প্রথম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা - বাঁচার অধিকার
Others/অন্যান্য
যে উপাখ্যান লেখা হয়নি (ধারাবাহিক রচনার তৃতীয় পর্ব)
অজন্তা সিনহা
৪
ভাগ্য এমনি এমনি সহায় হয় না
পাহাড়ের মানুষের দিনযাপন, তাদের সুখদুঃখের কথা তো চলতেই থাকবে। তারই মাঝে নিজের কিছু অভিজ্ঞতার ছবিও তুলে ধরতে চাই পাঠকের দরবারে। সেসব বেশ মজাদার ও ভিন্নস্বাদের, আবার কখনও কখনও বিপদজনকও বটে!
সব মিলিয়ে বিচিত্র এবং চিরতরে স্মৃতিতে থেকে যাবার মতো। বলতে পারি, এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়েই বারবার নিজেকে আবিষ্কার করেছি। পাহাড়ের জীবন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং, এ তথ্য সকলেরই জানা। মজা হল, এই চ্যালেঞ্জটাও স্থানীয় মানুষ আর আমার মতো আজন্ম শহুরে একজন মানুষের ক্ষেত্রে একেবারে পৃথক। যদিও সবকিছুর শেষে সবটাই প্রাপ্তি।
এক ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পাকাপাকি নিজেকে চুইখিমে স্থাপন করলাম, আগেই বলেছি। হিমশীতল সেই দু’টি মাস, ডিসেম্বর-জানুয়ারি, সেও একসময় শেষ হল। বসন্তের বার্তা জানিয়ে দিল, আমার বাড়ির পিছনের বড় গাছটিতে উড়ে আসা পাখির দল। যখন প্রথম আসি, তখন সেই গাছটি ছিল একেবারে পত্রবিহীন। আশপাশের সব গাছেরই তখন শূন্য বাহু মেলে বসন্ত আসার অপেক্ষা। একটাই বড় গাছ, তার ডালপালারাও বেশ বিস্তৃত। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সেই সব ডালপালায় ছোট ছোট শাখা, আর সবুজ পাতারা দেখা দিতেই পাখিদের কি আমোদ! তখন আর শীতবুড়ির দাপট আটকে রাখতে পারে না তাদের। সকাল হতেই দল বেঁধে হাজির। কিচিরমিচির করে আমার ঘুম ভাঙানোর দায়িত্বও নিয়ে নেয় তারা। সেও এক পরম আনন্দের অভিজ্ঞতা।
শীত যেতেই কুয়াশা উধাও। ঝকঝকে নীল আকাশ। প্রকৃতির শরীর জুড়ে বসন্তের গান। গাছপালায় খুশির ছোঁইয়া। বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণী এখন এক্কেবারে পরিষ্কার দৃশ্যমান। প্রকৃতির এইসব অনির্বচনীয়তার মাঝেই আমাকে একবার জরুরি প্রয়োজনে কলকাতা যেতে হল। জন্মকর্মের শহর শুধু নয়, আত্মীয়-বন্ধুরা আছে। বলা বাহুল্য, এদের সকলেরই বেজায় আপত্তি ছিল আমার কলকাতা ছাড়ার সিদ্ধান্তে। তার মধ্যে আবার এলাম তো এলাম এক প্রত্যন্ত গ্রামে। যেখানে আবার ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। অর্থাৎ, আমি বেঁচে না মরে, সেই খবরটুকু পাওয়ারও উপায় নেই। এহেন এক পটভূমিতে আমার এটাও এক গুরুদায়িত্ব সকলের কাছে, কলকাতা গিয়ে জানান দিতে হবে, আমি বহাল তবিয়তে আছি।
