Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা - শারদীয়া, ২০২০

Others/অন্যান্য

হিন্দি-চিনি – ভাই ভাই; আম জনতার সাথে তাই (ধারাবাহিক রচনার দ্বিতীয় পর্ব)

তপন কুমার দাস


এদিকে সময় বেরিয়ে যাচ্ছে, সন্ধ্যা নেমে আসছে। ঘড়ি বড়ই অনুদার, সে কারো জন্যই অপেক্ষা করতে রাজি নয়। অনেক কাজ বাকি রয়েছে, প্রথমে এই শহরে আমায় একটি সাইকেল কিনতে হবে, প্রায় পনের হাজার কিমি পথ চলে আগের সাইকেলটির প্রাণশক্তি কমেছে, বেশি ভার সে বইতে অক্ষম। চীনে সাইকেলের দাম কম, তাই এখানে থেকেই নতুন সাইকেল নিতে হবে, এই ভাবনায় পুরাতন সাইকেলখানি রেখে এসেছি। দ্বিতীয়ত, টেন্ট ও আরো কিছু কেনাকাটা বাকি আছে। স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আশেপাশে কিছু পথ ঘুরে দোকান খুঁজে না পেয়ে একজন ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে, ও বাইডু তে ম্যাপ দেখে চার কিমি দুরের জায়ান্ট বাইকশপের সন্ধান দিল। পায়ে হেঁটেই শহর দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম দোকানে, প্রাথমিক কথাবার্তা বলে ফিরে এলাম।

ইউথ হস্টেলের কাছেই শহরের মূল আকর্ষণ তার ম্যাল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত সমাগত। শত-শত লোকের পদচারণায় সরগরম এই অঞ্চল। আলোর ছটায় মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। বিরাট বিরাট শপিং মল, অনেক চেষ্টা করেও ক্যামেরায় আনতে পারছি না, জামাকাপড়, খাবারের দোকান, গয়নাগাঁটি, কসমেটিকস - কেউ জায়গা ছাড়তে রাজি নয়। নাইকি, মোবাইল ফোন, ক্যামেরা কোম্পানিগুলো নিজেরাই একটি আস্ত মল খুলে বসেছে। এ শহরের মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার ছবি যেন আলোর মতই ঠিকরে বেরোচ্ছে।

চীন সাইকেলে (১২) :- আজ সারা দিন চক্কর কাটলাম শহর জুড়ে। শেষে সাইকেল নিয়ে ফিরলাম হস্টেলে। রাতের সাংহাইকে স্মৃতিতে ধরে রাখার আছিলায় বেরিয়ে পড়লাম আরেকবার ম্যালের দিকে। পূর্বমুখী হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গিয়েছি অনেকটাই, হঠাৎ নজরে এল, পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমমুখীও একটা বিপরীত স্রোত আসছে। ঠিক যেন কলকাতার পূজার প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখার লাইন, সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশরা। এত লোক আসছে কোথা থেকে, তার খোঁজে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বুঝলাম, ম্যালের বাইরে রাতের সাংহাই-এর আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে আাছে এখানে। নদীকে ঘিরে চারপাশে সমস্ত প্রধান প্রশাসনিক ভবনের আলোকমালা রাতের শহরকে রাঙিয়ে তুলেছে। অদূরে নদীর ওপারে মাথা উচু করে আপন অস্তিত্ব, এই শহরের পরিচিতি জানান দিয়ে চলেছে, সাংহাই টাওয়ার। নদী পাড়ে রকমারি সাজে সুসজ্জিতা এক মনোরম পার্ক। ঢোকার পথে দাড়িয়ে রয়েছেন মাও। পার্কের উপরিভাগে ওঠায় নজরে এলো চারপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। মাঝে-মাঝে নদীপথে আলোর মালায় সজ্জিত ট্যুরিস্ট লঞ্চগুলো যেন মন চুরি করে নিয়ে যায়।

