প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা - শারদীয়া, ২০২০
Short Stories/ছোটগল্প
স্বর্ণচাঁপা
অঙ্কুর রায়
প্রিয়ব্রত চুপ করে বসে আছেন। সবাই কিছু না কিছু বলছে, শুধু তিনিই চুপচাপ। এমনকি, তাঁর শূন্য দৃষ্টি দেখে তিনি কিছু শুনছেন কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না।
কিন্তু প্রিয়ব্রত শুনছিলেন। সব শুনছিলেন। বাবা মারা যাবার এক মাসের মধ্যেই তাঁর ছয় ছেলেমেয়ে একসাথে বসেছেন পৈতৃক বিষয়সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেবার জন্যে। বাবার ব্যাঙ্কের লাখখানেক টাকা আর মা’র অবশিষ্ট যা কিছু গয়না ভল্টে ছিল তা সহজেই ভাগাভাগি হয়ে গেছে। এখন আলোচনা চলছে পৈতৃক বাড়ি আর বাড়ির পিছনে যে ছ’কাঠার একটা বাগান আছে সেটা নিয়ে। বড়দা তপোব্রত এই বাড়ীতেই থাকেন তাঁর পরিবার নিয়ে। তিনি চাইছেন বাড়ীটা নিতে। সেজভাই সবিতাব্রত চাইছেন বাড়ী আর বাগান মিলিয়ে একটা বড় ফ্ল্যাটবাড়ী বানিয়ে নিজেরা একটা করে ফ্ল্যাট রেখে বাকি ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করে দিতে। ছোটভাই অনুব্রত আর দুই বোন, রেবা আর কাবেরী বলছেন অত ঝামেলা না করে পুরোটাই কোন প্রোমোটারের কাছে বিক্রি করে দিতে। হ্যাঁ, যদি বড়দা বাড়িটা নিতে চান নিতে পারেন কিন্তু তাহলে বড়দাকে শুধু বাগানের অংশ ছেড়ে দিলেই হবে না, অন্তত লাখ দশেক টাকাও দিতে হবে নয়তো বাকিদের ক্ষতি হয়ে যাবে। শুনতে শুনতে প্রিয়ব্রতর মনে হল, ক’টা ক্ষুধার্ত কুকুর মাংসের হাড় নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে। তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন, বড়দা এবং তিনি ছাড়া আর সব ভাইবোনের জন্ম এই বাড়ীতে। তিনি বাদে আর সবার ছোট থেকে বড় হওয়াও এখানে। অথচ কী আশ্চর্য কারো একবারও মনে হচ্ছে না এই বাড়ী এই বাগানে তাদের ছোটবেলার কত স্মৃতি, বাবা মায়ের কত স্মৃতি! এগুলো এরকমই থাক। সবাই আজকে প্রতিষ্ঠিত। কিসের সবার এত প্রয়োজন পড়ল এই সবকিছু বিক্রি করে দেবার?
প্রিয়ব্রতর মনে পড়লো ছোটবেলার কথা। তাঁদের বাড়ী ছিল ঢাকায়, বুড়িগঙ্গার তীরে। বিশাল বাড়ী। তাঁর তখন পাঁচ, দাদার আট। হঠাৎ করেই সব কেমন বদলে যেতে লাগল। বড়দের মুখে তখন খুব শুনতেন ক’টা অপরিচিত শব্দ - পার্টিশন, রায়ট, ইস্ট পাকিস্তান, ইন্ডিয়া। ঠিক বুঝতেন না এগুলোর মানে কিন্তু সব যে ঠিক নেই সেটা তিনি আর দাদা বেশ বুঝতে পারছিলেন। একদিন শুনলেন শ্যামবাজারে তাঁদের দুটো দোকানেই কারা যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছ। তাঁদের যে এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা ছিল সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। একদিন সকালে জেঠুমণি বাড়ী থেকে বেরিয়ে আর ফিরলেন না, তাঁকে তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। প্রিয়ব্রত ভীষণই ভয় পেয়েছিলেন। শুধু বুঝতে পারেননি জেঠুমণি কাদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। তারপর একদিন শুনলেন তাঁরা ইন্ডিয়ায় চলে যাবেন, আর ফেরা হবে ন। এই বাড়ীটায় আর থাকা হবে না, এই বিশাল ছাদে আর দৌড়াদৌড়ি করে খেলা যাবে না। খুব কান্না পেয়েছিল প্রিয়ব্রতর। তাঁর একটা কাঠের ঘোড়া ছিল, খুব প্রিয়, যেখানেই যেতেন ওটা সাথে করে নিয়ে