প্রথম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা - বাঁচার অধিকার
Short Stories/ছোটগল্প
মুক্তি
ডাঃ অনুপম ভট্টাচার্য
১
গত দুদিন ধরে বেশ ঝামেলা চলছে। চারটে লাশ পড়েছে। অশ্বিনী খুড়ো এসব ঝামেলায় যায় না। ভয়ে গুটিয়ে ছিল সে তারপর দুটো দিন। শান্তশিষ্ট স্বভাবের অশ্বিনী খুড়ো কারো সাতে-পাঁচে থাকে না। আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খোঁজ সে রাখেও না, রাখতে পারেও না। কিন্তু চারিদিকে একটা খবর সে শুনেছে -- মানে খবরের প্রাবল্য এতটাই জোরালো যে আর কানে না ঢুকে থাকেনি। সেই খবরের ভয়াবহতা আলিপুর জেলের সাম্প্রতিক গন্ডগোলের কারণ। সুদূর চিন দেশ থেকে কোনো এক ভাইরাস নাকি সারা বিশ্বে কামড় বসানোর পর কলকাতাতেও থাবা ফেলেছে। ভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে মানুষের সাথে মানুষের শারীরিক দূরত্ব বাড়াতে হবে। তাই আতঙ্কে ও সন্দেহের বাতাবরণে বন্দীরা একে অপরের সঙ্গে, জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছে, জেল থেকে ছাড়ার দাবিতে। যাই হোক, অশ্বিনী খুড়ো এই দাবি দাওয়ার মধ্যে নেই। কারণ সে জানে, জেল থেকে মুক্তি মানেই তো জীবন থেকেও মুক্তি। না খেতে পেয়ে মরা। আর কেই বা আছে তার? কার জন্যই বা সে জেল থেকে বেরোবার চেষ্টা করবে? এইসব ঝামেলা করা তার ক্ষমতার বাইরেও। তাই সকালে নিশ্চিন্ত মনেই জেলের জোলো লাল চা আর শুকনো রুটি চিবোচ্ছিল সে। হাল ভাঙা পাল ছেঁড়া নৌকোর যাত্রী যেমন মাঝসমুদ্রের ঝড়ের মধ্যে “নিশ্চিন্ত” ভাবে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে, অশ্বিনী খুড়োর প্রতীক্ষা ঠিক সেই রকমই নিশ্চিন্ত। জেলেই জীবন তার। হারানোর আর কিছু নেই। সে খেতে পায়, সশ্রম কারাদণ্ডের দরুণ কিছু মাইনেও পায়। শুধু মাঝে মাঝে কর্তৃপক্ষের মদতপুষ্ট কর্তাগোছের বন্দীদের একটু ফাইফরমাশ খাটলেই হল। বুড়ো মানুষ আর নিরীহ স্বভাবের বলে তাকে বেশি ঘাঁটায় না। কারণ, নির্বিবাদী মানুষটি হ্যাঁ-তে হ্যাঁ আর না-তে না মেলাতেই অভ্যস্ত।
সকলেই ভাবে, এই অশ্বিনী খুড়োর মতো লোক একটা ‘আস্ত’ খুন করল কী করে! তার পক্ষে কী করে সম্ভব হল মানুষের জীবন নেওয়া? আসলে, ব্যাপারটা ঘটে গিয়েছিল চোখের নিমেষে।
২
দমদম স্টেশন। রিক্সার লাইন। লাইনে কে দাঁড়াবে সেই নিয়ে বচসা। ধাক্কাধাক্কিতে অশ্বিনীর ঠেলা খেয়ে পড়ে গিয়েছিল নরেশ। মাথাটা ধাক্কা লেগেছিল রকে। সকলে তাড়াহুড়ো করে আর জি কর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল নরেশকে। কিন্তু তখন নরেশ আর নেই। নিছকই একটা বডি। শোকটা বড় লেগেছিল অশ্বিনীরই। নিজের সমস্ত জমানো টাকার অর্ধেক সে দিয়ে দিয়েছিল নরেশের বৌকে। দু’বছর আগে রক্তের ক্যান্সারে মারা গিয়েছে অশ্বিনীর ছেলে পল্টু। বৌ বাড়ি বাড়ি কাজ করত। ছেলে মারা যাবার পর ঘরবসতি। যেন পাথর হয়ে গিয়েছে বৌ। সব ভুলে যায়, খায় না। দু’দিন পর পুলিশ যখন অশ্বিনীকে হত্যার অপরাধে