সাংহাইয়ের এই রাতের স্মৃতি সত্যিই মনে দাগ কেটে যায়।

চীন সাইকেলে ( ১৩) ঃ - গতকাল রাতেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়েছিলাম, সকাল হতেই সাইকেলটিকে সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। সামনে চীনা ভাষায় লেখা world cycle expedition in China, 2019, গোলাকারে 'We want Pollution free and Peaceful world' নিচে লেখা বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিপদ ঠেকাতে, আমাদের সাম্প্রতিকতম আবেদন, Please, declare Environmental emergency. সবটাই চীনা ভাষায় লেখা। বাস্তবিক, চীনা ভাষায় এই আবেদনই কিন্তু সর্বত্র পরিবেশ সচেতন চীনাবাসীর মন জয় করে নিয়েছে। আমার সাইকেলের দু’পাশে দুই ব্যাগ ও গেঞ্জিতে, টুপিতেও জায়গা পেয়েছে একই আবেদন, সঙ্গে গেঞ্জিতে স্থান পেয়েছে আমাদের অপর্ণার আঁকা দুদেশের জাতীয় পতাকা। সবটাই অবশ্য তিন শিল্পী অভিজিৎ, অপর্ণা আর আনন্দের অবদান।

 

যাই হোক, বাইরে ইউথ হস্টেলের উল্টোদিকেই সাংহাই শহরের দমকল বিভাগ। অনেকগুলো কমবয়সী যুব কর্মচারী শারিরীক কসরতে ব্যস্ত। ভালো লাগল এদের নিজেকে ফিট রাখার এই উদ্যম দেখে, অবশ্যই এই উদ্যোগ দপ্তরের। জাপানেও এই জিনিস চোখে পড়েছিল। সব দেশেই পুলিশ প্রশাসন, দমকল, নিজের কর্মীদের ফিট রাখার রুটিন মাফিক কর্মসূচি রয়েছে, আমাদের দেশে শুধুমাত্র সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য কোথাও তা নজরে আসে না। যাই হোক, এদের এই বহুমুখী উদ্যম এতো ভালো লাগল যে ঠিক করলাম এখান থেকেই আমি আমার যাত্রার সূচনা করব। ফিরে এসে সাইকেল নিয়ে ওদের কাছে দাড়াতেই ওদের প্রধান এগিয়ে এলেন, সাইকেলে লেখা আর আমার আবেদনে এতটাই আপ্লুত হলেন যে একাংশের যুবককে শরীরচর্চা বন্ধ করিয়ে তাদেরও ডেকে নিলেন। সবাই মিলে হৈ হৈ করে আমার সাইকেলটিকে নিখুঁতভাবে সাজিয়ে দিলেন। সবাই মিলে যাত্রার ছবি তুলে, কোন পথে আমি বেজিং পৌছব, তার নাড়ি-নক্ষত্র বাতলে দিলেন।

যাত্রা হল শুরু, কিন্তু এদেশে মাও-কে বাদ দিয়ে কিছু হয় না, কাজেই আমিই তার অন্যথা করি কেন? তাই ওখান থেকে বেরিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রের দিকে এগিয়ে চললাম, শহরের সাইকেল লেন আলাদা, জনবসতির মধ্যে দিয়েই বেশি। একটু এগোতেই বড় হেল্থ কমিউনিটি সেন্টার। দুই বৃদ্ধের তুমুল বিতর্ক চলছে, হাতাহাতিটুকু বাকি আছে, দাঁড়িয়ে ওদের বিতর্কটা একটু উপভোগ করে আবার এগিয়ে চলি, শহরের প্রাণকেন্দ্রে যে দাঁড়িয়ে আছেন এদেশের বিপ্লবের পথপ্রদর্শক মাও। পার্কে পৌঁছে তাঁর মূর্তিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে শহর ছাড়লাম।

