Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

প্রথম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা - বাঁচার অধিকার

Others/অন্যান্য

হিন্দি-চিনি – ভাই ভাই; আম জনতার সাথে তাই (ধারাবাহিক রচনার তৃতীয় পর্ব) 

তপন কুমার দাস


বিশ্বাস হয়নি, আজ কিন্তু মনে হয়, আমরা সবাই নিজের অজান্তেই আটকে গেছি তাদের তৈরী ও নির্ধারিত করে দেওয়া ছোট জগতে। সমস্ত দেশগুলোতে একই চিত্র। তরুণ প্রজন্ম পৃথিবীর সব দেশে, ঘাড় গুঁজে মাথা নিচু করে, ঐ ছোট্ট স্ক্রিনে আটকে। দেশের তরুণ সমাজ (চীনকে কিছুটা ব্যাতিক্রম মনে হল) দেশের কোন খবরই রাখে না। জাপানের মতো উন্নত দেশেও যুবকরা বলতে পারছে না কেন তাদের দেশে এতো জিনিসের দাম? কেনই বা তারা আমেরিকার সাথে চলেছে? হিরোশিমা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্ররাও এর উত্তর দিতে পারেনি। অন্যান্য দেশেও একই চিত্র। চীনের অভিমত, গুগলকে সামনে রেখে তার বিভিন্ন অ্যাপসকে ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে চলেছে আমেরিকা, তাই তারা গুগলকে ওখানে স্পেস না দিয়ে নিজস্ব এ্যাপ বাইডু-কে গড়ে তুলেছে। চীনের এই ভাবনা যে অবান্তর তা কিন্তু একেবারেই বলা যাবে না। কারণ, আমাদের তথ্য জানবার সূত্র কিন্তু আমেরিকার গুগল। ফোন জগতের মধ্যে দিয়ে অরাজনীতিকরণের যে হাওয়া যে দেশে দেশে শক্তিশালী হয়েছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

 
শুধু তাই নয়, ফোন ছাপ ফেলছে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কেও। দক্ষিণ কোরিয়ায় নজরে এল, একটি পার্কে দুই প্রেমিক-প্রেমিকা মুখোমুখি বসে, কিন্তু চোখ বা মুখের ভাষা, প্রেমের ভাষা হারিয়ে গেছে দু’জনেরই, কেউ কাউকে দেখছে না, দু’জনেরই নজর তাদের ফোনে। কাজেই সবটা নিয়েই ভাবার সময় এসেছে।

চীন সাইকেলে (১৭):- রাত দশটা পেরিয়ে গেছে, রাত্রিবাসের জায়গা খুঁজে নিতে হবে, ডাইনে-বাঁয়ে দেখতে দেখতে চলেছি। হঠাৎই নজরে এল থানা। ঢুকে পড়লাম। কি করবে জানি না, বলে দেখা যাক। কয়েকজন পুলিশ স্টাফ বসে। আমাকে দেখেই একটু নড়েচড়ে বসল। কি ব্যাপার, সবটা শুনে আমার সমাদর করল বটে, কিন্তু ভাষার কারণে কথা বেশি এগোতে চাইলেন না, অন্য এক অফিসারকে ডেকে আনলেন। এখানে উল্লেখ্য যে প্রতি থানায় ওদের একজন কম-বেশি ইংরেজি জানা স্টাফ থাকে (বেশিরভাগই তারা এই প্রজন্মের), আমি সেই অফিসারকে পুনরাবৃত্তি করে বললাম, আপনাদের ঐ বড় বড় হোটেলে থাকার মতো আমার যথেষ্ট পয়সা নেই, দঃ কোরিয়াতে আমি থানাগুলোতেই থাকতাম, এখানে কি আমি আপনাদের থানায় রাত কাটাতে পারি? অফিসার আমায় শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন, সরি, থানা হল অফিস, তাই এখানে আপনাকে থাকতে দেবার উপায় নেই। আমি বললাম, তাহলে অন্য কোন জায়গা? যেখানে আমি কম খরচে অথবা বিনে পয়সায় থাকতে পারি। অফিসার একটু ভেবে বললেন, আপনি একটি কাজ করুন, আপনি এক কিমি সামনে চলে যান, ব্রিজের ওপারে একটি হোটেল রয়েছে, ওখানে ওরা আপনায় ওদের সোফায় ফ্রিতে থাকতে দিতে পারে। অফিসারকে দিয়ে চীনা ভাষায় হোটেলের নামটি লিখে বেরিয়ে পড়লাম।


কিছুটা গিয়েই ব্রিজে ওঠার মুখে চার-পাঁচজনের জটলা দেখে ঠিকানাটা ঝালিয়ে নেব বলে দাঁড়ালাম। রাত প্রায় পৌনে এগারোটা, ব্রিজের গোড়ায় ছোট এক রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে-দেয়ে সব বাড়ি ফিরছে। কাগজে লেখা চিরকুটটা এগিয়ে দিতেই সব এবার আমায় নিয়ে পড়ল। আমার সাইকেলে লেখা আবেদন, আমি সাংহাই থেকে বেজিং সাইকেলে চলেছি বলে ওরা আপ্লুত হয়ে হৈ হৈ করে আরো লোক ডাকতে শুরু করল। যত লোক তত জিজ্ঞাসা, আমার আসল প্রশ্নই চাপা পড়ে যাচ্ছে দেখে আমি আবার হোটেলের পথটা জানতে চাইলাম। আমাকে সমস্বরে সবাই চেয়ারে বসিয়ে দিতেই ফুডস্টলের মহিলা আমায় খাবারের থালা ধরিয়ে দিল। ক্ষিদে যে খুব একটা পেয়েছিল তা নয়, কিন্তু ওদের খানিকটা খুশি করার জন্যই কষ্ট করে হলেও খেয়ে নিলাম। খাবার পরে আমার হাতে আপেল ধরিয়ে, ঠিকানা বুঝিয়ে তারপর বিদায় দিলে। বুঝে গেলাম, পথে আমার শুভানুধ্যায়ীর আর অভাব হবে না।
ব্রিজ তো পেরিয়ে চলে এলাম, বামপথেই গিয়ে ফাঁকা রাস্তা, তস্য ফাঁকা গলি ধরে এগোচ্ছি, ডাইনে-বাঁয়ে করতে করতে অনেক পরে আরেক নদীর পাড়ে এসে গেলাম। এক কোথায়, তিন চার কিমি চলে এলাম, ফোনের চার্জও গেছে, এবার কোন দিকে যাব তাও বুঝে উঠতে পারছি না। রাত ১২ টা, নদীর পাড়ে পাক খাচ্ছি, একটি জনপ্রাণী কেউ নেই যে জিজ্ঞেস করব। থানা একটি পেলাম বটে কিন্তু সেখানেও কেউ নেই। কর্পোরেশনের গাড়ি জল দিয়ে রাস্তা ধুতে ব্যস্ত, উত্তর দিতে নয়। হঠাৎই দেবপুত্রের মত হাজির হলেন দুই যুবক, খাওয়া-দাওয়া শেষে হাঁটতে বেরিয়েছিল তারা। এরাই শেষপর্যন্ত ওভার ব্রিজের ওপর সাইকেল তুলে দিয়ে আমার রাস্তা ধরিয়ে দিয়ে যায়। তারপরেও ওপারে ঘণ্টাখানেক অনেক পাক খেয়ে এক তরুণের হাত ধরে হোটেলটিতে পৌঁছলাম। 


