Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা - শারদীয়া, ২০২০

Others/অন্যান্য

যে উপাখ্যান লেখা হয়নি (ধারাবাহিক রচনার দ্বিতীয় পর্ব)

অজন্তা সিনহা


প্রাণের পুজো যেখানে

এই পর্বের শুরুটা করবো আগের পর্বের রেশ ধরেই…! সেই তরুণ নেপালি ড্রাইভার, যে বৃষ্টিমুখর পাহাড়ী পথে যেতে যেতে ভিজে বাতাসের সৌরভ মাখিয়ে বলছিল তার একান্ত অন্তর ভাবনার কথা ! "স্কুল ছাড়লেও স্কুলের প্রেয়ারে যে কবিতাটা বলতাম,সেটা আজও ভুলিনি ম্যাডাম...Where the mind is without fear and the head is held high,where knowledge is free…"! বলেছিল, সমস্যা-সংকটে আজও সে এই শব্দগুলি উচ্চারণ করে শক্তি ফিরে পায়। আহা, কি অপূর্ব এই প্রাপ্তি। কি অপ্রত্যাশিত উপহার। আমি নিজেও মনে মনে বলি,'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর…'! রবীন্দ্রনাথকে যথার্থই প্রাণের মধ্যে পেয়েছে এই ছেলে ! সেদিন কথা রেখেছিল সে । নিয়ে গেছিল আমায় মংপুতে । সেও এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা।

 

মংপু বাংলো, যেখানে কখনও কখনও অবকাশে এসে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। এখন এটি রবীন্দ্রভবন মিউজিয়াম। শ্রাবণের শেষ। পাহাড়ের পথে প্রান্তরে শেষ বরষার ধারা ঢেলে বিদায়ের গান গাইছে প্রকৃতি। সেই সুর আবহে নিয়েই পৌঁছলাম কবির পাহাড়-বাড়ির দরজায়। আমাদের মতো মানুষের কাছে এ যে এক পরম তীর্থক্ষেত্র, তা বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না। স্বাধীনতা দিবসের ছুটি। অতএব রবীন্দ্রভবনের গেটে তালা। সে যাই হোক ! এত কাছে এসেছি, এমন কোন তালা আছে যে আমায় আটকাবে ? 

মূল গেটটি বিশাল। তবে, সেটা খুলতে খুব সমস্যা হলো না। ড্রাইভার ভাই নেপালি ভাষায় তার চেনা দারোয়ানকে কিছু বললো। দারোয়ান খুলে দিল গেট। ভিতরে ঢোকার পর দেখলাম খোলা জানালার ওপাশে একজন দাঁড়িয়ে, ইনিই কেয়ারটেকার। ওঁকে দেখামাত্রই আমি একেবারে ছিঁচকাদুনে বালিকা হয়ে গেলাম। অঝোরে বৃষ্টি, আমার সর্বাঙ্গ ভিজে একাকার, কলকাতা এবং বাঙালি...এই যাবতীয় পরিস্থিতি বিচার করে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন তিনি। ঘুরে দেখলাম ভিতরটা। ঢুকেই রবীন্দ্রনাথের বিশাল এক আলোকচিত্র। মনে হলো তাকিয়ে আছেন আমার দিকেই। শান্ত, সৌম্য ও অদ্ভুত অন্তর্ভেদী এক দৃষ্টি। দেখলাম ওঁর ডিজাইন করা আসবাব, বিশেষত লেখার টেবিল-চেয়ার। টেবিলের ওপরের কলমদানিটিও নিজেই ডিজাইন করেছেন। ভগ্নপ্রায় উপাসনাঘর দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। শুনেছি কবির বড় প্রিয় ছিল এই উপাসনাঘর !

