Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা - সেপ্টেম্বর, ২০২০

Others/অন্যান্য

হিন্দি-চিনি - ভাই ভাই; আম জনতার সাথে তাই (ধারাবাহিক রচনার প্রথম পর্ব)

তপন কুমার দাস


এসো গড়ে তুলি দূষণমুক্ত পৃথিবী, শান্তি ও সম্প্রীতির পৃথিবী" - এই আহ্বান নিয়ে, দিবাকর মেমোরিয়াল এ্যাক্সপ্লোরার্স ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে, বিশ্বব্যাপী পর্যায়ক্রমে সাইকেল যাত্রার, পঞ্চদশতম দেশ চীন। প্রথমে হংকং থেকে সাংহাই হয়ে বেজিং সাইকেল অভিযানের পথ ঠিক করা হলেও, হংকং এর সাম্প্রতিক গন্ডগোলের জন্য পারমিট পেতে দেরি হওয়ায়, পথ পরিবর্তন করে গত ১৪ই অক্টোবর থেকে ৩রা নভেম্বর ২০১৯ সাংহাই থেকে বেজিং দীর্ঘ প্রায় ১৮০০ কিমি পথে পরিচালিত হলো এই অভিযান। ধন্যবাদ সবাইকে যারা এই অভিযানে উৎসাহিত করেছেন।

চীনে সাইকেল যাত্রা (২): পর্যায়ক্রমে বিশ্ব সাইকেল যাত্রায় এবারের অভিযান চীন, সাংহাই থেকে বেজিং। কম খরচে সাংহাই পৌছাতে বেছে নিয়েছিলাম দিল্লি থেকে হিমালয়ের ওপারে ওদের বিমানবন্দর চেঙদু, তারপর রেলপথে সাংহাই। ৮ই অক্টোবর, ২০১৯ দুপুরে শিয়ালদহ থেকে শেষ মুহূর্তে কিছু কেনাকাটা সেরে ট্রেনে চেপে বসলাম। সম্পর্ক ক্রান্তি এক্সপ্রেস। এককালে বাঙলার বাইরে আর কারো সাথে তেমন সম্পর্কে না রাখলেও আজকাল কারো গুরুত্ব খাটো করতে চায়না। তাও ভালো অন্য ট্রেনের মত উপচে পড়া যাত্রী নেই। দশমী, সংস্কারাবদ্ধ বাঙ্গালী এখনো এই দিনে থেকে বাড়ি থেকে বেড়োতে অনেকে কিন্ত কিন্তু করে। আমার অবশ্য ভালোই, আমি চিরকাল এই দিনটাকেই বেছে নিই, টিকিট পেতে সুবিধা হয় বলে।

ট্রেনে ওঠার আগে বেআক্কেলে ঘোষণা একটু চিন্তায় ফেলে দিলো। ট্রেন ট্রাফিক জ্যামের কারণে, মোঘলসরাই এর পর কানপুরের পথ এড়িয়ে লক্ষ্ণৌ হয়ে দিল্লি পৌছাবে। ক'টায় পৌছাবে কি জানে? ফ্লাইট ধরা গেলে হয়! নতুন ট্রেন, যাত্রীরা প্রায় সবাই দিল্লিতে কর্মরত খেটে খাওয়া বাঙ্গালী। এখন বাংলায় কাজ নাই কাজ নাই রব, তাই খেটে খাওয়া মানুষ কাজ আর সামান্য কিছু বাড়তি মজুরির আশায় ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ছে। দক্ষিণের ট্রেনে তো দাড়িয়ে দাড়িয়ে যেতে হয়, এখানে তাও বসতে পেড়েছে ভাগ্য ভালো। ওদের জীবনের কলরব শুনতে শুনতে মোঘল সরাই পৌছে গেলাম।

চীনে সাইকেল যাত্রা (৩): মোঘলসরাইতে ট্রেন পৌছে ছিলো রাত দুপুরে। স্টেশনটি আহামরি কিছু নয়, কিন্তু তার অবস্থানের জন্যই বিখ্যাত। উত্তর ও পূর্ব ভারতের সব ট্রেনই এখানে একটু জিরিয়ে নিয়ে তারপর এগোয়। আমি ও সেই ফাকে নেমে পড়ি। স্টেশনের নেমপ্লেট দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সেই ছোট বেলা থেকেই কত স্মৃতিবিজড়িত স্টেশন তার আসল নামটাই হারিয়েছে। সেই শেরশাহের হাত ধরে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড, মোঘল আমলে গুরুত্ব পায় এই জায়গা। পরে ব্রিটিশ আমলে দিল্লির পথে রেললাইন পাতা হলে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয় মোঘলসরাই স্টেশন।