যেতেন। আর ছিল কয়েকটা ছবির বই। কিন্তু এর কোনটাই তিনি সঙ্গে করে আনতে পারেননি। কী করেই বা পারবেন! এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি মূল্যবান, প্রয়োজনীয়, প্রিয় সব জিনিস, এমনকি পূর্বপুরুষের ভিটে পিছনে ফেলে রেখেই যে সবাইকে চলে আসতে হচ্ছিল! কয়েকমাস পরে বাবা, মা আর দাদার সঙ্গে প্লেনে চেপে কলকাতায় চলে এসেছিলেন প্রিয়ব্রত। এসে উঠেছিলেন এই বাড়িতে। এটা ছিল তখন নিতান্তই ছোট একটা একতলা বাড়ি, পিছনে বাগান। তাঁদের ঢাকার বাড়ির তুলনায় কিছুই নয়। কিন্তু এর চেয়ে বেশী কিছু করা তখন প্রিয়ব্রতর বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সঞ্চয়ের শেষ অর্থটুকু দিয়েই তিনি এটা কিনেছিলেন।
প্রিয়ব্রতদের আর্থিক অবস্থা তখন যে অত্যন্তই শোচনীয় সে না বললেও চলে। জমিজমা থেকে আয় কমতে কমতে অনেকদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসা বন্ধ। বিধবা জেঠিমা তাঁর মেয়েদের নিয়ে এখানেই এসে উঠেছেন। প্রিয়ব্রতর বাবা ঢাকায় একটা চাকরি জোগাড় করেছেন। এতগুলো মানুষের অন্নের সংস্থান মাইনের ওইক’টা টাকাতেই হচ্ছে।
কলকাতায় চলে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই জন্ম হয় বড় বোন রেবার। এই সময় প্রিয়ব্রতর দিদিমা একদিন এসে বললেন – “ছোট পোলাটার তো এহানে কোন যত্ন হইতাসে না। ওরে বরং আমিই লইয়া যাই।“ এই প্রিয়ব্রতর বাড়ি ছেড়ে, মাকে ছেড়ে যাওয়া। সেইসময় প্রিয়ব্রতর জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতেই পারত না।
দিদিমার কাছে প্রথম প্রথম খুব আনন্দেই দিন কাটছিল প্রিয়ব্রতর। বাড়ীতে যেগুলোর অভাব ছিল দিদিমার কাছে সেগুলোই ছিল অফুরন্ত। বাড়ীতে অভাব ছিল যত্ন, আদর আর অবাধ স্বাধীনতার। মামাবাড়িতে দিদিমার সবটুকু আদর, যত্ন আর প্রশ্রয় ছিল প্রিয়ব্রতর জন্যই। কাছের একটা ইস্কুলে দিদিমা ভর্তি করে দিলেন প্রিয়ব্রতকে। রবিবার আর অন্যান্য ছুটির দিন ছোটমামার হাত ধরে বাড়ি আসতেন প্রিয়ব্রত। ঘুরতে। ফেরার সময় কেন যেন মনটা একটু খারাপই হয়ে যেত তাঁর। আবার দিদিমার কাছে ফিরে গিয়ে দিদিমার আদরে মন ভালো হয়ে যেত। তবে মামাবাড়িতে একটা জিনিস ভীষণই খারাপ লাগত প্রিয়ব্রতর। যখন কোন প্রতিবেশী জিজ্ঞাসা করতেন – ‘এই ছেলেটা কে?’ তখন মামারা বলতেন – ‘আমাদের বড়দিদির ছেলে, এখানে থাকে।‘ প্রিয়ব্রত বুঝতেন, তিনি আসলে এই বাড়ির কেউ নন।
প্রিয়ব্রতর অন্য ভাই বোনেরা জন্মানোর পর বাড়িটা আস্তে আস্তে জমজমাট হয়ে উঠছিল। নতুন পরিবেশে সবাই ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছিল। আর্থিক স্বচ্ছলতাও ফিরে আসছিল একটু একটু করে। তখন প্রিয়ব্রতর বাড়িতে এলে আর দিদিমার কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করত না। বলেওছিলেন কয়েকবার, কিন্তু দিদিমা দুঃখ পাবেন তাই মা রাজি হননি। রাত্রিবেলা দিদিমার পাশে, বিশাল পালঙ্কে ইলেকট্রিক ফ্যানের তলায় শুয়ে প্রিয়ব্রতর ভীষণই কান্না পেত। বুকে পিঠে ঠান্ডা হাতটা বুলিয়ে দিতে দিতে দিদিমা নানান গল্প শোনাতেন। শোনাতে শোনাতে কখন নিজেই ঘুমিয়ে পড়তেন। প্রিয়ব্রতর কিন্তু ঘুম আসত না। তাঁর শুধু মনে হত, বাড়ীতে এখন মেঝেতে ঢালাও বিছানা করে মা’র পাশে সব ভাইবোনেরা শুয়ে আছে। মা তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করতে করতে সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখন কেউ যদি ফিসফিস করে কথা বলে মা পাখার বাঁট দিয়ে এক বাড়ি মারছেন। প্রিয়ব্রতর খুব ইচ্ছে করত এক ছুটে মা’র পাশে গিয়ে শুয়ে পড়েন।