দূর থেকেই বাইশতলা হোটেলটি দেখে ভাবছি, আরে পুলিশ অফিসার কি আমার সাথে ইয়ার্কি করল! এই বিরাট হোটেলে আমায় বিনে পয়সায় থাকতে দেবে? কাছে গিয়ে অবাক হলাম, আরে এ যে আমাদের সল্টলেক স্টেডিয়ামের গায়ের হায়াত রিজেন্সি! কিন্তু একই সাথে দুশ্চিন্তাও বাড়ল, এরা কলকাতায় কখনো বিনে পয়সায় থাকতে দিয়েছে বলে তো শুনিনি। এখানে কি আমায় এরা বিনে পয়সায় থাকতে দেবে? একটু ভেবে যা হবে দেখা যাবে বলে বাইরে দাড়ানো লিমুজিন গাড়ির পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে, পৌঁছে গেলাম রিসেপশন কাউন্টারে। রিসেপশনের যুবক-যুবতী সবটা না বুঝেই ‘নো রুম’ বলতে থাকল। আমি তখন ওদের আমার আসার কারণ বুঝিয়ে বললাম, দেখো তোমাদের রুম আমি চাই না, রুমে থাকার মতো অত পয়সাও নেই। আমার সাথে ম্যাট্রেস রয়েছে, তোমরা আমাকে একটা জায়গা দাও, যেখানে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারি। ওরা পড়ল মুশকিলে, আমার সমব্যথী হলেও কি করবে বুঝতে না পেরে ওদের জুনিয়র ম্যানেজারকে ডেকে পাঠাল। সে এসে আমার কথা শুনে দুশ্চিন্তায় পড়ল। বলল, দেখো তুমি কি আমাদের বিজনেসটা ডকে তুলবে? আমিও মনে মনে ভাবলাম, সত্যিই তো, এই বড় বড় গাড়ি আর তার বড় বড় মালিকদের মাঝে এরা আমায় জায়গাটা দেবেই বা কোথায়? কিন্তু ওরা চিন্তামগ্ন দেখে চুপ করে রইলাম। শেষে জুনিয়র ম্যানেজার বলল, দেখো তুমি গেষ্টদের বসার এই জায়গাটায় যদি বসে রাত কাটাতে পারো কাটাও, কিন্তু তোমার ঐ ম্যাট্রেস পেতে ঘুমোতে পারবে না। রাত শেষ হতে বাকি আর কয়েক ঘণ্টা, আমি রাজি হয়ে গেলাম। বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই, হঠাৎ দেখি, একজন এসে হম্বিতম্বি করছে, এই! ওঠো, ওঠো, চল চল। আমি চোখ মেলে দেখলাম, সিকিউরিটি গার্ড, আমায় বেরিয়ে আসতে বলছে। আমি বললাম, বাবা, তোমার রিসেপশনিস্টরা, তোমাদের বড় কর্তাই তো আমায় থাকতে বলল, তুমি আবার চলে যেতে বলছ কেন? কিন্তু কাকে বলব? ভাষা বুঝলে তো!
ওর চেচাঁমেচিতে বাধ্য হয়ে উঠলাম। ভাবলাম, দেখি ও কি বলতে চাইছে। রিসেপশন কাউন্টারে তাকিয়ে দেখলাম ফাঁকা। বাইরে আসতেই ও বলল, সাইকেল নাও। সেকি! ও কি সত্যি আমায় বার করে দিচ্ছে! এই শেষ রাতে আবার কোথায় আস্তানা খুঁজব? এবার বিরক্ত হয়ে বললাম, তুমি কোথায় যেতে বলছ? তোমার ম্যনেজারই তো থাকতে বলল। কিন্তু ও কোন কিছুই শুনতে নারাজ। বাধ্য হয়ে ওর পেছন পেছন সাইকেল নিয়ে এগোচ্ছি, মনে মনে ওকে গাল দিতে দিতে ভাবছি, এই অন্ধকার ভোরেই আজকের যাত্রা শুরু করব কি না। হঠাৎ ও দেখি হেঁকে বলল, এদিকে এস, সাইকেল রাখো। রাখলাম। তারপর বলল, এসো আমার পেছন পেছন। এগোলাম। ২২ তলা বিল্ডিং। এমার্জেন্সি সিঁড়ির তলায় একটি ছোট ঘর। আমায় নিয়ে পৌঁছে বলল, “এই নাও, এবার পাতো তোমার ম্যাট্রেস, শুয়ে পড় ওখানে”।
বুঝলাম, এটা ওর কাজের ফাঁকে বিশ্রামের জায়গা। বাইরের লোকের অজানা। বুঝলাম, সিকিউরিটিসুলভ হম্বিতম্বি থাকলেও মনটা আসলে ওর নরম। এই শীতের ভোরে যেন উষ্ণতার ছোঁয়া দিয়ে গেল। ভালোলাগায় মনটা ভরে উঠল। ঘুম আসছিল না, সাত-পাঁচ ভেবে চলেছি। হঠাৎ আওয়াজ পেয়ে বুঝলাম, ও আমার পাশে এসে শুয়ে পড়েছে। পরে কখন উঠে চলে গেছে আর টের পাইনি। ওর একটি ছবি নেওয়া দরকার ছিল, সেই সুযোগও পাইনি। অপরাধীই যেন মনে হচ্ছিল নিজেকে।

চীন সাইকেলে (১৮):- ঘুম ভাঙতে তৈরি হয়ে, হোটেলের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে নেমে রাস্তার অপর পাড়ে আসতেই নজরে এল একটি পার্ক, সামনে কমিউনিস্ট পার্টির অফিস। দাঁড়িয়ে মাও আর তার সম্মুখে রাখা মাও-এর উক্তি সংকলিত সেই বিখ্যাত ‘রেড বুক’, যা বিপ্লবোত্তর চীনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, হাজার হাজার বিপ্লবীর গীতা। গোটা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইগুলোর একটি। সামনে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে শরীরচর্চারত বয়স্ক মানুষেরা। এই কথা কিন্তু অস্বীকার করার নয় যে চীনে কমবয়সি ছেলেমেয়েদের শরীরচর্চায় কমই দেখেছি। সেই তুলনায় বয়স্করাই বেশি। আমিও ওদের সাথে শরীরটাকে একটু ঝরঝরে করে নিলাম। ওটা আমার অভ্যাসের অঙ্গ। না হলে শরীর সঙ্গ দেবে না।
শহর থেকে বেরোতে হবে। কালকের পথ পূরণ করতে হবে। কাজেই প্যাডেলে চাপ পড়ল। সাড়ে আটটা, অফিস যাত্রীদের ভীড় বাইরে চলছে সমান তালে। রাতে হোটেলেই চার্জ দেওয়া ফোনে আমার গন্তব্য স্থির করে দিতে ‘অ্যা ম্যাপ’ আমায় নিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে চলল। কাল রাতের ব্রিজ পেরোতেই নিচে পার্কের ছবিটা আমায় টেনে ধরল। এখানে সন্ধ্যার পর মল কিংবা পার্কে সুন্দর সুন্দর গান চালিয়ে মহিলাদের নাচের আসর চলে। কিন্তু এ দেখছি সকালবেলাই নারী পুরুষ জোড়ায় জোড়ায়। সম্ভবত শরীরচর্চাও এই ছলে। নিচে নামার সময় নেই, ওপর থেকেই ছবি তুলে এগোতে থাকি। শহর ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসবো কি! দেশটার বুঝি সবই শহর, একের পর এক এসেই যাচ্ছে। তবে আজ থেকে বুঝি আমার সঙ্গী হলো ওদের শিল্প জগত, ইন্ডাস্ট্রি। নদীগুলোকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করেছে। আসব আমি পরে সে কথায়। তার পরেই জেটি, জলপথে পণ্য আনাগোনা। থামলে চলবে না, সমুখের আহ্বানে একে একে ওদের পাশে রেখে এগিয়ে চলতে চলতে বিকেলবেলা এসে পৌঁছলাম Changzhou।


বড় শহর, গাড়িঘোড়ার ভীড়, সবাই যেন ছুটছে। গতিময় জীবন। শুধু পথের ধারে পড়ন্ত বেলায় রোদ গায়ে মেখে আড্ডায় রত আশি উর্ধ্ব মানুষ জন। শহরের প্রাণকেন্দ্রে সামনে সুউচ্চ অট্টালিকা, কোনদিকে যাব, আর এগোব কি না ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে পড়ি। ডাইনে দাঁড়িয়ে বিশাল স্টেডিয়াম, বাঁয়ে বিরাট বিরাট বিল্ডিংগুলো যেন ওদের প্রযুক্তিবিদ্যাকে সদর্পে জানান দিয়ে চলেছে। সত্যি কথা বলতে কি যেমন ওদের স্থাপত্য, তেমনি ওদের প্রযুক্তি।

 সমস্ত বাড়ি-ঘর, অফিস, স্টেডিয়াম কিংবা ব্রিজ এতটাই ইস্পাতের শক্ত বাঁধুনিতে মজবুত আর চওড়া যে আমার আনাড়ি চোখও বলে দেয় যে আগামী পাঁচশ’ বছরেও ঐ স্থাপত্যে বন্যা, ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনো আঁচড় লাগাতে পারবে না। আর আমাদের দেশ, বিশেষ করে বাংলায় রোজই শুনি ব্রিজ ভেঙ্গে যায়! আমার চাকদা বাজার থেকে ইটখোলা পথে কিংবা চেতলার সেই দীর্ঘকাল পড়ে থাকার পর, সদ্য কাজ শুরু হওয়া সুউচ্চ বিল্ডিং-এর সরু সরু পিলার যখন দেখি, তখন আতঙ্ক হয়। দেখি আর ভাবি, পিলার ভেঙ্গে পাশের বসতিতে না পড়ে! 