কলকাতায় গিয়ে ফিরতে ৮/৯ দিন হল। ফেরার পর একপ্রস্থ সাফাই অভিযান। জঙ্গল কাছে বলে প্রচুর মাকড়সা আর যেখানে-সেখানে যখন-তখন ঝুল বানিয়ে ফেলে। আর একটু হাওয়া দিলেই কাঠকুটো ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে। যাই হোক, সাফাই ইত্যাদি করে, নিজে সাফ হয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা। যেটা হয়, দুপুরটা সংক্ষেপে সেরে রাতে একটু ঠিকঠাক রান্নার আয়োজন করা। এবারেও সেরকমই…! সন্ধ্যা নেমেছে। এখানে তখনও বেশ ঠান্ডা। কলকাতায় তো ফেব্রুয়ারিতে রীতিমতো গরম পড়ে যায়। আমার সাহায্যকারী মেয়েটি চলে যাওয়ার পর দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়েছি। রান্না করতে করতে হঠাৎ দেখি মাথার ওপর চক্রাকারে উড়ে বেড়াচ্ছে নানা সাইজের কয়েকটি মৌমাছি। ভাবলাম, কোনও ফাঁকফোকর দিয়ে কখন ঢুকে পড়েছে, টের পাইনি, হয়তো জানালা খুলে দিলে চলে যাবে। জানালা খোলার পরও যে কে সেই। তারা উড়েই চলে। একটি-দু’টি আবার মজা দেখার জন্যই যেন আমার আশপাশে বাতাসে গোঁত্তা মেরে আবার ওপরের দিকে চলে যায়। গতিক সুবিধার নয় দেখে তাড়াতাড়ি রান্নাপর্ব সেরে খাবারদাবার নিয়ে মূল ঘরটিতে আসি। রান্নাঘরের দরজা বন্ধই রাখি। রাতটা কোনওমতে কাটে। ভাগ্য ভালো, এঘরে হানা দেয়নি ওরা।
পরদিন সকাল। ঘুম ভাঙতেই প্রথম মৌমাছিতত্ত্ব মাথায়। সব দরজা-জানালা খুলে দিলে বেটারা পালাবে নিশ্চয়ই। ভেবে যেই বাড়ির পিছনের দরজার তালা খুলতে গেছি, চক্ষু চড়কগাছ। বিশাল এক মৌচাক দরজার কোণে, একটি দেওয়ালের অংশ আর দরজার কিছুটা নিয়ে কোনাকুনিভাবে তারা তাদের ঘর বানিয়েছে। ঘর তো নয়, পাক্কা ষড়যন্ত্র! যেন আমাকে উৎখাত করার জন্য রাতারাতি এক ব্যবস্থা। আসলে তো রাতারাতি নয়! আমি কাল ফেরার পর কাজের তাড়নায় খেয়াল করিনি চাকটি। এখন বুঝলাম, আমার অনুপস্থিতিতে এ কর্মকাণ্ড বেশ কিছুদিন ধরেই চলেছে। ততক্ষণে, আমি দরজা খুলতেই তারা পুরো বাড়ি ঘিরে উড়তে শুরু করেছে। কোনওমতে সামনের দরজা খুলে আমার নিকটতম এক প্রবীণ প্রতিবেশীকে খবর দিই।
তিনি তৎক্ষণাৎ একটি কিশোরকে ডাকেন। সে এসে অদ্ভুত এক প্রক্রিয়ায় মৌচাকটির গতি করে।
সাধারণত, ওদের জব্দ করতে আগুন জ্বালানো হয়। এখানে সেটা সম্ভব নয়। কাঠের বাড়ি। পুরো বাড়িটাই জ্বলে যাবে। ছেলেটি একটি গাছের মোটা টুকরোর মধ্যে আগাগোড়া চপচপে করে মধু মাখিয়ে মৌচাকটির সামনে ধরে। তার আগে আর একজন বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। এবার ওই মধুমাখা গাছের টুকরোতে ঝাঁকে-ঝাঁকে মধুকর মৌচাক থেকে বেরিয়ে বসছে আর ছেলেটি তাদের নিয়ে আগুনের কাছে চলে যাচ্ছে। আগুনের কাছে গেলে ওরা কিছুটা ভীত হয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া সে চালিয়ে যায় রানী মহাশয়া মৌচাক ছেড়ে না বের হওয়া পর্যন্ত। রানী বের হয়ে উড়ে যেতেই বাকিরাও তার পিছু-পিছু সুশৃঙ্খলভাবে অন্যত্র চলে গেল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