একবার পুরো গরমের ছুটিটাই প্রিয়ব্রত বাড়িতে ছিলেন। মা’র শাসনটাও প্রিয়ব্রতর ভীষণই ভালো লেগেছিল। সেবারই প্রিয়ব্রত একটা স্বর্ণচাঁপা গাছ বাগানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে লাগিয়েছিলেন। খুব খুশি হয়েছিলেন মা। রোজ সকালে নিজেই গাছটায় জল দিতেন। সেবার গরমের ছুটির শেষে দিদিমার কাছে ফিরে না যাবার জন্য প্রিয়ব্রত খুব কান্নাকাটি করেছিলেন। কিন্তু তখন নয় , আরো বছর পাঁচেক পর প্রিয়ব্রত যখন ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ভীষণই খারাপ রেজাল্ট করলেন তখন মা বুঝলেন, দিদিমার আদরে ছেলের একদমই পড়াশুনা হচ্ছে না। তিনি নিজেই প্রিয়ব্রতকে বাড়ীতে ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু ততদিনে স্বর্ণচাঁপার সুগন্ধি দিনগুলোও পার হয়ে গেছে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মা'র শরীর ভালো নেই, প্রিয়ব্রতও ছোটবেলা পিছনে ফেলে এসেছেন।
এরপর মাত্র কয়েক বছরই প্রিয়ব্রত মাকে পেয়েছিলেন। বাড়ীতে থাকাও ওই কয়েক বছর। কলেজ পাশ করার মাস কয়েকের মধ্যেই একটা গ্রামীণ ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে প্রিয়ব্রত চলে যান এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানেই মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলেন মা চলে যাবার পরের দি। এরপর আরো বারদুয়েক চাকরি পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু বাড়িতে থাকা আর হয়নি। চাকরি জীবনের প্রায় উপান্তে পৌঁছে এখন অফিসের কাছেই একটা ফ্ল্যাট কিনে থিতু হয়েছেন প্রিয়ব্রত। কিন্তু কী আশ্চর্য সমাপতন! এবারও যখন অফিসের কাজে তিনি দিল্লিতে তখনই পেলেন বাবার মৃত্যুসংবাদ। এবার অবশ্য সাথে সাথেই।
প্রিয়ব্রত একটাও কথা বলছেন না দেখে ছোটভাই অনুব্রত বললেন – ‘কিরে মেজদা! তুই কিছু বলছিস না যে?’
- ‘কী বলব? শুনছি তো।‘
- ‘কেন তোর কোন বক্তব্য নেই?’ বড়দা তপোব্রত জিজ্ঞেস করলেন।
- না।
- ‘তুই তাহলে ভাগ নিবি না?’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বড় বোন রেবা।
- ‘না। আমার কোন ভাগ চাই না।‘
- ‘মানে?’ কথাটা ছিটকে বেরোল অনুব্রতর মুখ থেকে।
- ‘তোরা আমাকে আজকে সবকিছুর ভাগ দিতে পারবি? মা তোদের একটা এত বড় থালায় ভাত মেখে সবাইকে একসাথে খাইয়ে দিত, পড়তে না বসলে বকত, রাতে পাশে নিয়ে শুত, বাবা শীতকাল এলেই রোজ জয়নগরের মোয়া নিয়ে আসতো। সেই সবকিছুর ভাগ আজকে দিতে পারবি? থাকার জন্য আমার ঘর আছে, এখন ভালোই মাইনে পাই, রিটায়ার করলে যথেষ্ট পেনশন পাব। আরো একটা ফ্ল্যাট আর কয়েক লাখ টাকার আমার দরকার নেই।‘
- ‘তুই তাহলে কিছুই নিবি না?’ তপোব্রত গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
- ‘নেব। বাগানের ওই দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে যেখানে একটা স্বর্ণচাঁপা গাছ লাগিয়েছিলাম, মা যেটায় রোজ জল দিত, সেখান থেকে এক বালতি মাটি আমি নিয়ে যাব। একটা বড় টবে ওই মাটিতে একটা স্বর্ণচাঁপা গাছ লাগিয়ে আমার ফ্ল্যাটের বারান্দায় রেখে দেব।‘