প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা - সেপ্টেম্বর, ২০২০
Others/অন্যান্য
যে উপাখ্যান লেখা হয়নি (ধারাবাহিক রচনার প্রথম পর্ব)
অজন্তা সিনহা
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য...
চুইখিম আসার পর একটি পুরো শীত ও বসন্ত গেছে। শীতে প্রবল ঠান্ডা পড়েছিল। সন্ধে ৭টার পর আর কিছুতেই বিছানার বাইরে থাকা যাচ্ছিল না। অথচ উচ্চতা মাত্র ৩৫০০ ফুট। এর থেকে অনেক বেশি উচ্চতায় থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। সে অবশ্য বেড়াতে গিয়ে। বসবাস ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। সে যারা জানে, তারা জানে। যাই হোক, জানুয়ারির শেষ থেকেই আবহাওয়ার পরিবর্তন বেশ বোঝা গেল। বাড়ির পিছনের বড় নাম না জানা পত্রবিহীন সুখা গাছটার গায়ে লাগলো সবুজের মোড়ক। পাতা গজাবার সঙ্গে সঙ্গেই পাখিদেরও যাতায়াত শুরু হলো। ঘুম ভাঙতো তাদেরই কলতানে। আর সব ঋতুতেই যারা মানবজাতির ঘুম ভাঙানোর দায়িত্ব নিয়েছে, সেই মুরগি ব্রিগেডও ইতিমধ্যেই খুঁজে নিয়েছে আমার বাড়ির ঠিকানা। কাকভোরে ঘুম ভাঙিয়ে মুড়ি খেতে চলে আসতো তারা।
প্রকৃতি ও পরিবেশ ঘিরে এই যে নতুন অনুষঙ্গে দিনের রুটিন বদলে যাওয়া, সেটা বলতে, ভাবতে বা গল্পের আকারে পড়তে বেশ রোমান্টিক মনে হয়। সেসময় আমিও সেই অনুভবের স্রোতে ভেসে যাচ্ছি। তখনও জানি না, নাকি মনে রাখিনি, বসন্তের পরেই আসবে গ্রীষ্মকাল। অর্থাৎ কালবৈশাখী এবং তার ফুটস্টেপ ধরে বর্ষা। পাহাড়ের ঝড়! পাহাড়ের বর্ষা! সে যে দেখেছে, সে-ই একমাত্র জানে। আর এটা না জানলে পাহাড়-প্রকৃতির কিছুই জানা হলো না। আর এই প্রকৃতি? সেও কি শুধু পাহাড়, জঙ্গল, নদী আর আকাশ? এর সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষ, তাদের যাপনের কথামালা? সেসবও তো জানতে হবে! সেইসব কথামালা কেমন করে আমার ব্যক্তিগত জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে সমষ্টির উপাখ্যান হয়ে উঠলো, শুরুতে তারই প্রস্তাবনা।
চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর স্থায়ীভাবে কলকাতা ছেড়ে পাহাড়ে চলে আসবো, একথা তখন জনে জনে বলছি। পাহাড় মানে উত্তরবঙ্গ। দৌড় এটুকুই। এর বেশি দূরে যাওয়ার সামর্থ কোনও দিক থেকেই নেই। তাতেও আত্মীয়স্বজন, চেনা-পরিচিতদের কি প্রবল দুশ্চিন্তা। 'হঠকারি সিদ্ধান্ত' বলছেন সকলেই। প্রবলভাবে নিরুৎসাহিতও করছেন। আর সেটাই স্বাভাবিক। সেই সব বাধা এবং নিজেরও দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর করে একদিন কলকাতার ঠিকানা চিরকালের মতো ছেড়ে চলে এলাম উত্তরবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।
পাহাড় ভালোবেসে পাহাড়ে বেড়াতে আসা আর পাহাড়ে স্থায়ীভাবে থাকতে আসা, দুটোর মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক! এটা যে আমি জানতাম না, তা নয়। যাবতীয় প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতেও প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু সেই প্রস্তুতিও যে নিছক ছেলেখেলা, অপরিণত মনের অপটু পদক্ষেপ, সেটা বুঝলাম বর্ষা আসতেই।