তুলে নিয়ে গেল তখনও বৌ-টা কাঁদেনি। আসলে কিছু বুঝতেই পারেনি। ছ’মাস পর রিক্সা স্ট্যান্ডের অনিমেষ খবর দিয়ে যায় অশ্বিনী খুড়ি মারা গেছে। অনিমেষরাই শেষ ক’টা দিন দেখত। হাসপাতালে ভর্তিও করেছিল। খুব কেঁদেছিল অশ্বিনী। কিন্তু পরে এই ভেবে সান্ত্বনা পেয়েছিল, যাক, বৌ-টা মরে বেঁচে গেল। সেই থেকে এই জেলখানাটাকেই ভালোবেসে ফেলেছিল। সেখানে কত মানুষ। কেউ নেশাখোর, খুনি, লম্পট। কেউ বা ভালোমানুষ কিন্তু ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে মিথ্যা অপরাধে; কারো বা বিচার চলছে তো চলছেই। অশ্বিনী ভাবত, বিচারে যদি এরা নির্দোষ হয়? তবে তো জেলে এরা বিনা অপরাধে পচলো!! তার উপর ছিল জেলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। কিন্তু এর থেকে বাইরে গিয়েই বা অশ্বিনী খুড়ো কী করবে? কি খাবে? রিক্সাটাও কী আর আছে? যদি বা থাকে, তবু রুলিং পার্টিকে লাইনের টাকা দেবে কোত্থেকে? অতএব খাটার উপায়ও নেই। এর থেকে জেলেই ভালো। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তো পাওয়া যাচ্ছে। কোন ভাইরাস এল গেল তাতে তার কি? মরতে তো একদিন হবেই। অশ্বিনী খুড়ো তাই নিরুদ্বিগ্ন। তার ভয় মৃত্যুকেও নয়, কেবল ক্ষুধাকে।
৩
জেল কর্তৃপক্ষ এদিকে ভাবছে, জেলে লোক কমিয়ে সোশ্যাল ডিস্টানসিং কীভাবে বাড়ানো যায়। উপর থেকে অর্ডার আছে। নিজেদের প্রাণেরও ভয় আছে। অবশ্য নিজের প্রাণের ভয় না থাকলে এসব নিকৃষ্ট কীটপোকাদের মুক্তি দেবার কথা ভাবত না। আবার এদিকে সরকার নির্দেশ দিয়েছে লকডাউন না মানলে লক-আপ। লক-আপ তো খালিও করতে হবে। তাই তালিকা তৈরি শুরু হল। শর্ত হল, যাদের
অপরাধ কম বা জেল রেকর্ড ভালো তাদেরই মুক্তি অগ্রাধিকার। সুতরাং, অশ্বিনী খুড়োর নাম এলো প্রথম লিস্টেই। অশ্বিনীর ডাক পড়ল জেলারের সামনে। অশ্বিনী এল। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরা জেলার। বাইরেই আটকে দেওয়া হল। এটাই সোশ্যাল ডিস্টানসিং। জোরে জোরে কথা বলছে দু’জনেই।
-- শোনো, আজ তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
-- কেন স্যার? আমার অপরাধ?
-- অপরাধ হবে কেনচ? তোমার জেল রেকর্ড ভালো। তাই ছেড়ে দিচ্ছি। করোনার জন্য জেলে ভিড় কমাতে হবে।
-- কিন্তু আমি খাবো কি? থাকবো কোথায়? আমায় ছাড়বেন না স্যার।
জেলার হতবাক। সত্যিই তো!! কিন্তু তাকে যে ছাড়তেই হবে।
-- “সশ্রম কারাদণ্ডের পারিশ্রমিক পাবে। এতে লকডাউনটা চালিয়ে নাও। তারপর আগে যা কাজ করতে তাই করবে।“
-- কিন্তু স্যার, আমার রিক্সা বেচে পার্টির ছেলেরা নিয়ে নিয়েছে। আমার আর কেউ নেই। আপনার পায়ে একটু জায়গা দিন স্যার, দয়া করুন।
জেলার বুঝলেন, কথায় ঢুকলে কার্যসিদ্ধি হবে না।
-- তোমার ছুটি হবে, ব্যাস!! কাল সকালে তিন হাজার টাকা নিয়ে চলে যাবে। কোনো কথা নয়। যাও, বিরক্ত কোরো না।
মাথা নিচু করে চলে গেল অশ্বিনী খুড়ো। মাথা নিচু করে থাকতেই তো অভ্যস্ত সে। কী-ই বা করতে পারে!
