প্রহেলিকা, ২০২৩
Poems/কবিতা
পরাজিত দিনেও, স্পন্দন
অমল কর
পরাজিত দিনেও, স্পন্দন (১)
বুড়োবুড়ি আমরা জীবনে খোঁড়খুঁড়ি বাড়াবাড়ি করেছি বিস্তর।কসবার সাবেকি বাড়ির তিনতলায় কখনো একলপ্তে বারান্দায় বসি মুখোমুখি, কখনো বিছাই জীবনের বাহান্ন তাস। একদা দাপুটে সরকারি অফিসার আমি মণিময় ভট্টাচার্য বেনিয়ম বেয়াদপি বরদাস্ত করিনি কখনো। মেয়েস্কুলের কড়া বড়োদিদিমণি আমার বহু বছরের গৃহিণী শ্রাবন্তী-র এখন শরীরে অনেক বয়েস। তিনকাল পেরিয়ে কবেই আমরা এখন এককালে। ফাঁকা ঘরের মতো বুকে বেজে যায় নিরন্তর অনন্ত আর্তনাদ আর হাহাকার।সাদা দেওয়ালের দিকে কিংবা কড়িবরগার দিকে তাকিয়ে চিত্রপট স্মৃতি খেলি। দুটি মানুষের ঘরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া ভাষা নেই কোনো,মর্মবেদনা ছাড়া নেই কোনো উচ্চারণ। গ্ৰীষ্ণের দীপক বর্ষার মল্লার আশ্বিনের ভৈরবী হেমন্তের শ্রী শীতের মালকোশ বসন্তের হিল্লোল আমাদের আজ আর টানে না ।
বিভুঁই সমুদ্রপাড়ে দুরালাপে মাঝেমধ্যে ছোটো বড়ো বাতাসে ভেসে আসে প্রবাসী পুত্র পুত্রবধূ এন্ডি-গেন্ডি নাতি-নাতনির কলরব, সংলাপ। "সাবধানে থেকো বাবা"। "মা, ভালো আছো তো! নিয়মমতো নিয়মিত ওষুধ খেয়ো।" "খোকারে, সুযোগ করে আসিস একদিন , কতদিন তোদের দেখি না রে!" চকচক গৃহিণীর চোখ, ঝলমল মুখ, কখনো বিষণ্ণতা চোখেমুখে, উদবেগ কখনোবা ।জড়ানো গলায় হারানো মুখ মুখর হয়।তারপর! হাসিও কেমন কখন যেন কেঁদে ওঠে বুকে।
মানতে হয় ডাক্তার-বদ্যির অনুশাসন।
হৃদযন্ত্র প্রেসার সুগার শরীরের হালহকিকত দেখে যান গৃহ-ডাক্তার।
ঘর-বোঝাই একরাশ ওষুধ-পথ্য।
কাজের মেয়ে সরমার খর-ঠাসঠাস
শাসন যেমন, আদরের তদারকিও।
'সোনাদাদু, ওষুধটা খেয়ে নাও লক্ষ্মীটি!'
'দিদুন, ওষুধটা খেলে না যে বড়ো! তেতো
তো কী হয়েছে! খাও, খেয়ে নাও বলছি।'
পরাজিত দিনেও , স্পন্দন (২)
খানিক পরে ফের সরমা বলে,
'আর একটু স্যুপ নাও দিদুন।'
দুহাতে স্নেহ কখনো,মধুক্ষরা
সুবাসও। তবুও শ্রাবন্তী বেজে
ওঠে ঠাসঠাস নানা নালিশে
'আমাদের খায়-পরে, আমাদের
চুল ছেঁড়ে।'
সারাদিন অজস্র ব্যথা নিয়ে থাকি।
শরীরে বেনিয়মী তিলতিল স্বেচ্ছাসংহার। বুকে পারাপারের নদী এখন কখন করোটি।জাড্য ভুলতে পারি না ।
একটি-দুটি দুঃখ ছিঁড়ি প্রতিদিন
মন্থর লাগে জীবনে।চড়ুই ঢোকে ঘরে।
ফাঁকফোকর পেরিয়ে রোদ্দুর আসে।
দিন কেটে যায় দিনের খেয়ালে।দিনরাত
একাকার হাহাকারে।
তারপর প্রতিদিন রাত নামে চরাচরে
আমাদের ঘরে। রাত মানে তো ডাঁই করা একরাশ ঘন অন্ধকার আর সীমাহীন
ব্যথার সংসার।রাত এলে বয়ে যায় পৃথিবী।মড়মড় হাড়গোড় নিয়ে শ্রাবন্তী ক্লান্তি বদলে নেয় 'ওঃ আঃ বাবাগো মাগো' শব্দে এ-পাশ ও-পাশ। সারাদিন শ্রমে-ঘামে ক্লান্ত সরমা ধড়মড় জেগে
ওঠে 'দিদুন,কষ্ট হচ্ছে খুব!হাত বুলিয়ে দেব!' নির্ঘুম শ্রাবন্তী নিজের উপর অভিমানে বলে 'নাঃ, আরাম খাচ্ছি খুব।'
বাতাস আসুক-না-আসুক, আমাদের
ঘরে অনায়াসে দীর্ঘশ্বাস আসে।প্রবাদ
আছে, 'নারী আর রাতের চেয়ে শান্তি
নেই কোনোখানে।' আমার একান্ত নারী এখন অসাড়।আর রুগ্না স্ত্রী শান্তি খোঁজে
কার কাছে!রাতের কাছে ঘুম ছাড়া কী
চাইবার আছে! ঝুলপড়া বালবের আলো ছুঁয়ে স্নিগ্ধ রাত বয়ে যায়। বিশালদেহী
টিকটিকি আমাদের সাথে রাত জাগে
আর টপাটপ গিলে খায় পোকামাকড়।
আর, আমাদের পোড়াচোখে ঘুম আসে না,সারারাত আমরা গিলে খাই অন্ধকার।
ঘুম মানে তো আমাদের কাছে সমার্থক মৃত্যু ।
মৃত্যুকে সরিয়ে রেখে বারান্দায় বসে
সারারাত পাঠ করি নক্ষত্রের করুণ
ভাষা।সময়ের অসময়ে বেতালা বাতাস ওড়ে।আর সময়ের কাছে আমার একান্ত পরাজয় দেখি। এ বাড়ির ইটগুলো
জানল না কোনোদিন আমার বেদন-কাহিনি।তখন কত প্রাণকথা
বেজে বেজে ওঠে বিষাদের গান হয়ে!
পরাজিত দিনেও স্পন্দন (০৩)
খণ্ড খণ্ড স্মৃতি ডাকি। বানিয়ে ফেনিয়ে
কত আর হাজার বিলাপ আর মৌন
কথার ফোয়ারা ! যে জ্বলে, সে-ই
বোঝে প্রকৃত দহন। ইতিহাস ছাড়া
কে আর সয় এত রক্তপাত! পরাজিত দিনে উদ্যত মৃত্যুর মাঝখানে বসে
আছি এক গাঢ় পরিব্যাপ্ত আসরে।
শ্মশান-খেলা আছেই যখন জীবনে,
অনন্তে তো দাঁড়াতেই হবে কোনো
একদিন! প্রত্যেক মৃত্যু -রাতে, আশ্চর্য,
কেমন করে যেন ফিরে ফিরে আসে
নিশ্বাস, মৃত্যু এসেও চলে যায়।
আবার জেগে ওঠে চনমন মন।
কেবলই মনে হয়, বাজাও রে বাতাস,
ওড়াও আকাশ, নেচে ওঠো প্রাণ,
বেজে ওঠো স্পন্দন।