প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা - আগস্ট, ২০২০
Short Stories/ছোটগল্প
পরিত্রাণ
অঙ্কুর রায়
তোমরা আমার জন্য অনেক করেছ। তোমাদের জন্যই এই তিন মাস না খেয়ে থাকতে হয়নি। কিন্তু আর চাই না। বিশ্বাস করো হাত পেতে সাহায্য নিতে একদমই ভালো লাগে না। আমি যেক’টা ওষুধ পারবো সেই ক’টা কিনে দেব। তারপর মা-র ভাগ্য। আমার ভাগ্য। দরজা খুলে মিঠু আর অপুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললো কার্তিক।
মানুষের দুঃখে খুব কম মানুষই সমব্যথী হয়। বেশিরভাগ মানুষের অন্যের দুঃখে কিছুই আসে যায় না। কিছু মানুষ সহানুভূতির মুখোশ পরে সাহায্য করে, আত্মপ্রসাদ লাভের জন্য বা আত্মপ্রচার করার জন্য। খুব কম লোকই অন্যের প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজন মনে করে পাশে দাঁড়ায়।
নাথ বাড়ির মেজ ছেলের গাড়ি চালায় কার্তিক। অনেকগুলো গাড়ি, অনেকরকম ব্যবসা আর অনেক অনেক টাকা। কিন্তু লকডাউনের শুরু হতেই ‘সব ব্যবসা বন্ধ’, ‘গাড়ি তো আর চালাতে হচ্ছে না’ - এইসব অজুহাতে কার্তিকের মাইনে বন্ধ করে দিয়েছে মালিক। বাবা, মা, ছেলে-মেয়ে, বউ এতগুলো মুখে কীভাবে ভাতের যোগান দেবে এই ভেবে যখন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল কার্তিকের তখন মিঠু, অপুরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল কার্তিকের।
মিঠুদের সঙ্গে কার্তিকের এই যোগাযোগের মাঝেও রয়ে গেছে এক অসহায় অবমাননার ইতিহাস। সেদিন সকালে ঘরে কয়েক মুঠো চাল ছাড়া আর কিছু নেই। আর অন্যদিকে পার্সে নেই কয়েকটা কাগজের টুকরো ছাড়া আর কিছুই। বাজারে যাবার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে কার্তিক। শূন্য হাতে বাজারে গিয়ে কী হবে জানে না। শূন্য হাতে বাড়ি ফিরলেও কী বলবে জানে না। চোখ দুটো জ্বালা করছে। কোথায় যাচ্ছে জানে না। কী করবে জানে না। শুধু এইটুকু জানে মালিকের বাড়ি যাবে না। কিছুতেই না। কারণ ও জানে ওর সামান্য চাওয়ার পরিবর্তে যে শুধু রূঢ় প্রত্যাখ্যান আসবে তাই নয়, ও যেন কোন সংক্রমিত রুগি বা ঘেয়ো কুকুর এমন করেই ওকে দরজা থেকেই দুর দুর করে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। রাস্তায় লোকজন, সাইকেল, বাইক কিছুই দেখছে না কার্তিক। হঠাৎই ওর চোখ পড়লো সুজনদার উপর। কখনও সখনও সুজনদার গাড়ি ও চালিয়েছে। সুজনদার দরাজ গলায়, ‘‘কী রে, কই চললি?’’ শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি কার্তিক। তখনই ওর হাতে হাজার খানেক টাকা ধরিয়ে দেয় সুজন আর বলে, ‘‘যা বাজারটা ঘুরে আয়। ফিরে এসে মিঠুদের সাথে গিয়ে দেখা কর। আমি কথা বলে রাখছি।’’
