বাহিরযাত্রা, ২০২৫
Others/অন্যান্য
ছবির দেশে কয়েক দিন I পর্ব শুরু
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
সাবান পড়া মেঝেয় পিছলে যাবার মত একটার পর একটা দৃশ্য পিছলে যাচ্ছে ট্রেনের জানলার কাঁচে।চলন্ত ট্রেন থেকে দেখছি ক্ষেত ভরা গ্রাম। এটাই তো স্বাভাবিক।কিন্তু ঘটনা হচ্ছে যে এটা সেই দেশের গ্রাম যেখানে প্রতিটা খাঁজে জমে আছে আমার কৈশোর যৌবনের কত কত কৌতুহল আর স্বপ্ন।
২০২৩ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। আমরা তিনজন অর্থাৎ আমার অর্ধাঙ্গীনি নূপুর় ,অচ্যুত আমার জামাতা বাবাজীবন, আর আমি।না না, আমাদের কন্যা ছুটির ভিসার অভাবে লন্ডনের ঘরে বন্দি। তবে এর আগে ওর প্যারিস দেখা। লন্ডনে আমাদের টেম্স্ নদীরতলা দিয়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা থাকলেও সমূদ্রের তলা দিয়ে যাবার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। চূড়ান্ত উত্তেজিত। তবে একমাত্র দ্রুতগামী ট্রেন ইউরোস্টারে রওনা দিয়ে দুপাশে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের গ্রাম্য দৃশ্য দেখার ফাঁকে পাহাড়ের টানেলে ঢোকার মত অল্প কিছুসময় সমূদ্রের তলায় থেকে বিশেষ আলাদা অনুভূতি হল না। ঠিক ২ ঘন্টা ২৮ মিনিট লাগলো লন্ডন থেকে প্যারিসে পৌঁছতে। বাইরে তখন জাঁকিয়ে বৃষ্টি ।প্যারিসে থাকার ব্যাবস্থা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তবে লাগেজ নিয়ে এখনই সেখানে না গিয়ে স্টেশনের ক্লোক রুমে লাগেজ জমা রেখে দিলাম।সবার খিদে তখন চনমনিয়ে।গ্রান্ড দে নর্থ স্টেশনের সামনেই সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। ভেতরে ইন্ডিয়ানদের উচ্চগ্রামে আলাপ। অচ্যুতের অর্ডার দেওয়া ভেজ বিরিয়ানী ঠিক মন্পসন্দ হল না। আমাদের ধোসা ছিল “ঐ আর কি” গোছের।খাওয়ার শেষে বিল মেটানোর সময় দেখা হল ছুটির (মেয়ে) যাদবপুরে পড়াকালীন এক সহপাঠীর সঙ্গে। উচ্চশিক্ষার জন্যই ঐ সহপাঠীর প্যারিসে আগমন। বিয়ের সময় না এসেও ছবি দেখে অচ্যুতকে (জামাই) চিনতে পারায় একটু অবাকই হলাম।
সময় যেহতু নষ্ট করা যাবে না , প্রথমেই রওনা দিলাম ওরানজেরী (Orangerie) মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে।রাস্তায় বেরিয়ে প্রথমেই নজরে পড়ল শহরের বেশির ভাগ বাড়িই একই ধরনের , প্রায় একই উচ্চতা বিশিষ্ট।।কলকাতার সমস্যা হল এখানে বহুতল বাড়ির পাাশে বহু টালির ঘর,যা দৃষ্টিনন্দন তো নয়ই, আর্থিক সংগতির পার্থক্যও খুবই প্রকট ভাবে ধরা দেয়।প্যারিস শহরের স্থাপত্যে এই সৌন্দর্যের চাবিকাঠি ছিল Haussmann সাহেবের পকেটে , যার ওপর Napoleon III অনেকটাই নির্ভর করতেন। একই ধরনের বাড়ি,মাটির তলার পাইপ লাইন,আলোকিত পথঘাট ,পানীয় জল সরবরাহ, সবইএই Haussmann সাহেবের চিন্তার ফসল ।১৮৫৩ সালের আগে প্যারিস ছিল ঘিন্জি,পরিকল্পনাহীন ছোটশহর। এরপর থেকে বিভিন্ন ধাপে ধাপে এর উন্নতি শুরু হয় যা ১৯২৭ সাল পর্যন্ত চলে।