এদেশে মোঘলরা বিদেশী হয়ে এলেও ক্রমে ক্রমে তারা ভারতবাসীই বনে গিয়েছিলেন। মোঘলদের সামন্ত শাসন নিশ্চয়ই স্বর্গরাজ্য কিছু ছিলোনা, কিন্তু বিশ্ব মাঝে ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা, স্বর্ণযুগ, তা কিন্তু তাদেরই কৃতিত্ব। তারা তাজমহল, মোঘলসরাই গড়ার সময় ভাবেননি যে কখনো এদেশে তাদেরই ঠাই উঠে যাবে। কিন্তু আকবরের সর্বধর্ম সমন্বয়ের বানী আজ এই ভারতে অরণ্যে রোদন। তাই তাদের নামাঙ্কিত স্টেশন আজ হিংসার ধারকদের দখলে। কিছু করার নেই এই মুহূর্তে, জনগণের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হবার অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কি আছে।

ট্রেন ছাড়লো বটে কিন্তু ক্রমাগত পথিমধ্যে দেহ রাখতে রাখতে যখন দিল্লি পৌছালো, তখন ফ্লাইটের টাইম সমাগত। কোনরকমে ছুটতে ছুটতে যখন বিমানের দরজায়, হটাৎ ফোন এলো এয়ারলাইন্স কোম্পানির, আপনি কোথায়? আমরা আপনারই অপেক্ষায়।। বিমানে উঠে নিজেরই লজ্জা লাগলো, সত্যি, সবাই আমারই অপেক্ষায়।

চীনে সাইকেল যাত্রা (৪): প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, জায়গা নিয়ে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই দৌড় শুরু করে স্বপ্নের ডানা মেললো। হিমালয়েরই ওপারে চীন। আমাদেরই প্রতিবেশী। আয়তনে এবং জনসংখ্যায় বিরাট দেশ, অথচ দেশটির সম্পর্কে আমাদের এবং গোটা পৃথিবীর জানা বোঝার সুযোগও কম। সাইকেল অভিযানের সুযোগে সেটাও বুঝে নিতে হবে।

১৯৪৯ এর আলোরণ সৃষ্টি কারী চীন বিপ্লব, শিল্পী ভূপেন হাজারিকা যাকে নিয়ে গান গেয়ে ছিলেন, "পাহাড়ের ওপারে ঐ কিসের যেন প্রতিধ্বনি শুনি" - সত্যিই সে বিপ্লব সাধারনের জীবনে কতটা পরিবর্তন আনলো ? আদৌ আনলো কিনা? তার সত্যাসত্য ও বুঝে নেওয়া দরকার।

সত্যি কথা বলতে কি, উনিশ শতকের আগে চীন ছিল, আমাদের মতই পিছিয়ে পড়া কয়েক হাজার বছরের রাজতন্ত্রের শাসনাধীন একটি সামন্ত তান্ত্রিক দেশ। কৃষক সহ সাধারণ শ্রমজীবী জনতা ছিল অবর্ণনীয় শোষন, দুঃখ কষ্টের শিকার। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে আমাদের দেশের মত ওখানেও হাজির হয় ইংরেজ ও তার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। একে একে হাজির হয় ফ্রান্স,স্পেন, পর্তুগাল,অন্য ইওরোপীয় শক্তি এমনকি সদ্য স্বাধীন হওয়া আমেরিকাও। এতো বিপুল জনতা ও তার সম্পদ লুটের সুযোগ তারা ছাড়বে কেনো? তারা মাঞ্চু রাজার ওপর চাপ সৃষ্টি করে, ক্যান্টন, সাংহাই কয়েকটি বন্দরে বানিজ্যের অধিকার আদায় করে নেয়। পরে আফিম যুদ্ধে জয়ের মধ্যে দিয়ে, তারা রাজা ও এদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই বাড়িয়ে নেয়। চীনাদের আফিমের নেশায় জড়িয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ তারা লুটে নিতে থাকে। আমাদের দেশের জমিদারদের মতই, এদেশেও বিদেশী এই শক্তির শোষনের সঙ্গী হয়, হাতিয়ার হয় ওদেশের সামন্ত প্রভুরা। সাধারণের দুর্দশা চরমে উঠতে থাকে, কিন্তু বিনা প্রতিবাদে তারাও এ জিনিস মেনে নেয়নি। রাজার প্রতি অনাস্থা, সামন্ত শোষণ ও বিদেশী লুন্ঠনের বিরুদ্ধে ১৮৪৮ থেকে ১৮৬৪ তে বিরাট আকারে কৃষক বিদ্রোহ ঘটে, যা তাই পিং বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৮৯৩-১৮৯৪ তে চীন-জাপান যুদ্ধে চীনের পরাজয়ে রাজতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা চরমে ওঠে। উনিশ শতকের শেষ ভাগে ঘটে বক্সার বিদ্রোহ। কিন্তু রাজনৈতিক বিবর্তনের পথ প্রসস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত, ১৯১১তে সান ইয়াত সেন এর নেতৃত্বে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে, প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হলো এদেশে।

চীনে সাইকেল যাত্রা (৫): হটাৎ, মাইকে সবাইকে সচকিত করে ঘোষনায় স্মৃতিচারনে ছেদ। ভয়ানক মেঘের চারিদিক আচ্ছন্ন, দুরের কিছু তেমন নজরে আসছেনা, সবাই বেল্ট বেধে নিন। আগে হলে একটু ঘাবড়াতাম, কিন্তু এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি, জানি, একটু পরেই মেঘমুক্ত আকাশে পৌছে যাবে তরী। তাই ডুবে গেলাম আবারও অতীতে।

