অন্তর্দীপ্তি
Poems/কবিতা
চলমান বঙ্গ চালচিত্র ও কাতর প্রার্থনা
সোমনাথ সরকার
সে এক সোনালী দিন ছিল আমাদের বাংলার কপালে,
বিদ্যাবুদ্ধিতে ধর্মেকর্মে বাঙালি সেরা ছিল বিশ্বের খেয়ালে।
ছিল গোলাভরা ধান,পুকুরভরা মাছ,
গোয়ালভরা গোরু,ফুলেফলে ভরা গাছ।
ভবশঙ্করী,ভবানী,শিরোমণি,রাসমণি,-কত অনন্যা রাণী,
উজ্জ্বল করে রেখেছে আজও বাংলা মায়ের মুখখানি।
ছিল জয়দেব,চৈতন্য,রামপ্রসাদ,রামমোহন, বিদ্যাসাগর,
রামকৃষ্ণ,সারদামণি,বিবেকানন্দ,অরবিন্দ, আরও গুণীবর ।
কৃত্তিবাস, কাশীরামরা লেখে মহাকাব্য রামায়ণ, মহাভারত,
চণ্ডীদাস,বিদ্যাপতি,ভারতচন্দ্ররা গড়ে শুরুতে ভাষাসাহিত্য ইমারত।
ছিল বঙ্কিম,রবীন্দ্রনাথ, নজরুল,জীবনানন্দ, শরত,বিভূতিভূষণ,
বিজ্ঞানে জগদীশ,প্রফুল্ল,সত্যেন্দ্র,মেঘনাদ,প্রশান্ত কত মণিকাঞ্চন।
স্বনামধন্য ডাক্তার মহেন্দ্র গড়ে বিজ্ঞান গবেষণার প্রতিষ্ঠান,
বিজ্ঞানী রমণের কাজে ভারতে আসে নোবেল সম্মান।
ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল, বসন্ত,প্রদ্যোত, বিনয়,বাদল,দীনেশ,
সূর্য,প্রীতিলতা,- কত শহীদের রক্ত করেছে পরাধীনতার শেষ।
মাতঙ্গিনী,রাসবিহারী,বাঘা যতীন থেকে নেতাজী সুভাষ,
কত বাঙালির নেতৃত্বে লেখা হল রক্তে স্বাধীনতার ইতিহাস।
কত বাঙালির শেষ নিঃশ্বাস পড়েছে আন্দামানে সেলুলার জেলে,
গর্বে বুক ভরে যায় আজ বাঙালির গরিমা জেনে গেলে।
চিকিৎসায় উপেন্দ্র,রাধাগোবিন্দ কাদম্বিনী,নীলরতন প্রমুখ,
বিধানের যত্নে এল এই বাংলায় স্বাস্থ্য, সম্পদে বহু সুখ।
হাজী মহসিন,রোকেয়া,হেয়ার,-রাজা আর ঈশ্বরের সাথে,
ঢেলে দেয় প্রাণ শিক্ষায় চারিদিকে আলোক ছড়াতে।
উচ্চশিক্ষায় একাই একশ শিরোমণি নেতা আশুতোষ,
বাঙালির মেধার ভরে ভারতে বিদ্যার হল বজ্রনির্ঘোষ।
খালি পায়ে ফুটবল খেলে গোষ্ঠ পাল ইতিহাস গড়ে,
আনন্দের সাথে সবাই তাই বাংলার মহিমা পড়ে।
এই তো সেদিন সত্যজিত,ঋত্বিক চলচ্চিত্রে করল বিশ্বজয়,
অর্থনীতির নোবেলজয় করেছে কলকাতায় পড়া দুই বঙ্গতনয়।
কীর্তনে,গানে বাউলে এখনও বাংলা ভক্তিপ্রেমে জাগে নিত্য দিন,
লালন,রবীন্দ্র,দ্বিজেন্দ্র,নজরুল, অতুল,রজনীতে থাকে লীন।
সত্যেন্দ্র কবি গেয়ে গেছে বাঙালির বাংলার গৌরবগাথা,
সে সব কাহিনী মনে করে আজও চলে গর্বের মালা গাঁথা।
তারপর কখন রাজধানী কলকাতা থেকে গেল দিল্লীতে,
দেশ হল তিন ভাগ সাতচল্লিশে গভীর রাতে নিভৃতে।
কপাল পুড়তে শুরু করল কখন বুঝল না বাঙালি,
শিল্প,শিল্পপতি,কর্ম নেই,সে হচ্ছে হাভাতে কাঙালি!