আসলে পাহাড় ও প্রকৃতি নিয়ে আমাদের সবার মনেই এক অন্ধ রোমান্টিসিজম কাজ করে। আমরা নিজেদের 'শরীর-মন'কে কল্পনায় একেবারে কবিতা হয়ে উঠতে দেখি। মনে মনে কখনও পাকদন্ডী ধরে হারিয়ে যাই অথবা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চা বা কফিপানের মৌতাতে মাতি। চা-কফির বদলে পছন্দের উষ্ণ পানীয়ও হতে পারে। বহু ট্যুরিস্টকে আমি দেখেছি, তারা বেড়াতে গিয়ে প্রথমে এই কাজটিই করে। একটি বোতল খুলে বসে পড়ে। শেষে এমন কান্ড, পাহাড় দেখবে কি, অজ্ঞান, অচেতন হয়ে চিৎপটাং। আরে, এসব তো বাড়িতে বসেই করা যায়, এর জন্য প্রকৃতির কাছে যাওয়ার কি দরকার ! পাঠক ক্ষমা করবেন, জানি, এ পুরোপুরি ব্যক্তিগত রুচি-অরুচির ব্যাপার। আমিও তাই সমালোচনা করছি না। শুধু ছবিটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বলতে পারেন, পাহাড়ে থাকতে আসার আগে রোমান্টিসিজম নিয়ে আমারও কিছু গতে বাঁধা ধারণা ছিল। আমিও ভাবতাম পাহাড়ে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখেছি, আর কি চাই ? যেবার দয়া করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন দিলেন, সেবার তো রাজা হয়ে গেছি। প্রসঙ্গত, বঙ্গবাসীর পাহাড় সিলেবাসের সিংহভাগ জুড়ে আজও কাঞ্চনজঙ্ঘাই বিরাজমান। কাঞ্চনজঙ্ঘা আর তিস্তা। দুই খাড়াই পর্বতশ্রেণীর মাঝখান দিয়ে তিস্তার দীর্ঘ যাত্রাপথের সঙ্গী হওয়া ! আহা, কি অপরূপ বিচিত্ররূপিনী এই নদী!
নাহ, এই দুই মহার্ঘ প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতার পরেও বলবো, এইসবই যথেষ্ট নয়। পাহাড়ের (আমার জীবনে উত্তরবঙ্গের) ক্যানভাসে রোমান্টিসিজমের আসল ছবিটা দেখতে চাইলে এখানকার মানুষের ভাতের লড়াইটা বুঝতে হবে। এ এক অন্তহীন লড়াই। তিস্তা, কাঞ্চনজঙ্ঘা বা ডুয়ার্সের জঙ্গলের অপরূপ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েও এই মানুষগুলো কখন যেন প্রকৃতি দেখতে ভুলে যায়! আমাদের পাগল পাগল মুগ্ধতা ওদের নিত্যযাপনের কঠিন যুদ্ধে মাঝে মাঝেই হাসির খোরাক হয়ে ওঠে ! এসব বোঝার সময় পার হয়ে গেছে অনেক কাল আগে। আমরা আসা-যাওয়া করেছি। দেখিনি চেয়ে। আমার সৌভাগ্য না নিয়তি জানি না। আমি দেখেছি সেই নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত মুখগুলি। দেখেছি সবকিছুর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে সেই নৈর্বক্তিক হাসি হাসতে, যেখানে আসলে জীবন থেমে গেছে। থেমে গেছে, তাই, আর হারাবার ভয় নেই।