১৯১১তে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে চীনে প্রজাতান্ত্রিক শাসন এলো বটে, কিন্তু জনজীবনের মূল সমস্যাগুলোর সমাধান হলোনা। আসলে সান ইয়াতের বিপ্লব ছিলো, উনিশ শতকের শেষ দিকে চীনে গড়ে ওঠা স্বল্প কলকারখানা, নবাগত বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থে তাদেরই বিপ্লব। কলকারখানা মানেই শ্রমিক শ্রেণি, সংগঠিত শক্তি। বিপুল সংখ্যক কৃষিজীবী ও শ্রমিক শ্রেণির গড়ে ওঠা একতা, সংঘবদ্ধ লড়াই, বুর্জোয়া শ্রেণীর ভবিষ্যৎ কে অনিশ্চিত করে তুলবে, রুশ বিপ্লবের এই শিক্ষা তাদেরকেও সতর্ক করেছিল। তাই সামন্ত প্রভুদের আধিপত্যের অবসান করে, কৃষককে শোষণমুক্ত করার বদলে, সামন্তদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির পথে গেলো।

১৯২৫এ সান ইয়াৎ মারা গেলে চরম অত্যাচারী শাসক চিয়াং কাই শেক এলেন ক্ষমতায়। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই নতুন সৃষ্টি প্রজাতান্ত্রিক শাসকদের সাথে জনগণের বিবাদ বেড়ে উঠলো। ইতিমধ্যে পাশের দেশ রাশিয়ায় ১৯১৭র লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লব, শ্রমজীবী মানুষের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা, কৃষক পেলো জমি ও কারখানার মালিকানা পেলো শ্রমিকরাএই অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ও কাজের নিশ্চয়তা - এই ঘটনা উদ্বেল করে তুললো এদেশের মানুষকে।

১৯১৯-এর ৪ঠা মে র আন্দোলন ছাত্রদের দিয়ে সূচনা হলেও অচিরেই তা বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবী জনতার আন্দোলনে পরিনত হলো। চীনে সাম্যবাদী সমাজ গড়ার লক্ষ্যে গড়ে উঠলো কমিউনিস্ট পার্টি। মাও সে তুঙ হলেন তাদের নেতা।

তার পরের এক দশক, ঝড়ো সংগ্রামের দশক। দীর্ঘ বছরের জীবন যন্রনার অবসান ঘটাতে মানুষ যেনো তৈরি ছিলেন ডাক পাবার অপেক্ষায়। কমিউনিস্টদের ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলেন তারা। কৃষকের আন্দোলন, শ্রমিকের ধর্মঘটে দেশ যেনো উত্তাল হতে লাগলো। জায়গায় জায়গায় গড়ে উঠতে লাগল বিপ্লবী বাহিনী।

প্রমাদ গুনলেন এদেশের বুর্জোয়ারা। চিয়াং কাই শেক, তার সেনাদের নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন এই গরীব খেটে খাওয়া বিপ্লবী শক্তির ওপর। কিন্তু না, পরাভূত করতে তিনি পারলেন না। মাও এর ডাকে, কমিউনিস্টদের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে দেশের বিশাল প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়ে সংগঠিত হলো ছ'হাজার মাইল ব্যাপী ঐতিহাসিক লঙ মার্চ। গ্রামাঞ্চলের গরীব, গুর্বো হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে জীবন্ত, নতুন কলেবরে হাজির হলেন কমিউনিস্টরা।

চীনে সাইকেল যাত্রা (৬): চেঙদুর আকাশে চক্কর খাচ্ছে বিমান। মিনিট কুড়ির মধ্যে পা রাখবে চাকা। তারা নেই আমার, এই ভোর রাতে নেমে ইউথ হোষ্টেলে পৌছানো চাপ। তাই লেখায় ফিরে যাই।

১৯৩৪ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজনা বেজে ওঠার আগেই, জার্মান ও ইতালির দোসর সাম্রাজ্যবাদী জাপান উত্তর চীন আক্রমণ করলো। নানকিং এ বহু মানুষ আক্রান্ত হলো। দেশ রক্ষার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে, চিয়াং কাই শেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পেছনে মুখ লুকালো, কিন্তু দায়িত্ব এড়ালোনা কমিউনিস্টরা। সাম্রাজ্যবাদী জাপানকে পর্যুদস্ত করার আহবান জানালেন মাও। হাতে অস্ত্র তুলে নিলেন নিলেন সাধারণ জনতাও। মরনপন সেই লড়াইয়ে জয়ী হলেন চীনের জনতা।