লেখাপড়া,প্রতিযোগিতায় বাঙালিরা আজ পিছু হটে,
কেন্দ্রীয় উচ্চপদে কর্মসংস্থানে তার বড় বিপর্যয় ঘটে।
শান্তিনিকেতনে লেগে থাকে নানা অশান্তি গণ্ডগোল,
মহিলা চিকিৎসক খুনধর্ষণে আন্দোলনে নেই কোন হেলদোল।
এই তো সেদিন, টেস্ট টিউব বেবির জনক ডাক্তার সুভাষ,
রাজনীতির মারপ্যাঁচে আত্মঘাতে তার অবদানে এল সর্বনাশ।
আজকাল মনে হয় বাঙালি হয়েছে প্রতিবাদজীবি,
আন্দোলন,রাজনীতি সব যেন ঘিরে ধরা উঁইঢিবি।
নইলে কেন কিছু মূঢ় লোকজন বিদ্যাসাগরের অযথা মূর্তি ভাঙে,
কবে উত্তাল বাণ আসবে বিস্মৃতিপ্রবণ বাঙালির মরা গাঙে?
বেকার বাঙালির অর্থ নেই,ভিন দেশে,প্রদেশে পরিযায়ী,
কারা ফিরিয়ে ঘরে এনে দেবে তাকে শান্তি চিরস্থায়ী?
সাহিত্য, বিজ্ঞানে,শিল্পে লেগেছে তারকার ভারী আকাল,
পাঠকের থেকে লেখকের সংখ্যা বহুগুণ বেশী আজকাল।
পাঙ্গা নিতে,দাঙ্গা,হাঙ্গামায় আজ বাঙালি নাঙ্গা,
জানি না কে করবে বাংলা, বাঙালিকে চাঙ্গা?
বাঙালির ধর্ম,কর্ম, সংস্কৃতি ঠেকেছে এখন বিনোদনে,
তাই ব্যর্থ আজ সে মহাজীবনের অমূল্য রত্ন আবাহনে।
বাংলা টিভি সিরিয়াল কুকুরের ল্যাজ সোজা বাঁকা করে থামে না,
একই মশলায় হিন্দী চটুল গানের ভরসায় চলে খেলো বেচাকেনা।
খবরের দৌলতে দাদাগিরি,তোলাবাজি এখন জীবনের অঙ্গ,
কেমন রাজনীতির ফাঁসে দম আটকে মরে বাঙালির বঙ্গ।
দেখনদারি,দুনিয়াদারির রোগ ঢুকেছে তার মজ্জায়,
তবু ভাগ্য,কিছু সেবাসঙ্ঘ নীরবে থাকে জনসেবায়।
হায় নিবেদিতা,টেরেসা তোমরা করেছ প্রাণপাত এ দেশে,
শিখবে না কিছুই কি বাঙালি তোমাদের ভালবেসে?
বিদ্বজন অর্থলোলুপ,দলদাস হয়ে নেমে গেলে রসাতলে,
কে দেখাবে দিশা অমানিশা শেষে বাংলার মঙ্গলে?
কি করে পাব ফের অবন-গগন ঠাকুর যামিনী,নন্দলাল,
কারা আঁকবে বল বাঙালির ভবিষ্যতের রঙীন মশাল!
ও পারে,এ পারে রক্ত,অশ্রু ঝরে যায় অবিরত,
পদ্মা,ভাগীরথী বয় নানা ব্যথা নিয়ে নিজের মত।
অন্তঃসারশূন্য বাঙালির আজ ধরেছে বেজায় ভীম রতি,
ওগো চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, একবার এসে ফেরাও মতিগতি।
হাল জমানায় কেউ নেই যার ছবি টাঙাবে বাঙালি ঘরে,
ভাবুক বাঙালি,মানুষের মত মানুষ আজ সে পাবে কি করে?
সুভাষ,সুকান্ত,নজরুল,বিবেক,রবি,মধু ফের চেতনায় দাও আগুন,
বাঙালির ঘরে বাইরে আনো নানা গুণের রঙীন জীবন্ত ফাগুন।
ধনেমানে দেউলিয়া দশা বাঙালি ঠিক কাটাবে পরিশ্রমে,
অতীতের রোমন্থন করে সামনে এগোবে ফের পুরোদমে।
ও আমার জগতজননী,বাংলা আর বাঙালিকে কৃপা করো,
বঙ্গজননীর মুখে ফের একবার আশীর্বাদী আলো ধরো।