এমন নয় যে মিঠুরা বেজায় বড়লোক। মিঠু একটা ছোটখাটো চাকরি করে আর অপু সরকারি কেরানি। কিন্তু লকডাউন শুরুর পরে মানুষের দুরবস্থা দেখে ওরা কয়েকজন ঠিক করে, কিছু করতে হবে। এলাকায় সক্রিয় বামপন্থী কর্মী হিসেবেই ওরা পরিচিত। কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয় বড় হয়ে উঠলে কিছু মানুষের সাহায্য থেকে হয়তো বঞ্চিতই হবে আর কিছু মানুষের কাছে হয়তো পৌঁছাতে পারবে না, তাই ওরা কোনও সংগঠনের নাম না নিয়েই কাজ শুরু করে। দেখা গেল, বহু মানুষ যে কষ্টে আছে এটা অনেক স্বচ্ছল মানুষেরই জানা আছে এবং সাধ্যমতো কম-বেশি টাকা বা অন্য কিছু দিয়ে সাহায্য করতে অনেকেই প্রস্তুত। সবার সাহায্য এক জায়গায় এনে প্রথমে পাড়ার অভাবীদের হাতে যৎসামান্য সাহায্য তুলে দিল ওরা। তারপর চেষ্টা করলো আশেপাশের অঞ্চলের মানুষের পাশেও যথাসাধ্য দাঁড়ানোর। এভাবেই তিন মাস ওরা কাজ করেছে। ধীরে ধীরে কাজের পরিধি বেড়েছে। এমনকি আমফানের পরে এলাকার জলমগ্ন মানুষদের কাছে রান্না করা খাবারও পৌঁছে দিয়েছিল। এমনকি সুন্দরবনের সবহারানো মানুষদের পাশেও ওরা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কিছু শুকনো খাবার, জল, তেরপল নিয়ে।
সুজনের কাছে হাত পেতেই কার্তিক মনে মনে সঙ্কুচিত হয়ে ছিল। ও আর যায়নি মিঠুদের কাছে। সুজনদাই জোর করে ওকে নিয়ে গিয়ে কথা বলিয়ে দেয়। প্রতি সপ্তাহে ওরাই ডেকে খুঁজে কার্তিকের হাতে চাল, ডাল, আলু এসব ধরিয়ে দিত। ওর মা যখন বুকে ব্যথা আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল তখন ওর হাতে অল্প কিছু টাকাও ধরিয়ে দিয়েছিল মিঠু, অপুরা।
লক ডাউন উঠে যাবার পরে মিঠুরা এখন ঠিক করেছে, গরিব বাড়ির বয়স্ক মানুষদের যাদের নিয়মিত প্রেসার, সুগার এসবের ওষুধ খেতে হয় তাদের হাতে পুরো মাসের ওষুধ তুলে দেবে। কারণ, এই লকডাউনে অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছে। এখন রোজকার বাজার-দোকানের টাকা জোগাড় করাই কঠিন। তার উপরে আবার ওষুধ। পাড়ার একজন ডাক্তারবাবু ওদের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন এক ওষুধের ডিলারের। সেই ভদ্রলোক ওদের পরিকল্পনা শুনে নিজের লভ্যাংশ ছেড়ে দিয়ে দামে দামে ওষুধ দিতে রাজি হয়েছেন।
তখনই ওরা কার্তিককে বলেছিল, ‘‘তোর মা হাসপাতাল থেকে ফিরলে প্রেসক্রিপশনটা দিস, আমরা ওষুধ এনে দেব।’’ আজ বিকেলে কার্তিকের সেই প্রেসক্রিপশনটা দিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হতে চললো, তখনও ওর দেখা নেই। এদিকে ডিলার ভদ্রলোকের কাছে আজ সন্ধ্যাবেলাই ওষুধের লিস্ট পৌঁছে দিয়ে আসার কথা। তাই ওরাই কার্তিকের ঘরে এসেছে ওষুধের নামগুলো লিখে নিতে।
কার্তিকের কথায় প্রথমে ওরা একটু থতমত খেয়ে গেল। কী বলবে বুঝতে না পেরে মিঠু তাকালো অপুর দিকে। অপু কার্তিকের কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে বললো, ‘‘চল, চা খেয়ে আসি।’’ চা খেতে খেতে অপু বললো, ‘‘হাত আমরা সবাই পাতছি, ভাই। দেখ আমি কি রোজ অফিস যাচ্ছি? কিন্তু মাসের শেষে হাত পেতে মাইনেটাতো ঠিক নিচ্ছি। লোকের থেকে হাত পেতে সাহায্যও নিচ্ছি। পাড়ার অনেক ঘরে যদি আগুন লাগে তবে যে দু’একটা ঘরে আগুন লাগেনি তারা কি নিশ্চিন্ত থাকতে পারে? দেখ ভাই, এই কঠিন সময়ে আমরা সবাই মিলে একসাথে একটা লড়াই করছি। একসাথে বেঁচে থাকার লড়াই। সবাই মিলে একসাথে না লড়লে আমরা সবাই যে একসাথে মরবো এইটা বুঝছিস না?
কুয়াশা কখন কার্তিকের চোখ ঝাপসা করে দিয়েছে কার্তিক নিজেও বোঝেনি।