ইতিমধ্যে জাপান বিশ্বযুদ্ধে হারের খাতায় নাম লিখিয়েছে। হিরোশিমা, নাগাসাকিতে আনবিক বর্ষনে বিধ্বস্ত সে। না, বিজয় উল্লাসে ভুলে যাননি সেদিন এদেশের কমিউনিস্টরা, তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। ১৯৪৫-এ পার্টি কংগ্রেসে মাও এর ডাকে সাড়া দিয়ে, পরের লড়াইতে নেমে পরলো কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে মেহনতি জনতা, সহস্র বছরের শৃঙ্খল মুক্তির লড়াইয়ে। মানুষের সেই রুদ্র মূর্তির সামনে দাড়াতে পারলেন না চিয়াং কাই শেখ ও তার বাহিনী। মালিক শ্রেনী ও দালালদের সঙ্গী করে দেশ ছেড়ে পালালেন তিনি, আশ্রয় নিলেন ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন হঙকঙে।

বজ্র নির্ঘোষে বিদীর্ণ হলো আকাশ। রাশিয়ার পর আরেকটি বৃহৎ রাষ্ট্রে শ্রমজীবি মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা গোটা পৃথিবীকে আলোড়িত করলো আরো একবার। নতুন রাষ্টের চেয়ারম্যান হলেন মাও। তারপর? নতুন রাষ্ট্র গড়ার উদ্যোগ, সেও এক ইতিহাস। চলতে চলতে সে আলোচনা করে নেবো আমরা।

চীনে সাইকেল যাত্রা (৭): হিমালয়ের এপারে একটি মাঝারি মাপের শহর চেঙদু। খানিকটা অবহেলাতেই নিয়েছিলাম এয়ারপোর্ট টিকে, কিন্তু নিচে নামতে নামতেই সে জানান দিলো, আদৌ অবহেলার পাত্র সে নয়। ওপর থেকে একনজর চোখ বুলিয়ে অবাক হলাম। প্রায় শতাধিক বিমান দাড়িয়ে সারিবদ্ধ ভাবে। কেউ বিশ্রামে, কেউবা ওড়ার অপেক্ষায়। দেশটিতে পা রাখার আগেই, তার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যাপকতা, বানিজ্য বিস্তৃতি এক লহমায় যেনো বুঝিয়ে দিয়ে গেলো।

দিল্লি থেকে কিছু মানুষও এসেছিলেন, তাদের কেউ বা ট্যুরিস্ট, কেউবা বাণিজ্যে। একে একে সবাই হাজির হলাম ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। কমিউনিস্ট শাসিত চীন, ভেবেছিলাম কড়াকড়ি হবে অনেকটাই, দিতে হবে অনেক প্রশ্নের জবাব, কিন্তু না তেমন কিছু হলোনা, পাসপোর্টটি খতিয়ে দেখে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভিসার কাগজে ছাপা মেরে দেশে ঢোকার ছাড়পত্র দিয়ে দিলো। অন্যদেরও তাই। বুঝলাম, উদারনীতির হাওয়া লেগেছে এদেশেও, ভিয়েতনামেও অবশ্য তাই দেখেছিলাম। যারা এই দেশগুলো নিজের চোখে দেখবেন, বুঝবেন বলে আসতে চান, তাদের বলবো, নিশ্চিন্তে চলে আসুন এদেশে। সাধারণ জনতাও রয়েছে আপনারই পাশে।

এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে ঢুকতে হবে শহরে, ইউথ হোষ্টেল, আট দশ কিমি দুরে। এয়ারপোর্ট মানেই সব দেশের ট্যাক্সি চালকদের খানিকটা বাড়তি ইনকামের জায়গা, এগিয়ে আসা তাদেরই একজনকে তাই কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করলাম কত নেবেন? বললো, যাবো তো মিটারে। ঐ গোটা কুড়ি টাকা হবে। প্রথমেই বলে রাখি, চীনে সব কিছুরই দাম কম, কিন্তু তা ওদের কাছে, ওদের টাকার বিচারে। আমাদের তাতে আনন্দিত হবার কিছু নেই, কারণ আমাদের টাকার দাম এতটাই নেমে গেছে, যে ভারতীয় টাকায়, আমাদের দিতে হয় দশগুণের বেশি। ফলে ওদের কাছে কম হলেও আমার কাছে তা দুশো। যাইহোক, উঠে পড়লাম ওনার গাড়িতে। এয়ারপোর্ট পেছনে ফেলে, শহরমুখী হয়েছে গাড়ি, চওড়া, ছিমছাম পরিস্কার রাস্তা, বড় বড় মাল্টিপ্লেক্স বাড়িগুলো চারপাশে মাথা উচু করে আগন্তুককে স্বাগত জানাচ্ছে। শহরবাসী, না তাদের ঘুম ভাঙ্গেনি। ভারতীয় সময় সাড়ে সাতটার দিকে এগোলেও এখানে এখন পাচটার ঘরে। মিনিট কুড়ির মধ্যেই ট্যাক্সি এসে দাড়ালো ইউথ হোষ্টেলে। দরজায় লাগানো ওদের জাতীয় পতাকা যেনো স্বাগত জানাচ্ছে আমায়। নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে, চালক ভদ্রলোক কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিটারে ওঠা পনেরো টাকা নব্বই পয়সাই নিলেন, দশ পয়সাও ফেরত দিলেন, মনে হলো, সততার নূন্যতম একটা মাপকাঠি ধরে রাখতে পেরেছে দেশটা।