এতকিছুর বিনিময়ে ছেলেটির একটিই আবদার, সে চাকটি নেবে, বাড়িতে বসাবে। সে নিক, আমি আর এটা রেখে কি করব! কিন্তু কাজের পারিশ্রমিক? কিছুতেই টাকা নেবে না সে। শেষে প্রায় হাতেপায়ে ধরে তাকে দু’শো টাকা দিলাম। মৌমাছি পর্বের অবসান মোটামুটি এখানেই। শুধু আমার সেই প্রবীণ প্রতিবেশী যাওয়ার আগে বলে গেলেন, “খুব সাবধান! ওরা আবার চাক বানাতে আসতে পারে। ওরা কিন্তু যে কোনও জায়গায় বাসা বাঁধে না। আপনার এই জায়গাটায় আসলে আগে মৌমাছির চাষ হত! এটা ওদের পছন্দের জায়গা!” আরে, বলে কি, আবার? যাই হোক, এখনও পর্যন্ত তাদের আর আগমন ঘটেনি।
ভবিষ্যতে যখন হবে, সে দেখা যাবে।
মৌমাছির ফাঁড়া কাটতে না কাটতেই কাঁকড়াবিছে। একটি নয়, এখনও পর্যন্ত চারটির দেখা পেয়েছি বিভিন্ন সময়ে। হাতের তালুর অর্ধেক সাইজ। অর্থাৎ, যথেষ্ট বিপদজনক। একবার তো রান্নাঘরে বাসন মাজার সাবান যেখানে থাকে, সেখানে ওঁৎ পেতে বসেছিল। কৌতুক ছেড়ে মনের কথা বলি, প্রতিবারই বেশ আতঙ্কিত হয়েছি। গ্রামের এক তরুণকে একদিন এই আতঙ্কের কথা জানাতেই সে বলে, কুছ নেহি হোগা ! ইধারকা লোক তো মারকে খা লেতা হ্যায়! বোঝো !!! এদিকে যথেষ্ট সাপের উপদ্রব থাকলেও আমার ঘরে হানা দেননি তারা এখনও। বাড়ির এপাশ-ওপাশ দিয়ে চলে যেতে দেখেছি। কার্বলিক অ্যাসিডের রক্ষাকবচ আছে বলেই হয়তো! আর মাকড়সার কথা তো বলে শেষ করা যাবে না। বিশাল বিশাল সাইজের এক-একটি। রীতিমতো আসর জাঁকিয়ে অবস্থান করে। ইঁদুর-ছুঁচোরাও আছে। প্রত্যেকের এমন একটা ভঙ্গি, যেন আমি এখানে পরদেশী। ওদের জায়গায় বহিরাগত। দয়া করে থাকতে দিয়েছে। এখানে একটা কথা না বললেই নয়। যাঁরা দিবারাত্র পাহাড়ে থাকতে পারছি বলে হিংসে করেন আমার সৌভাগ্যকে, এহেন কমেন্ট দেন ফেসবুকে আমার পাহাড়-সম্পর্কিত পোস্টে, তাঁরা একটু এই অভিজ্ঞতাগুলো চেখে দেখবেন প্লিজ। জীবনে কোনওটাই পড়ে পাওয়া চোদ্দআনা নয়। তাও তো এখনও বর্ষার গল্প করিনি।
কথাগুলো কিছুটা নেতিবাচক শোনালেও আসলে বিষয়টা কিন্তু ঠিক উল্টো। উপরে বর্ণিত যাবতীয় ঘটনাবলীর জন্য প্রস্তুত হয়েই আমার আজন্মের চেনা শহর ছেড়ে এই পাহাড়ী গ্রামে থাকতে আসা। অস্বীকার করব না, হাজার প্রস্তুতির পরও আতঙ্ক হয়, দুশ্চিন্তা, হতাশা গ্রাস করে। কিন্তু সেসব কাটিয়ে ওঠার পথও নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। আমি নিয়েছি, নিচ্ছি নিরন্তর। আর তার পিছনেও আছে কিছু অনির্বচনীয় আবিষ্কারের কাহিনী। এখানকার মানুষ ও অন্যান্য নানা অনুষঙ্গ কত যে অনাবিল সুধায় ভরিয়ে দিয়েছে আমার ঝুলি, সেসব বলে শেষ করা যাবে না। সেইসব বিস্তারে যাব পরের কোনও পর্বে। আপাতত এই পর্বের শেষ। সামনের কোনও দিনে আসবে এখানকার মণিদা, কিরণ, কুমারী, বাহাদুর, অগম, নরেশ, গঙ্গা এবং আরও অনেকের কথা। আর বলব মিনির গল্প।
৫
আপন হতে বাহির হয়ে