৪
পরের দিন সকালে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে বেরোলো অশ্বিনী খুড়ো। লকডাউনের কলকাতা। চারিদিক শুনশান। চড়াই, কাঠবেড়ালী, কুকুরগুলো রাস্তার দখল নিয়েছে। বসন্তের ঝরা পাতা ডি.এল.খান রোডের উপর আস্তরণ বিছিয়ে দিয়েছে। যা প্রতিটি পদক্ষেপের মর্মর শব্দ ধ্বনিত করছে। যখন এক্সাইডের মোড়ে এল অশ্বিনী তখন ব্যস্ত রাস্তাটা শুনশান। দশ মিনিট অপেক্ষার পর একটা পুলিশের গাড়ি হুস করে বেরিয়ে গেল। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। কী করা যায়? ভাবছিল কোনদিকে যাবে। নিজের চোখে বিশ্বাস হচ্ছে না কলকাতার এই নির্জনতা। সাতটা বছর জেলে থাকার পর ওতেই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তার। বাইরের এই মুক্ত জীবনে একাকী অশ্বিনী এখন দিশেহারা।
না, দমদম রেল কলোনির বস্তিতেই যাবে সে। বৌ মারা যাবার পর ঘরটা হয়তো শূন্যই পড়ে আছে। সে ভারি যত্ন করত খুড়োকে। স্ট্যান্ডের ছেলেরা বলত, ভাগ্যি করে খুড়িকে পেয়েছে খুড়ো। ছেলে মারা যাবার পর থেকে নিজের সর্বসামর্থ্য দিয়ে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থ খুড়িকে সেই যত্ন ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বৌ-টাও মরে গেল। এখন কি হবে তার? জেলার সাহেবও কী তাকে আর ক’টা বছর জেলে রাখতে পারতেন না? এইসব ভাবতে ভাবতে ধর্মতলা মোড়ে পুলিশ আটকাল তাকে।
-- কি দরকার?
-- আজ্ঞে বাড়ি যাচ্ছি।
-- কোথায় গিয়েছিলে?
-- আজ্ঞে!! মানে....
আমতা আমতা ভাব দেখেই লাঠি চালাল পুলিশ। লকডাউন অমান্য করবার অপরাধে। এইসবে আর অপমানিত হয় না খুড়ো। কিন্তু বড় ব্যথা করছে পিঠটা। হাঁটতে হাঁটতে শিয়ালদহ থেকে ট্রেন লাইনের রাস্তা ধরে যখন রেল কলোনির চেনা বাড়িটাতে এল, তখন বস্তিটা আর চেনাই যাচ্ছে না। কারণ ওর জায়গায় তৈরি হয়েছে প্রোমোটারের তৈরি অট্টালিকা। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। পাগলের মতো লাগল অশ্বিনী খুড়োর। দমদম রেললাইনের ধারে শুয়ে আছে কিছু পরিবার আর কিছু অভুক্ত শিশু। উদর জ্বলছে খিদের জ্বালায়। একটা বাচ্চা এসে বলল, “দাদু, কিছু খাবার দাও না! কিছু খাইনি।“ মায়া হল খুড়োর। কঙ্কালের মতো বাচ্চাগুলো। মনে পড়ল, রোগে ভুগে ছেলেটারও এমনধারা হয়ে গিয়েছিল। তার ট্যাঁকে গোঁজা আছে তিন হাজার টাকা। এই টাকা নিয়ে সে কী করবে? কেউই তো নেই তার। এর চেয়ে ছোটখাটো অপরাধ করে জেলে চলে যাওয়া ভালো। আসলে জেলটাই যেন ঘর হয়ে গেছে খুড়োর। বাইরের বাতাস, লকডাউনে বাচ্চাদের কান্নাই বরং জেলখানা লাগছে।