যেমন ১৮৬০ সালে Napoleon III প্যারিসের পাশের এলাকাগুলোকে বাসিন্দাদের আপত্তি সত্বেও শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে শুরু করেন। Haussmannএর তত্বাবধানে পয়ঃ প্রনালীর আমূল পরিবর্তন সহ শহর জুড়ে প্ল্যনমাফিক রাস্তাঘাট নির্মানের কাজ শুরু হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এই শহরের বাড়িগুলো। একই রকম পাঁচ/ছয় তলা বাড়ি , যার নিচতলায় দোকান বা অফিস রুম। দোতলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত প্রত্যেকটা তলায় অজস্র ছোট ছোট ব্যলকনি ,কখনও বা টানা বারান্দা। প্রতি বাড়ির ছাদে আছে লেবার বা নীচু তলার কর্মচারীদের থাকার জন্য attic জাতীয় কিছু ঘর।যাই হোক, প্রথম দর্শনে সব মিলিয়ে শহরের সর্বত্র অতি আধুনিকতার বদলে এক প্রাচীন আভিজাত্যের ছাপ চোখে পড়ল।
এইসব দেখতে দেখতেই একসময় পৌঁছে গেলাম Orangerie Museum । Tuileries Garden এর পশ্চিম কোণে এই মিউজিয়াম। উঁচু একতলা বাড়ি, দুপাশে দুটো করে পাথরের পিলার। মাথার ওপর ত্রিভূজাকৃতি আর্চ। বাড়ির দুধারে বড় বড় কাঁচের জানলা।পাশে বয়ে চলেছে Seineনদী ।এই মিউজিয়ামে ইম্প্রেশনিস্ট আর পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট পেইন্টিংয়ের আর্টগ্যালারি আছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ক্লদ মনের আটটা বিশাল ওয়াটার লিলির ম্যুরাল। এই মিউজিয়ামের ইতিহাসটা একটু চোখ বুলিয়ে দেখে নেওয়া যেতে পারে। ১৮৫২ সালে Napoleon III এই Orangerie তৈরী করেছিলেন। কারন হিসেবে বলা হয় যে প্রবল শীতে সাইট্রাস গাছের চারা বাঁচানোর উদ্দেশ্যে Louvre মিউজিয়ামের একটা অংশ ব্যবহার করা হত, যার অনুমতি এক সময় আর ছিল না। ফলেএই Orangerie মিউজিয়ামেই গাছের চারা সংরক্ষন করা শুরু হয়েছিল। তবে ১৮৭০ সালে Napoleon III র সাম্রাজ্যের পতনের পর এই মিউজিয়ামে সঙ্গীত কনসার্ট ,শিল্প প্রদর্শনীর মতো পাবলিক ইভেন্টে ব্যবহার করা হত। এমনকি ১৯২২ সাল পর্যন্ত এখানে কুকুরের প্রদর্শনীও হত। যাইহোক, মিউজিয়ামের সামনে এসে দেখি বিরাট লাইন। এক ঘন্টা থেকে দেড় ঘন্টা তো লাগবেই ঢুকতে। এর মধ্যে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি, গাছের তলায় বলে কিছুটা রেহাই। হঠাৎ আমাদের নজরে পড়ল যে মূল ফটকের বাইরে রাস্তার ধারে রঁদার বিখ্যাত স্থাপত্য ‘The Kiss ‘ – যা আমাদের দেখার অপেক্ষায় । লাইনটা কোনমতে রেখে যতগুলো সম্ভব ছবি তোলা হল। দেখার খিদেটা গেল আরো বেড়ে। মিউজিয়ামে ঢুকে ঘন্টা দুয়েক আমরা এখানে পল সেজান, হেনরি ম্যতিস, পাবলো পিকাসোর মতো বহু শিল্পীর আঁকা ছবি দেখলাম। এবার এগোলাম ক্লদ মনের ওয়াটার লিলি দেখতে । একখন্ড ওয়াটার লিলির ছবি বাড়িতে শোভা পাচ্ছে বেশ কিছু বছর ধরে। আমার শ্যলকের উপহার। তাই স্বল্প ধারনা আছে এই ছবির ব্যাপারে। তা ছাড়া Impressionism(১৮৪০-১৯২৬) সম্বন্ধেও শুনি মাঝে মাঝে, যা এই মনে( Monet )র হাতেই সৃষ্টি। এ প্রসঙ্গে বলি যে এই ধরনের আঁকার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছোট দৃশ্যমান ব্রাশস্ট্রোক যা মেশানো রং আর প্রাকৃতিক আলোর ওপর জোর দেয়।যা দেখছি তাই আঁকা, কিন্তু হুবহু নয়। রং এর মাধ্যমে যেন এক কবিতা সৃষ্টি হয়।