চীনে সাইকেল যাত্রা (৮): শহরের ঘুম ভাঙলেও আমি চলে গেলাম সেই রাজ্যে। ঘুম ভাঙলো বেলা দশটায়। স্নান সেরে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পরলাম। শহরটা ঘুরে নিতে হবে আজই, কাল আবার সাংহাই পাড়ি দিতে হবে ট্রেনে। সেখান থেকেই শুরু আমার সাইকেল যাত্রা। বেরোনোর আগে ইউথ হোষ্টেল কর্তৃপক্ষ আমার হাতে তুলে দিলেন শহরের একটি ম্যাপ। আমি এদেশ সাইকেলে পরিক্রমা করবো শুনে একটি মেয়ে আমার ফোনে লোড করে দিলে ওদের জিপিএস, 'Amap'। প্রকৃতপক্ষে এই amap ও জিপিএস-ই ছিলো ভাষা না বোঝা এদেশে আমার গাইড।

হোষ্টেল থেকে বেড়িয়ে দুপা যেতেই সামনে চার রাস্তার মোড়। ডানদিকে মোড় নিতেই বাজার, ছোট হলেও মানুষ জন রয়েছে, তবে কিছুটা যেনো ছুটির মেজাজে। বাজার শেষের দিকে, বেশিরভাগই আড্ডা, গান বাজনা, দাবা তাস খেলায় মজে। নবাগতর ওপর দু'একবার চোখ বুলিয়ে আবার তারা তাদের জগতে মগ্ন হয়ে যায়। রাস্তার ওপরেই একটি বড় রেষ্টুরেন্ট, গোটা বারো কর্মচারী দুই সারিতে মুখোমুখি দাড়িয়ে। তাদের একজন বক্তব্য রাখছেন, সম্ভবত তাদের ইউনিয়নগত কোন সভা হচ্ছে। বক্তব্য শেষ হতে সবাই কেমন লাইন দিয়েই ভেতরে চলে গেলো। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হলো? ভদ্রলোক বুঝলেন, কিন্তু ভাষার ব্যবধানে আমাকে বোঝাতে পারলেন না।

দুপুরের খাবার দোকানে ঢুকে বিপত্তি, রাইস বোঝাতে কালঘাম, শেষে দোকানে খেতে আসা পাসের অফিসের ইংরেজি জানা মেয়েটি সমস্যার সমাধান করলো। ভাত পাওয়া গেলো বটে, বিরাট পাত্রে আমাদের প্রায় দুজনের খাবার, দাম? দশ টাকা।

খাবারের পাট চুকিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রে যাবো বলে, বাস ধরতে দাড়ালাম উল্টোদিকের বাসস্ট্যান্ডে। একতলা বাস, এসি, আকারে একটু বড়ই। তবে বাসের থেকে বেশি অবাক হলাম তার চালককে দেখে। বছর ২৫শের একটি মেয়ে চালকের আসনে, সবাইকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। বাসে তো উঠলাম, কোথায় নামবো ম্যাপ দেখিয়ে বলেও দিলাম, কিন্তু ভাড়া? প্রথমেই বলি এদেশের যে শহরেই যাবেন, শহরের যে প্রান্তেই যাবেন ভাড়া সেই দুটাকা। সামনের গেট দিয়ে উঠে, সবাই ফোন পেতে তে পয়সা দিয়ে দিচ্ছে, এদেশের সর্বত্রই এভাবেই টাকা পয়সার লেনদেন, মনে হলো আমাদের প্রধানমন্ত্রী চীনের কাছ থেকে এই একটি বিষয়ই নিয়েছেন, তাই পে-টাইমের ঢাকঢোল ভারতে, কিন্তু সে নয় হলো, কিন্তু আমার ভাড়া দেবো কি করে? আমার তো ফোনে দেবার সুযোগ নেই। বাক্স একটা রাখা আছে, তাতে দুটাকা জমা করা যায়, কিন্তু আমার কাছে তো খুচরোও নেই। কি করবো জিজ্ঞেস করতে চালক মেয়েটি মিষ্টি হেসে বললো, দিতে হবেনা আপনাকে, আপনি আমাদের অতিথি। আমি ভাবলাম বাবা! শুধু তাই নয়, আমার নির্দিষ্ট স্টপেজ আসতেই আমাকে ডেকে দিলো, নামার সময় আমি কিভাবে ওদের মিউজিয়াম এবং ম্যাল-এ পৌছাবো বাস থামিয়ে আমাকে তা বুঝিয়ে দিলো। হাতে একটি কার্ডও ধরিয়ে দিলো, ভাবলাম টাকা রিচার্জের, খুলে দেখলাম না, এতে পরিবহন বিভাগ আর শহরের পুলিশ কনট্রোল রুমের ফোন নং দেওয়া, পাছে হারিয়ে গেলে সাহায্য নিতে পারি। বুঝলাম, এদেশটায় পথ হারানোর সম্ভাবনা কম, হারিয়ে গেলে পারলে এরা আমায় বাড়ি অবধি পৌঁছে দেবে।

