Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা - আগস্ট, ২০২০

Short Stories/ছোটগল্প

কোভিডনামা

পিয়ালী হালদার


(১)

অতিমারী ও রক্তক্ষণ

আজ অনেকদিন বাদে রেবাদের বাড়ি এলাম। আমি, কুহু, বিট্টু, রেজা, আর রেবার ভাই ডোডো। এতোদিন পর সবাই একসঙ্গে। আমি আর বিট্টু সেই প্রাইমারী থেকে বন্ধু। এক স্কুল, এখন কলেজও এক। করোনার জন্য মার্চ মাস থেকে সেই বাড়িতে। বাড়ি থেকে আর বেরোনো হয় না, তাই আর কারোর দেখাও পাইনা। এখন তো বাড়ির কাজ ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে, তাই সময়ও হয় না। সে যাই হোক, সবটা ম্যানেজ করে আজ সকলে এক জায়গায়। অনেকদিন বাদে কাকিমার হাতের চা আর মুড়ি মাখা। রাতে Swiggy করে ডিনার সারলাম সকলে। কে ক’টা কাবাব খেল, তা নিয়ে হিসেব চলছে। তখন প্রায় রাত দেড়টা। এমন সময় বিশাল একটা আওয়াজ। বারান্দায় ছুটলাম সবাই। দেখি, অ্যাম্বুলেন্সের তলায় চাপা পড়ে আছে একজন। কয়েকজন ভীড় করে আছেন। অ্যাম্বুলেন্সের চালকের দিকের দরজা খোলা। বোধ হয় ডাইভার পালিয়েছে। আর চারতলার উপর থেকে দেখা যাচ্ছে, আকাশি জামা পরা একজন চাকার তলায়। কয়েকজন টানাটানি করে আকাশি কাপড়ে মোড়া দলা পাকানো দেহটা টেনে বের করার চেষ্টা করছে। তবে দেহ তখন নিথর। মনে হয় স্পট ডেড। কাকিমা আমাদের বাইরে যেতে দিল না। চোখের সামনে আকাশি জামাটা ভাসছে। ঘণ্টা দুই পর শুলাম। স্নান করলাম, ঘুম আসছে না। এখনও চোখের সামনে আকাশি জামা। এরপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। ব্রেকফাস্ট করে বাড়ি ফিরবো। উঠে চা খেতে খেতে ফোনটা নিয়ে সবে ফেসবুকে অন হয়েছি, দেখি ঐ আকাশি জামা। আর মুখটা আমাদের ছোটবেলার স্কুল ভ্যানের অনিল কাকুর। ছবির ক্যাপশন ‘‘চুরি করতে গিয়ে কুকুরের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে গাড়ীর চালায় পিষ্ট হয়ে মৃত বছর চল্লিশের এক যুবক’’। অনিল মানে বাতাস। আটত্রিশ বছরের অনিল কাকু, অনিল সাধু। স্কুল ভ্যান চালক।

(২)

অতিমারী ও বাবুজী

‘‘বাবুজী জারা ধীরে চালো, বিজলি খাড়ি, য়াহা বিজলি খাড়ি’’ - ফোনে বাজছে, আর মধু তখন চোখ আঁকছে। আই শ্যাডো লাগানো হয়ে গেছে, এবার আই লাইনার। তুলিটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বারবার ধেবড়ে যাচ্ছে। আর মধু নাইটির একদিক ভিজিয়ে মুছে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। এমন সময় দরজায় টোকা দিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হতে বলে গেল মীনা মাসি। কাস্টোমার ওয়েট করছে। মধু যা হোক করে চোখ এঁকে ঠোটে লিপস্টিক লাগালো। আঁচল সামলে দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা মেলে বসল। ফোনে জানিয়ে দিল সে রেডি। করোনায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বারবার বলা হচ্ছে। তাই মধুরাও সামাজিক দূরত্ব মেনেই তাদের কাজ করছে। এখন ওরা ভার্চুয়াল মাধ্যমেই সেক্সুয়াল সার্ভিস দেয়। ভয়েস কল, ভিডিও কলই এখন ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে। ফোনের গান ততক্ষণে শেষ, আর বাবুজীকে নিয়ে ব্যস্ত মধু।

(৩)