‘একলা চলা’-র মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার শুরুতেই একটা কথা জেনে গিয়েছিলাম, এখন থেকে আমার সিলেবাসে আর যা-ই থাক, ‘নিরাপত্তা’ নামের চিনি-মাখানো বস্তুটি আর থাকবে না। আর একটু প্রাঞ্জলভাবে বলা যায়, তথাকথিত নিরাপত্তার বলয় ভেঙেই তো স্বাধীনতা লাভ! স্বাধীন চিন্তা, যাপনের নতুন সংজ্ঞা খুঁজে বের করবার পথ ধরেই একদা শুরু হয় আমার উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ। পাকাপাকি থাকার স্বপ্ন আরও অনেকটা পরে। বছরে বেশ কয়েকবার আসার সূত্রে এখানকার, বিশেষত পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে একটা অমলিন আত্মীয়তার বন্ধন রচিত হয়। পাহাড়ের প্রতি অদম্য আকর্ষণ তো বটেই, এই অনাবিল আত্মীয়তার প্রেক্ষিতটিও ছিল শিকড় উপড়ে কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে পাকাপাকি চলে আসার একটি বড় কারণ। সেখান থেকেই প্রস্তাবনা পর্ব। এবারে সেই সব মানুষদের কথা। তাদের মধ্যে কারও কারও সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তবে, ভুলিনি তাদের। আবার কেউ কেউ আছেন, যাঁদের সঙ্গে আজও জড়িয়ে আছি। আজও নানাসূত্রে যোগাযোগ হয় সেই মানুষগুলোর সঙ্গে।
এই তালিকায় প্রথমেই যাঁর কথা মনে আসছে, তিনি পূর্ণ তামাং। পেডংয়ের পূর্ণজিকে তাঁর এলাকার বাইরেও বহু মানুষ চেনে ও মানে। ওঁর নিজের একটি হোমস্টে আছে পেডংয়ে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তাকে সচল রাখার পাশাপাশি সমাজের জন্যও কিছু করার একটা তাগিদ সব সময় লক্ষ্য করেছি এই মানুষটির মধ্যে। পর্যটনকে ঘিরে এলাকায় কতভাবে যে কাজ করেন তিনি! সে নতুন কোনও অঞ্চলে হোমস্টে খোলা হোক বা কোনও ড্রাইভারকে কাজের ব্যবস্থা! পর্যটকদের উৎসাহ দিয়ে নতুন নতুন জায়গায় পাঠানো। আমি নিজেই তো কত জায়গা আবিষ্কার করলাম ওঁর কল্যাণে! স্কুল, গুম্ফা, গির্জা---যেখানে যা সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ হোক, পূর্ণজিকে বাদ দিয়ে সেটা হবে না।
বেশ কয়েকবছর আগের কথা। পুজোর ছুটি মানেই একছুটে পাহাড়ে। সেবারের ট্রিপে রয়েছে সিলেরি গাঁও আর পেডং-এ। সেই প্রথম গেলাম ওই দিকটায়। প্রথমে সিলেরি গাঁও। বড় সুন্দর একটি গ্রাম। মিডিয়ার কল্যাণে পর্যটকদের মধ্যে বেশ ভালো রকমের ক্রেজ তৈরি হয়েছে জায়গাটা নিইয়ে। এই ক্রেজ, অর্থাৎ হুজুগের পরিণাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভালো হয় না। সিলেরি গাঁও-কে ঘিরেও সেবার সেটাই হল। কলকাতার সেক্টর ফাইভ থেকে বেশ বড় একটি দল এসেছে, ছেলে-মেয়ে, বাচ্চাকাচ্চা-সহ। শোরগোল হচ্ছে খুব। সে হোক। ব্যাপারটা সীমার বাইরে যেতে শুরু করল সন্ধ্যার পর থেকে। পাহাড়ে সন্ধ্যার পর আর তেমন কিছু করার থাকে না। এক্ষেত্রে আমি গল্পের বই পড়ি। ভোল্টেজ ডাউন থাকলে গান শুনি। কিছুই করার না থাকলে চুপ করে বসে বাইরের অন্ধকার প্রকৃতি দেখি। আমি একাই বেড়াতে যেতাম সাধারণত। দু’-একবার দলে গেলে, তখন জমিয়ে আড্ডা দিয়েছি।