এমনিতে ভবনটি বেশ পরিচ্ছন্ন। বারান্দায় ওঠার যে দু'চার ধাপ সিঁড়ি, সেখানেই বসে পড়লাম। কি শান্তি চারপাশে। জায়গাটি একটি মালভূমির আকার, যাকে ঘিরে রেখেছে প্রকৃতি মায়ের আঁচল। রয়েছে প্রাচীন বেশ কিছু গাছ, মাথা প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে তাদের। এছাড়া ফুল ও অর্কিডের বাহার তো আছেই। সেসব দেখতে দেখতেই কানে এল এক উদাত্ত পুরুষকণ্ঠের গান। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক গাইছেন। আহা, কি অপূর্ব! ওঁর কন্ঠ, বাইরের ভেজা প্রকৃতি, সব মিলিয়ে এক অনির্বচনীয় আবহ সৃষ্টি হলো। মনে হলো, আমাদের সকলের প্রাণের মানুষ যেন আজও আছেন এখানে। সেই দ্রবীভূত অনুভূতি কাটিয়ে এক সময় গাড়িতে উঠলাম। দাওয়াই পানি পৌঁছনোর সিডিউল সময় বহুক্ষণ পার হয়ে গেছে। সে হোক, যা পেলাম, তা যে চিরকালের সম্পদ !

বাদল মেঘ সরে যেতেই আকাশ-বাতাস জুড়ে উৎসবের আমেজ। পুজো এসে গেল। প্রকৃতির এত কাছে আসার আগে পর্যন্ত শরতের এমন নীল আকাশ দেখিনি। দেখিনি কালো মেঘের ভ্রুকুটি দূর হতেই আলস্যে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের দলকে। পাহাড়ের শরৎ, পাহাড়ের আর সব ঋতুর মতোই বড় সুন্দর। চলতে-ফিরতে ছুটির আমন্ত্রণ এসে হাজির হয় অনুভবের দরজায়। সেই অনুষঙ্গেই মেলে দুর্গাপুজোর আমেজ। পাহাড়ে একেবারে কাছ থেকে প্রথম দুর্গাপুজো দেখি সিলেরি গাঁও বলে উত্তরবঙ্গের এক গ্রামে। সেটা অন্য এক কারণেও এক না ভোলা শারদীয়া হয়ে আছে আমার কাছে। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার বছর সেটা। আর ওই দূর পাহাড়ে বসেই সেই খবর পাই। কলকাতা থেকে চেনা একজন ফোন করে জানায়। 

বহু বছর ধরে পুজোর ছুটি আমার উত্তরবঙ্গেই কাটে। আগের দিনই পৌঁছেছি সিলেরি গাঁও। সম্ভবত সেটা ছিল সপ্তমী। পরের দিন সকালে ওই খবর...বড় বেদনার মতো বেজেছিল! ফিরে আসি পুজোর কথায়। পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে সেদিন গিয়েছিলাম রোমিতে ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে তিস্তা বড় সুন্দর। অনেকটা দীর্ঘ তার যাত্রাপথ দৃশ্যমান। চারপাশের আকাশ ছোঁয়া পর্বতমালার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে তিস্তা। সেই অবর্ণনীয় সৌন্দর্য স্মৃতিতে ও ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করে ফিরছি, হোমস্টে-র কাছে আসতেই ঘিরে ধরলো একদল খুদে। ওরা দুর্গাপুজো করেছে সেখানে যেতে হবে। পিছনের ক্যানভাস রচনা করেছে সারি সারি পাইন গাছ। পুজোটা যেখানে হচ্ছে, সেটা ছোট্ট একটুকরো সমতল জমি। রংবেরংয়ের কাপড়,জরি, চুমকি ইত্যাদি দিয়ে বেশ বাহারি এক প্যান্ডেল। সেখানে মা দুর্গা তাঁর সন্তানসন্ততি নিয়ে দাঁড়িয়ে। সকলেই বেশ ছোটখাটো মিষ্টি চেহারার। এমনকী অসুরও। ওদের কাছ থেকে প্রসাদ খেয়ে, জোর করে কিছু টাকা হাতে দিয়ে এলাম। বললাম, আমাদের নিয়ম পুজোয় চাঁদা দিতেই হয়। নয়তো মা দুর্গা রুষ্ট হন। আমার ভাঙা হিন্দি ভাষা শুনে ওরা ওদের মতো করে কিছু বুঝে নেয়। আমি ঘরে ফিরি।  