তার মানে কি শুধুই বিষণ্নতা? শুধুই অপ্রাপ্তির হাহাকার? শুধুই বিশ্বাসভঙ্গ? নিশ্চয়ই নয়। এর উল্টোটাও আছে। তবে, সেই আশাবাদের ছবিটা দেখার শুরু এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে আসার অনেক আগে থেকেই। বলতে পারি, শুধু প্রকৃতি নয়, এখানে একেবারে চলে আসার ক্ষেত্রে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছে এখানকার লড়াকু মানুষগুলি। ওদের সংস্পর্শে এসেই বদলে যেতে থাকে জীবনবোধ। শেষে কোনও একসময় 'লড়াই', 'যুদ্ধ', 'সংগ্রাম' এই শব্দগুলির ব্যঞ্জনাও নতুনরূপে ধরা দেয়। জীবনের যাবতীয় অপ্রাপ্তিজনিত রাগ, ক্ষোভ, তিক্ততা, বিরক্তি একটু একটু করে প্রশমিত হতে শুরু করে। এও এক অনুপম লগ্ন জীবনের। এবার একে একে সেই মুহূর্তগুলির গল্পেই যাব।
একটা সময় ছিল, যখন নতুন বছর শুরু হলেই তারিখ ধরে আমি আমার বেড়াতে যাওয়ার ক্যালেন্ডার বানিয়ে ফেলতাম। সাংবাদিকতা পেশায় ছুটিছাটা কম। তবু, বছরে তিন/চারবার আমি পালিয়ে আসতাম পাহাড়ে। তেমনই একবার, আমাদের মতো কেজো লোকের ভাষায় বেশ গুছিয়ে পড়েছে ১৫ আগস্টের ছুটি। অতএব চলো পাহাড়ে। গন্তব্য 'দাওয়াই পানি' বলে একটি জায়গা, যা তখনও কলকাতার ট্যুরিস্টমহলে প্রায় অশ্রুত। অশ্রুত অর্থাৎ ভিড় নেই। আদতে, সেই সময় 'দাওয়াই পানি'তে একটাই হোমস্টে। আমিই সেখানকার প্রথম অতিথি। এসব তো খুব ভালো ভালো অনুভূতির ব্যাপার। কিন্তু বাস্তব তো সব সময়ই কান ধরে শেখায় জীবনের বিপরীত প্রেক্ষিতগুলিকে। আমারও এই যাত্রার শুরুতে সেটাই ঘটলো। সারাদিন অফিস করে, সারারাত ট্রেন জার্নি করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যখন নামলাম, তখন ক্লান্তি, খিদে, বহুক্ষণ এক জামাকাপড় পরে থাকার বিরক্তিতে বিপর্যস্ত আমি। ট্রেন স্টেশনে ঢোকার আগে থেকেই ড্রাইভারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ চলছে। সে শেষ যা জানিয়েছিল, তা হলো, প্রবল বৃষ্টিতে দ্রুত গাড়ি চালানো মুশকিল, তাই কিঞ্চিৎ দেরি হতে পারে তার।
সেই ধারণা মতো আমি অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার কাল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। এদিকে শেষ শ্রাবণ একেবারে পাগল হয়ে উঠেছে। এত জোরে বৃষ্টি পড়ছে যে স্টেশনের বাইরের কিছুই দৃশ্যমান নয়। স্বাভাবিক। কলকাতার হিতাকাঙ্খীজন বার বার বারণ করেছিল, বর্ষায় পাহাড়ে না আসতে এবং আমি সেই বারণ শুনিনি। অতএব ভোগান্তি নিতেই হবে! এরই মধ্যে ড্রাইভারকে ধরার চেষ্টাও চলছে এবং 'নট রিচেবল' শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। এই পর্বের বিস্তারে না গিয়ে বলবো, এত কাণ্ডের পর গাড়ি যখন এসে পৌঁছল, তখন আমি অসীম তিতিবিরক্ত এবং তার জের পুরোটাই গিয়ে পড়লো ড্রাইভারের ওপর। সে অত্যন্ত কাঁচুমাচু হয়ে, গাড়িতে আমার মালপত্র তুলতে তুলতে বললো, "রাগ করবেন না প্লিজ। যাওয়ার পথে আপনাকে মংপু ঘুরিয়ে নিয়ে যাব, ওখানে রবীন্দ্রনাথের একটা বাড়ি আছে ।" আমি বিরক্তি ভুলে খুশি হয়ে বলি,"তুমি জানো মংপু সম্পর্কে ?" "জানি তো! কলকাতা থেকে গেস্টরা এলে, ওখানে অন্তত