এটাই বোধ হয় একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাথে পুঁজিবাদী মালিকি রাষ্ট্রের তফাৎ। আমাদের দেশে লাভের অঙ্ক আর লোভই আমাদের প্রোমোটার ও কন্ট্রাক্টর কূলকে পরিচালিত করে। মানুষের জীবনের মূল্য সেখানে কম। আর এদেশে লাভ নয়, মানুষই সব। 


যাই হোক বা আর রাত করব না বলে এই শহরেই আজকের যাত্রার ইতি টানলাম, খুঁজে-পেতে গোটা সত্তর টাকায় একটি হোটেলও পেয়ে গেলাম।

 

চীন সাইকেলে (১৯) :- Changzhou ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। আজকের লক্ষ্য বায়োইং-এর পথে ১০০ কিমি দূরের একটি শহর। হোটেল ছেড়ে বেড়িয়ে বামমুখী মোড় ঘুরতেই চমকিত হলাম। গোটা চারেক মহিলা, বাইক নিয়ে বসে, ফোন ঘাঁটতে ব্যস্ত। বুঝলাম, এরা women Rapido. গোটা দুনিয়ায় বেকার ছেলেমেয়েদের একটি অংশ উপার্জনের জন্য বাইক নিয়ে যাত্রী বহনের কাজে যুক্ত। ভারতে এই কলকাতায় শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন। আমাদের এই কাজ নেই-এর দেশে, এটি জীবিকা হিসেবে খারাপ নয়। অনেক যুবকরা, যাদের বাইক ঘরেই পড়ে থাকে, তারাও এই কাজে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাদের মাঝে-মধ্যেই পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আমাদের দেশে সরকার মানে ‘ভাত দেবার নাম নেই, কিল মারার গোঁসাই’। সরকার এদের লাইসেন্স দিয়ে ট্যাক্স কিছু নিতেই পারে, যাতে এরা নির্ঝঞ্ঝাটে গাড়ি চালাতে পারে, তার সুযোগ দেওয়া উচিত। যাই হোক, আমাদের এখানে মেয়েদের কিন্তু এই কাজে যুক্ত হতে দেখিনি। চীনের মহিলারা সেইদিক থেকে এগিয়েই। ভালো লাগলো ওদের এই বাঁধন ভাঙ্গার পণ দেখে।
বেলা দশটা। কিছুটা এগোতেই শিশুর কলরব, সুরেলা গলায় ভেসে আসা গান পেছনে টেনে ধরল। এদেশের স্কুলগুলো আমাদের মতোই। ওরা প্রথমে প্রার্থনা ও পরে সবাই মিলে মর্নিং পি.টি.-তে অংশ নেয়। গানের তালে প্রায় হাজার ছেলেমেয়ে যে নাচ নেচে চলেছে, তা আদতে শরীরচর্চাই। ভালো লাগলো, অনেকের কাছে শরীরচর্চার মতো বিরক্তিকর বিষয়টিকে আনন্দদায়ক করে উপস্থাপন করার কৌশল দেখে। এদেশে মহিলারাও সন্ধ্যায় তাদের সমবেত নাচের মধ্যে দিয়ে কার্যত আনন্দ নেবার সাথে সাথে শরীরটাকে ফিট রাখার চেষ্টা করে।
হাইওয়ে থেকে এগিয়ে চলেছি, পথপাশে তখন মাঝেমধ্যেই কারখানার সারি, বহুজাতিক কোম্পানি, হুন্ডাইরাও জায়গা নিয়েছে এখানে। কারখানা গেটে দেখা হল অফিসার থেকে শ্রমিক কর্মচারী সকলের সাথে। কথাও কিছু হল। জিজ্ঞেস করছিলাম কাজের সময়। উত্তর এল, আট ঘন্টা, সপ্তাহে দু’দিন ছুটি, শনি আর রবি।


আমাদের দেশের মানুষ বোধহয় এটা এখন আর সম্ভব বলে ভাবতে পারি না।
গোটাকয়েক খাল-বিল ও এক নদী পেরিয়ে ইচ্ছে করেই হাইওয়ে ছেড়ে গ্রাম্য পথে ঢুকে পড়লাম। রাস্তা এখানে তুলনামূলকভাবে অপ্রশস্ত, কিন্তু একটি বাস যাবার বা গোটা কয়েক গাড়ি পাশাপাশি যাবার মতো করেই তৈরি। এই প্রথম কাছে এল ধানক্ষেত, টালির বাড়ি, পুকুরের মাছ। টালির বাড়ি মানে এটা ভাবার কারণ নেই যে, তারা গরীব মানুষ। এদেশে এটা এদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অঙ্গ। একতলা কিংবা দোতলা, টালির চাল থাকবেই। টালিগুলো লাল সুরকি রঙ, কিন্তু সিমেন্টের ঢালাই ছাঁচে তৈরি।

চীন সাইকেলে ( ২০) :- প্রায় ত্রিশ কিমি চলবার পর পথ আমায় পৌছে দিল আবার হাইওয়েতে। দুপুরের খাবার শেষ করে আনমনে পথ চলছিলাম, হঠাৎ হাইওয়ে থেকে সামান্য ভেতরে পথের ধারে হাট বসেছে দেখে থমকে দাঁড়ালাম। প্রায় এক মাইল লম্বা সারি সারি তাঁবু ফেলা। হরেকরকম মনিহারী দ্রব্যে সাজানো। কি নেই সেখানে? সব রয়েছে। পথ দেখানোর জন্য ফোনটাকে সাইকেলে ধরে রাখবেন যিনি, তাঁকেও অবশেষে পেলাম এই হাটের মাঝে। দেখছিলাম রাইস কুকার, জ্যাকেট আরো অনেক কিছু। তারই মাঝে ছুটে এলো দোকানি। চারপাশে মানুষজনও এসে ভীড় করল। দূষণমুক্ত পৃথিবী আর সম্প্রীতির বাণী নিয়ে বেজিং চলেছি শুনে খুব খুশি, কেউ এগিয়ে এল আপেল হাতে কেউ বা টাকা হাতে। এক দোকানি খুব কম দামেই আমার সাইকেলে ফোনটাকে ফিট করে দিল। যেন আমি তাদের পাড়ার লোক, চলেছি বিদেশ বিভুঁইয়ে। ভালো লাগল এদেশের মানুষের আপন করে নেবার মানসিকতা দেখে। খুব ইচ্ছে করছিল এদের সাথে একটা রাত কাটিয়ে যাই। এক রাত একসাথে কাটালে মানুষকে আরো গভীরভাবে চেনা যায়। কিন্তু রবিকিরণ তখন আলতো হেলে পশ্চিমে। আমায় যেন ইশারায় জানান দিচ্ছে, চলো চলো, অনেক পথ পড়ে আছে এখনো। ব্যাথাতুর মনে ওদের বিদায় জানিয়ে এগোতে শুরু করলাম।
পড়ন্ত আলোর রেখা, ছবি তোলার জন্য দু’-এক মিনিট না দাঁড়িয়ে পারি না। কিন্তু বেশি সময় দেবার উপায় নেই।

