প্রথম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা - বাঁচার অধিকার
Short Stories/ছোটগল্প
কহেন বিদ্যাপতি
মণিরত্না রায়
আজ সকালে ভাতের ফ্যান গালতে গালতে নিজের মনে গুনগুন করছিলাম ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’.... রান্নাঘরের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল আকাশের একটা কোণ নিকষ কালো। ঝিরঝিরে বৃষ্টির সঙ্গে ঘাম শুকোনো হাওয়াটা সবে বইতে শুরু করেছে। আর বিদ্যাপতির প্রভাবে মনে বেশ রাধা-রাধা ভাব জেগেছে। কাল্পনিক কৃষ্ণের প্রেমে গদগদ হয়ে যেই না গানটা আরেকটু গাঢ় স্বরে গাইতে যাব, ঘর থেকে আয়ান ঘোষের মেয়ে, মানে আমার কন্যারত্নের ডাক। ডাক তো নয়, হুংকার ভেসে এল। ‘মাম্মা, এখুনি এসো, দেখে যাও’। উনি ডাকলে সঙ্গে সঙ্গে না গেলে আবার ওনার গোঁসা হয়। তার ওপর এই লকডাউনের দৌলতে হরমোনদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। কথায় কথায় ‘মুডসুইং’। যাই হোক, ভাতের হাঁড়ি সোজা করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম। দেখি, আলমারি হাট করে খোলা, মেয়ের মুখে একরাশ বিরক্তি। বলল, ‘আমার teal কালারের টপ্-টা কোথায়? ওটা আমার একটা মাত্র ফেভারিট টপ্।’ আমি তো তখন চোখে রামধনু দেখছি। টিল-টা অ্যাকচুয়ালি কি শেড তাইতো মনে করতে পারছি না! সেটা বললে তো রক্ষে নেই, তাই আমতা আমতা করে বললাম, ওওও তোর কচি কলাপাতা রঙের টপ্-টা তো? মেয়ে তো অগ্নিশর্মা। টপ্ খুঁজে না পাওয়ার দুঃখের চেয়েও টিল-কে কচি কলাপাতা বলায় সে তো পুরো খেপচুরিয়াস্। বলল, ‘গোটা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির হয়ে তোমাকে ভর্ৎসনা করছি, সেদিন মেজেন্টা আর পার্পল গুলিয়েছ, ক্ষমা করে দিয়েছি, তাই বলে টিল আর কচি কলাপাতা! ! কতবার বলেছি ওটা গ্রিনিশ্ ব্লু। উফ্ জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না।’ বেগতিক দেখে আমি ফোকাসটা তুসু, মানে আমার কাজের মেয়েটির দিকে ঘোরাতে গেলাম, বললাম, কি যে করে তুসুটা, নির্ঘাত টপ্-টা ছাদে মেলে ভালো করে ক্লিপ আঁটেনি। দেখ আবার উড়ে যায়নি তো! মেয়ে তো দ্বিগুণ রেগে বলল, ‘তুমি-ই তো তুসুদিদিকে আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছ, একটা কাজও যদি মন দিয়ে করে! এখুনি বলবে আহা, পাঁচ বাড়ি কাজ করে বেচারি। বোঝো এখন, আরো হও, দয়াময়ী মা।’ (ফোকাস আবার আমার দিকে। আমি ট্র্যাক পালটে বললাম, মাঝে-মাঝে একটু নড়ে বসতেও তো পারিস, নিজের জিনিস নিজে একটু দেখেও তো রাখতে পারিস, সব আমার ঘাড়ে ফেলে তোরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোস। এই তুই আর তোর বাবা মিলে আমার জীবনটা ইত্যাদি ইত্যাদি বহুবচনে বলার কারণ হল…, গোলযোগ শুনে আয়ান ঘোষ, থুড়ি, আমার স্বামী দেবতা উঁকি দিচ্ছিল, তাকেও একটু মুফতে খোঁচা দেওয়া গেল। মেয়ে দমবার পাত্রী নয়। বলল, ‘ওই তো এক অস্ত্র তোমার, বাংলা সিরিয়ালের নির্যাতিতা মায়ের ডায়লগ। আমার টপ্-টাই হারিয়ে গেল।’ আমি তাড়াতাড়ি অবস্থা সামাল দিতে আলমারিতে মুণ্ডু ঢুকিয়ে প্রবল খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। আরে ওই তো, ওটা কি? ওই দ্যাখ কালো কুর্তিটার তলায় তোর নীল-টিল টপ উঁকি দিচ্ছে। মেয়ে এবার মাথা চাপড়ে হাসতে লাগল, বলল, ‘তুমি সত্যি কালার ব্লাইন্ড, এটা পরিষ্কার সী-গ্রীন কালার, কতবার বলব, ফর দ্য লাস্ট টাইম, টিল হল গ্রীনিশ্-ব্লু.......’
সত্যি বলছি, আমার তখন মাথা ভোঁ ভোঁ করছে, টিল-এর গুঁতোয় বিদ্যাপতি তো কখন পালিয়েছেন, অগত্যা গ্রীনিশ্ ব্লুয়িশ্ আওড়াতে আওড়াতে ফের রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।