একবার তো যাবেনই।" প্রসঙ্গত, আমাদের সব কথাই হিন্দিতে হচ্ছিল, আমি তার বাংলা তর্জমা করে লিখছি। এ পর্যন্ত যা কথোপকথন, তাতে প্রাপ্তি ছিল, কিন্তু চমক নয়। পরে যা পেলাম, তাকে চমক না বলে, উপলব্ধি বলাই বোধহয় বেশি ভালো হবে। আমাদের গাড়ি যাত্রা শুরু করেছে। আকাশ ও রাস্তা দুইয়ের অবস্থাই অত্যন্ত খারাপ। বৃষ্টির বিরাম নেই। ছেলেটি ধীরগতিতে খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে। আমি কিছুটা ধাতস্থ। আপাতত ধৈর্যের পরীক্ষা। বৃষ্টিস্নাত পাহাড়, গাছপালা দেখতে দেখতে চলেছি। কিছুদূর এভাবে যাওয়ার পর আকাশের মুড ঠিক হয়। ধারাপাতের ধার কমে। রাস্তাও এখন কিছুটা ভালো। আমি ছেলেটিকে এটা-সেটা প্রশ্ন করি। সাধারণত নেপালি ছেলেমেয়েরা অল্প বয়সেই বিয়ে-থা করে সংসারী হয়ে যায়। ইনিও দেখলাম সে পথেরই পথিক। বলে, "জানেন ম্যাডাম, আমি সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই গাড়ি চালাই। তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। ঘরে মা আর ছোট ছোট ভাইবোন। আমি বড়, আমাকেই তো ভার নিতে হবে। সেই শুরু। আপনাদের আশীর্বাদে এখন আমার নিজের গাড়ি হয়েছে। আর কি চাই ? শুধু পড়াটা আর হলো না, ওই একটা দুঃখ। ছেলেকে অনেকদূর অব্দি পড়াবো। যতদিন ও লেখাপড়া করতে চাইবে!"
বাতাস কিছুটা ভারাক্রান্ত। সে হাসিমুখেই সবটা জানায়, তবু…! গাড়ি চলছে। সুকৌশলে কয়েকটি হেয়ারপিন বেন্ড পার করে হঠাৎই আবার বলে ওঠে, "স্কুল ছাড়লেও স্কুলের প্রেয়ারে যে কবিতাটা বলতাম রোজ সকালে, সেটা আজও ভুলিনি... Where the mind is without fear and the head is held high, where knowledge is free…"! শ্রাবণের এলোমেলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায় তার কন্ঠ। আমি সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ ! তারপরেই সে যোগ করে, "এটা তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। বিশ্বাস করুন, যখনই কোনও সমস্যায় পড়ি, মনে মনে এই কথাগুলো উচ্চারণ করি। শক্তি পাই। সাহস আসে মনে।"
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর... আজ এত বছর পরও সেই মুহূর্তটি স্মরণ করে শিহরিত ও আপ্লুত হই আমি। কলকাতায় এত বছর আছি। রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা করছি আশৈশব। কিসের চর্চা, কিসের কি? আমার সব অহংকার ধুলোয় লুটিয়ে যায়। আমি বা আমরা নই, রবীন্দ্রনাথকে প্রাণের মধ্যে পেয়েছে তো এই ছেলেটি ! আহ, এই পরাজয়েও কি আনন্দ! দূর পাহাড়ী পথে চড়াই-উৎরাই বেয়ে গাড়ি চলতে থাকে। আমি সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতার মাঝে মগ্ন হয়ে থাকি। এ কাহিনী আমি বহুবার লিখেছি, বলেছি। তবু, এর প্রাসঙ্গিকতা এতটুকু কমেনি। পাহাড়-জীবনের আসল রোমান্টিকতা এইসব অনির্বচনীয় স্মৃতির ভান্ডারে গচ্ছিত রয়েছে, যা কখনও বহু ব্যবহারে জীর্ণ হওয়ার নয়।