পর্যটকদের মধ্যে একটি বেশ বড় সংখ্যক মানুষ আছে, যারা হোটেল বা হোমস্টে-তে ঢুকেই উষ্ণ পানীয়ের বোতল খুলে বসে। বিশেষত, ওই সন্ধ্যার পরে, যখন নাকি আর কিছু করার থাকে না। এ নিয়ে আমার কোনও নীতি পুলিশি নেই। যে যার মতো যাপন করুক জীবন। সমস্যা হয় সভ্যতা, শালীনতার বেড়া ভাঙলে! এই দলটি সেই কাজটি বিপুল আকারে শুরু করল। ঝগড়া, পরস্পরকে গালিগালাজ, কান্নাকাটি শুরু করল বড়রা। তারা প্রত্যেকেই তখন বাহ্যজ্ঞানশূন্য! বেচারা বাচ্চাগুলো পরিত্রাহি চিৎকার করতে লাগল। শেষে হোমস্টে-র বাকি অতিথিরা সবাই মিলে হোমস্টে মালিককে অভিযোগ জানালাম। কিন্তু ওঁরাও অসহায়। অতগুলি গাঁট্টাগোট্টা ছেলে। যাই হোক, একটা সময় ক্লান্ত হয়ে নিজেরাই থামল! ততক্ষণে পরিবেশ একেবারে শেষ। নির্জন প্রকৃতির কাটা-ছেঁড়া হয়ে গেছে। সিলেরি গাঁও ছাড়লাম এই তিক্ত অভিজ্ঞতাকে সাথী করে। অথচ হোমস্টে-র মালিক ও তাঁর পরিবারটি অত্যন্ত আন্তরিক ও সুন্দর স্বভাবের। জায়গাটিও চমৎকার। পাইনের অসাধারণ একটি ভিউ রয়েছে। রয়েছে আরও অনেক বিরল গাছপালা, কয়েকটি দুর্দান্ত ভিউ পয়েন্ট। আর সেরা আকর্ষণ কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন তো আছেই। এত ভালোর মাঝে ছন্দপতন যেন ওই দলটি।
পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে সিলেরি গাঁও থেকে পেডং গেলাম। আর যাওয়ার পরই মন একেবারে শান্ত ও সুস্থির হয়ে গেল। পেডং নিয়ে লিখতে গেলে কয়েকটি অধ্যায় হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের আলোচনা পেডং নয়, পূর্ণজিকে নিয়ে। প্রথম দেখাতেই ওঁর হোমস্টে-র লাল বাড়িটার প্রেমে পড়ে গেলাম। আগে একটি রিসর্টে চাকরি করতেন পূর্ণজি। সেখানকার চাকরি ছেড়ে নিজের এই হোমস্টে খুলেছেন। পরিবার-সহ নিজেও ওই বাড়িতেই থাকেন। জায়গাটা সিকিম বর্ডার। ওঁর বাড়ির পর থেকেই সারি সারি পাহাড়, যেগুলি আদতে সিকিমের অন্তর্গত। রাতে ওই বাড়ি থেকেই দেখা যায় মিটিমিটি আলো জ্বলা সিকিমের বিখ্যাত মনিপাল বিশ্ববিদ্যালয়। কাছেই ক্রস হিল পয়েন্ট, সেখানে পাহাড়ের ওপরে ঐতিহাসিক গির্জা। এখান থেকেই ভাগ্যে থাকলে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর আছে লাগোয়া কাশ্যম জঙ্গল ও গ্রাম। এই গ্রামেই এলাকার শেষ লেপচা পরিবারের বাড়িটি, যা এখন হেরিটেজ বলে স্বীকৃত। সেই বাড়িটি তৈরির শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। মাটির ঘরের ওপরে খড়ের চাল, সেই চাল তৈরিতে কোনও পেরেক ব্যবহৃত হয়নি। এটাই এর প্যাটার্ন। বলা বাহুল্য, এইসব দর্শন ও তথ্য সংগ্রহের হোতা ওই পূর্ণজি।