শহর ছেড়ে এগিয়ে চলেছি, শেষ হবে এই যাত্রা বেজিং-এ, কিন্তু আজকের গন্তব্য প্রায় ১০০ কিমি দুরের Suzhou, চলতে চলতে মাঝে মধ্যেই সিগন্যাল-এ দাঁড়াতে মানুষ নিজেই এসে জেনে যাচ্ছেন, লেখা পড়ে বুঝে নিচ্ছেন কোথায় চলেছি, কেন চলছি। নিজে থেকেই তাঁরা বেজিং যাবার পথ বাতলে দিচ্ছেন।

গোল বাধলো এখানেই। ফোনটা একইসাথে ছবি তোলার জন্য ব্যবহার হচ্ছে বলে তাকে পথ দেখার কাজে ব্যবহার করতে পারছি কম। প্রায় দু’ঘন্টা পথ চলার পর মালুম হল বেজিং শুনে মানুষ আমাকে বেজিং-এ যাবার সর্টকার্ট পথে এগিয়ে দিয়েছেন। আজকের গন্তব্য Suzhou-র পথে নয়। শেষ পর্যন্ত এক জোমাটো যুবকের পর Suzhou যাবার হাইওয়ের পথ খুঁজে পেলাম। হাইওয়ে যদিও আমার পছন্দের নয়, মানুষের মাঝেই আমাদের বার্তা নিয়ে যেতে চাই, তাও যেন শহরের অসংখ্য জটিল চক্রব্যূহ পথের বাইরে বেরোতে পেরে স্বস্তিই পেলাম।

চীন সাইকেলে ( ১৪) : – শহর ছাড়িয়ে চলতে চলতে মাঝদুপুরে পৌছালাম টঙ্গি ইউনিভার্সিটির দোরগোড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় মানে সর্বোচ্চ জ্ঞানের জগৎ। অনেক ভাবেন, আমার এই সাইকেল অভিযান কোনো ভ্রমণ কর্মসূচি, মোটেই তা নয়, দর্শনীয় স্থান অপেক্ষা আমাদের পরিবেশ বার্তা মানুষের কাছে পৌছে দেবার জন্য, জনবসতিকে ঘিরেই আমার সাইকেল যাত্রা বেশি। পথে দর্শনীয় স্থান পড়লে নিশ্চয়ই দেখে নেবার উৎসাহ থাকে, কিন্তু ওটাই প্রধান নয়, ওটা অতিরিক্ত। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পথে পড়লে, কেন জানি তাকে উপেক্ষা করতে পারি না। মনে হয়, আজকের এই উষ্ণায়নের যুগে আমাদের বার্তা সবচেয়ে বেশি গ্রহণীয় হবে তো ওনাদের কাছেই। ভাষার ব্যবধান সত্বেও আমাদের প্রোগ্রামের গুরুত্ব ওনাদের থেকে কে আর বেশি বুঝবে? ওদের কাছেই ওদের দেশের তথ্যভাণ্ডার, সুচিন্তিত বিশ্লেষণ ও মতামত দিতে ওদের থেকে আর কে বেশি পারবে? তাই এই তীর্থক্ষেত্র আমি মিস না করারই চেষ্টা করি।

টঙ্গি বিশ্ববিদ্যালয়টা বড়ই, কম করে ৪-৫ কিমির বেশি জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে। স্থাপত্যতেও কম যায় না। সবটা ঘুরে দেখার মতো সময় হাতে নেই, আকাশও কালো করে আসছে। খেলার মাঠ, ডেভলপমেন্ট সাইন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগেই আবার অনেক উপবিভাগ, সবটাই বর্তমানের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন বিষয়। দেখতে দেখতে কম্পিউটার বিভাগে পৌছাতেই আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু হল। মনে মনে ভাবলাম, ভালোই হল, আরেকটু ভালো করে দেখে নিই। ঢুকতেই বড় হল, রিসেপশন ছাড়িয়ে হলে সার বেঁধে অতীতের রাষ্ট্রনেতারা, তার পরের সারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকপাল ব্যক্তিত্বরা। ভেতরে হলে প্রজেক্টরে ক্লাস চলছে। ক্লাসে ঢোকার আগে হতে ছাত্রদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে পানীয় জলের বোতল। বাঁদিকে মোড় নিতেই বড় বড় করে বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের খতিয়ান। লেখা বর্তমান বর্ষে কম্পিউটার বিভাগ ১১৭ জনকে প্লেসমেন্ট-এর ব্যবস্থা করেছে। ভালো লাগল, শিক্ষা শেষে জীবিকার দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা রয়েছে। স্টাফরা যথেষ্ট আন্তরিক ও উদারমনা। চার্জ চলে যাওয়া ফোনে চার্জ এবং টিফিন ও জলের ব্যবস্থা করে দিল তারাই। 