এরপর বহুবার বহু ছোট ছোট গ্রামে এভাবেই পুজো দেখার অমল অভিজ্ঞতা হয়েছে। এক বছরের কথা, সেবার পেডং-এ আছি। সপ্তমীর সকালে একটি গাড়ি নিয়ে পেডং থেকে লাভা যাচ্ছি। রাস্তায় ওই রকমই একটি ছোট আকারের পুজো। এখানে উদ্যোক্তারা বয়সে একটু বড়। আমি গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলতে যেতেই তারা নেপালি ভাষায় কিছু বলে। ড্রাইভার তরুণটি (প্রায় কিশোর/খুব অল্প বয়সেই জীবিকার প্রয়োজনে এরা ড্রাইভারের পেশায় চলে আসে) বলে, এখনও ঠাকুরের মুখ ঢাকা, পুরুত আসলে খোলা হবে, ততক্ষণ অপেক্ষা করতে অনুরোধ করছে ওরা। বলতে বলতেই আর একজন আমাকে চেয়ার পেতে দেয় বসার জন্য। আমি এই সুযোগে কিছু প্রশ্ন করে নিই, যা ফিরে গিয়ে আমার লেখার রসদ হবে। পুরুত আসতে আরও ঘন্টাখানেক বাকি। ড্রাইভার ভাইয়ের পরামর্শে আমরা লাভার পথে রওনা দিলাম। ফেরার পথে ছবি তোলা, প্রসাদ খাওয়া সব হবে। লাভাতে কিছুক্ষণ থাকবো আমি। তারমধ্যে এদের পুজো হয়ে যাবে। হলোও সেটা। ফেরার পথে কিছুক্ষণ বসি মণ্ডপের বাইরে খোলা আকাশের নিচে। চা তৈরি হচ্ছে আর পরিবেশন চলছে। আমিও সেই চা যজ্ঞের শরিক হলাম। ইতিমধ্যে পুরো গ্রামের নারীপুরুষ ভিড় করেছে সেখানে। নেপালিরা এমনিতেই খুব সাজগোজ করে। রঙিন মন ও মেজাজের একটি জাতি। উৎসব হলে তো কথাই নেই। শুধু ঠাকুর নয়, উৎসব মুখরিত সেই প্রাঙ্গনে বিচরণরত সেই সব মানুষের ছবিও তুলি। বড় আনন্দময় এক মুহূর্ত। ফল-মিষ্টি-হালুয়ার প্রসাদ, অমৃত হয়ে ওঠে আন্তরিকতার স্পর্শে। 

তিনটি গ্রামের কথা এ উপলক্ষে মনে পড়ছে, যেখানে পুজোর খুঁটিনাটি গল্প শুনেছি, কিন্তু চাক্ষুষ করা হয়নি। একটি হলো লাটপাঞ্চার। এই গ্রাম সম্পর্কে আর একটা কথা বলার, আমার একেবারে একা একা বেরিয়ে পড়ার প্রথম নামটিই এই লাটপাঞ্চার। শিলিগুড়ি শহরের একেবারে শরীর ঘেঁষে দাঁড়ানো মহানন্দা অভয়ারণ্য । তারই উচ্চতম অঞ্চল হচ্ছে লাটপাঞ্চার। আমি যখন যাই, তখন সেখানে থাকার একটাই হোমস্টে। ছোট গ্রাম। মনে পড়ছে, বাড়ির মালিকেরই আত্মীয়, গ্রামের তিনটি ছেলেমেয়ে, ওরাই আমায় গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। রোজ সকাল হলেই চলে আসতো ওরা আর আমি ওদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম গ্রাম পরিক্রমায়। ওখানকার পুজোটাও হয় পাহাড়ের ওপরে। সেখানে গাড়ি যায় না। ট্রেক করে উঠতে হয়। সে আর আমার সাহস বা ক্ষমতা কোনওটাতেই কুলোয় না। শেষকালে আমার কিশোর বন্ধুরাই আমায় প্রসাদ এনে খাওয়ায়। দশমীর দিন টিকাও পরায়।

কাগে বলে একটি গ্রাম, পেডং থেকে আধঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত। এখানেও একটাই হোম স্টে। ধারাবাহিকতা মেনে এখানেও একবার  পুজো কাটালাম। সেবার আমার সঙ্গে পরিচিত এক ভাই ছিল। অনেক উঁচু পাহাড়ের ওপরে তৈরি মণ্ডপে আমার সাধ্য নেই যাই। সেই ভাইটি যেত আর এসে এসে গল্প করতো, ফোনে ছবি তুলে এনে দেখাতো। খুব হিংসে করতাম তাকে। প্রতি সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো এখানে। মাইকে ভেসে আসতো তার জমকালো শব্দ। নৃত্যগীতপ্রিয় জাতি নেপালিদের যে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে নাচগান থাকবেই। কাগেতে খুব সুস্বাদু খিচুড়ি ভোগ খেয়েছিলাম, আজও মনে আছে। সবথেকে মজার ব্যাপার, পেডংয়ে সবচেয়ে বেশি থেকেছি আমি। কিন্তু সেখানকার পুজোও দেখা হয়নি আমার। কারণ ওই এক, পাহাড়ের ওপরে পুজো। পাহাড়ীদের মধ্যে একটা প্রবাদ আছে, পুজো হবে সেখানে, যেটা তাদের বসবাস স্থল থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে। মানুষ যেন কষ্ট করেই দেবতার কাছে  পৌঁছয়।