৫০০ টাকার একটা নোট ওদের মায়ের হাতে দিয়ে দিল সে। কিছু খাওয়া হয়নি সারাদিন। খাবারের দোকানও নেই যে কিছু কিনে খাবে। খুড়ো ভাবছে কী করবে। অনিমেষের বাড়ি যাবে? ও খুব ভালোবাসে খুড়োকে। সামনেই তো ওর বাড়ি। গিয়ে কড়া নাড়ল। অনিমেষের মা বেরিয়ে এল। অনিমেষ নাকি আর রিক্সা চালায় না। দেনার দায়ে বিক্রি করেছে রিক্সা। কেরালায় জোগাড়ের কাজ করতে গেছে সে। লকডাউনে আটকে পড়েছে ভিন রাজ্যে। ফিরতে পারেনি। বাড়িতে মা আর ছোট বোন। থাকতে দেবার কথা বলতে পারল না খুড়ো। দরজায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। ওদিকে, নতুন অচেনা লোককে পাড়ায় ঢুকতে দেখে বেরিয়ে যেতে বলছে প্রতিবেশীরা। অপরিচিত লোক দেখে অনিমেষের মা-ও সন্দিগ্ধ। আসলে করোনার আতঙ্ক মানুষের স্নেহের বন্ধনকেও যখন আলগা করে দিয়েছে তখন অশ্বিনী খুড়ো তো নেহাৎই পরগাছা। বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল পাড়া থেকে। হাঁটতে হাঁটতে শ্যামবাজার। রাত তখন দশটা। একটা ক্লাব থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল ভবঘুরেদের জন্য। লাইন দিল খুড়ো। ভেবেই চলেছে সে কি করবে!! কি করে চালাবে আগামী দিনগুলো?
কি করবে সে? চুরি করবে? করে জেলে যাবে? পাপ হবে না? কখনো তেমন বড় কোনো অন্যায় করেনি অশ্বিনী খুড়ো। নরেশের মৃত্যুটা নেহাৎই দুর্ঘটনা। তারপর কত রাত নিঃশব্দে কেঁদেছে সে। নিজের উপর ধিক্কারও দিয়েছে কত। ভাবতে ভাবতেই তার খাবারের লাইন এসে গেল। বুভুক্ষু উদরকে অবশেষে খানিকটা সান্ত্বনা প্রদান করা গেল।
হাঁটছিল বাগবাজারের গঙ্গার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবছিল। জেলে করোনার ভয়। পুলিশ জেলে নেবে না ছোট অপরাধীদের। পিটিয়েই শাস্তি দেবে। আবার তেমন বড় অপরাধ সে করবেই বা কী করে! সে তো আর অপরাধী নয়। জেলে কিভাবে যাওয়া যায় সেই সব পন্থা ভাবতে ভাবতে গঙ্গার ঘাটে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। স্বপ্নে এল স্ত্রী রমা, ছেলে অর্ণব, নরেশ। রমা নিষেধ করেছে ‘স্বপ্নে’, সে যেন আর অপরাধ না করে। নরেশ বলছে, “আমি কী অপরাধ করলাম খুড়ো? আমাকে তুমি মেরে ফেললে!” ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে অশ্বিনী খুড়ো। না, আর সে কোনো অপরাধ করতে পারবে না। কিন্তু যাবেই বা কোথায়? সকাল হয়। পরের সারাদিন সে শ্যামবাজার, বাগবাজার, নাগের বাজার আর দমদম কাজের খোঁজে ঘুরে বেরিয়েছে। কিন্তু হা হতস্মি। বিফল মনোরথ। এই লকডাউনের বাজারে রিক্সা থাকলেও কোনো লাভ হত না। এবার তার সব রাগ গিয়ে পড়ল জেলারের উপর। তাকে ছাড়তে গেল কেন! এর মধ্যে একটা পাড়ায় ঢুকেছিল কাজের আশায়। কিন্তু করোনা সন্দেহে সবাই মেরে ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছে। মুখে মাস্ক নেই বলে চিড়িয়া মোড়ে জুটেছে পুলিশের মার। খুব কষ্ট হচ্ছে অশ্বিনী খুড়োর।
৫