এখানে দিন কাটালে চলবে না, এখনো প্রচুর পথ বাকি। তাই হালকা বৃষ্টির মধ্যেই রেনকোট চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মাঝে-মধ্যে পথ ভুল, ঠিক সময়ে ঠিক লেন নিতে না পারায়, অতিরিক্ত পথ জুড়ে দিচ্ছে আমার জিপিএস।

বিকেল গড়িয়ে রাত, মাঝরাত পথ যেন ফুরোয় না। রাত এগারোটা, রাজপথের ক্যামেরা অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে আমারও ছবি তুলে চলেছে। মুশকিল হল, আজকের দিনটির জন্য আগাম বুক করা রয়েছে হোটেল, তা তখনো ত্রিশ কিমি দূরে। ফাঁকা রাস্তায় একাই চলেছি, মাঝে-মধ্যে এক-আধটি গাড়ি আমায় পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এগোনো ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। রাত প্রায় ১২ টা, পথে পুলিশ দেখে দাঁড়ালাম, আমার প্রোগ্রামের কথা বলতে ভাষার কারণে প্রথমে মাথা নেড়ে ‘নো নো’ করলেও পরে সাইকেলের সামনের চীনা ভাষায় লেখা পড়ে আপ্লুত হয়ে স্যালুট জানাতে লাগল। মনে মনে বললাম, বাবা আমাকে স্যালুট না জানিয়ে একটি রাত কাটানোর জায়গা খুঁজে দাও, খুশি হব। মুখে সেকথা বলতেই উনি আমায় সামনের হোটেলে পৌঁছে দিলেন, কিন্তু উনি পৌঁছে দিলে কি হবে, রিসেপশনে বসে থাকা মহিলাদ্বয় হোটেলের রুমের ভাড়া কমাতে রাজি হলেন না। অগত্যা, আমার নির্দিষ্ট হোটেলের দিকে আবার রওনা হলাম। পথঘাট ফাঁকা, চোর-ডাকাতের ভয় নেই। কিন্তু ঠিক পথে যাচ্ছি কি না তা জিজ্ঞেস করে জানার লোকও নেই। অবশেষে এপাশ-ওপাশ করতে করতে রাত দু’টোর সময় নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছলাম, কিন্তু তার পরেও বিপত্তির শেষ নেই, হোটেলের কাছাকাছি এসেই ফোনের চার্জও বিদায় নিল।

ভাগ্য ভালো, একটি বড় দোকান খোলা ছিল, ওখানে ফোন চার্জ দিয়ে, ফাংশান ফেরত একদল ছেলেমেয়ের সাহায্য নিয়ে যখন হোটেল পৌঁছলাম, তখন রাত প্রায় তিনটে। ভিয়েতনামে একদিন রাত দু’টো অবধি সাইকেল চালাতে হয়েছিল, এখানে রাত তিনটে, এ-ও এক রেকর্ড। আর এর মধ্যে দিয়েই একইসাথে পাঠককূল নিশ্চয়ই অনুভব করবেন, এই দেশগুলোর আইনশৃঙ্খলা, মানুষের নিরাপত্তা কোন স্তরে রয়েছে।