মূল ফটক দিয়ে বেরোনোর সময় চোখে পড়ল “Place de la Concorrde “ যা ফ্রান্সের অন্যতম প্রধান পাবলিক স্কোয়ার। এর পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাসের ছোঁয়া। এই কনকর্ড স্কোয়ারটা মূলত ১৭৭২ সালে King Louis XV এর একটা অশ্বারোহী মূর্তি স্থাপনকে কেন্দ্র করে তৈরী হয়, যা ফরাসী বিপ্লবের সময় ভেঙ্গেঁ ফেলা হয়। এই স্কোয়ারের উত্তর দিকে ১৭৬০ সাল থেকে ১৭৭৫ সালের মধ্যে দুটো প্রসাদ ভবন তৈরী হয়, যার একটা বর্তমানে Hotel de la Marine।অপর প্রাসাদটা রাজকীয় সম্পত্তি হিসেবে রাখা আছে৷ ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের কেন্দ্রীয় স্থল ছিল এই Concorde Square।১৭৯২ সাল থেকে ১৭৯৫ সালের মধ্যে এখানে গিলোটিনের মাধ্যমে বহু মানুষের মৃত্যুদন্ড হয়। কাছে যেতেই ইতিহাসের সেই মর্মান্তিক অধ্যায় মনের পর্দায় ভেসে উঠল চোখের সামনে। সামনের চত্বরে চোখে পড়ল মিশরীয় ভাষায় লেখা এক স্তম্ভ। সব মিলিয়ে বেশ গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছিল। তবে আমার সুবিধে একদিকে আমার স্ত্রী ইতিহাসের অধ্যাপিকা অন্যদিকে অচ্যুত ইতিহাসে বেশ আগ্রহী , এছাড়া ও আমাদের লোকাল গাইডের ভূমিকাও নিয়েছে।সেই সুবাদে জানতে পারলাম যে স্তম্ভটার নাম Luxor Obelisk , মিশরের অটোমান সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ Mehmet Ali Pasha এখানকার রাজাকে ১৮৩৬ সালে উপহার দিয়েছিলেন। জানিনা সত্যি কিনা ; কারণ ইউরোপিয়ানরা তো অনেক কিছুই বিভিন্ন দেশ থেকে লুট করে নিয়ে এসেছিল এক সময়। সেই সময়ের ফ্রান্সের আটটা শহরের প্রতিনিধিদের মূর্তি রয়েছে স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে কালের সাক্ষী হয়ে। এছাড়াও দুটি সু্ন্দর ফোয়ারা চোখে পড়ল। সূর্যাস্তের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চতূর্দিকে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে Seine নদী। নদীর ওপর রয়েছে Concorde bridge। ওপারে পার্লামেন্ট ভবন।দূরে গাছের ফাঁকে সূর্যের শেষ আলোয় রাঙ্গা Eiffel Tower। নদীর ওপর বিভিন্ন সাজে সজ্জিত জলযানে পর্যটকদের উল্লাস।।ব্রীজ থেকে নেমে এসে নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।।ধারে ধারে ভাসমান রেঁস্তোয়াও রয়েছে বেশ কিছু।এই জায়গাটার নাম হল ‘Cours de la Reine’।এক অনিন্দ্য সুন্দর উদ্যান।এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিই। ১৬১৬ সালে ফরাসি রানীএই উদ্যানটা তৈরী করেন যার দুপাশে রাজকীয় গেট বসনো হয়। মধ্যে চারটে ভাগে বিভিন্ন গাছের সারি।পার্কে বসানো রয়েছে King Albert সহ বহু রাজা ও কবিদের মূর্তি যা সেই সময়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। বাগানটা অনেক পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়েছে ১৭২৩ সালে ,এছাড়া Seine নদীর ধারে পাঁচিলও তোলা হয়।