 

চুইখিমে আসার পর প্রথম যে বছর পুজো, সেবারই আমি শিলিগুড়ি চলে আসি কার্যকারণে। সেটা আমার জীবনের এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণ। কলকাতা থেকে সোজা চুইখিম। গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন, হেরিটেজ বললে ভুল হয় না, সেই বাড়ি লিজ নিয়ে নিজের থাকার উপযুক্ত করে নিই স্থায়ীভাবে বসবাস করবো বলে। তবে, মানুষের ভাবনামতো সবসময় সবকিছু হয় না। আমারও হলো না। চুইখিমে টানা দশ মাস থেকে, বাড়ি তালাবন্ধ করে শিলিগুড়ি আসতে হলো। তবে পুজোর দিনগুলো কাটিয়েই এসেছিলাম মনে পড়ছে। চুইখিমে সেবার পুজো হয়নি। হয়তো পাহাড়ের কোনও অঞ্চলেই হয়নি। না হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। সে বছরেই পাহাড়ের মানুষ এক বৃহত্তর আন্দোলনের পথে গেছিল। টানা তিনটে মাস সমতলের সঙ্গে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অর্থনৈতিক পরিকাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। দু'বেলা কি খাবে, জানে না মানুষগুলো, পুজো তো অনেক দূরের কথা। 

চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার প্রথম পাহাড়বাসের শারদীয়া। সারাদিন সোনালি রোদ্দুর মাখা আকাশ। যা কিছু উৎসব প্রকৃতির ক্যানভাসে। মানুষের রাজনীতি, মানুষের জীবনের সমীকরণ প্রকৃতি জানেও না, মানেও না। সেই না মানার সৌরভ আমার বাড়ির সামনের ছোট শিউলি গাছটিকে ঘিরে। সন্ধ্যা নামতেই কি আমোদ ফুলেদের। এর বাইরে আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ। শহরের পুজোর ঠিক বিপরীত ছবি। ঝলমলে আলো নয়, যেন বিষণ্ন অথচ মহৎ এক শরৎ উদযাপন। নির্জন চুইখিমে আমার নিরালা ঘরে বসে শরতের সেই মহিমা অনুভব করি। এখানকার মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই প্রাণের পুজোর অনুষঙ্গে সার্থক হয়ে ধরা দেয়, যা ক্রমশ আমারও বেঁচে থাকার রসদ হয়ে ওঠে।

ওরা নিজেরাই লিখুক নিজেদের ভবিষ্যৎ

সাল ২০১৭। পাহাড়ের তিন মাসের টানা অস্থির অবস্থার কিছুটা উল্লেখ ছিল আগের পর্বে। এবার তার বিস্তারে যাব। সেই সুভাষ ঘিসিংয়ের আমল থেকে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ের মানুষের অধিকারের লড়াই শুরু। এই অধিকার শব্দটি নিয়ে অবশ্য যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। সরকারি স্তরে তো বটেই রাজ্যের আম জনতার মধ্যেও অনেকেই একে ঔদ্ধত্য, শৃঙ্খলাভঙ্গ, বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রকাশ বলে মনে করে। মজা হলো, এই দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে কোনও সমন্বয় নেই। বরং রাজনৈতিক আকচা-আকচি আছে। আর রাজ্যবাসীর মধ্যে যারা একে বিচ্ছিন্নতাবাদ মনে করে, আর বিপরীতে যারা এই আন্দোলনকে সমর্থন করে, তারাও কতটা বিষয়ের গভীরে গিয়ে এই আন্দোলনের ইতিহাসকে অনুধাবন করেছে, সন্দেহ হয়। ব্যক্তিগতভাবে যতটা কাছ থেকে পাহাড়ের মানুষের জীবনযাপন দেখেছি, তাতে বলতে পারি, পৃথক রাজ্যের দাবিটুকু বাদ দিলে ওদের পুরো চাহিদাটাই উচিতগ্রাহ্য । আদতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার যদি যথাযথ সমন্বয়ে প্রকৃত সদর্থক ভাবনা থেকে এই বিষয়টি বিবেচনা করতেন গোড়া থেকে, তাহলে এই আন্দোলন কখনই বিচ্ছিন্নতাবাদের চেহারা নিত না। প্রতিষ্ঠানই জন্ম দেয় গণ আন্দোলনের। অতৃপ্তিই বিদ্রোহের উৎস, এ কথা অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিদরা বার বার বলেছেন। আক্ষেপের কথা, অর্থনীতিবিদ বা সমাজবিদ নয়, এদেশে জনগণের ভালোমন্দের নিয়ন্ত্রণ কিছু স্বার্যান্বেষী রাজনৈতিক নেতার হাতে। 