চীনে সাইকেল যাত্রা (৯): শহরের কেন্দ্রস্থল, বেশ বড় জায়গা জুড়ে পার্ক কাম ম্যাল, অনেক মানুষের মিলনের জায়গা। ডাইনে রাস্তার পাড়ে বিশাল অবয়ব নিয়ে দাড়িয়ে মাও, সামনে চেঙৃুদুর ইতিহাস নিয়ে দাড়িয়ে বিরাট মিউজিয়াম, পার্কে বিপ্লবের সত্তর বছর পূর্তিতে সাজ সজ্জা, আর চারিদিক ঘিরে রয়েছে অফিস, আদালত, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সুউচ্চ অট্টালিকা। মিউজয়ামে এই শহরের অতীত ও বর্তমানের বিবর্তনের ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন চারপাশটা আলোর ঝলকানিতে যেনো আরো সুন্দর। পাশের বিরাট পার্কে পৌছে দেখলাম আধো আলোতে বক্স চালিয়ে মহিলারা নাচগানে ব্যাপিত। বেড়িয়ে চলতে চলতে একটি ছেলের ব্যাটারি বাইকে পৌছে গেলাম, (চিনতে পারলাম না বলে ও নিজেই বাইকে করে দিয়ে এলো) অতীতের চেঙদু-তে। শহরের এই পাড়া, রাস্তা আর গলির সব ঘরবাড়ি রেষ্টুরেন্ট সেই পুরনো আদলে গড়া। বিদেশী ট্যুরিস্টের ভীড় ঠেলে গলির মধ্যে এগিয়ে চলেছি, কেমন নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত আমিও, যেনো আমিও ফিরে গিয়েছি পাঁচশো কিম্বা হাজার বছর আগের চেঙদুতে। ঘোরের মধ্যেই গলি আমায় রাজপথে পৌঁছে দিলো। হোটেলে ফেরার বাস ধরবো, ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলেছি হটাৎ নজরে এলো একটি রেষ্টুরেন্ট এর সামনে সাড় দিয়ে বসে সবাই ফেসবুকে ব্যস্ত। এখানেও ফেসবুক! সবাই যে বলেছিলেন এখানে ফেসবুক চলে না। নিঃশব্দে ছবিটা তুলে নিচ্ছিলাম কিন্তু ধরা পরে গেলাম, রেষ্টুরেন্ট এর মহিলা মালকিন বাইরে হাকডাক করে আমায় প্রায় ঘিরে ধরলো। প্রথমে ঘাবড়ে গেছিলাম, পরে বুঝলাম না মারবার জন্য নয়, আমায় দেখে ওরা উচ্ছাস প্রকাশ করছে। আমাকে অবাক করে মহিলা চেচিয়ে বললো, বলো সবাই "হিন্দি-চিনি ভাই ভাই"।, সবাই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গলা মেলালো, মুহুর্তে আমার মনে পরে গেলো কলোম্বোয় শ্রীলঙ্কার দুতাবাসের সেই কর্মচারীর কথা। দেশে দেশে মানুষের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, সরকার তার নিজস্ব রাজনৈতিক কারনে কখনো সম্পর্ক ভালো করে, কখনো মন্দ। আমরা তার শিকার হই মাত্র। ঠিক, তবে আমি কেনো সেই ভুল করি? তাই আমিও সেই বন্ধুত্বের আহ্বানে গলা মেলালাম। ভালো লাগায় মন ভরে গেলো, সেই কবে পঞ্চাশের দশকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মঞ্চে চৌ এন লাই আর আমাদের নেহেরু শ্লোগান তুলেছিলো, যা সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল, আজ আমরা ভারতবাসী অনেকেই ভুলে গেছি, ওরা কিন্তু মনে রেখে দিয়েছে। এক বুক ভালোবাসা সঙ্গী করে সে রাতে হোটেলে ফিরলাম।

চীনে সাইকেল যাত্রা (১০): সাত সকালেই পৌঁছে গেলাম চেঙ্দু স্টেশনে। চলেছি দেশের পূর্ব প্রান্তে সাংহাই। কোলকাতা থেকে অনলাইনে কাটা কাগজ দেখিয়ে পেপার টিকিট নিতে হবে। ভেবেছিলাম ভাষার কারণে অসুবিধা হবে, কিন্তু না দেখলাম বিদেশী জাতির লোকেদের ডিল করতে করতে ইংরেজি তে কিছুটা অভ্যস্ত। ট্রেন ছাড়বে সাড়ে আটটায়। দেরি আছে, স্টেশন তখনো ফাকা। সাতটা বাজতেই হৈ হৈ, কলরব, সব জনতা যেনো একসাথেই ঢুকে পরলো, । দেশটির যে জনসংখ্যা বিপুল তা যেন এক লহমায় বুঝিয়ে দিলো। কিন্তু প্লাটফর্মে ঢোকার গেট খুলবে কুড়ি মিনিট আগে।