অতিমারী ও পকেটমারী

শিবাজী, বয়েস ২৭, কর্পোরেট চাকুরে। বেলঘড়িয়ার এক অ্যাপার্টমেন্টের পাঁচতলায় দুই বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ভাড়ায় থাকে। ওর যা স্যালারি, তাতে মোটামুটি টেনেটুনে চলে যায়। বাড়িতে টাকা পাঠানোর ঝক্কি তেমন নেই, তাই বাঁচোয়া। ওর শিফটিং ডিউটি। কখনও ভোর পাঁচটা থেকে অফিস, আবার কখনও বিকেল চারটে। ঘুম থেকে উঠে অফিস, অফিস থেকে ফিরে ঘুম। উইক-এন্ডে বন্ধুদের সঙ্গে একটু আড্ডা, বান্ধবীর সঙ্গে বেরোনো। দু’তিন মাস পর বাড়ি যাওয়া। এভাবেই চলছিল বেশ। হঠাৎ বিশ্বব্যাপী করোনার থাবা। লকডাউন। স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি, বাজার সব বন্ধ। কয়েকদিন এভাবেই চলল। কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছিল না কোম্পানিগুলো। তবে কাজ থামিয়ে রাখা চলবে না। ক’টা দিন যেতেই work from home চালু হল। শুরু হল বাড়ি বসেই কাজ। স্কুল, কলেজ, অফিসের কাজ বাড়ি বসেই চলল। শিবাজীদের বাড়িতে মেশিন পাঠানো হয়। মেশিন মানে কম্পিউটার। এক সপ্তাহের মধ্যেই ওরাও কাজে লেগে গেল। এরই মধ্যে এপ্রিল মাসের শুরুতেই ঋজুর অফিস জানিয়ে দিল আপাতত কোম্পানী ওকে বেঞ্চে রাখছে। ঋজু শিবাজীর রুমমেট। অর্থাৎ, মাইনে কম দিয়ে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। কারণ কাজের চাপ কম। তিন মাসের মধ্যে কোম্পানির অন্য উইংসে ওকে ডেকে নেওয়া হবে। ঋজু বেশ মজাই পেল। ওর স্যালারি এমনিতেই বেশ ভালো। তাই ওর অসুবিধা হবে না। ওদের আরেক রুমমেট তমাল একটি প্রাইভেট কলেজে পড়ায়। ওদের যদিও কলেজে যেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। এখন অবশ্য পুরোপুরিই work from home চলছে। আজ এপ্রিলের ৭ তারিখ। প্রতি মঙ্গলবারের মতোই সেদিন মিটিং চলাকালীন বস্ জানিয়ে দেন কোম্পানি ওদের স্যালারী থেকে একটা অ্যালাওয়েন্স কেটে নেবে। শিবাজীর স্যালারী এমনিতেই কম। মিটিং শেষে ওরা ফোনে আলোচনা করে। আলোচনার পর রাতে বান্ধবীকে ফোন করে। বান্ধবী তখন হেডফোনে ওর সঙ্গে কথা বলছে, আর ফোন হাতে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করছে। হঠাৎই আনন্দীর চোখ পড়ল একটা খবরে। মুম্বাইয়ের একটি BPO ওদের ১৭০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে। কর্মীরা সেদিন অফিসের গেটে গিয়ে জানতে পারে, ওদের কাজ নেই। কোন নোটিস ছাড়াই ওদের বাদ দেওয়া হয়। শিবাজীকে সবটা পড়ে শোনাতে থাকে আনন্দী। আর শিবাজী চুপ করে শুনে যায়। যা বলবে ভেবেছিল, তা আর বলা হয়ে ওঠেনি। একটা সময় দাপিয়ে ছাত্র রাজনীতি করা ছেলেটাও কেমন মুখ বুজে থেকে যায়। কর্পোরেট সেক্টরে যে ইউনিয়ন থাকে না! শিবাজী মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে থাকে, অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে গেছে। পকেট কাটা গেলেও, খুন হতে হয়নি ওকে।

(৪)