এবার এই আন্দোলন প্রসঙ্গে সেই রাজনীতির কথা ! শুধু আন্দোলন নয়, দৈনন্দিন চলাফেরা জীবনচর্চার ক্ষেত্রেও রাজনীতি আর সব ক্ষেত্রের মতোই এখানেও পক্ষ বিস্তার করেছে। একটা কথা এখানে বলা জরুরি, আমি রাজনীতির বিপক্ষে নই। জীবন রাজনীতির বাইরে নয়। আপত্তি সেখানে, যেখানে রাজনীতি বৃহত্তর সমাজের জন্য নয়, মুষ্ঠিমেয়র পকেট ভরানোর হাতিয়ারে পরিণত হয়। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি থেকে কাটমানি, কাটমানি থেকে ধর্মের রাজনীতি--গত তিন/চার দশক ধরে বাংলার মানুষ এটাই দেখছে। উত্তরবঙ্গও তার বাইরে নয়। এখানে একটি কথা বলার, নানা সমালোচনা-বিতর্কের পরও এখানকার প্রবীণ ও সচেতন মানুষ মাত্রই বলেন, পাহাড়ের জন্য বামপন্থীরাই সবচেয়ে ভালো ছিল। এ বার্তা আমি চেনা পরিচিত বামপন্থী মানুষজনের কাছে পৌঁছে দিই স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই। খুব ইতিবাচক মনে হয়েছিল পাহাড়ের মানুষের এই উপলব্ধি। কিন্তু যাঁদের কাছে বার্তাটি পৌঁছই, তাঁরা তেমন সাড়াশব্দ করেননি। সে দিন বোধহয় সত্যিই গেছে, যখন গ্রামগঞ্জের মানুষের এই আবেগ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাম সংগঠকদের কাছে। রাজনীতি প্রসঙ্গে বাকিদের কথা আর বলতে চাই না। এমনকী পাহাড়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে যে দল (বা দলগুলি), তাদের কথাও আলোচনার বাইরেই রাখলাম। যেটা বলার, নানাবিধ দলের নানান কার্যকলাপে পাহাড়ের মানুষের কতটা উপকার হয়েছে, তা হয়তো সময় নির্ধারণ করবে ! কিন্তু কিছুটা তো এখনই স্পষ্টত দৃশ্যমান। প্রথম ও সবচেয়ে জরুরি হলো অর্থনীতি, সেখানে আজও এখানকার মানুষ যে তিমিরে, সেই তিমিরে। পরিবহন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিও চূড়ান্ত অবহেলিত। শহরাঞ্চল বাদ দিলে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে। অথচ পর্যটনের ওপর এখানকার অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভরশীল এবং একথা সব সরকারই জানে। সেই পর্যটন এগোতেই পারে না রাস্তার উন্নতি ছাড়া। বিদ্যুতের অবস্থাও তথৈবচ। ইন্টারনেট ব্যবস্থা ছাড়ুন, সাধারণ টেলি যোগাযোগও বহু জায়গায় এখনও সঠিক বণ্টনে পৌঁছয়নি। এরই সঙ্গে রেশনের বন্দোবস্ত, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের একান্ত জরুরি জীবনধারণের উপায়। সেখানেও পণ্যের যোগান যথাযথ নয়। আর দুর্নীতি, অসাধুতা তো এখন আমাদের জাতীয় চরিত্র। এর প্রভাব এখানেও বিলক্ষণ ভোগ করে আম জনতা। মাঝখান থেকে আঞ্চলিক, রাজ্যস্তর ও সর্বভারতীয় একাধিক রাজনৈতিক দলের যোগবিয়োগের খেলায় প্রাণান্তকর মানুষের জীবন। এখানে এসে আক্ষরিক অর্থেই সত্যি হতে দেখেছি এই প্রবাদ,'রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে/উলুখাগড়া প্রাণে মরে' ! 