চীন সাইকেলে (১৫) :- পরদিন ঘুম ভাঙলো বেলা ৯ টায়। রেডি হয়ে বেরোতে দশটা। সুঝুঁ শহরের শেষ প্রান্তে এটি একটি উপশহরই বলা যেতে পারে, কিন্তু সব ব্যবস্থাই রয়েছে। শহর তস্য শহর ভেঙে এগোতে থাকি, গাছের ছাওয়ায় ঘেরা পথ, হালকা হাওয়ায় যেন ঠান্ডাই লাগে। কাল রাতে দেখা হয়নি, এখন নজরে পড়ল, এই শহরের প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বার এখন আমার কাছে বহির্দ্বার। শহরের মায়া পেছনে ফেলে এগিয়ে চলছি, আজকের গন্তব্য Wexi শহর পেড়িয়ে Schouzhou, প্রায় ১২০কিমি। কিছুটা এগোতেই পথের পাশে ছোট নদী পাড়ে পুরোনো বৌদ্ধ মন্দির, পূজার জন্য নয়, ঐতিহ্যমণ্ডিত দর্শনীয় স্থান হিসেবেই ভিড়। দূর থেকেই ছবি তুলে দায়িত্ব সারলাম। কিন্তু ঘণ্টাখানেক ওই ছোঁয়া নদীকে সঙ্গী করে চলতে চলতে, চলে এলাম আরো এক হেরিটেজ শহরে। রাজপথ ছেড়ে গলিতে পা রাখতেই যেন ফিরে গেলাম দু’হাজার বছর আগে। ঐতিহ্যবাহী ওই বাড়িগুলো চীনা সংস্কৃতির অঙ্গ। পুরোনো এই মডেল শহরের মধ্যে দিয়ে ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার এই যে প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে চীনাবাসীদের ইতিহাসবোধের পরিচয়। আধঘণ্টা ওখানে কাটিয়ে ফিরে আসি বাস্তবে। 

অনেক পথ চলতে হবে। হাইওয়েতে পড়ে কয়েক শহর পেরোতেই বড় নদী এসে সঙ্গী হলো, নাম jinghang yumhe, নদী না হয়ে খালও হতে পারে, কারণ, নদী এমন সোজা হবার কথা নয়। পরে এদেশের নদী ও খাল সংস্কার নিয়ে আলোচনা করব। আপাতত ম্যাপে দেখলাম, এই নদী ১০০ কিমি দুরে আমার আজকের গন্তব্য Canzhouhh পর্যন্ত চলে গেছে। বাস্তবিকই, দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি সেই ছিল আমার পথের সাথী।

নদী পাড়ে সুদীর্ঘ পার্ক, তার পাশ দিয়ে দীর্ঘ পথ। এই পথে একটি সুবিধা হারিয়ে যাবার বা পথ ভুলের ভয় নেই। বিকেল তিনটের কাঁটা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ, পেট চুঁই চুঁই করছে, খাবারের জায়গাও নজরে আসে না। ফোনটা চার্জ দিতে হবে। অনিচ্ছুক শরীরকে জোর করে এগিয়ে নিয়ে চলেছি। হঠাৎই নজরে এল একটি মাল্টিপ্লেক্স এরিয়া ও তার শপিং মল।

সাইকেলটাকে জনতার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিয়ে খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম।

একটি রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে পড়লাম। মালিক সম্ভবত কমিউনিস্ট, রেস্টুরেন্টের দেওয়ালে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন ও মাও-এর একত্রিত ছবি। রেস্টুরেন্ট জুড়ে বিপ্লবের সময়কালের জনযুদ্ধের ছবি। রয়েছে সেই সময়ের একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিখ্যাত কার্টুন ছবি, মাও-এর নেতৃত্বে জনতা দেশ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করছে মালিকশ্রেণী ও তাদের দালাল চিয়াং কাইশেককে। খেতে খেতে সামান্য কথা এগোল ভদ্রলোকের সাথে, হয়তো ইচ্ছে থাকলেও ওনার মনের সব কথা উজাড় হল না ভাষার ব্যবধানে।