চারশো বছরের পুরনো বাগান আজও নতুনের মত সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে। খুবই যত্নে লালিত এই উদ্যান। মনে আসলো হঠাৎ আমাদের কলকাতার ধর্মতলায় লর্ড কার্জন উদ্যানের কথা। নাঃ , এ সব ভেবে মন খারাপ না করাই ভালো। আসলে প্যারিস শহরের যে দিকেই তাকাই মনে হয় শিল্প ভাষ্কর্যের শেষ কথা। সৌন্দর্যের বোধের চূড়ান্ত নিদর্শন।বহমান স্রোতস্বিনী Seine নদীর ওপর মোট ৩৭টা ব্রীজ আছে , এরমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম Pont Alexandre (III ) মানে আলেকজান্ডার( ৩ ) ব্রীজে। বিশ্বমেলার উদ্যোগে এই ব্রীজ ১৮৯৬ সালে শুরু হয়ে ১৯০০ সালে শেষ হয়। এর মধ্যেই Unesco র World Heritage site এর সম্মান পেয়েছে। ব্রীজের ওপর যখন উঠলাম তখন শেষ সূর্যের আলোয় ব্রীজের সমস্ত মূর্তি রাঙা । কি যে অসাধারন তার সৌন্দর্য , ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। প্রায় সমস্ত মূর্তিই gold plated আর আলোর shade গুলো সবই cast iron এ তৈরী । ব্রীজের ওপর কিছুটা এগোতেই সমস্ত আলো জ্বলে উঠল। মুহূর্তে সাময়িক চেনা সেতু হয়ে উঠল আবার অচেনা। Seine নদীর জলে আলোর প্রতিফলন। একের পর এক ক্রজ , বেয়ে চলেছে Seine নদীতে। মোহময় এক অসাধারন দৃশ্য।ব্রীজ থেকে নেমে Seine নদীকে ডান দিকে রেখে এগিয়ে চললাম Eiffel Tower এর দিকে। মনে প্রবল উত্তেজনা । হঠাৎ চোখে পড়ল সেই আকাঙ্খিত সুউচ্চ Eiffel Tower যার আনুমানিক উচ্চতা হাজার ফুটের থেকে বেশী (প্রায় ৮১ তলা বাড়ির সমান )। গুগুল খুলে দেখে নিলাম এই টাওয়ার ১৮৮৭ সালে তৈরী হতে শুরু হয়েছিল যা ১৮৮৯ সালে শেষ হয়। উদ্দেশ্য ছিল ১৮৮৯ সালে প্যারিসে আয়োজিত বিশ্বমেলার গেট হিসেবে একে ব্যবহার করা। কিন্তু পরবর্তী সময় এই টাওয়ার সমগ্র পৃথিবীর এক বিষ্ময়কর স্থাপত্য হয়ে ওঠে। এখন তো World Heritage site হিসেবে স্বীকৃত। আমরা এই সুবিশাল Eiffel Tower এর তলায় না গিয়ে একটু দূরে গিয়ে বসলাম। এখান থেকে সম্পূর্ণ টাওয়ারটাই ভালোভাবে দেখা যায়। প্রতি সন্ধেবেলায় টাওয়ারটা সোনালি আলোয় ভরে যায় আর প্রতি ঘন্টায় পাঁচ মিনিটের জন্য সাদা আলোর জ্বলা নেভা দেখা যায়। সঙ্গে মাথার ওপর ঘুর্নায়মান সার্চ লাইট। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ যেন সব মানুষকে এক সুতোয় বেঁধে দিচ্ছিল। এক পশলা আনন্দে মনটা ভরে উঠল। কিন্তু তার মধ্যেই যখন দেখলাম চতুর্দিকে কিছু কালো মানুষ অর্থের প্রয়োজনে Eiffel Tower এর ছোটো ছোট মডেল বিক্রি করার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে , তখন উপলব্ধি হল যে সারা পৃথিবীই এই বিষয়ে একই সুরে বাঁধা। শুধুই খাতায় কলমে ধনী দরিদ্রের ব্যবধানের হিসেব। লন্ডনের মতো ধনী শহরেও রাতের অন্ধকারে গীর্জার গাড়িবারান্দাতে বা টিউবে ঢোকার মুখে ছাউনিতে বহুলোক গরম কোট পরে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেয়। যাইহোক সেদিনের মতো রাতের প্যারিসকে বিদায় জানিয়ে ঢুকে পড়লাম মেট্রোর গহ্বরে।