আন্দোলনের ওই তিনমাস স্বচক্ষে দেখা এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার বৃত্তান্ত। একদল, যারা তথাকথিত আন্দোলনকারী, তারা মানুষকে পাহাড় থেকে নিচে নামতে দেবে না। না নামলে মানুষের ভাতের যোগান বন্ধ। কাজ না করলে খাবে কি দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ ? অন্যদিকে শক্ত হাতে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে কোথাও কোথাও যেন বেশ খানিকটা অমানবিক প্রশাসন। মিথ্যে প্রতিশ্রুতির কথা তো ছেড়েই দিলাম। সর্বস্তরেই এই প্রবণতা ! মোদ্দা কথা, শেষ পর্যন্ত হাতে রইলো ওই শূন্য। তিনমাস পর বন্ধ তুলে নেওয়া হলো। তখনকার মতো আন্দোলনের ইতি। সমঝোতা হলো, কিন্তু সেটা কার সঙ্গে কার বা কিসের বিনিময়ে, সেসব হিসেবের খবর আর রেখে উঠতে পারে না খেটে খাওয়া মানুষ। মাঝখান থেকে এবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। খালি হাত আরও খালি করে নতুন করে বাঁচার লড়াইয়ে নামে তারা। 

নাহ, এ লড়াইয়ের খবর মিডিয়া রাখে না। এ তো নিত্যদিনের ! নিত্যদিনের বলেই আমরা এটা দেখতে অভ্যস্ত। কোথাও অজান্তে ওরাও ! তাই তো আধপেটা খেয়েও বেশ বেঁচে থাকে পাহাড়ের মানুষ । মেনে নেয় বিনা চিকিৎসায় আপনজনের মৃত্যু। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার বিষয়েও উদাসীন হয়ে পড়ে। সব কিছুই ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে কবে সৌভাগ্য দরজায় কড়া নাড়বে, সেই আশায় বসে থাকে। জীবনের প্রতি এই যে দৃষ্টিভঙ্গি পাহাড়ের মানুষের, এটাকে আমি নেতিবাচকই বলবো। এতে জীবনযাত্রা আপাত শান্তিপূর্ণ থাকলেও এটা সামগ্রিক ভাবে সামাজিক উন্নয়নের অন্তরায়। 

সমস্যা হলো, এই সত্যিটা ওদের বলার কেউ নেই। কোনও সত্যিই বলে না কেউ ওদের। বলে না, "হাত পেতো না, স্বনির্ভর হও।" এ প্রসঙ্গে একটি তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। চুইখিমে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার পর গ্রামের একটি স্কুলের উন্নয়নের ব্যাপারে কিছুটা যুক্ত হই। নিজেকে উজার করে দেওয়ার চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারি না। কারণটা খুব সরল, আমি কয়েকটি নির্দিষ্ট সমস্যার স্থায়ী সমাধান চেয়েছিলাম। তার জন্য অভ্যন্তরীণ প্রত্যেকটি বিষয়, মানে কাজের ভাষায় যাকে আমরা বলি, 'পেপার ওয়ার্ক', সেসব ঠিক  করার একটা উদ্যোগ নিই আমি। এটা ছাড়া সরকারি অনুমোদন অসম্ভব। সরকারি অনুমোদন ছাড়া স্কুলের কোনও রকম উন্নতিই সম্ভব নয়। শিক্ষকদের মাইনে থেকে শুরু করে যে যে খাতে অর্থের প্রয়োজন, তার সবেরই একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত একমাত্র সরকারি অনুমোদনেই সম্ভব। 