সন্ধ্যায় পথ এসে ফুরিয়ে গেল বিশাল এক জেটি ঘাটে। বিরাট ভেসেল দাঁড়িয়ে। সার দিয়ে উঠছে ছোট-বড় ট্রাক,গাড়ি। সাইকেল কি নেবে, এগোব কি না ভাবছি, হঠাৎ আরেক সাইকেল আরোহীকে দেখে ভরসা পেলাম। সাইকেল যাত্রী, তাই টিকিটও লাগল না। সাইকেল তুলে দিয়ে, ভেসেলের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। বিকট হর্ন দিয়ে জল কেটে এগোতে লাগল আমাদের যান। দূরে ওপারে ক্ষীণ আলোর বিন্দু, ওপারের জেটি। নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় ওপারে দাঁড়ানো দায়। মিনিট ২৫ পর ভেসেল ভিড়ল এপারে। সন্ধ্যা সাতটা, সবাই গাড়ি ধরার তাড়নায় ছুটছুট। আমার সে তাড়া নেই বটে, কিন্তু রাস্তাও কম পড়ে নেই। ফোন আমার দেহ রেখেছে অনেকক্ষণ। নেমে কোনদিকে যাব তাও বুঝে উঠতে পারছি না। শেষে স্থানীয় একজন চার মাথার মোড়ে পথ ধরিয়ে দিলে। এখনো প্রায় ৩০ কিমি। পথ এখানে কিছুটা সরু হয়ে গেছে, গাড়ির ভীড় নেই, কিন্তু পথও অন্ধকার। কোনরকমে হাতড়াতে হাতড়াতে অন্ধকারে গ্রাম-গঞ্জ পেরিয়ে এক আলোর জগতে পৌঁছলাম। বড় মল, অনেক মহিলার সমবেত নৃত্য চলছে। আমাকে দেখেই মানুষের ভীড়, অনেকে অনেক কথা বলতে চায়, কিন্তু ভাষার কারণে সব কথা বলাও হয় না, শোনাও যায় না। এবারে সত্যি সত্যি অনুভব করলাম, গুগল ট্রানশ্লেট নেই তো কি হয়েছে, অন্য এখানকার অ্যাপস্ লোড করে নিতে হবে। ভাবতে ভাবতেই একজন চেঁচিয়ে তাঁর স্ত্রীকে হাঁকডাক করে বললেন, এস এস দেখবে এস। সেই ভদ্রলোক, ট্রেনে দেখা হয়েছিল, ভুলে গেছ তুমি? আমি তাকিয়েই অবাক, আমার স্মৃতি গুলিয়ে গেলেও ওনারা ভোলেননি। আমায় দেখেই চিনে নিয়েছেন। পুরনো বন্ধুকে পাবার মতো করে আমায় জড়িয়ে ধরলেন। আমাকে বললেন, থেকে যাও এ শহরে। কিন্তু উপায় নেই। আরো পনেরো কিমি পথ পেরিয়ে, বিরাট গোলকধাঁধার এক্সপ্রেসওয়ে গলে, হাইওয়ে দিয়ে যখন বায়োয়িং শহরে ঢুকলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে ন’টা।
শহরে ঢুকে হোটেল খুঁজে পাওয়া, তার ওপর কম পয়সায়, সে এক ধাঁধার ব্যাপার। এর থেকে পথ চলা সহজ। এপাশ-ওপাশ বড় পার্ক সব চক্কর কাটতে কাটতে এসে এক পেট্রল পাম্পে হাজির হলাম। ফিলিপাইন, কিংবা জাপানে বেশির ভাগ রাতই আমার কেটেছে পেট্রল পাম্পগুলোতে। কারণ, পেট্রল পাম্প ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। কিন্তু এখানে খোলা থাকলেও রাতে কেউ থাকে না। নিরাপত্তার কারণে রাত্রে থাকাও তেল কোম্পানিগুলো অ্যালাউ করে না। তাও দেখি, এরা কি বলে, বলে ঢুকে পড়লাম। জনাদুয়েক মহিলা আর একজন তাদের ইনচার্জ ভদ্রলোক এই মুহূর্তে পেট্রল পাম্প এবং একইসাথে থাকা মলটি চালাচ্ছেন। আমার আসার কারণ বলতেই বলে উঠলেন, পরে শুনব আপনার কথা। নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে। আগে খেয়ে নিন। বলে রাতের খাবার হাতে ধরিয়ে দিল। গরম নুডলস, খেতেও ঝামেলা। একটু ঠান্ডা হতে সময় লাগে, ওদের দোকান বন্ধ করার সময় হয়ে আসছে, তাও তাঁরা ধৈর্য্য ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করলেন। খাওয়া শেষ হলে, আমার হাতের সামনে রুমালটা নেই দেখে আস্ত একটি সুন্দর নতুন টাওয়েল আমার হাতে তুলে দিলেন। ইনচার্জ ভদ্রলোক বললেন, কোম্পানি পাম্পে রাতে থাকার অনুমতি দেয় না। আমরাও দশটায় বাড়ি চলে যাব। তাই আপনার এখানে থাকার উপায় নেই। চলুন, আপনাকে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করে দিই। বলে ভদ্রলোক নিজেই প্রায় দু’কিমি পথ আমার সাথে গিয়ে মাত্র ত্রিশ টাকায় হোম স্টে-তে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। টাকাও নিজেই দিয়ে দিলেন। মানবিক এই মুখগুলোই বোধহয় আমার একাকী চলার পথে মনের জোর। ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁকে বিদায় দিলাম।

 

চীন সাইকেলে (২১) :- গেস্ট হাউসের মাঝখানে প্রশস্ত হলঘর-কাম-ডাইনিং রুম। বাঁ দিকে কোণে ওদের কোন দেবতার প্রতিমূর্তি, ছোট করে আলোক মালায় সজ্জিত। মালকিন পরিপাটি করে পেতে দিলেন বিছানা, সাইকেল সযত্নে ঢুকিয়ে নিলেন সিঁড়ি ঘরে। জামাকাপড় কেচে দিতে ভদ্রমহিলার নিজেই সেগুলো নিয়ে গিয়ে মেলে দিলেন। স্নান সেরে বিছানায় পড়তেই একঘুমে সকাল। ভোরের আলো না ফুটতেই, তাদের ঠুং-ঠাং কাজের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আপনা হতে। এখানে সাড়ে ছ’টা-সাতটা না বাজলে সকাল হয় না। আটটা না বাজতেই সেজেগুজে স্বামী-স্ত্রী আমাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তাঁদের কর্মস্থলে। ছেলেও বাইরে অপেক্ষা করছেন বাইক নিয়ে, বউমাও রেডি হচ্ছেন বেরোবেন বলে। আমি আর খালি বাড়ি পাহারা দেবার দায়িত্ব নিই কেন? আমিও বেরিয়ে পড়লাম। শহর ছেড়ে বেরিয়ে আসছি, দোতলা-তিনতলা বাড়ি, সামনে প্রায় সবার বাড়িতেই সবজির চাষ। ছবি তুলব বলে দাঁড়িয়েছিলাম, লেন্সের সামনে এসে দাঁড়াল এক যুবক। জিজ্ঞেস করলাম, নাম? উত্তর এল, ওয়ান। জীবিকা? কম্পিউটার সফ্টওয়্যারের ছোট ব্যবসা। গোটা কয়েক যুবক-যুবতী কাজ করেন সেখানে। বেতন তাদের হাজার পাঁচেক। ভারতীয় টাকায় পঞ্চান্ন হাজার। বললাম, বাড়ির জমি কি তোমাদের সরকার দিয়েছে? বলল, হ্যাঁ, আপনাদের থেকে আমাদের সিস্টেম আলাদা, জমি কেনা যায় সত্তর বছরের জন্য লিজে। বললাম, বেকার ছেলে-মেয়ে আছে? এখানে কাজ কর্ম সবাই পায়? বলল, তা পায়। বলেই তার জিজ্ঞাসা, তুমি এত কিছু জানতে চাইছ কেন? তোমার কি কাজের দরকার? হেসে ফেললাম আমি। বললাম, না আমার দেশে তো লক্ষ কোটি বেকার, তোমাদের অবস্থাটা কি, জানবার জন্যই এই প্রশ্ন। কথা হচ্ছিল আরো অনেক কিছু নিয়েই। কিন্তু সাইকেলের দোকান চাই আমার, সিটটা বড্ড ভোগাচ্ছে। কোথায় পাব, জিজ্ঞেস করতেই তার উত্তর, কেন সিটের জন্য? চলো আমার বাড়িতে নতুন একটি সিট পড়ে আছে, তোমায় দিয়ে দিই।

বলে নতুন দামি সিট একটা হাতে ধরিয়ে দিল। সত্যি বলতে কি, এরপর আমার আর সাইকেল নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়নি। যাই হোক, ওরও অফিস খোলার তাড়া রয়েছে, আমারও পথ চলার। দু’জন দু’জনকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
কাল সন্ধ্যায় ইয়াংজি নদীর সুবিশাল জলধারা পেরিয়ে এসে পৌঁছেছিলাম ইয়ানজো শহরে। আজ পথের ধারে মাঝে-মধ্যেই অনেক ভেড়ি। অনেক খাল তো গোটা দেশের পথে পথেই। প্রতি ১৫-২০ কিমি অন্তরই আপনি ওদের দেখা পাবেন। প্রথমে আমি ওদের নদী বলেই ভুল করতাম। পরে মনে হল নদীতো আকা বাকা হবে, এরা একদম সোজা, কোন বাঁকের চিহ্ন নেই। কিন্তু খাল, এতো খাল কেন? মনে পড়ে গেল, বিপ্লবের আগে ক্ষুধার্ত এই দেশে শতকোটি বুভুক্ষু জনতার কাছে খাদ্যের জোগান দেওয়াকেই প্রথম কাজ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এদেশের কমিউনিস্টরা। বিপ্লবের পরে-পরেই মাও-এর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সরকার দেশের সমস্ত জমি ভূস্বামীদের হাত থেকে নিয়ে, গরীব কৃষকের মাঝে বণ্টন করে। পরে কৃষকদের হাত থেকে তা কমিউনে আসে। নতুন চাষি প্রাণের আনন্দে চাষের মাঠে, কিন্তু জল ছাড়া চাষ হবে কি করে? নদী থেকে দূরের জমি জল পাবে কি করে? নতুন বিপ্লবী সরকার লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে নিয়ে শুরু করে গণ-উদ্যোগের এক ইতিহাস। লাখো লাখো মানুষ কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে নিজের নিজের এলাকায় খাল খননে নেমে পড়ে। ভগীরথ হয়ে তারা টেনে নিয়ে চলে নদীর জলধারাকে নিজ নিজ এলাকায়, নিজেদের চাষের মাঠে। তার একটি ধারা যেমন চাষের মাঠকে সিঞ্চিত করে তোলে, ফসলে ফসলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে মাঠ, তেমনি আরেকটি ধারাকে তারা নিয়ে চলে মাছের ভেড়িতে। নিচু জায়গা, জলাভূমিতে তারা গড়ে তুলেছে অসংখ্য মাছের ভেড়ি। শুধু লক্ষ লক্ষ লোকের জীবিকার ব্যবস্থা হয়নি, মানুষের মাছে-ভাতে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা শুধু হয়নি, মৎস চাষে দেশটা আজ পৃথিবীর মধ্যে সেরা জায়গায়। বাজারে বাজারে তারই প্রতিচ্ছবি আমি দেখেছি।

