Editorial/সম্পাদকীয়
প্রায় অর্ধবছর ধরে চলা এই অভূতপূর্ব লকডাউনের মধ্যে প্রকাশিত হলো ‘সমাজ ভাষা ও সংস্কৃতি’র প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় মাসিক সংখ্যা। নিয়মিত বিভাগীয় লেখার সঙ্গে এই সংখ্যার মুখ্য বিষয় ছিল ‘রোগ ও সভ্যতার চ্যূতি’ বা ‘ডিসিজ অ্যান্ড ডিসপ্লেসমেন্ট অফ সোসাইটি’। কবিতা, গল্প, নিবন্ধ এবং প্রবন্ধ’এর সমন্বয়ে এই সংখ্যা তৈরি হয়েছে। একটি রোগ এবং অতিমারী যদি মূল অর্থক হয় তবে তার দ্বারা মানবসভ্যতায় নানাবিধ চ্যূতি বা ফাঁক লক্ষ করা যায় এবং এক্ষেত্রেও নানাভাবে দেখা গেছে। কখনো এই চ্যূতি ভরাট করার চেষ্টা করা হয় সামাজিকভাবে আবার কখনো সেই চ্যূতি’গুলিই আবার গহনার মতো নানারকমভাবে সভ্যতাকে সাজাতে থাকে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মৃত্যু, অর্থকষ্ট, কর্মহীনতা, চিকিৎসা সহ সমস্ত সামাজিক অধিকার থেকে আসলে বঞ্চিত হয়ে “কোনোরকমে” ঠেকা দেওয়ার জন্য, কাজ চালিয়ে যাবার জন্য যে পদ্ধতিগুলি আমরা বাধ্য হলাম গ্রহণ করতে সেগুলিকেই ‘নিউ নরম্যাল’ নামক আরেকটা তত্ত্ববন্ধে বন্দী করে ফেলেছি নিজেরাই। মধ্যবিত্ত মহলে ‘নিউ নরম্যাল’ শব্দটি সম্প্রতিকালে যথেষ্ট ‘এটাও বেশ হয়েছে’ মার্কা ইতিবাচক চেহারা নিয়ে প্রতিভাত হয়েছে যেখানে উচ্চবিত্ত এবং ক্ষমতাকেন্দ্রের সখ্য’কে এককথায় বৈধতা দিয়েছে মধ্যবিত্তের এমন নব-উৎফুল্ল মনোভাব। যত আলোচনাসভা, প্যানেল ডিসকাশন ‘ওয়েবিনার’ নামক আরেকটি শব্দবন্ধে বন্দী হয়েছে তাদের প্রায় প্রত্যেকটি এইসব ‘সিগনিফায়েড’ বা শব্দটির মধ্যে যতরকমের অর্থ (মানে) আর নতুন ভাবনা ঠেসে ঠেসে যেন তুবড়ি বানানোর প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দিয়েছে। একটা করে টার্ম বা তত্ত্ববন্ধ বাজারে ছেড়ে দাও, আর সেইগুলোতে কত বৈধতার বারুদ ঠেসে নতুনরকম করে চালানো যেতে পারে, তার প্রতিযোগিতায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ লেগে পড়েছে প্রবল উদ্যমে। হাজারে হাজারে বাড়িতে বসা ওয়েবিনার কোনো না কোনোভাবে নতুন গজিয়ে ওঠা আন্তর্জাতিক তত্ত্ববন্ধগুলোকে বৈধতা দেওয়ার কাজ করে চলেছে। এক একসময় এমনও মনে হয়, যেন একটু ঠেলে জাগিয়ে দিতে হয়, যে, বাবা এখনো রোগপর্ব চলছে, মানুষের মৃত্যুপর্ব চলছে, আর বাঁচার লড়াই বলতে যা চলেছে, সেটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। কিন্তু তা বললে তো চলবে না। আমাদের সবাইকে কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের মতো করে ইতিবাচক হতেই হবে। এবং উপর থেকে ছুঁড়ে দেওয়া যে কোনো ‘কোড’কে প্রয়োজনমতো ইতিবাচক হয়ে সুবিধামতো বৈধতা দিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়াটাই একমাত্র কর্তব্য। এর সমালোচনায় কিছু বললে তো হবে না। সবাই তখন ‘তাসের দেশ’এর এক একটি তাসের মতো অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখবে আর বলবে – এ তো নিয়ম ভাঙ্গতে চায়।
এইরকম ভাবনাই আসলে ক্ষমতাকে বৈধতা দেবার প্রধানতম উৎস।
‘সমাজ ভাষা ও সংস্কৃতি’ এই চ্যূতিগুলিকে ধরার চেষ্টা করেছে। সঙ্গে নিয়মিত বিভাগে গবেষণাধর্মী লেখার সম্ভার তৈরি করেছে, যার মধ্যে কিংবদন্তী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’এর অবদান’কে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক সমন্বয়ের উপর লেখা, অক্ষয়কুমার দত্তের জন্মের দ্বিশতবর্ষ’কে স্মরণ, নাট্যব্যক্তিত্ব অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের মূল সামাজিকতার আখ্যানসমূহ রচিত হয়েছে। এই লেখাগুলি পাঠকসমাজের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে। সংখ্যায় এখনো তেমন বেশি নয় ফলে আমাদের পাঠকবর্গের কাছে প্রত্যাশা তাই অনেক। যাঁরা একটু অচেনা ‘কোড’, অন্য নিয়ম, বা ‘আরেকরকম’ কিছু ভাবেন তাঁরা এই পত্রিকা পড়ুন, আলোচনাসভায় যোগ দিন, এই পত্রিকায় লেখা দিন, সবাইকে এই পত্রিকা পড়তে অনুরোধ করুন। তবেই একটা বিকল্প জমি তৈরি হতে পারে।