আটটা দশ, গেট খুলে গেলো, তারাহুড়ো করে কামরার দিকে এগিয়ে চললাম। কামরায় ওঠার মুখে দাড়িয়ে কোচ এটেনন্ড্যান্ট কাম টিটি। সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছে। বসলাম ট্রেনে উঠে।একটি ব্যাগ রাখার জায়গা পেয়েছি, আরেকটির জায়গা নেই। টিটি ভদ্রলোক নিজেই নজর করে, এগিয়ে এসে অন্য যাত্রীদের বলে আমার ব্যাগ রাখার ব্যবস্থা করে দিলেন। অদ্ভুত অনুকরনীয় ওদের কোচ এটেনন্ড্যান্ট ব্যবস্থা। আমাদের দেশে টিটি শুধু টিকিট পরীক্ষা করে দায়িত্ব শেষ করেন, কিন্তু এখানে? আপনাকে সিট দেখিয়ে দেওয়া, ব্যাগপত্র রাখতে সহযোগিতা, কোচের জানলার পর্দা সাজানো, শেষে অবাক হয়ে দেখলাম,যাত্রী দের খাবার খাওয়ার পর এখানে ওখানে কিছু খাবারের টুকরো পরে রয়েছে দেখে উনি নিজেই ঝাটা হাতে পরিস্কার করতে লেগে গেলেন। মাঝরাতে উনিই আবার আমার গলায় ঝোলা ব্যাগের চেনটি ঘচঘচ করে খুলে আমায় সজাগ করে বললেন, ব্যাগটি ভেতর দিকে রাখুন। বুঝলাম, উনিই হলেন রেল যাত্রায় কামরার সবার অভিভাবক। কামরার ভালো মন্দ, পরিস্কার অপরিস্কার সবই ওনার দায়িত্ব। এমনকি ট্রেন থেকে নেমে যাবার সময় উনি গেটে দাড়িয়ে আপনাকে বিদায়ও জানাবে। ভালো লাগলো ওদের এই ব্যবস্থাটিকে। আর ভালো লাগলো এদেশের মানুষেরা কোন কাজকেই ছোট মনে করেনা। ট্রেন ছাড়লো সময়েই, ধীরে ধীরে শহর ছাড়িয়ে লম্বা সাপের মত একেবেকে হারিয়ে গেলো পাহাড়ের কোলে। কখনো নদীপাড়, কখনো বনাঞ্চল, চা বাগান, সবুজের সমারোহ, সুরঙ্গের পরে সুরঙ্গ পেড়িয়ে ট্রেন আমাদের ছুটে চলেছে ঘন্টায় কখনো ১০০, ১২০ কখনো বা দেড়শ কিমি বেগে। গতির সাথে পাল্লা দিয়ে ট্রেন তখন কোলাহল তর্ক বিতর্কে সরগরম। কি নেই সেই আলোচনায়, ঘর সংসার থেকে দেশ, বিদেশ সব চলে আসছে আলোচনায়, সমানতালে অংশগ্রহণ করছে মহিলারাও, কামরার অপরপ্রান্ত থেকে সবাইকে ছাপিয়ে ভেসে আসছে এক মহিলার গলা। এদিকেও কমতি নেই। অনেকেই বলে থাকেন, এদেশে নাকি গণতন্ত্র নেই। আমার কিন্তু তা মনে হলোনা। বরং পক্ষ বিপক্ষ আলোচনায় সবসময় সরগরম রেলগাড়ির কামরা যদি গোটা দেশটার প্রতিচ্ছবি হয়, তাহলে বলতেই হবে, এদেশের মানুষ আলোচনা মুখর, এখানকার গনতন্ত্র, সাধারণ মানুষের জ্ঞান এর জগতের পরিসর অনেকটাই বড়। বাইরের দুনিয়া দেখতে দেখতে, আর এদের আলোচনার বিষয়বস্তু অনুধাবনের চেষ্টা করতে করতে কখন চোখ বুঝে গিয়েছিলো জানিনা, হটাৎ কানে এলো, 'নীল আকাশের নিচে' সিনেমা নিয়ে জোর চর্চা চলছে। বুঝলাম আলোচনার সুত্রপাত আমাকে ঘিরে। ষাট কিম্বা সত্তরের দশকের বাংলায়, কোলকাতায় বাসরত একজন চীনা মানুষের মাধ্যমে তাদের জীবনধারা, তাদের অনুভুতি প্রবন সুন্দর মনকে পরিচালক তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত পুরস্কারও পেয়েছিল ছবিটি। ভালো লাগলো সেই কোন ছোটবেলায় দেখা ছবিখানির আদ্যপ্রান্ত আমার মনে না থাকলেও চীনবাসীদের মনে রয়েছে। আমাকে সেই উদার হৃদয়ের অধিকারী কোলকাতারই একজন বলে ভাবছে, সেই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসারই প্রতিচ্ছবি দেখলাম যেনো তাদের চোখে মুখে। চোখ মেলতেই আমার ডানদিকে সামনের সিটে বসা চীনা যাত্রী, যিনি এতক্ষণ হাসি আর মস্করা দিয়ে ট্রেন যাত্রী দের মাতিয়ে রেখেছিলেন, তিনি আমায় সস্নেহে বললেন, তুমি তো কাল রাত থেকেই তেমন কিছুই খাওনি, নাও তুমি এগুলো খেয়ে নাও বলে আমার হাতে ওদের বাড়িতে তৈরি খাবার, আপেল, কমলা লেবু, একগাদা কুল পর্যন্ত ধরিয়ে দিলে। ভাষার ব্যবধান, কিন্ত সখ্যতা, আন্তরিকতা গড়ে উঠতে দেরি হলোনা। এদিকে ভোর রাতেই হিমালয়ের প্রভাব মুক্ত হয়ে ট্রেন পূর্ব প্রান্তে সমভূমিতে নেমে এসেছে। যত এগোচ্ছে ততই শহরের আকার, জনঘনত্ব আর আধুনিকতার ছোঁয়া যেনো পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। ট্রেন ন্যানজিং, চ্যানজো, সুজু হয়ে সাংহাই স্টেশন ঢুকলো বেলা দুটোতে ওর নির্দিষ্ট সময়েই। আমার সহ-যাত্রীরা, কোচ এটেনডেন্ট বিদায় জানালেন আমায়। মনটা কেমন ফাকা হয়ে গেলো মানুষ গুলোর জন্য। এগিয়ে চলেছি নতুন শহরের আঙ্গিনায়। নতুন পরিবেশের ডাকে। আবার নতুন মানুষের ভালোবাসায় হৃদয় হয়তো ভরাট হয়ে যাবে, কিন্তু রেল যাত্রার এই স্মৃতি আমারই সাথে পথ চলবে অনেক দিন।