আজ দশ দিন হল হন্যে হয়ে উত্তর কলকাতার গলি গলি ঘুরেছে সে। একটু কাজের আশায়। একটু খাবারের খোঁজে। ঘুরে ঘুরে যখন সেই শ্যামবাজার এল তখন সন্ধ্যা। আবার প্রতিযোগিতা করে ক্লাবের ছেলেদের বদান্যতায় আংশিক ক্ষুন্নিবৃত্তি। শ্যামবাজারের এই ক্লাবটা তাকে এই ক’টা দিন বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু ছেলেরা বলছে কাল থেকে আর তারা খাওয়াতে পারবে না। তাদেরও নাকি ফান্ড শেষ। এই কথাটা শোনার পর বাকি মানুষগুলোর দিকে তাকাচ্ছিল অশ্বিনী খুড়ো। মাছের চোখের মতো পাতা না-পড়া তাদের চোখ। অসহায় ঝাপসা দৃষ্টি। নতুন করে কোন দুঃখ যাদের আর স্পর্শ করতে পারে বলে মনে হয় না। এই মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু ভরসা পায় অশ্বিনী খুড়ো। এরা যদি বেঁচে থাকতে পারে তো সেই বা তার জীবন নিয়ে এতো ভাবছে কেন!! এদেরও হয়তো একদিন সব ছিল, কেউ বন্যায় হারিয়েছে কেউ বা ঝড়ে হারিয়েছে তাদের জীবনের শেষ সম্বলটুকু। তারপর হয়তো এই মহানগরের ব্যস্ত রাস্তায় তাদের জীবনের ভাগ্যের ভেলা ভাসিয়ে দিয়েছে। ক্ষণিকের জন্য হলেও জন্য কলকাতার এই ভবঘুরদের শীতল চোখ তাকে খানিকটা আশার আলো দেখায়। কিন্তু এইভাবে সে বেঁচে থাকবে কি করে!! এইসব ভাবতে ভাবতে সে চলে যায় তার চেনা বাগবাজার গঙ্গার ধারে। হঠাৎ একটা চিন্তা মাথার মধ্যে উঁকি মারে অশ্বিনীর। তার থাকা না থাকায় দুনিয়ায় কার কী আসে যায়! কারো জীবনের দায়িত্ব নেই তার উপর। সে নিশ্চিন্ত সে মুক্ত। হঠাৎ এই চিন্তাটা অনেকটা হালকা করে অশ্বিনীকে। কিন্তু তার তার যে একটা অপরাধ হয়ে গেছে, একটা দায়িত্ব রয়ে গেছে। এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছে অশ্বিনী। হঠাৎ ভোররাতের দিকে ঘুমটা ভেঙে গেল। একি! ও নরেশের গলা না! ও আবার বলছে, “খুড়ো তুমি আমাকে মেরে ফেললে! আমার ছোট্ট মেয়েটাকে কে মানুষ করবে? আমার বউটার কি হবে? আমার বুড়ো বাপ তো আমি মরে যাবার দুঃখেই মরে গেল। তুমি খুন করেছ। তুমি খুনি।“ মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ ধাক্কা মারল তাকে। এখনো হাজারটা টাকা আছে। রাত ভোর থাকতে বাগবাজার থেকে সে হাঁটা দিল দমদমের দিকে। নরেশের বাড়ির দিকে। নরেশের বস্তির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সে। কিন্তু সে ওই বাড়ির মধ্যে ঢুকবে কি করে! ওরা কি বলবে? খুনি? কত সর্বনাশ করেছে সে এই পরিবারটার! সে কি উত্তর দেবে! ধার শোধ করতে এসেছে! একটা মানুষের জীবনের দাম কি শোধ করা যায়? না, ওদের মুখোমুখি হবার নেই সাহস নেই অশ্বিনী খুড়োর। পারবে না সে। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে পকেটের ওই এক হাজার টাকা, তার জীবনের শেষ স্থাবর সম্পত্তিটুকু কাগজে মুড়ে জানালা দিয়ে ওদের বাড়িতে দিয়ে দেয় সে। কোনো নাম থাকে না তার মধ্যে। আসলে নাম দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সেই সমস্ত মানুষের যারা বাইরের চাকচিক্যে বিশ্বাস করে। কিন্তু খুড়োর মতো মানুষেরা বিশ্বাস করে নীরব এই নিবেদনটুকুতেই। ওখান থেকে বেরিয়ে এল। এবার বড্ড হালকা লাগছে