প্রথমদিন পৌঁছেই প্যারিসের রুপ,রস,গন্ধের আস্বাদন যতটুকু করা সম্ভব তার পুরোটাই আমরা গ্রহণ করেছি বলেই মনে হল। ফিরে চললাম আামাদের আগে থেকেই বুক করা AirBNBর উদ্দেশ্যে। একটা ক্যাব নেওয়া হল। ঘন জনবসতী পূর্ণ এলাকায় গলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল আমাদের নিবাস। তবে শুরুতে একটা ছোট্ট বিপত্তি হচ্ছিল। চাবি তো পাওয়া গেল কিন্তু লক খুলছে না। পরে বুঝতে পারলাম যে আমাদের ঠেক হচ্ছে নীচ তলারই পরের ফ্ল্যটটা। One room flat,তবে drawing cum dinning space এ আছে Sofa cum bed, সুতরাং সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। খাবারের অর্ডার করলাম অন লাইনে।এখানেও সমস্যা।এরা চট করে নিজেদের ফ্রেন্চ ভাষার বাইরে কথা বলতে খুব একটা রাজী নয় । অচ্যুত অবশ্য কাজ চালিয়ে দিতে পাারে। এত ক্লান্ত ছিলাম সবাই, যে কথা বলতে বলতে সকলেরই চোখ বুঁজে এল। পরের দিন সকালে আমরা পৌঁছে গেলাম এ। ঢোকার মুখে লাইন, এগোচ্ছে খুবই ধীর গতিতে। দেড় ঘন্টা পর যখন গেটের মুখে পৌঁছলাম ,এয়ার পোর্টের মত ফুল চেকিং। শুরুতেই এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিলাম এই চ্যপেলের ইতিহাসে। চ্যপেলের চতুর্দিকে Louis IX রাজার বাসভূমি। King Louis VIII মারা যাবার পর তার ছেলে Louis IX মাত্র ১২ বছর বয়সে রাজা হয় আর জীবিত অবস্থাতেই নিজেকে Saint Louis হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ১২৩৯ সালে যীশুখ্রীস্টের কাঁটার মুকুট, ক্রশের কিছু অংশ, এরকম ২২টা অতীব মূল্যবান জিনিস সংগ্রহ করেন। Louise IX এই সম্পদগুলো ঠিকমত রক্ষনাবেক্ষণের জন্য ১২৪৮ সালে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করেন যার ওপরের তলায় এই সব সংগ্রহ রাখা হত আর নিচের তলায় কর্মচারীদের বাসগৃহ। ওপরতলায় এই চ্যপেলের সঙ্গে রাজার বাসগৃহের সরাসরি সেতুর মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। ফরাসি বিপ্লবের সময় বেশিরভাগ সংগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। শুধুমাত্র কাঁটার মুকুটটা (Crown of Thorns) রক্ষা পায় যা ২০০৩ সালে Notre Dame Cathedral কে রক্ষণাবেক্ষনের জন্য দেওয়া হয়। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে এই সৌধ আর ধর্মীয় উপাসনার জন্য ব্যবহার করা হয় না। এখন শুধুই এক দর্শনীয় স্থান। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে প্রথমেই নজরে পরল সুউচ্চ রঙীন কাঁচের জানলায় প্রায় পুরোটাই যীশুখ্রীষ্টের জীবনের নানান মুহূর্তের ছবি আঁকা আছে। দেয়াল বলতে অল্প কিছু অংশে স্বর্নের প্রলেপ এখনও নিষ্প্রভ হয় নি। হলঘরের একদম শেষে দেওয়ালের একটা অংশ বৃত্ত আকৃতির যা অসংখ্য Stained glass এ আবৃত। মধ্যে যীশুখ্রীষ্টের মূর্তি , অপরদিকের শেষে কারুকার্যমন্ডিত এক বেদি। ২০০৩ সাল পর্যন্ত এখানেই ক্রাইস্টের মাথারমুকুট ও অন্যান্য অনেক সম্পদ শোভা পেত। দিনের আলো রঙীন কাঁচ ভেদ করে সমস্ত চ্যাপেলের ভেতর যখন আলোকিত করছিল মন তখন চলে গিয়েছিল তেরো শতকের মাঝামাঝি। সেই সাথে মনে হচ্ছিল তখনকার মত এখনো শাসকের ইচ্ছায় আমাদের দেশেও কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে মন্দির তৈরির প্রচেষ্টায়। এই ধরনের দম্ভের প্রকাশ বোধহয় যুগ যুগ ধরেই রয়েছে। Sainte-Chapelle এর নীচ তলায় এখন বেশ কিছু উপহার সামগ্রীর দোকান। কিছুক্ষন এসব নাড়াচাড়া করে শুরু করলাম আমাদের পথচলা। কিছুটা এগিয়ে আবার চোখে পড়ল Seine নদী। সামনেই ব্রীজ। ব্রীজে উঠে নজরে আসলো পর্যটকে ভরা অজস্র জলযান , যার ছাদে কাঁচের আচ্ছাদন। নানান দেশের নানান মানুষ, ভিন্ন তাদের রুচি, কিন্তু এই একই দৃশ্য দেখে তাদের উচ্ছাসের কোন ফারাক হচ্ছে বলে মনে হল না । একটু এগোতেই দেখলাম পথের মধ্যে রয়েছে Saint-Michel ঝর্না। পর্যটকদের অবশ্য দেখার লিস্টে Saint-Michel আসে না, তবে হেঁটে যারা প্যারিস শহর ভ্রমন করে তারা Saint-Michel এর সঙ্গে যুদ্ধরত ডেভিলের ঝর্নাময় মূর্তি এক ঝলক দেখেই নেয়। দুপাশে রাস্তার মাঝে একটা বাড়ির সামনের অংশ জুড়ে এই স্থাপত্য যা ১৮৬০ সাল থেকে শহরের শোভা বর্ধন করছে। প্যারিস শহরকে Napoleon এর সময় নতুন করে যখন সুসজ্জিত করা হয়, তখনই এই স্থাপত্য তৈরী হয়। এখানে Saint-Michel এর যে ব্রোন্জ মূর্তি রয়েছে তা শান্তির প্রতীক। পিছনে রয়েছে লাল ,সবুজ ,নীল,হলুদ রঙের পাথর। Michel এর পায়ের কাছে রয়েছে শয়তানের প্রতিমূর্তি। নীচে দুপাশে ব্রোন্জের দুই ড্রাগনের মূর্তি, যাদের মুখ থেকে ঝর্ণার জল ফোয়ারার মত ছড়িয়ে পড়ছে। শোনা যায় যে প্রতিটা মূর্তিই আলাদা আলাদা শিল্পীর সৃষ্টি। এখানে একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করলাম যে পৃথিবীর নানান দেশের নানান সমস্যা এখানকার চত্বরে দাঁড়িয়ে লোকে প্রচার করছে।
বেশ খিদেও পেয়েছে আমাদের। কাছাকাছি একটা রেস্তোঁয়াতে ঢুকে অর্ডার দিতে গিয়ে দেখি কর্মচারীটি বাঙ্গালী মানে বাংলাদেশী। কর্ম সন্ধানে এখানে এসে রেস্তোঁয়ার কাজে ঢুকে পড়েছে। খাবার মোটামুটি। খেয়েদেয়ে রাস্তার উল্টোদিকে নূপুরের গলাঢাকার জন্য বেশ বড় সাইজের মাফলার কেনা হল। এবার হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম মধ্যযুগীয় Notre-Dame ক্যাথিড্রালের সামনে। ১১৩৬ সালে তৈরীর কাজ শুরু হয়ে ১২৬০ সালে শেষ হয়। কিন্তু প্রবেশ নিষেধ, চারদিক ঘেরা। কারন ২০১৯ সালে এক সাংঘাতিক আগুনে ক্যাথিড্রালের বেশ কিছুটা অংশ পুড়ে যায়। এর আগেও ফরাসি বিপ্লবের সময় ধর্মীয় বহু মূল্যবান সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। প্রতিবারই আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে।তবে এখনও কাঁটার মুকুট (Crown of Thrones) ,মূল ক্রশের অংশ ইত্যাদি যীশুখ্রীষ্টের অনেক স্মৃতি এখানে সংরক্ষিত আছে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ক্যাথিড্রালের সামনের অংশ দেখতে পাচ্ছিলাম। এখানেই Napoleon এর রাজ্য অভিষেক হয়েছিল। এছাড়া ফ্রান্সের বহু রাজাই এখানে সমাধিস্থ। বাইরে এই ২০১৯ সালে পুড়ে যাবার ছবি, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে পুরোনো অবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টার ছবিও সাজানো আছে। ২০২৪ সালের ৮ই ডিসেম্বর পুনরায় জনগনের জন্য খুলে দেওয়ার আশ্বাসবাণীও রয়েছে। ফ্রান্সের প্রতীক হিসেবে Eiffel Tower এর মত Notre-Dame ক্যাথিড্রাল কেও ধরা হয়। এত কাছে এসে না দেখার কষ্ট বুকে নিয়ে এগিয়ে চললাম পরবর্তী কিছু দেখার উদ্দেশ্যে।