 
আজ সারাদিনই পথ করে নিলাম সবুজ আর সোনালি সমারোহে। চাষের মাঠ, সোনালি ধানের বিচ্ছুরিত রং গায়ে মেখে এগিয়ে চললাম। কখনো বড় রাস্তা কখনো বা ছোট, এভাবেই এগিয়ে চলতে চলতে বিকেল-বিকেল এসে পৌঁছলাম বায়োয়িং শহর ছাড়িয়ে হুইয়ান শহরে।

 

চীন সাইকেলে (২২) :-হুইয়ান চীনের ঐতিহাসিক শহরগুলোর মধ্যে একটি। ঢুকতেই বড় বড় করে চীন সরকারের লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্যগুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। খিদে পেয়েছিল অনেকক্ষণ, দুপুরের খাওয়ার সুযোগ হয়নি। ডাইনে-বাঁয়ে দোকান খুঁজতে খুঁজতে চলেছি। হঠাৎই মাল্টিপ্লেক্স দেখতে পেয়ে থেমে গেলাম। শপিংমল রয়েছে, টেন্ট যদি মিলে যায়! ওদের পরোটা আর সাথে টক দই-জাতীয় স্যুপ কষ্ট করেই গিলতে হচ্ছিল। আমার উল্টোদিকে চেয়ারে বসা শিশুর তো ঐ খাবারে ঘোরতর অনিচ্ছা। বেচারা অনশনে বসে শেষে ঘুমিয়েই পড়ল।
আমি খাবার পাট চুকিয়ে ওর হাতে একটি চিটবাদাম ধরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। না, টেন্ট এখানেও পাওয়া গেল না। ফোন অবসরে চলে যাওয়ায়, ঐতিহাসিক স্থানেরও হদিশ মিলছিল না। খুঁজে পেলাম তার এক কিমি পরের রাস্তায়। স্থানীয় মানুষের সহায়তায় ঠোক্কর খেতে খেতে হাজির হলাম শহরের ইতিহাস বিজড়িত অংশে। কিন্তু সন্ধ্যায় তা আগেই ডুবে গেছে অন্ধকারে। আফশোস হচ্ছিল, এত কাছে এসেও ইতিহাস দূরে চলে যাওয়ায়। মূল শহরের পানে রওনা হয়েছি। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো ট্রামগাড়ি ঐতিহ্যবাহী জায়গার দর্শন সেরে যাত্রী নিয়ে ফিরে চলেছে। আমিও তার পিছু নিলাম।


ঘণ্টাখানেক বাদে হুইয়ান শহরে প্রবেশ করলাম। শুরুতেই বিরাট মল ও তার সামনে মহিলাদের নিত্য বিরাট নৃত্য অনুষ্ঠান শহরের আভিজাত্যের পরিচয় জানান দিয়ে চলেছে। শহর বড়, ঐতিহাসিক স্থান আর হোটেল কম খরচে হবে, তা হয় না। বিরাট দরদাম বলে দিল, আরো এগিয়ে চল। ফোনে ইউথ হস্টেলের ঠিকানা পেলাম বটে! কিন্তু তা শহরের শেষ প্রান্তে। খুঁজে পেলে হয়! 


চলতে চলতে নদী-ব্রিজ পেরিয়ে, কি মনে হল হোটেল ভেবে এক অফিসে ঢুকে পড়লাম। দুই ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা বসে। বললাম, আমি দূষণমুক্তির আবেদন নিয়ে বেরিয়েছি পৃথিবী পরিক্রমায়। আমি কি তোমাদের সাথে রাত কাটাতে পারি? শুনে ভদ্রলোক খানিকটা অবাক হয়ে বলল, দেখো, এটা তো আমাদের অফিস। এখানে আমরা স্বামী-স্ত্রী আর আরেকজন কোনরকমে থাকি, তোমাকে থাকতে দিই কোথায়? বরং সামনেই একটা হোটেল রয়েছে। ওখানে গেলে একশ’টা টাকাতেই তুমি ঘর পেয়ে যাবে। বললাম, তোমাদের হোটেল ভাড়া অনেকটাই বেশি বাপু, আমার কাছে অত টাকা নেই। ভদ্রলোক কেমন যেন ছটফট করতে লাগলেন। স্বামী-স্ত্রীতে নিজেদের মধ্যে কি কথাবার্তা বলে চলে গেল পাশের দোকানে। তখন অবধি কি হয়েছে, আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম, ওনার শরীরের ভেতর কোনো একটা অস্বস্তি হচ্ছে। প্রেশার বেড়ে গেলে কিংবা স্ট্রোক হবার আগে যেমন হয়। উনি পাশের দোকানে গিয়ে সেই ভদ্রলোককে ওদের ভাষায় কি যেন বলছিলেন। আমি ভাবলাম, হয়তো ঐ দোকানেই আমার থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে। ওদের কথার ফাঁকে, আমি তখন দোকানের ভেতরে দেখে থাকবার জায়গা কতটা, তা বুঝে নিচ্ছি। ভদ্রলোক আবার পাশের দোকানে নিয়ে গেলেন, কিন্তু ওখানে গিয়ে আমি অবাক। ভদ্রলোক আমাকে দেখিয়ে দোকানি ভদ্রমহিলাকে বলছেন, “ওনার হাতে যথেষ্ট টাকা নেই। আমি ওনাকে দু’শো টাকা দিতে চাইছি, কিন্তু আমার পকেটে ক্যাশ টাকা নেই। তোমায় আমি ফোনে পেমেন্ট করে দিচ্ছি, তুমি আমায় দু’শ টাকা দাও”। এতক্ষণে আমি ওনার এতক্ষণের ছটফটানির কারণ অনুভব করলাম। বুঝলাম, ওনার হাতে ঐ মুহূর্তে টাকা নেই। কিভাবে উনি আমাকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করবেন, এই ভেবে অস্থির হচ্ছিলেন! ধন্য হে, বসুন্ধরা! এমন মানুষেরা আছে বলেই পৃথিবীটা আজো সুন্দর! কি ভাবছিলাম, হঠাৎ আমার হাতে একটি হাত, মুঠোয় দু’শো টাকা গুঁজে বলল, ওই টাকাটা রাখুন আপনি। এটা দিয়ে আপনার হোটেল ভাড়া হয়ে যাবে। আমার মনটা কেমন ভারি হয়ে এল। নিজেকে কেমন খাটো লাগছিল। বললাম, দেখুন, আমি টাকা চাইনি। আমার যা আছে, তাতে আমার চলে যাবে। থাকার একটা জায়গা চেয়েছিলাম। ভদ্রলোক আমার হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলল, আপনি এটা রাখুন। পথে আপনার কাজে লাগবে। ওনার ঐ করুণ মুখখানি দেখে, মুহূর্তে আমার মনে পড়ে গেল ইন্দোনেশিয়ার সেই বুড়িমার কথা। ডাব বেচে যার সংসার চলে। দিনের সামান্য আমায় তুলে দিচ্ছে দেখে, তার টাকা আমি নেব না বলায়, মুহূর্তে মুখখানি পাংশুটে হয়ে গিয়েছিল। পরে নিজেরই তার 

জন্য অনুশোচনাও হয়েছিল। আজ আর তার পুনারাবৃত্তি চাইলাম না।
যাই হোক, ওখান থেকে মন খারাপ নিয়ে বেরিয়ে, সেদিন ঐ হোটেলটি খুজে না পেলেও শহরের শেষ প্রান্তে কিন্তু রাত এগারটায়, চল্লিশ টাকার হোটেলে অনেক আরামেই রাত কাটিয়েছিলাম। ভদ্রলোকের দেওয়া টাকায় আমার আরো চার রাত হোটেলে থাকার সুযোগ হয়েছিল।