ওর। হাঁটছে উদাস মনেই। আজ আর ওর চাকরি খোঁজার তাড়া নেই। কারণ, খুঁজে লাভ কি? আবার চমকের মতো একটা চিন্তা এল। জেলে যাব? চেনাশোনা লোকেরা আছে। খাবার আছে। অপরাধীদের সরল মন আছে। বাইরের এই জেলখানার “নিরপরাধী” কুটিল মনের চেয়ে ওই জেলখানা যেন ভালো মনে হচ্ছে ওর। এই জীবনে তার পাবার কী আছে? বৌ নেই, ছেলে নেই, বাড়ি নেই, জীবিকা নেই, জীবিকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার বড় অপরাধ না করলে জেলে যাওয়ারও উপায় নেই। আচ্ছা এত লোকের করোনা হচ্ছে, তার কেন হচ্ছে না? করোনাও তাকে কেন দয়া করছে না? বড্ড বেয়াড়া এই করোনা ভাইরাস। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বড় হতাশ লাগে তার। হাঁটতে হাঁটতে যখন বাগবাজার গঙ্গার ঘাটে পৌঁছল তখন বেলা দশটা। আজ তার তাড়া নেই। ক্ষুধা নেই। তাই ক্ষুধা নিবৃত্তির তাড়নাও নেই। আজ তার মনটা পেশাদার খুনিদের মতোই শান্ত, শীতল। জেলে তাকে যেতেই হবে। কোনো গত্যন্তর নেই তার। তার জন্য চাই বড় একটা অপরাধ। একটা খুন! কিন্তু সে কি পারবে? বুকটা ধুকপুক করছে। লকডাউনের নীরবতায় প্রবহমান গঙ্গার ধারে নিজের হৃদস্পন্দন নিজেই শুনতে পাচ্ছে অশ্বিনী খুড়ো। ভাবনাগুলো দ্রুত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে তাকে। এখন কোনো একটা লোককে খুন করলে তো কেউ দেখতেই পাবে না, তাই জেলে যাওয়ার প্রশ্নও নেই। জেলে যেতে হলে কোনো জনবহুল এলাকায় খুন করতে হবে। কোনো জনবহুল এলাকাই বা এখন কোথায়? তাছাড়া সে তো খুনি নয়। কীভাবেই বা সে খুন করবে? গঙ্গায় ফেলে? ছুরি দিয়ে না বিষ খাইয়ে? ঘুম আসে না। বসন্তের নদীর বাতাসেও সে ঘেমে উঠছে। রমাকে যেন আবার ও দেখতে পাচ্ছে। সে বলছে, “পাপ করো না”। এই সব ভাবতে ভাবতে ওই তো একটা দড়ি। একটু দূরে একটা পাথর পড়ে আছে। এইরকম একটা পাথরে পড়ে খুন হয়েছিল নরেশ। ওগুলোই আজ তার খুনের অস্ত্র। খুনের শিকারও ঠিক করে নিয়েছে। রমাকে প্রথমবার দুঃখ দেবে সে। তবু অপরাধ না করে তার উপায় নেই। মুক্ত বাতাসে তার মুক্তি নেই। কারাগারেই তার মুক্তি। দড়ির একদিক পাথরে বাঁধে আর আর একদিক বাঁধে শিকারের কোমরে। তারপর গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে শিকারকে ছুঁড়ে ফেলল গঙ্গার জলে। অনাবিল আনন্দ। এবার রমার কাছে যেতে পারবে সে, অর্ণবকে আবার দেখতে পাবে। নরেশের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেবে অশ্বিনী খুড়ো।
৬
দুদিন পর দৈনিক সংবাদ এর কলকাতা পাতায় -
গার্ডেনরিচে কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্থায় একটা মৃতদেহ ভেসে উঠেছে। পুলিশ দেহটি শনাক্ত করেছে। মৃতের নাম অশ্বিনী বিশ্বাস। সম্প্রতি সে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল। পুলিশ জানিয়েছে, ময়নাতদন্ত না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।