Editorial/সম্পাদকীয়
যে কোনও স্রষ্টা নিজের সৃষ্টির দিকে বারংবার ফিরে তাকান। তা তিনি গায়কই হোন, আঁকিয়েই হোন বা অন্য কোনও ধরণের স্রষ্টা। এই ফিরে তাকানোর কারণ কিন্তু মুগ্ধতা নয়। বরং, যা সৃষ্টি করেছেন, তা আরও উচ্চমানের কীভাবে করে তোলা যায় তা বোঝার চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন নিজের তৈরি ধাঁচ এবং ছাঁচ নিজের হাতেই ভেঙে আবার নতুন কিছু গড়ে তোলার। যাতে ভিতরকার কূপমণ্ডুকতা কোনওভাবেই প্রশ্রয় না পায়, যাতে সৃষ্টিশীল স্নায়ুগুলির মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করা যায়। ইংরেজি ভাষায় একেই বলে Improvisation; অর্থাৎ, যা রয়েছে তাকে আরও উন্নত করে তোলা। যার জন্য প্রয়োজন বদল বা পরবর্তন।
কিন্তু সব বদলই কি Improvisation? সব পরিবর্তনই কি আমাদের সর্বাংশে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়? প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্নটা কার দিক থেকে? সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দিক থেকে। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে কেমন ভাবে ব্যবহার বা চিহ্নিত করা হচ্ছে তার উপর।
সাম্প্রতিক শিক্ষানীতি এরকমই এক প্রশ্নের মুখে আমাদের ঠেলে দিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই নীতির এমন বেশকিছু অংশ রয়েছে যা যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। যেমন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চার বছরের সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রি। মনে হতেই পারে, বিদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মতো আমরাও তিন বছরের স্নাতক এবং দু’বছরের স্নাতকোত্তরের ‘বস্তাপচা’ ধারণা ছেড়ে চার বছরের স্নাতক এবং এক বছরের স্নাতকোত্তরের মতো আধুনিক নীতির পথে এগিয়ে চলেছি। ভাবতে ভালো লাগে যে আমাদের দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিদেশে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য এক বছর বাড়তি অপেক্ষা করতে হবে না। নিজেদের ‘বিশ্বমানের’ বলে মনে হয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? সাম্প্রতিক অতীতে যা আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হল, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিদেশে চলে যাওয়া, তাদের দেশের উন্নয়নের অংশ করে তুলতে না-পারার আক্ষেপ; ইংরেজিতে যাকে বলে Brain Drain। এই বিপদকে সামাল দেওয়ার রাস্তা আমাদের দেখাতে পারবে কি নয়া শিক্ষানীতি?
‘সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি’ ই-পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় আমরা এই প্রশ্নগুলিরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। সেই উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে আমাদের অভিভাবকের মতো যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন এমন কিছু মানুষ, যাঁরা স্ব-ক্ষেত্রে সুচিন্তিত মতামত দিয়ে আমাদের পত্রিকাকে ঋদ্ধ করেছেন। এই সংখ্যায় আমরা যেমন প্রাজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের পাশে পেয়েছি, তেমনই পেয়েছি তরুণ প্রজন্মের বেশকিছু শিক্ষাব্রতীকে। প্রত্যেকেই তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী থেকে শিক্ষানীতি ২০২০-কে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করেছেন, যা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত যে কোনও মানুষকে বিষয়টি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করবে।
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০-তেই ‘সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি’ পত্রিকার এই সংখ্যা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। কারণ, এই দিনই বাংলার শিক্ষাজগতের প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবার্ষিকী।
শিক্ষা-সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার পরিসর হিসাবে নির্বাচন করতে হলে এর থেকে উপযুক্ত দিন সম্ভবত আর পাওয়া যেত না।
আমাদের পাশে থাকার জন্য ‘সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি’ পরিষদের পক্ষ থেকে পাঠকদের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ। আপনাদের বিশ্লেষণধর্মী মতামত আমাদের আগামী দিনের পাথেয় হয়ে উঠুক।