চীন সাইকেলে (২৩) :- হুইয়ান শহরে স্থানীয় দোকানদার মহিলারাই হোটেল খুঁজে দিয়েছিলেন। রাতে মালিক ভদ্রলোক খুবই আপ্যায়ন করেছিলেন। ঐ রাতে তিনি তার গাছের ফল আমাকে খাইয়েই ছাড়বেন। পরদিন সকালে কিন্তু তিনি ছিলেন না, ছিলেন তাঁর স্ত্রী। আমি আগেই বলেছি, এদেশের মহিলারাও দেশ, গোটা পৃথিবীর অনেক খবর রাখেন। বেরিয়ে আসব, হঠাৎ করে কথার ফাঁকে ভদ্রমহিলা আমায় প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা তোমরা ভারতীয়রা কি যুদ্ধ চাও?” আমি অবাক চোখে তাকালাম। সাধারণ একজন মহিলা, তার মুখে অনেক বড় প্রশ্ন, অনেক গভীরতার ছাপ। কিন্তু প্রশ্নটা বড্ড কঠিন ঠেকল আমার কাছে। এর আগে এদেশে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি। আজকের ভারত সরকারের নীতিতে এককথায় আমরা শান্তির পূজারী, একথা বলার উপায় নেই। আবার আমরা যুদ্ধ চাই, একথাও বলা যায় না। বললাম, দেখো, যে কোন দেশের সাধারণ মানুষ যেমন যুদ্ধ চায় না, তেমনি সাধারণ ভারতবাসীও যুদ্ধ চায় না। কারণ, যুদ্ধে মূল ক্ষতি সাধারণ জনতার। কিন্তু যুদ্ধ করব, না শান্তির পথে চলব, সেটা সব দেশের সরকারের নীতি ও পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশেও তাই। তবে সাধারণভাবে ভারতবাসী শান্তির পক্ষে। মহিলা বলে উঠলেন “আমরাও তাই, কিন্তু এই বিবাদ কি এড়ানো যায় না?” বললাম, আমি এবং আমার মতো অনেকেই মনে করে আলাপ-আলোচনাই সমস্যা সমাধানের পথ খুলে দিতে পারে। আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধ কারো জন্যই নিরাপদ নয়। বরং যুদ্ধ হোক বেঁচে থাকার জন্য। সরকার সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিক আমাদের জীবনযুদ্ধে। 


বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবছিলাম, হঠাৎ মহিলা এই প্রশ্ন করলেন কেন? দেশের খবর অনেক দিন আমার কাছে নেই। তাহলে কি রণসজ্জা শুরু করে দিয়েছে ভারত সরকার? পরে হোয়াটসঅ্যাপ-এর বন্ধুদের কারো কারো লেখা পড়ে বুঝলাম, পশ্চিম সীমান্তে সরকারের সেনা জড়ো করার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে এদেশের একজন সাধারণ মহিলাকেও। পৃথিবীর অন্য দেশগুলো এবং বিশ্ববাসী আমাদের পদক্ষেপকে কিভাবে নিচ্ছে, সেই দিকেও বোধহয় সরকারের হিসেব রাখা প্রয়োজন। 


হোটেল ছাড়িয়ে রাস্তার এপারে আসতেই এই প্রথম সাইকেলের একটি দোকান নজরে এল। ওয়ানের দেওয়া সিটখানি লাগাতে হবে, সাইকেলের ক্যামেরা আমার ব্যাগে ব্যাগে ঘুরছে, লাগানোর জায়গা পাচ্ছিলাম না। আরো টুকিটাকি কাজ।
সাইকেল দোকানদার ভদ্রলোক দেখেই বেরিয়ে এলেন, সাথে তাঁর বন্ধু। দু’জনে মিলে অনেক কসরত আর যত্ন নিয়ে আমার সাইকেলটাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দিল। না তার জন্য কোন পয়সা তাঁরা নিতে রাজি হলেন না। ওনাদের সাথে ছবি নিয়ে আবার পথমুখী হলাম। চলতে চলতে মনে হল, বাঃ এবার আর সাইকেলে কোন অসুবিধা নেই, শহর ছেড়ে বেরোতে হবে দ্রুত, তাই গতি বাড়িয়ে দিলাম।


আজও এবেলা ও বেলায় গ্রাম চীনই পথে পড়ল বেশি। নদী-নালা, চাষের মাঠ সরিয়ে রেখে আবার পৌছে গেলাম আরেক শহরের দ্বারপ্রান্তে। মাঝে চোকে পড়ল অনেক কৃষক। আলাপ করব বলে দাঁড়িয়ে গেলাম অন্নদাতার কাছে। বললাম, আমি ভারত থেকে আসছি, কথা বলার মতো সময় আছে আপনার? বলল, হ্যা, কেন নয়? বলুন। বললাম, আপনার নাম? উত্তর দিলেন, জিয়াং। আপনার ফসল? নিজের জমি? বললেন হ্যাঁ। জমি কি সরকার থেকে দিয়েছে? বললেন, হ্যাঁ, সরকার থেকে দিয়েছে। ফসল থেকে আয় কেমন? লাভ হয়? সংসার চলে? কে কে আছেন? প্রশ্নটা যেন তার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। এবার যেন আরো ঘনিষ্ঠ হলেন। সস্নেহে উত্তর দিলেন, বাড়িতে দু’মেয়ে, এক ছেলে। ছেলে ছোট। সবাই পড়াশোনা করে। ওনার একার আয়েই সংসার। গড়ে মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার আয় (ভারতীয় টাকায় ৪০-৫০ হাজার)। মোটামুটি চলে যায়। সুখী আপনারা? কোন অভিযোগ আছে সরকারের বিরুদ্ধে? বললেন, না, কোন অভিযোগ নেই, আমরা খুশি। তবু কেন জানি মনে হল, আরো একটু বেশি আয় হলে বোধহয় আরেকটু স্বচ্ছন্দে থাকতে পারতেন।

 

চীন সাইকেলে (২৪) :- দূষণ রোধে চীন :- ভরদুপুর। শহরে ঢুকতেই থমকে গেলাম, কি ব্যাপার! বিরাট আকারের গাছকে ক্রেনে করে বয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে কেন? কয়েক সেকেন্ডেই ব্যাপারটা মালুম হল, চমকিতও হলাম বটে। গাছ কাটা যখন অনেক দেশেই জলভাত, ইচ্ছে হলেই প্রশাসন কিংবা জনতা গাছ কেটে ফেলেন, এদেশে সেখানে কনস্ট্রাকশনের কারণে কোন একটি জায়গা থেকে গাছকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এভাবেই অন্যত্র। 


সত্যি কথা বলতে কি এই দেশটায় এখন সরকারের সবচেয়ে প্রধান কর্মসূচিই হল বনসৃজন, গাছ লাগানো। আসার আগে অপর্না আমায় খবরটা দিলেও তাকে হৃদয়ঙ্গম করিনি। এখানে এসে তা প্রতিদিন মালুম হচ্ছে।

 
চীন শুধু আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে, এই পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা কমিয়ে আনার বিষয়ে, ফ্রান্স কিংবা ভারতকে পাশে নিয়ে নেতৃত্বের ভূমিকা দিচ্ছে তা নয়, নিজ দেশে বায়ূদূষণকে কমিয়ে আনতে, চার চাকার কিছু গাড়ি বাদ দিলে, সমস্ত যানবাহনকেই ব্যাটারি চালিত বা বিদ্যুৎচালিত গাড়িতে পরিণত করেছে। ট্রামের মত বাসের মাথায়ও টিকি ঝুলছে। বাস ডিপোতে ব্যাটারি চার্জ দিয়ে বেরিয়ে পড়ছে বড় বড় এসি বাস। দু’চাকা, তিন চাকার যত গাড়ি সবই ব্যাটারিতে। সমস্ত পেট্রল পাম্পেই রয়েছে গাড়ি চার্জ দেবার ব্যবস্থা। সাংহাই থেকে বেজিং ১৮০০ কিমি আমার সাইকেল পথে মাত্র তিনটি পেট্রল বাইক নজরে পড়েছে। ধুলো বালি থেকে দেশটাকে দূরে রাখার জন্য প্রতিদিন রাতে সমস্ত রাস্তা ধুইয়ে দেওয়া হয়। দেশজুড়ে গড়ে উঠছে অসংখ্য হাইরাইজ বিল্ডিং, চলছে অসংখ্য কনস্ট্রাকশনের কাজ, কিন্তু সমস্ত জায়গাগুলোই সবুজ চাঁদোয়ায় ঢাকা। রাস্তার ধারে ধুলো ওড়া মাটিও কোথাও কোথাও সবুজ কাপড়ে ঢাকা।