পেডংয়ে দিন দুয়েক ছিলাম সেবার। কি পরিশ্রমী একটি পরিবার! আর কি সুন্দর সমন্বয়! ঘুম ভাঙতেই স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে কাজে লেগে পড়ছেন। বাড়িঘর ঝকঝকে করে তোলা থেকে রান্নাবান্না, গাছের পরিচর্যা, বাচ্চার স্কুল ও পড়াশোনা এবং অতিথির পরিচর্যা। অতুলনীয় রান্না আর অপূর্ব পরিবেশন। উত্তরবঙ্গের এত জায়গায় গেলাম। আজ পর্যন্ত কোথাও এই পরিষেবা পাইনি। মোদ্দা কথা, পূর্ণজির হোমস্টে আমার হৃদয় হরণ করে নিল। তারপর কতবার যে গেলাম! কতজন যে আমার রেফারেন্সে ওঁর হোমস্টে-তে থেকে এল, ইয়ত্তা নেই। সকলেই সেখান থেকে ফিরে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মনে পড়ছে, এনজেপি স্টেশনে নেমেই ওঁকে ফোন করে খাবারের মেনু বলে দিতাম। উনি ঠিক ঘড়ির হিসেবে খাবার বানাতেন। পৌঁছে, স্নান করেই গরম গরম লাঞ্চ। অতি সাধারণ ডাল-ভাত, রুটি-সবজি, বেগুন ভর্তা, ওয়াই ওয়াই স্যুপ, বাঁধাকপির মোমো পূর্ণজির হাতে অমৃত হয়ে ওঠে। বারবার সেই স্বাদে মোহিত হয়েছি।
তবে, এসব নয়। পূর্ণজিকে আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ ওঁর সামাজিক ও মানবিক চেতনা। সঙ্গে অগাধ পড়াশোনা। পেডংয়ের ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। একদিকে অতি প্রাচীন সিল্ক রুটের প্রবেশপথ। অন্যদিকে, শতাব্দীপ্রাচীন গির্জা, গুম্ফা। রয়েছে একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। প্রতিটি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য কণ্ঠস্থ পূর্ণজির। সাংবাদিক হিসেবে কোনও বিষয়ে লেখার জন্য তথ্য সংগ্রহে বরাবর পূর্ণজির সহায়তা পেয়েছি। আমি সেসময়ের কথা বলছি, যখন ইন্টারনেট দূর, পেডংয়ে ভালো করে সেলফোন নেটওয়ার্কও নেই। শুধু এলাকার ভূগোল, ইতিহাস, গাছপালা, পশুপাখি নয়, বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন বিষয়ে ওঁর পড়াশোনা রীতিমতো চমকে দিয়েছিল আমায়। প্রত্যন্ত একটি অঞ্চলে জন্মকর্ম হওয়া সত্ত্বেও যে নিজেকে সমৃদ্ধ রাখা যায়, তার প্রমাণ পাই পূর্ণজির সংস্পর্শে এসে বারবার।
পর্যটন আসলে শিক্ষার, চেতনা নির্মিতির এক বিশাল দরজা খুলে দেয়। নানা মানুষের জীবনযাপন, রোজকার লড়াই থেকে উৎসব, পার্বন---সব কিছু জানার মধ্যে এক নির্মল আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষত, উত্তরবঙ্গের পাহাড় অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের জীবনগাথা এক অদ্ভুত অনুপ্রেরণার যোগান দেয়। হাজারও অবহেলা, বঞ্চনা, অপ্রাপ্তির মাঝেও কেমন করে ওরা এত সচল, সজীব, সৎ ও মায়াময় থাকে, সেই ম্যাজিকটার ভিতরে একটু সংবেদনশীল হলে প্রবেশ করতে ইচ্ছে করবেই। সেই অনতিক্রম্য ম্যাজিকে আমিও বশীভূত হলাম। হয়েই রইলাম বলতে পারেন।