্তু ঈশ্বর কারও সাহায্য নেবে না। সে অত্যন্ত আত্মসম্মানজ্ঞানী ও আত্মনির্ভরশীল।

 

কলকাতায় প্রথমবার দুর্গাপুজো ঈশ্বরের। ভগবতচরণের বাড়িতেই পুজো হয়। ঠাকুরদালানে একটু একটু করে রূপ পাচ্ছে মৃন্ময়ী মা। রঙ্গিন কাপড়, জরি, শোলা, আরও কত উপকরণে সেজে উঠছেন মা। অলংকারের কি বাহার ! একদিন মাকেও এমনি কাপড় ও গয়নায় সাজাবে সে। ঈশ্বরের গ্রামের কথা মনে পড়ে। বাবা বলেছে পুজোর পর তারা গ্রামে যাবে। এখন এখানে পুজো নিয়ে বিপুল আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। বাবারও কিছু দায়িত্ব আছে সেখানে। বাইরে থেকেও অতিথিরা এসেছে। রাইমনি বলে দিয়ে গেছে, এই ক'দিন যেন তারা রান্না না করে। ঠাকুরদালানের পাশেই ঘেরা জায়গায় সবার জন্য রান্না হচ্ছে। বিশাল বিশাল উনুনে বিরাট হাঁড়ি-কড়াইয়ে রান্না। বামুন ঠাকুর রাঁধছেন। না, ইনি উড়ে বামুন নন। পৈতেওয়ালা  উচ্চবর্ণের বামুন। ইনি আদতে এ বাড়িরই একজন আশ্রিত। কালী মন্দিরে নিত্য পুজো করেন। রান্নাতেও চৌখস। এতসব  ব্যাপার এর আগে দেখেনি ঈশ্বর।  ভিয়েন বসিয়ে মিষ্টিও তৈরি হচ্ছে। অনেক লোক একসঙ্গে কাজ করছে।

 

ঈশ্বর কৈশোরে পদার্পন করার পর থেকে ঠাকুরদাস অনেকটাই নিজের মতো চলাফেরা করতে দেন তাকে। এখন পুজোর ছুটি। আর ঘরেও তেমন কাজের চাপ নেই। বাড়তি সময় হাতে পেয়ে নতুন নতুন বই পড়ছে ঈশ্বর। স্কুলে যাওয়ার পর সংস্কৃতর পাশাপাশি বাংলা ও  ইংরেজি ভাষাও শিখতে হচ্ছে তাকে। বাংলা কিছুটা গ্রামেই পড়েছে সে। তবে, বাংলা ভাষাকে আরও সহজ, সরল ও মধুর করে তোলা যায় বলে ধারণা তার। এখনও পর্যন্ত বাংলা অনেকটাই সংস্কৃত ঘেঁষা। ইংরেজি বর্ণগুলির সঙ্গে ঈশ্বরের প্রথম পরিচয় হয়েছিল বাবার সঙ্গে গ্রাম থেকে কলকাতা আসার দিনে। মাইলস্টোন দেখিয়ে চিনিয়েছিল বাবা। ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও পঠনপাঠনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে ঈশ্বরের। গ্রামের খেলার সাথীদের আর তেমন মনে পড়ে না। বই তার সবথেকে বড় সাথী এখন। গঙ্গা নদী এই বাড়িটা  থেকে বেশ কাছে। রোজ সকালে গঙ্গাস্নান বড় পবিত্র এক অভিজ্ঞতা ঈশ্বরের । মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলায়ও আসে সে। ঘাটে বাঁধা সারি সারি নৌকা। মাঝিরা সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য নিজেদের মধ্যে গানবাজনা করে। রান্নাও করে। হাওয়ায় ভেসে আসে ফোড়ণের সুবাস।

 

গত সন্ধ্যায় ঠাকুর বিসর্জন হয়েছে। সেও এক এলাহী কারবার। ঈশ্বরের স্মৃতিতে বহুদিন থেকে যাবে এসব। আজ গমগমে বাড়িটা তুলনায় শান্ত। অভ্যাস মতো অতি ভোরে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে গঙ্গায় স্নান করতে যায় ঈশ্বর। এদিক-ওদিক ছড়ানো উৎসাবশেষের চিন্হ। মন্থর পায়ে হেঁটে গঙ্গার পাড়ে পৌঁছয় সে। কোথাও কোনও উত্তেজনা নেই। শান্ত, পবিত্র এক প্রভাত। যেন মা দুর্গা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার কালে দিয়ে গেছেন এই অপার শান্তি ও পবিত্রতা। মায়েরা এমনই হয়। তার মা-ও তো অতি শৈশব থেকে তার ভুল ও অন্যায়গুলিকে দূর করে উত্তরণের পথে এগিয়ে দিচ্ছেন। এই যে ছোট্ট মেয়ে রাইমনি, সেও তো মাতৃস্নেহেই তার যত্নআত্তি করছে।

 

ঈশ্বরের হৃদয় প্রাপ্তির সুধারসে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। এই প্রাপ্তির ঋণ শিকার করতেই হবে তাকে। সমগ্র সমাজকে। পূর্ব দিগন্তে নতুন সূর্যের উদয় হচ্ছে। ধীরে ধীরে জলে নামে ঈশ্বর। মা গঙ্গা বুকে তুলে নিচ্ছেন তাকে মায়ের মতোই। স্নিগ্ধ, সিক্ত করে তুলছেন। হাত জোড় করে উদিত সূর্যের বন্দনা করে ঈশ্বর। বাংলায় নতুন সূর্য উঠছে। নব জাগরণের প্রহর সমাগত। মমতাময়, মানবদরদী, সৎ, বলিষ্ঠ, অসাধারণ প্রতিভাধর ছোটখাট এই কিশোর একদিন সেই জাগরণের প্রতিভূ হবে। তার জ্ঞান, বিদ্যা ও পান্ডিত্যের জন্য বিদ্যাসাগর উপাধি পাবে সে । মানুষের প্রতি অপার দয়া ও করুণার জন্য তাকে বলা হবে দয়ার সাগর। দিনের প্রথম সূর্য আলোক বিকিরণের মধ্য দিয়ে এই সবকথাই বলে যায়।