 
দেশটাকে গাছে গাছে ঢেকে দেবার জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ চলছে। চলতে চলতে একদিন দেখলাম, হঠাৎ একটি কর্পোরেশনের লরি এসে থামতেই কর্পোরেশনের কর্মীরা একদল লাফিয়ে নেমে পড়ল, রাস্তার মাঝ বরাবর ডিভাইডারে পরপর গর্ত খুঁড়তে লেগে গেল। আরেক দল ছুটে ছুটে গাছ নামিয়ে আনছে, আরেকদল মাটি চাপা দিচ্ছে, আরেক দল পুঁতে দেওয়া গাছে জল দিতে লেগে গেল। একশত গাছ লাগানোর সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগল মাত্র ৪৫ মিনিটের মতো। তার ফাঁকে আমার অনুরোধে কয়েক মিনিট কাজ বন্ধ রেখে আমার সাথে ছবিও তুলে নিলেন। এরকমই যুদ্ধের গতিতে গাছ লাগিয়ে চলছে তারা। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন নিয়ম করে গাছে জল দেওয়া, তাকে ঠেকনা দিয়ে সোজা করে দেওয়াও হচ্ছে। 

চলছিলাম সাইকেল পথ দিয়ে, হঠাৎ গাছের গোড়ার দিকে নজর যেতে দেখলাম, বড় পাইপের মুখ গাছের গোড়ায় হাঁ করে রয়েছে। ব্যাপারটা কি? ভাবতে ভাবতেই ব্যাটারি বাইক থেকে নেমে এল কর্পোরেশনের এক মহিলা কর্মী। পথের ধারে গাছের আড়ালে থাকা পাইপলাইন থেকে হোসপাইপে করে জল ঢালতে লাগলেন গাছের গোড়ার ঐ পাইপে, বুঝলাম ঐ বড় বড় গাছেরও শেকড়ে প্রতিদিন এভাবেই জল পৌঁছে দেন তাঁরা। আর আমরা গাছ একটু বড় হলে আর নজর দিই না।
এক দুপুরে চলতে চলতে হঠাৎ ওপর থেকে ঝিরঝির বৃষ্টি নেমে গায়ে। আমি অবাক, আরে আকাশ রোদ ঝলমলে, মেঘ নেই, অথচ বৃষ্টি! আকাশ পানের তাকিয়ে আমি হাঁ হয়ে গেলাম, রাস্তার ধারে বড় বড় মোটা মোটা লাইটপোষ্ট। তার ভেতর দিয়ে উঠে গেছে কর্পোরেশনের জলের লাইন। ঝাঁঝরি মুখের ঐ পাইপ থেকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জল বেরিয়ে ঝিরিঝিরি করে ভিজিয়ে দিয়ে চলেছে গাছের পাতা। ধুলোবালি মুক্ত হয়ে তারা যেন ফিরে পাচ্ছে নতুন জীবন, নতুন প্রাণের স্পন্দন।


হ্যাঁ, এভাবেই গাছেদের নিয়ে মহাকাব্য লিখে চলছেন তাঁরা। বিজ্ঞাপন নয়, বাস্তবে ইতিমধ্যে এত গাছ তাঁরা লাগিয়ে ফেলছেন যে, পথগুলোর দু’ধার এবং সাইকেল পথগুলো সবই গাছের ছায়ায় ঢাকা। এতটাই ছায়া যে সকালে-বিকেলে সাইকেল চালাতে রীতিমতো শীত লাগত আমার। রেললাইনের ধার ধরে সাইকেল চালিয়েছি কয়েকদিন। কিন্তু ইচ্ছে করলেও পাশ দিয়ে যাওয়া বুলেট ট্রেনের ছবি তুলতে পারতাম না, কারণ রেললাইনের ধারগুলোও সব গাছের বেড়ায় ঢাকা।

চলতে চলতে আমার মনে হয়েছে, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম কিংবা দক্ষিণ কোরিয়াও পরিবেশ রক্ষায় অনেকটা এগিয়ে। কিন্তু বনসৃজন ও বৃক্ষরোপনের জন্য গোটা পৃথিবীতে কোন দেশকে যদি এই মুহূর্তে পুরস্কার দিতে হয়, তা কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে চীনেরই প্রাপ্য। যাই হোক, গাছের গল্প এখন থাক, পথ ঠেলে এগোতে থাকি শহরের দিকে।

চীন সাইকেলে (২৫) :- গাছের গল্প পেছনে ফেলে নতুন বই-এর পাতায় পাতায় চোখ রেখে এগোতে থাকি। এখানে শহর শুধু শহর নয়, উন্নয়নের রহস্যকে আত্মস্থ করার জায়গাও বটে। আগেই বলেছিলাম, এরা শিক্ষা সিলেবাস, বিষয়বস্তুকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম উপবিভাগে নিয়ে গেছে। শহরের শেষ প্রান্তে স্বাগত জানাল অনেকটা জায়গা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আকারে দাঁড়িয়ে থাকা টেকনোলজি ডেভলপমেন্ট কলেজ। ক্লাসের টাইম, দৌড়ে দৌড়ে শেষ মুহূর্তে কিছু ছেলে-মেয়ে ঢুকছে। সিকিউরিটি অফিসার এগিয়ে এসে স্বাগত জানালেন আমায়। ছবি তুলে নিলেন, ছবি তুললেন আমার সাথেও।
চলতে চলতে একসময় শহর পেছনে চলে যায়, ফুটে ওঠে গ্রামজীবনের ছবি। আগেই বলেছি, এখানকার খাল বিল, ভেড়ির গল্পের কথা। ক্ষিদে পেয়েছিল অনেকক্ষণ। এরকমই এক বড় ভেড়ির পাশে বসে পড়ি। খাবার খেয়ে, পাঁউরুটির টুকরোগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে মাছেদের কাছে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করি। ও বাবা, মুহূর্তে মাছেদের জনসভা শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ তারপর তারা আমায় মুখ ঘুরিয়ে রক্তচক্ষু দেখিয়ে বিদায় নিলেন। ভাবখানা এমন, তোমায় নিচে পেলে দেখে নিতাম। বুঝলাম, আমার মতোই ওদের হাল, বিদেশি খানা ওদের না পসন্দ। মিছিমিছি ওদের ডাকায় ওরা বিরক্ত আমার ওপর। 


চলো চলো চলো, তাড়া মারতে থাকে সময়। বাধ্য হয়ে বেরিয়ে পড়ি। বেলা গড়িয়ে আসছে, মাইলের পর মাইল ধানক্ষেত, মাঝে-মধ্যে অতি বয়স্কদের রাস্তার মোড়ে আড্ডা, সবই দেখতে দেখতে চলেছি। বেলা পড়ে আসছে, হালকা আলোর ছোঁয়া সামনের গ্রামখানির ওপরে। কি মনে হল, ঢুকে পড়লাম গ্রামের বাড়িগুলোতে। প্রতি বাড়ির সামনে সবজি বাগান, ফুলের গাছ, আর একটি করে ছোট হাতির ছোট সংস্করণ ব্যাটারি গাড়ি দাঁড়িয়ে। দিনের শেষে কাজ সেরে মহিলাদের আড্ডা বসেছে। চলছে সুখ-দুঃখের গল্প। ঠাকুমাকে ঘিরে নাতনীরা। কথা বলতে চাইলাম, কিন্তু বিদেশী বলে বাচ্চাগুলো ভয়ে কাছে ভিড়তে চাইলনা। আওয়াজ শুনে পাশের বাড়ির ছেলেটি বেরিয়ে এল। বাচ্চাগুলো এবার সাহস করে কাছে এল। ফাইভ-সিক্সে পড়ে ওরা। যুবকটির সাথে দু’-একটা সুখ-দুঃখের কথা বলে বেরিয়ে এলাম।


সন্ধ্যার পর রাত সাড়ে আটটা নাগাদ পৌঁছলাম সুকিয়ান। হোটেলের মালকিন ভদ্রমহিলা তেতো হলেও শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশ টাকাতেই হোটেলে জায়গা মিলল। রাত হয়ে আসছে, সামনের বাজারটায় খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। শেষ বেলার বাজার, অনেকেই হাঁকডাকে ব্যস্ত, অবশ্যই মাইকে। এখানকার বাজারগুলোতে ফুটের প্রায় দোকানেই ছোট হ্যান্ড মাইক। তাতেই হাঁক ডাকে, আমাদের এখানে ফুটের দোকানদারদের মতো মুখে রক্ত তুলে লোক ডাকতে হয় না। যন্ত্রের যুগ, যন্ত্রের পূর্ণমাত্রায় সদ্ব্যবহার রয়েছে এখানে। একজন মহিলা আবার মাইক হাতে হাকডাক নয়, রীতিমতো নাচগান করে লোক জড়ো করছে। হাসির সাথে দুঃখও লাগল। পৃথিবীটা সত্যিই এক নাট্যশালা। বাঁচার জন্য, পেটের ভাত যোগাড়ের জন্য মানুষকে কত কাণ্ডকারখানাই না করতে হচ্ছে! অবশ্য এও বুঝলাম মহিলা একই সাথে শীত তাড়ানোর ব্যবস্থাও করে ফেলছেন।