দিন শেষ সন্ধ্যা নামার ইঙ্গিত আসছে, তাড়াহুড়োয় বেড়িয়ে এলাম। অর্ধেক পথ পড়ে আছে এখনো, নদী পাড়ে পার্কের পথ ধরে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছি। নদী ছাড়া প্রকৃতির রূপ যেন খোলে না। সন্ধ্যার আগমনে নদীর ওপারের শহর যেন আলোর মালায় অপরূপা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, কিছুটা গিয়ে নদীর সাথে সখ্যতা ঘুচিয়ে পথ এখানে শহরমুখী। শহর মানেই গাড়ির ভিড়, সিগন্যাল, সামান্য হলেও জ্যামজট, সব পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছি হঠাৎ নজরে এল, এই! হেলমেট ? মনে পড়ল, এই যাঃ ! হেলমেট ছেড়ে এসেছি কুড়ি কিমি দূরের সেই মাল্টিপ্লেক্স-এর সাইকেল স্ট্যান্ডে। কি করব? আবার এতটা পেছনে যাব? ভাবলাম দু’ মিনিট, তারপর ছুট্ ছুট্ ছুট্ । আবার পেছন পানে ছুটে চললাম।

চীন সাইকেলে(১৬) :- ছুটলাম বটে কিন্তু শেষরক্ষা হল না। নদীর পাড় বরাবর এসেও ঠিক একটু আগে এসে পথ গুলালাম। ভুল করে অন্য একটি মাল্টিপ্লেক্সে ঢুকে তার বেরোবার পথে গোলকধাঁধায় অন্য দিকে গড়িয়ে গেলাম। জায়গার নামটিও সেই সময় নোট করা হয়নি। রাত সাড়ে ন’টা অবধি ঘুরপাক খেয়ে হতাশ হয়ে রণে ভঙ্গ দিলাম। কোথায় রাত কাটাব সেই খোঁজে লেগে পড়লাম। গতকাল অবধি হোটেল বুক করা ছিল, আজ থেকে খুঁজে নিয়ে ঠিক করার ভাবনাই ছিল। এদেশে একটি অসুবিধা হল তাঁবুতে রাত্রিবাসের সুযোগ নেই বললেই চলে। হোটেলে প্রায় সবই ডবল বেড ও এ. সি রুম, ভারতে যার ভাড়া নূন্যতম দু’হাজার টাকা, এখানে ওদের টাকায় ৬৮ থেকে একশ হলেও ভারতীয় টাকায় প্রায় হাজার টাকা টেন্টে থাকা মানুষ আমরা, গায়ে লাগে। গতকাল রাতে সাড়ে সাতশ টাকা নিয়েছে, আজ আর অত খরচ করলে চলবে না। কম খরচে হোটেলের খুঁজতে খুঁজতে এগোচ্ছিলাম, চীনা ভাষায় লেখা, বোঝাও যায় না, কোনটা হোটেল কোনটা অন্য কিছু। রিসেপশনের টেবিলটা দেখে বুঝে নিই। এরকমই একটি টেবিলে বসে ফোন ঘাট ছিল বছর ২৬-এর এক যুবক। হোটেল ভেবে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি সুইজা (হোটেল)? ছেলেটি কোন উত্তর না দিয়ে আপন মনে ফোনে মগ্ন। আবার কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলাম এটা কি সুইজা? এবার ওর সম্বিত ফিরলো, বলল, ‘আমায় বলছেন? না এটা একটি ডায়গনস্টিক সেন্টার।‘ আমার প্রোগ্রামের কথা বলে,বললাম, আমি কি তোমার সাথে রাত কাটাতে পারি? আবার কোন সারাশব্দ নেই, ভাবলাম আমার কথাটা বুঝতে পারেনি হয় তো, তাই আবার পুনরাবৃত্তি করলাম। এবার উত্তর এল, ‘দাঁড়াও আমার এক দিদি আছে। সে তোমায় এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারে। ভালো কথা, দাড়িয়ে রয়েছি, ও ফোন করল, না কি বলল কাকে, কিছুই বুঝলাম না। ও আবার ফোনের জগতে চলে গেছে। দাঁড়িয়ে আছি, এর মধ্যে বারদুয়েক ওকে মনেও করিয়েছি, ‘হ্যাঁ, দাড়াও’ বলেই ও আবার ওর জগতে। আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি, আর অপেক্ষা করা যায় না। এদিকে রাত বাড়ছে, নদীর হাওয়ায় বাড়ছে ঠান্ডাও, দাঁড়ানো যাচ্ছে না, চলে যাব কি না ভাবছি, হঠাৎ দেখি, ও বাচ্চাদের মতো হাত তুলে আনন্দে আর উত্তেজনায় চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘চালাও চালাও, ধরো ধরো ধরো, মারো মারো মারো!’ আমি আর থাকতে না পেরে ওর ফোনে উঁকি দিলাম, আমার চক্ষু চড়কগাছ! বাবু বাচ্চাদের গেম খেলছে, পাবজি বা টিকটক, একটা কিছু হবে। আমি ওই ঠান্ডায়, নিজের দুর্দশাতেও হেসে ফেললাম। ভাবলাম, আরে! এ কার পাল্লায় আমি পড়েছি! এতক্ষণ ও ওই জগতেই পড়ে আছে, আর আমি ভাবছি, ও হয়তো আমার জন্যই কাউকে ফোন অথবা মেসেজ পাঠাচ্ছে। এবার ওর উত্তেজনার মাঝখানে দাঁড়ি টেনে একটু গলা চড়িয়েই আমি বললাম, ‘আরে ভাই, আমি তো দাড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ, তোমার দিদি কিছু খবর দিল কি?’ এবার ও বাস্তবে ফিরে এল, একটু ভেবে নিয়ে বললো, ‘অ্যাঁ! তোমায় আমি বলিনি, দিদি তো অনেকক্ষণ আগেই বলে দিয়েছে, হবে না।‘ এবার একটু বিরক্ত হয়ে কড়া ভাষায় বললাম, দিলে তো আমার আধঘন্টা নষ্ট করে। ও ‘সরি, সরি’ বলছিল। আমি আর তার প্রত্যুত্তর না করে সাইকেলে উঠে পড়লাম।

