প্রথম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা - বাঁচার অধিকার
Short Stories/ছোটগল্প
গল্পের নায়িকা সাবিত্রী
মণিরত্না রায়
সাবিত্রীর বয়েস তখন উনিশ। ময়মনসিংহের নামকরা ডাক্তার, ডঃ যোগেশ চন্দ্র দত্তের কনিষ্ঠা কন্যা তিনি। বড় দাদাটিও ডাক্তার। ওপরের দুই দিদির বিয়ে হয়ে যাবার পর সবার কাছে একটু বেশিই আদর পেত সে। যেমন বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর আসতেন। তার কাছে অন্য সব বিষয়ের সঙ্গে চলত নিয়মিত ইংরেজি ভাষার শিক্ষা। কিন্তু যতক্ষণ মাস্টারমশাই পড়াতেন, সাবিত্রীর মা দরজায় বসে কড়া নজর রাখতেন। একদিন পড়াতে পড়াতে মাস্টারমশাই বললেন, “Look at me, Sabitri”, সাবিত্রী কঠিন মুখে উত্তর দিলেন, “Will I understand better if I look at you?” দরজায় বসা মা ইংরেজি না বুঝলেও মেয়ের আরক্ত মুখ দেখে বুঝলেন যে কিছু একটা হয়েছে। সটান বলে দিলেন কাল থেকে এই মাস্টার যেন না আসেন। সাবিত্রীর গানের গলা ছিল ভারী মিষ্টি। প্রথাগত সংগীত শিক্ষা না হলেও সবরকম গানেই ছিল তার অসীম পারদর্শিতা। একবার শুনেই যে কোনো গান অবিকল গাইতে পারত সে। যাই হোক, আর পাঁচ জন মেয়ের মতোই সাবিত্রীর বিয়ের জন্য নানান জায়গা থেকে প্রস্তাব আসতে লাগল। বড় দিদির বিয়ে হয়েছে সিলেটে। হোম চৌধুরী পরিবারে। বড় জামাইবাবু আদরের শ্যালিকাটির জন্য তাদেরই পরিচিত একটি পরিবারে সম্বন্ধ করলেন। বিয়ের দিন ঠিক হল। কিন্তু বিয়ের হপ্তা-খানেক আগে পাত্রপক্ষ পণ চেয়ে বসলেন। যদিও তারা সম্পন্ন পরিবার, তবুও সাবিত্রীর বাবা, দাদা বা জামাইবাবু পণপ্রথার ঘোরতর বিরোধী। জামাইবাবু যেহেতু নিজে এই সম্বন্ধ করেছিলেন তাই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে সটান পাত্রপক্ষকে মুখের ওপর না করে দিলেন। বিয়ে ভেঙে গেল। সাবিত্রীর দিদি শয্যা নিলেন। বিয়ে ভেঙে যাওয়া ছোট বোনটির এবার সম্বন্ধ পাওয়া দুষ্কর হবে......
গল্পের নায়ক সচ্চিদানন্দ।
তখন সচ্চিদানন্দের তেইশ বছর বয়েস। সিলেট অধিবাসী হোম চৌধুরী পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্র। এই পরিবারের পুরুষেরা সকলেই পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ-এ চাকরি করতেন। সুঠাম, দীর্ঘাঙ্গ এই যুবা তখন সবে চাকরি পেয়েছেন। এরই মধ্যে একদিন বাড়ি থেকে চিঠি এল, বৌদির বোন সাবিত্রীর বিয়ে। তাদেরই পরিচিত পরিবারে। তাই সে যেন সত্বর অফিসে ছুটির আবেদন করে। আর বিয়েবাড়িতে হাজার কাজ। দাদার আদেশ, সে যেন তিনদিন আগেই এসে পড়ে। সুতরাং, সচ্চিদানন্দ ছুটি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সাবিত্রীকে তিনি চিনতেন, জানতেন সাবিত্রী বই ভালবাসেন। তাই তার জন্য উপহারস্বরূপ নিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাবলী আর শরৎচন্দ্রের কিছু বই। ট্রেন যখন গন্তব্যস্থলে থামল, সচ্চিদানন্দ প্ল্যাটফর্মে নেমে দেখলেন, তাকে নিতে দাদা স্বয়ং এসেছেন। তিনি অবাক! হঠাৎ বিয়েবাড়ির সব কাজ ফেলে দাদা তাঁকে নিতে আসবেন কেন? দেখলেন দাদার পেছনে উঁকি দিচ্ছে তার আরেক তুতো ভাই, মুখে মুচকি হাসি। দাদা বললেন, শোনো, তোমাকে বাড়ি যাওয়ার পথে একবার দর্জির কাছে যেতে হবে। পাঞ্জাবির মাপ দিতে। সচ্চিদানন্দ আরো অবাক! বললেন, বিয়েবাড়িতে পরার মতো পাঞ্জাবি আমার আছে। রাশভারী দাদার মুখে কৌতুক ফুটে উঠল। বললেন, পরে বিয়ে করবার মত পাঞ্জাবি কি আছে? সচ্চিদানন্দর হতভম্ব মুখ দেখে পেছন থেকে ভাইটি বলে উঠল, আরে, তোর তো পরশু বিয়ে, সাবিত্রীর সাথে...!
সাবিত্রীর জামাইবাবু রাগের মাথায় শ্যালিকার বিয়ে তো ভেঙে দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বাড়িতে যখন সবার মাথায় হাত, তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে কন্যাদায়গ্রস্ত শ্বশুরকে বেশ খানিকটা বিপদেই ফেলেছেন। সুতরাং, এর উপায় তাঁকেই বের করতে হবে। তখন নিজের ছোট ভাইটির সাথে সাবিত্রীর বিয়ের প্রস্তাব দিলেন তিনি শ্বশুরমশাইকে। বৃদ্ধ তো হাতে চাঁদ পেলেন। চোখের সামনে এমন যোগ্য পাত্র থাকতে খামোখা তাঁরা বাইরে খুঁজছিলেন! একই বাড়িতে দুই মেয়ে থাকবে, এর চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে! ঘটা করে বিয়ে হয়ে গেল সাবিত্রী-সচ্চিদানন্দের। আর হ্যাঁ, সাবিত্রীর গানের চিরকালই ভক্ত ছিলেন সচ্চিদানন্দ। বিয়ের পর পাঁচ সন্তানের জননী সাবিত্রী যতই সংসারে ব্যস্ত হোন না কেন, দিনান্তে স্বামী-স্ত্রী দুজন ভেসে যেতেন গানের ভেলায়। সায়গল, কানন দেবীদের গান সাবিত্রীর মধুর কণ্ঠে বিভোর হয়ে শুনতেন সচ্চিদানন্দ। বাড়িতে গ্রামোফোন ছিল না, বন্ধুর কাছ থেকে সারাদিনের জন্য চেয়ে আনতেন, যাতে সাবিত্রী নতুন প্রকাশিত গানগুলি শিখে নিতে পারেন। আজকের প্রযুক্তির দুনিয়ায়, অঙ্গুলিস্পর্শে গান কেন, সবই মেলে, কিন্তু এমন প্রেম মেলে না। তাই, কোথায় যেন, আজও, সাবিত্রী-সচ্চিদানন্দরা জিতে যায়....