চীনে সাইকেল যাত্রা (১১): সাংহাই নগরী, চীনের শুধু নয়, গোটা বিশ্বের অন্যতম সেরা বানিজ্য বন্দর। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কর্মব্যস্ত বন্দর, সবচেয়ে বেশি কনটেনার ওঠানামা করে এখানে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে নানকিং এর সন্ধির পর ইওরোপীয় শক্তির নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে, এই বন্দর ছিল বাইরের জগতের সাথে যোগ সুত্রের একটি প্রধান ক্ষেত্র। এখানেই ৪ঠা মে আন্দোলন জম্ম দিয়েছিল এদেশের কমিউনিস্ট পার্টির।আজ দুনিয়ার বৃহৎ করপোরেট গোষ্ঠী এমনকি ছোট হলেও ভারতীয় পুজিগোষ্ঠী থেকে মধ্যবিত্ত ভারতীয় শিক্ষা,কাজ কিম্বা বানিজ্যের প্রয়োজনে যাতায়াত এখানে।

স্টেশন নেমে তার আভিজাত্য ভালোমতো মালুম হলো। বেশ কিছু ছবি তুলে স্টেশনের বাইরে এসে, স্বেচ্ছাসেবীদের পরামর্শে ১০৯ নম্বর বাসে চেপে বসলাম। লক্ষ্য শহরের ইউথ হোষ্টেল, ইউথ যদিও আর নই, কিন্তু সেই অনেক কালের ভালোবাসা, সবাই মিলে একসাথে হৈ হৈ করে কম পয়সায় থাকার এত ভালো ব্যবস্থা অন্য কোথাও নেই। পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষকেই আপনি এখানে পাবেন, যেনো ছোট্ট একটি পৃথিবী। যাই হোক শহরের আভিজাত্য আর মাথা উচু করে আপন গরিমায় দাড়িয়ে থাকা সুউচ্চ অট্টালিকা অফিস আদালত দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম আমার গন্তব্যে। বাস থেকেই নেমেই দেখি সামনের বিরাট অফিস বাড়ির সামনের ফুটপাতে বিরাট সংখ্যক মানুষের ভীড়, কি ব্যাপার? কোন প্রতিবাদ? কর্মচারী ছাটাই? তাই নিয়ে কোন প্রতিবাদ? জানবার আগ্রহের এগিয়ে গেলাম। সবাই টিভির সামনে কি যেনো দেখতে ব্যস্ত। জিজ্ঞেস করে জানলাম এটা শেয়ার বাজারের ভীড়, মনে পরে গেলো, বিশ্বের অন্যতম বড় শেয়ার বাজারের কর্মকাণ্ড এখানেই। যাইহোক, ডাইনে বায়ে করতে করতে পৃথিবীটা গোল প্রমাণ করে এরপর ইউথ হোষ্টেলে পৌছালাম। রুমে পৌছেও চমক, হংকং, চীন, পৃথিবীর অন্য অংশের মানুষ আছেন, কিন্তু আমার পাশের বেডে আমার সঙ্গী হয়েছেন পর্তুগাল থেকে আসা এক ভদ্রলোক। এখানে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে এসেছেন, ভদ্রলোক ১৪টি দেশের ভাষা জানেন। আমি বললাম পায়ের ধুলো দিন দাদা, এক চীনা ভাষা বুঝতে আমি নাকানি চোবানি খাচ্ছি, আর আপনি চোদ্দটি ভাষা! বললেন চীনা ভাষা বুঝতে একটু অসুবিধা হয়, তার কারণ ওরা খুব দ্রুত কথা বলে, তবে, কেউ যদি মনে জেদ নিয়ে কিছু শিখবে বলে এগোয় , সে সব পারে। একদম ঠিক কথা। এরপর আর কথা চলেনা।