এছাড়া কোনও বড় বেসরকারি সংস্থা যদি এই স্কুল স্পনসর করে, তাহলেও অর্থকরী সমস্যাটা মেটে। কিন্তু যেখানে এক পয়সা লাভ নেই, সেখানে বেসরকারি সংস্থাই বা বিনিয়োগ করবে কেন? চুইখিম অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা একটি গ্রাম ! এখানে বিনিয়োগ করে কোন নির্বোধ? বিনিয়োগের প্রশ্ন দিবাস্বপ্ন তাই। মোদ্দা কথা, সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য, দুটির একটিও স্থায়ীভাবে, সুস্পষ্ট একটি চুক্তি মেনে করায়ত্ত হলো না। তার কারণ, এখানে, এই উত্তরবঙ্গের পাহাড়াঞ্চল বলে নয়, সব পিছিয়ে থাকা এলাকাতেই কিছু উপকারী জুটে যায়। এরা আর যাই হোক, মানুষের স্বনির্ভর হওয়াটা মোটেই চায় না। এরা চিরকাল সাহায্যকারী বন্ধু হয়ে মানুষকে ভিখিরি করে রাখে। কি উদ্দেশ্যে, কোন পরিকল্পনায় এরা এটা করে, তা বলার দরকার পড়ে না। কোথাও ধর্ম, কোথাও রাজনীতি, কোথাও ব্যক্তিস্বার্থ---দরিদ্র ও অশিক্ষার অন্ধকারে বেঁচে থাকা মানুষ এই নানা কারিক্রমের শিকার হয়েই চলে আবহমানকাল। স্কুলের ব্যাপারেও এই জ্ঞানলাভ করে একসময় আমি থেমে গেলাম। এই যে একটা উদ্যোগে এগিয়েও থেমে যেতে বাধ্য হওয়া, এটা নিঃসন্দেহে ব্যর্থতার একটি নজির । আমি একা নই। অনেকেই হয়তো এ বাবদ হতাশার শিকার হয়েছেন। 
আমাদের কথা থাক। এতে পাহাড়ের মানুষের ক্ষতিটা কি পরিমান হচ্ছে, একবার ভাবুন। ছোট  ছোট প্রত্যন্ত গ্রাম। রাস্তা থাক না থাক, নেতারা পাঁচ বছরে একবার ঢুকে যাচ্ছেন সেখানে। উপকারী বন্ধুরা মাঝে মাঝেই পৌঁছে যাচ্ছেন সাহায্যের রসদ নিয়ে। ধর্মের ধ্বজাধারীরা ঝুড়ি করে ধর্ম বেচতে যাচ্ছেন। এইসব মিলিয়ে বেশ সুমধুর এক যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কাজের কাজ হচ্ছে না। কুটির শিল্প, সমবায় প্রথা, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের মতো বাঁচার দিশা কেউ দেখাচ্ছে না। তরুণদের সংগঠিত করে, তাদের অপরিসীম দৈহিক শক্তিকে সঠিক কাজে লাগানো হচ্ছে না। উল্টে তাদের দলে টানার জন্য নেশার দ্রব্য বিতরণ করা হচ্ছে। প্রশাসনের নাকের ডগাতেই ঘটছে সব। 

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, এইসব যাবতীয় অভিশাপজনিত গাঢ় অন্ধকার মুছে ফেলতে উদ্যোগী হতে হবে পাহাড়ের মানুষকেই। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রে, আমার একটি গ্রামের দিনযাপনের সঙ্গী হয়ে শুধু নয়, পাহাড়ের যেখানে যখন গেছি, মানুষকে এই বার্তা দেবার চেষ্টাই করছি। বলেছি, বলছি, চিরকাল ভিক্ষা মেলে না। চিরকাল বাইরে থেকে এসে কেউ উদ্ধার করে না। বেঁচে থাকার সব ম্যাজিক ওদেরই হাতে, অকৃপণ উজারে যা প্রকৃতি দিয়েছে ওদের। সেটাকেই হাতিয়ার করে স্বনির্ভর হয়ে, শিরদাঁড়া সোজা করে, আত্মসম্মান বজায় রেখে বাঁচুক ওরা ! লেখা হোক পাহাড়ের মানুষের আজ-কাল-পরশুর নতুন গল্প। বিদ্রোহের আগুন নয়, বিশ্বাস, পারস্পরিক নির্ভরতা ও ভালোবাসার পবিত্র আগুনে জ্বলুক আলো । সে আলোর অক্ষরে লেখা গল্প পড়ে আমরাও যে অনুপ্রাণিত হবো।