প্রথম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা - বাঁচার অধিকার
Short Stories/ছোটগল্প
এই পশুপ্রেম, এই ভালোবাসা !
উৎপল ঝা
‘মা, বনিকে এবার ছেড়ে দিই, কি বল?’ সুগত জানতে চায়।
অতিথিরা সবাই বিদায় নিয়েছে, বাড়ি শুনশান। সারাদিন খুব ধকল গেছে, মিসেস অলকা লাহিড়ী সোফায় গা এলিয়ে সবে একটু চোখ বুজেছেন, এমন সময় সুগতর এই প্রশ্ন।
সত্যিই, বেচারা ‘বনি’ আজ সারাদিন একতলার ঘরে বন্দী। কী করা যাবে, মানুষ কেন যে অকারণে পোষা, আদুরে জীবকে এত ভয় পায়! এই যেমন তার ছোট বোন শোভনা ফোনে বলছিল, ‘দেখ দিদি, তুই তোর ছোট ছেলেকে ছেড়ে রাখবি না কথা দিলে তবেই আমি তোদের বাড়ি যাব।’
অবশ্য অলকাও একসময় ভয় পেতেন। কিন্তু সমর সব ভয় কাটিয়ে দিয়েছিলেন। ছ’বছর আগের কথা। বনি এখন কেমন তাদের দু’জনের ন্যাওটা হয়ে উঠেছে। সমর চলে যাওয়ার পর বনি যেন আরও নিকটজন হয়ে উঠেছে তার এবং সুগতর।
অলকার চোখ চলে যায় সমরেরে বাঁধানো ছবিটির দিকে। কাঁচের দিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন তিনি।
‘মা, ঘুমিয়ে পরলে নাকি?’ সুগতর প্রশ্নে ধড়মড় করে উঠে বসেন অলকা – ‘না, এই একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। হ্যাঁ বাবা, এবার বনিকে ছেড়ে দে। বেচারা সারাদিন নিচের ঘরে বন্ধ, কী করছে কে জানে।’
‘ওকে কী ছেড়ে দেবেন নাকি?’ কখন নতুন বৌ তনিমা এসে দাঁড়িয়েছে। তার গলায় যেন আর্ত-স্বর। সুগত খুব মজা পায় যেন, বলে ওঠে, ‘নিশ্চয়ই, ও তো এখন এ বাড়ির গার্জিয়ান, বাইরের লোকের জন্য ওকে আটকে রাখা। তা তারা যখন বিদায় নিয়েছে, এবার ছাড়তে হবে বৈকি।’
অলকা বলে ওঠেন, ‘তনিমাকে অযথা ভয় দেখাচ্ছিস,’ তারপর তনিমাকেই ভরসা দেন, ‘ও কিচ্ছু করবে না, তুমি তো এই বাড়িরই একজন।’
ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বনি প্রথমে গরগর করতে করতে অলকা তারপর সুগতর গায়ে-পায়ে মুখ ঘষে, একলাফে ফুলশয্যার বিছানায়।
তনিমা ভয়ে-ঘেন্নায় সিঁটিয়ে যায় লমা জিভ বের করা জন্তুটাকে দেখে। সুগতর কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। সে চেয়ারে পাঞ্জাবিটা ছেড়ে রেখে অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকে যায়।
বনি তীব্র-দৃষ্টিতে তনিমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তনিমা সেই পাহারাদারের সামনে ঘামতে থাকে একা। কিছুক্ষণ সময় কাটলে তনিমার মনে কিছুটা সাহস জাগে। কতক্ষণ এইভাবে বসে থাকা যায়! সে চেয়ার থেকে সুগতর প্নজাবিটা তুলে যেই ওয়ার্ডরোবে রাখতে যাবে, বিশাল একটা হুঙ্কার দিয়ে বনি বাঘের মতো তনিমার হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ভয়ে, তীব্র ব্যথায় তনিমা চিৎকার করে ওঠে।
নতুন বৌয়ের আর্তনাদ শুনে সুগত, অলকা দুজনেই ছুটে আসে। বনির মুখে সুগতর পাঞ্জাবি, চোরের হাত থেকে মহা-মূল্যবান সম্পত্তি বাঁচানোর কৃতিত্বে তার চোখ জ্বলজ্বল করছে।
সুগত দেখে তনিমা ডানহাত দিয়ে বাঁহাত চেপে রেখেছে, আর সেখান থেকে টুপটুপ করে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পরছে পাথরের মেঝেতে।
নতুন-বৌয়ের হেনস্থায়, নাকি আজকের এই শুভদিনের অঘটনে সুগত স্থির থাকতে পারে না। সে বেল্ট দিয়ে বনিকে নির্বিচারে পেটাতে থাকে। এই প্রথম সে বনির গায়ে হাত তুলেছে। আর বনি কোনও প্রতিবাদ না করে অবাক চোখে কুঁই-কুঁই করতে করতে অলকার পায়ের কাছে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে।
অলকা হাত তুলে সুগতকে থামান – ‘আগে তনিমাকে দেখ।’
বেল্ট ছুঁড়ে ফেলে সুগত তনিমার বাঁ-হাতটা টেনে নিয়ে ফর্সা কব্জির ওপর ফুটে ওঠা লাল আঁকিবুঁকি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। তনিমা তীব্র রাগে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
সুগত, তনিমাকে টেনে বেসিনের কাছে নিয়ে গিয়ে জলের ট্যাপ খুলে দিয়ে জলের ধারার নীচে হাতটা ধরে। তারপর অভ্যস্ত হাতে একটি ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে ঘোষণা করে, ‘ওর ইঞ্জেকশন নেওয়া আছে কোনও চিন্তা নেই।’
দুই
গভীর রাত। ফুলশয্যার বিছানায় দুটি বিনিদ্র প্রাণী, দু’দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে।
একজন ব্যথায়, অপমানে; অন্যজন প্রত্যাখ্যান ও মেজাজ হারানোর অনুশোচনায়।
না, ঠিক দু’টি নয়, তৃতীয় একজনও বিনিদ্র। সে সুগতর ঘরের বন্ধ দরজার বাইরে পাপোষের ওপর চিবুক রেখে , দু’কান খাড়া করে শুয়ে আছে। তীব্র অভিমানে গুমরে উঠছে সে, শাড়িপরা একজন অচেনা লোক তার চেয়েও আপন হয়ে উঠল লাহিড়ী বাড়িতে! বাহ রে মানুষের ভালোবাসা।