খুঁজতে খুঁজতে ফুটের দোকানে রুটি বানানো দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। রুটি শুধু নয়, ভেতরে কাঁচা কাঁচা শাক ভরে রুটির রোল। খানদুয়েক অর্ডার দিয়ে ভদ্রমহিলার সাথে গল্প জুড়লাম, আস্তে আস্তে আরো লোক জমা হয়ে গেল। সবাই আমার নাড়িনক্ষত্র জানতে চায়। চলতে থাকে আমায় নিয়ে চর্চাও। দুটো রুটি গলাঃধকরণ করে ফিরব, ভদ্রমহিলার অনুভূতিপ্রবণ মন তখন আমায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। পরম স্নেহে জিজ্ঞাসা, “তোমার এই দুটো রুটিতেই রাত কেটে যাবে? তুমি স্যুপ চাওমিন খাবে না? এই খেয়ে তোমার চলবে? তোমার কি পয়সা নেই? বল তাহলে, পয়সা লাগবে না। আরো দু’-একটা রুটি তুমি খেয়ে নাও। কি করে বোঝাই ওদের এই বড় মোটা মোটা রুটি আমার পক্ষে যথেষ্ট! ওদিকে আমায় ঘিরে কৌতুহলী জনতাও তখন আমার জন্য কিছু করার জন্য উদ্গ্রীব, নিজেরা সেই শলাপরামর্শ শুরু করে দিয়েছে। আমি অনেক কষ্টে তাদের সম্বরণ করে বললাম, তোমরা আমার জন্য চিন্তা কর না, আমরা ভারতীয়রা তোমাদের মত বাটি ভর্তি অনেক খাবার খেতে পারি না। আর আমি? আমি সাধারণত রাতে অল্পই খাই। ভারতীয় রুটি পেয়েছি, এতেই আমি খুশি। হোটেলে ফিরতে ফিরতে ভাবছি, কে বলে আমি একা ? গোটা পৃথিবীটাই আমার সাথে সাথে চলছে।

সাইকেলে চীন (২৬) :-সুকিয়ান ছেড়ে বেড়িয়ে পরেছি ন’টাতেই। শহর ছাড়িয়ে আজ গ্রামমুখী পথ। গ্রামের পথ, ডাইনে কাশফুল, বাঁয়ে ছোট-ছোট বিল বেয়ে হাঁসের দল জলকেলিতে ব্যস্ত। পৌঁছতে হবে জুঝু (Zuzhu)। ছবির মতো কখনো শহর, কখনো গ্রাম এই করে এগিয়ে চলেছি। ইচ্ছে করেই হাইওয়ে ছেড়ে কখনো স্টেট হাইওয়ে বা কখনো গ্রামের রাস্তায় চলেছি, সবটাই বুঝে নেবার দরকার আছে। বিকেলে পেরিয়ে রাতে এসে পৌঁছলাম জুঝু শহরে। ব্রিজ, ওভারব্রিজ পেরিয়ে যখন শহরে ঢুকলাম তখন রাত আটটা বাজে। কম পয়সায় বা বিনে পয়সায় কোথায় থাকা যায় জিজ্ঞেস করতেই বলল, নদীর ওপারেই শহরের মূল কেন্দ্র, আপনি পেছনে ফেলে এসেছেন, এখানে একটি নেভাল কোয়ার্টার রয়েছে। ওদের সোসাইটিতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, আপনি ওখানে চলে যান। আবার চার কিমি পেছনে যাব?

একটু ভেবেই সোসাইটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সোসাইটি পেলেও তার কোন কর্মকর্তাকে হদিশ করতে পারলাম না। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসছি, হঠাৎই এক যুবককে পেয়ে গেলাম। তাকে আমার আসার কারণ বলতেই দু’মিনিট ভেবে নিল। তারপর আমায় নিয়ে হাজির হল সামনের থানায়, তার বন্ধুর কাছে। থানায় আমায় বসিয়ে দু’জনেই আলোচনারত। মাঝে-মাঝে অন্য স্টাফরা আমার ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। শেষে তারা আমায় জানাল, যেতে হবে পরের থানা। আমি একটু বিমর্ষ মুখে বললাম, আবার অন্য থানায়? কত দূরে? কাছাকাছি কম দামে কোন হোটেল নেই? আমার আগের বন্ধু জানাল, বেশি দূরে নয় চার কিমি, আমি তোমায় ড্রাইভ করে নিয়ে যাব। আমি ভাবলাম ও বোধহয় সাইকেল চালাবে, আমায় পেছনে বসতে হবে! আমাকে ওখানে বসিয়েই কিছুক্ষণ পরে আস্ত একটি লিমোজিন গাড়ি নিয়ে হাজির, ওর নিজস্ব। বলল, “নাও, সাইকেলটাকে তোল গাড়ির মধ্যে”। আমি বললাম, তোমরা এগোও, আমি পেছন পেছন যাচ্ছি।

‘না, না, তুমি তোল, তুমি সারাদিন সাইকেল চালিয়েছ, তুমি ক্লান্ত’। বলে নিজেই তার পুলিশ বন্ধুকে সাথে নিয়ে সাইকেলটাকে গাড়ির পেছনে তুলে দিলে। মিনিট কুড়ি পরে শহর পেরিয়ে আমারা পরবর্তী থানায় পৌঁছলাম। তারা আমাদের পাশ্ববর্তী একটি হোটেলে পাঠাল। ও বাবাঃ, এও যে বিশতলা হোটেল, এখানে কি জায়গা হবে? ভাবতে ভাবতেই হোটেলের এক যুবক জুনিয়র ম্যানেজার নিচে নেমে এল, কিছু শোনার আগেই বলল, চলো, আমার সাথে। ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে আমার পুরনো বন্ধুরা। রাত তখন বারোটা, ও আগে ওর সাইকেলে, ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে ওর পিছু নিয়েছি। কোথায় যাচ্ছি, জানি না। ভাবলাম, কি জানি, ওর বোধ হয় নিজস্ব কোয়ার্টার রয়েছে, তাতেই থাকতে হবে। ও বাবাঃ আবার আরেকটা থানা! আজ রাতটা কি থানায় থানায় কেটে যাবে? আনমনে ভাবতে ভাবতেই ওদের কথা শুনে বুঝলাম, বিদেশি কেউ এলে থানায় রেজিষ্ট্রেশন করিয়ে নিতে হয়। তারই অনুমোদন করিয়ে নিতে বেচারা এই রাতে আমার সাথে থানায় চলে এল। যাই হোক, থানার অনুমোদন তো হল, কিন্তু আমার বেবাক হবার পালা তারপরে। হোটেলে ফিরে, ও মিষ্টি করে আমায় জিজ্ঞেস করল, আপনার কোন রুমটা পছন্দ? আমাদের রুম সব তিনশ’ টাকা থেকে শুরু। আমি তখন হাঁ! হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছি না। বললাম, বুঝলাম, ও আমায় ধনী ট্যুরিস্ট ঠাউরেছে। বললাম, দেখো, আমি তো রুমের জন্য আসিনি, আমার অত পয়সাও নেই, তুমি আমায় কোথাও রাত কাটানোর একটা জায়গা করে দাও। এই ঠান্ডার রাতে, আমার জন্য এই পরিশ্রম শেষে, যদি কলকাতার কোন হোটেল ব্যবসায়ী আমার এই কথা শুনত, তবে কি বলতো সেটা আমি জানি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, ওর মধ্যে কোন বড় প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। একটু ভেবে নিয়ে বলল, আচ্ছা, তুমি এক কাজ কর, আমাদের কফি হাউসের এই সোফাটায় তুমি রাত কাটাতে পারবে? আমি বললাম, কেন নয়? দিব্যি পারব। বলল, খেয়েছ কিছু? অত রাতে আর দোকান কোথায়? বললাম, খাবার আমার সাথেই আছে। সেই রাতে আমার সাথে থাকা কেক খেয়েই নিদ্রা গেলাম। ভোররাতে ও নিজেও এসে আমার পাশে আরেকটি সোফায় শুয়ে পড়ল। সকালে পাশে ওদেরই একটি বড় রেস্টুরেন্টে, ওরই আনা ফ্রায়েড রাইস খেয়ে বিদায় নিলাম। যাবার আগে ওর একটি আই কার্ড দিয়ে আমায় বলল, শোন, পথে যদি অসুবিধায় পড়, তবে পুলিশকে আমার কার্ডটা দেখিয়ে সাহায্য চাইবে, তোমায় ওরা হেল্প করবে। আর কোথাও যদি থাকার জায়গা না পাও, তবে মনে রাখবে হোটেলের সোফায় তুমি বিনে পয়সাতেই জায়গা পেয়ে যাবে, আমাদের দেশে সেই ব্যবস্থা রয়েছে। বুঝলাম, সেই পুলিশ অফিসার মিছে কথা বলেনি। ভালো লাগল, দেশটা ধনীদের পাশাপাশি কপর্দকহীনদের কথাও ভোলেনি।