পৌঁছে গেলাম এক জলাশয়ের ধারে । একদিকে Saint Mary চার্চ , অন্য দিকে Centre Pompidou । এই Pomidou সম্বন্ধে পরে বলছি। এখন এই জলাশয় ঘিরেই অবাক হবার পালা। মোট ১৬ টা স্ট্রাকচার আছে এই জলাশয়ের মধ্যে। বেশীর ভাগই ছোটদের মজার খেলনার মত , ফোয়ারার সঙ্গে কোনটার আবার যোগাযোগও আছে। এই স্থাপত্যগুলো ফ্রান্সের এক বিখ্যাত কবির লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৮৩ সালে তৈরী হয়। চোখে পড়ল লাল রঙের দুটো ঠোঁট , স্প্রিং দিয়ে সাপের ওঠানামা, আরো কত কি। পাশে এক পুরোনো বহুতল বাড়ির গায়ে রাশিয়া ইউক্রনের যুদ্ধের প্রতিবাদ চিত্র। এবার বলি ঐ Pompidou এর কথা। সামনে দাঁড়ানো মাত্র অবাক হলাম এই ভেবে যে এই ভবনের সঙ্গে প্যারিসের অন্য কোন ভবনের মিল নেই। ভবনটার প্রধান বৈশিষ্ট চোখে পড়ে এর বাইরের বিভিন্ন ধরনের নল সমূহ। শুনলাম জলের নলগুলো সবুজ, বিদ্যুতেরটা হলুদ, এ.সি.র টা নীল রঙের। ফরাসি রাষ্ট্রপতি Georges Pompidou এর নামে এই ভবনটা ১৯৭৭ সালে তৈরী হয়। এখানে একটা পাবলিক লাইব্রেরি আর একটা আর্ট মিউজিয়াম আছে। এছাড়া রয়েছে মিউজিক রিসার্চ সেন্টার। লোহার পাইপে ঘেরা এই ভবনটা দেখে ১৯৭৭ সালে বেশ প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বলে শোনা যায়। এখন অবশ্য এই সংগ্রহশালা দেখার জন্য বহুলোকের ভিড় হয়, তবে সময়ের অভাবে আমরা আর ভেতরে প্রবেশ করি নি। একটা ক্যাব নিয়ে আমরা এবার রওনা দিলাম ঐতিহাসিক সৌধ হিসেবে স্বীকৃত Sacre-Coeur Church and Basilica দেখার উদ্দেশ্যে।
পথে শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। বৃষ্টির ঝাপটায় পথের দুপাশের দৃশ্য ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই পাহাড়ে ওঠার অল্প কিছু স্বাদ পেলাম, কারন এই Basilica প্রায় ৬৫০ ফুট উঁচু Seine নদীর থেকে। গাড়ি থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে। ২০২২ সালে এই রোমান Basilica জাতীয় ঐতিহাসিক সৌধের সম্মান পেয়েছে। ১৮৭০ সালে Napoleon III এর পরাজয়ের পর এই Basilica তৈরীর পরিকল্পনা হয়, যা ১৯১৪ সালে শেষ হয়। ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জন-সাধারনের জন্য তা খুলে দেওয়া হয়। ভেতরে অন্যান্য অনেক চার্চের মতই রঙ্গীন কাঁচের অসাধারন কাজ। টিলার মাথায় হওয়ায় বহুদূর এই চার্চের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বৃষ্টি একটু কমার পর বাইরের চত্বর থেকে শহরের বেশির ভাগ অংশই দেখতে পাওয়া গেল। গাছের ফাঁক দিয়ে নজরে এলো Eiffel Tower এর চূড়া। এর মধ্যেই বেশ কিছু তালা-চাবি বিক্রেতা তালা কেনার জন্য অনুরোধ করতে শুরু করল। কারনটা মাথায় ঢুকছিল না। হঠাৎ চোখে পড়ল বাউন্ডারির রেলিংএর দিকে। নাম লেখা, লক করা অজস্র তালা সেখানে ঝুলছে।