অতিমারী ও ভিনদেশী তারা

শ্যামল কুমার বন্দোপাধ্যায়, বয়স ৭২, পাটুলীর বাসিন্দা। ৬৬ বছর বয়সী ঊষা বন্দোপাধ্যায় তাঁর একমাত্র ছায়াসঙ্গী। নেই নেই করে আজ ৪২ বছর এক ছাদের তলায় ওঁদের বাস। তার আগে অবশ্য আরও ৬ বছর। সব মিলে ৪৮ বছরের সাথী। সে কি কম কথা! ঋদ্ধি ওঁদের একমাত্র সন্তান। বছর চল্লিশের ঋদ্ধি স্ত্রী ও ৭ বছরের ছেলেকে নিয়ে আজ ৮ বছর UK-তে সেটল্ড। বিদেশ যাওয়ার পর মাঝে একবারই বাড়ি এসেছিল। তোজোর তখন ঐ বছর তিনেক বয়স হবে। বাড়ি আসার কি কম খরচ নাকি! তাই ওদের আর আসা হয়নি। ঋদ্ধি ও বৌমার অফিসের চাপ খুব, বাবা মার সাথে কথাও হয় না তেমন। আসলে কলকাতার সঙ্গে সময়ের ফারাক, আর ওদের যা কাজ! দুজনেই সংবাদমাধ্যমে। যাই হোক, তবে ঋদ্ধি বলছিল সামনের বছর আসার খুব চেষ্টা করবে। দিল্লিবাসী ছোটকার মেয়ে তুলির বিয়ে বলে কথা। শ্যামল বাবু ও ঊষা দেবী এখন তুলির বিয়ের দিন গুনছে। এরই মাঝে পৃথিবী জুড়ে কোভিড হানা। ছেলে মেসেজে খোঁজ নিয়েছে। সাবধানে থাকতে বলেছে। দু’জনের সংসারে দু’টো ঠিকে লোক এসে কাজ সেরে, রান্না করে চলে যায়। বাজার-হাট করা, ওষুধ কেনা এসব অবশ্য সারতো অজয়। বাড়ির সামনের রাস্তার মুখটায় অজয় একটা ছোট্ট গুমটি করে জামাকাপড় আয়রন করে। বিহারে বাড়ি ছেলেটির। লকডাউন উঠতেই বাড়ি চলে গেছে। অন্য সময় অজয় বাড়ি গেলে রান্নার মেয়েটাই এসব করে দিত। দু’জনেই সোনারপুর থেকে ভোরের ট্রেনে আসে। এখন ট্রেন বন্ধ, তাই ওরাও আর আসছে না। অগত্যা শ্যামলবাবুকেই বাইরে বেরোতে হচ্ছে। বাড়ির কাজ সামলাচ্ছেন দু’জনে মিলেই। বললে হবে, ৪৮ বছরের জোড়! তবে ক’দিন ধরেই শ্যামলবাবুর শরীরটা একটু খারাপ। এমনিতেই ওনার হাই সুগার। দু’জনেই ভাবছেন এতোদিন পর কাজের চাপ বাড়ায় শরীর খারাপ করছে। শ্যামলবাবু আর বাইরে বেরোচ্ছেন না। ঊষা দেবী খুব বকেছেন। তবে তিনদিন কেটে গেলেও জ্বর আর কমছে না। আজ আবার শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। এতো দূর থেকে ছেলে চিন্তা করবে বলে তাকেও কিছু জানাননি। সারারাত ঊষা দেবী শ্যামল বাবুর মাথার কাছে বসে। ক্রমশ শ্যামলবাবুকে নিথর হতে দেখছেন। রাতে যদিও কয়েকবার ছেলেকে ফোন করেছেন। তবে লাইন পাওয়া যায় নি। সকাল হতেই ঊষা দেবী হেল্প লাইনে ফোন করলেন। অ্যাম্বুলেন্স এলো। পিপিই পরা অ্যাম্বুলেন্স চালক বাড়ির বাইরে থেকে ডাক দিলেন। ঊষা দেবী শ্যামলবাবুকে গাড়িতে উঠতে বলছেন। ঋদ্ধি তখন তোজোর খবর নিতে অফিসের ক্যাফেটেরিয়ায়। ফোন সেরে ফিরে গেল ডেস্কে। খবরের খোঁজ করতে করতে চোখে পড়ল সেই ভাইরাল হওয়া ভিডিও, শ্যামল বাবু তখন প্রায় মাটিতে মিশে যাচ্ছেন। হামাগুড়ি দিয়ে গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করছেন। ছ’ফুট উচ্চতার শ্যামল বাবুকে টেনে টুলতে পারছেন না ঊষা দেবী। বলে চলেছেন, ‘‘কি গো ওঠো! এই দেখো অ্যাম্বুলেন্স এসেছে। আর একটু জোর দাও’’। শ্যামলবাবু পেরে উঠছেন না। ঊষা দেবী হাল ছাড়ছেন না। পিপিই পরা অ্যাম্বুলেন্স চালক সামনে দাঁড়িয়ে। কেউ এগিয়ে আসছেন না। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার লড়াই এবার থেমে গেল। শ্যামলবাবু তারা হয়ে গেলেন।

এখন ঊষা দেবী একা এই ভিনদেশে।