ভাবতে শুরু করলাম, পাবজি, টিকটক, আর ভিডিও গেম আমাদের তরুণ সমাজকে কোথায় নিয়ে চলেছে। এই ব্যাধি কীভাবে আমাদের দেশ ও গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে। এখানেও কেউ কেউ তার মোহ এড়াতে পারছে না।

পৃথিবীর সর্বত্রই দেখছি মানুষের জীবনটা অর্ধেক ফোনেই আটকে গেছে। হয় ফেসবুক, না হয় হোয়াটসঅ্যাপ অথবা অন্য কিছু। ফোন আমাদের দরকার অবশ্যই, কিন্তু এটাই জীবনের সবকিছু হয়ে গেলে বিপদ। আগে বাম নেতাদের বক্তৃতায় শুনতাম যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তার ভাবনায় যুবসমাজকে গড়ে তোলার জন্য একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার চেষ্টা করে কখনো সিনেমা ও সংস্কৃতি জগতের মধ্যে দিয়ে কখনো বা অন্যভাবে। যে ভাবনার মোদ্দা কথা হল, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তুমি দেশ, সমাজ, মানুষের অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামিও না, ওটা রাজনীতিকদের কাজ, ওটা ভালো মানুষের কাজ নয়। তুমি তোমার নিজের জগতে থাক, ওই জগৎ নিয়ে থাক। তার সব আয়োজন ও উপকরণ নিয়ে হাজির হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া ও বহুজাতিক টেলিকম ও কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলো। দেশে দেশে তাদের নিরুপদ্রব লুট প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবার জন্যই তাদের এই আয়োজন। তারা এই কাজে যে অনেকটাই আজ সফল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।