Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা - আগস্ট, ২০২০

Short Stories/ছোটগল্প

তখন বিকেল

গৌতম ঘোষ


(১)

দীর্ঘ চল্লিশ মিনিট ধরে কথা বলে ফোনটা রেখে দিলেন অরুণাংশু।

‘‘কে ফোন করেছিলো? ছোট বৌদি?’’, অদিতি জিজ্ঞেস করে।

অরুণাংশু মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। চুক্‌ করে একটা ধ্বন্যাত্মক শব্দ ভেসে আসে অদিতির মুখ থেকে। ঠোঁটে চাপা হাসি। স্ত্রীর ঠোঁটের কোণের এই তির্যক হাসিটুকুর অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না তাঁর। ভালোও লাগে না একজন বিড়ম্বিত মানুষকে নিয়ে উপহাস করা। স্ত্রীকে বোঝেন তিনি। কিছু বলেন না, বলতেও পারেন না। বিগত দিনের অনেক টুকরো টুকরো ঘটনা যে সদ্য দেখা ছায়াছবির মতো মনে ভেসে আসে!

ছোট বৌদি মৃদুলা। তাঁর কনিষ্ঠ শ্যালক শ্যামলের স্ত্রী। কর্মজীবনের শুরু থেকেই শ্যামলের প্রতিষ্ঠা ছিলো আকাশছোঁয়া। সে আই আই টিয়ান, এছাড়া এম.বি.এ. করেছিলো জোকা থেকে। রীতিমতো মোটা দরের চাকরি করতো সে। বছরের অর্ধেক সময়ে দেশের বাইরে থাকতে হতো তাকে। এহেন স্বামীর গর্বে গরবিনী তার স্ত্রী। এই যৌথ সংসার, সেকেলে শ্বশুর-শাশুড়ি, অন্যান্য পরিজন কিম্বা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি মৃদুলা। এ বাড়ি ছাড়ার জন্যে বারবার বলা সত্ত্বেও, তার রাগারাগি মান-অভিমান সকল ইচ্ছেকে উপেক্ষা করে শ্যামল তাদের এই যৌথ পরিবার ভেঙে চলে যায়নি। সে স্পষ্টতই মৃদুলাকে বলেছিলো, বাবা মা দাদা-বৌদিদের ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। ফলত, শ্যামলের অনুশাসন যত কঠোর হয়েছে তত বেশি নিজের চারপাশের বৃত্তটাকে ছোট করে ফেলেছে মৃদুলা। অপছন্দের চেহারাটা তত বেশি স্পষ্ট করে তুলেছে। নীরব তাচ্ছিল্য আর অনুকম্পা ছাড়া এ বাড়ির লোকদের আর কিছু জোটেনি তার কাছ থেকে। শ্যামল দুঃখ পাবে ভেবে তার মা-বাবা ভাই-বোনেরা একদিনের জন্যও ছোট বৌয়ের নামে অভিযোগ করেনি। বরং তারা নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলো মৃদুলার ব্যাপারে। এক ছাদের নিচে থেকেও দূরত্ব ছিলো যোজনব্যাপী।

তিনতলার ছাদ-সহ সংলগ্ন ঘরগুলিতে মৃদুলার সংসার। শুধু খাওয়া ছাড়া এদের কারও সঙ্গে তার তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। শ্যামল সঙ্গে করে বাইরে নিয়ে না গেলে সারাদিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে বই পড়ছেন বা এমন কিছু করছেন। শ্যামলের অফিসের সুবাদে পরিচিত একই স্ট্যাটাসের মহিলাদের নিয়ে মাঝে মাঝে নিঝুম দুপুরে আসর বসতো তার ঘরে। বিয়ের পর অরুণাংশু এ বাড়ির ছোট বৌয়ের সাথে আত্মীয়তা করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু কঠিন শিলায় আঘাত খেয়ে ভেঙে যাওয়া ঢেউয়ের মতো তার সব আগ্রহ চুরমার হয়ে গিয়েছিলো। একথা কাউকে বলা যায়নি, অদিতিকেও নয়। মৃদুলাকে বোঝার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বুঝতে পারেনি সে। অরুণাংশু আরও অবাক হয়েছিলো যখন জানলো ভালো স্কুলে পড়াবার অছিলায় একমাত্র সন্তান বুলটুনকেও মৃদুলা নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেরাদুনে ও.এন.জি.সি-র অফিসার বড়ো ভায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। বুনো জন্তুর মতো শুধুমাত্র নিজের পুরুষকে আগলে রাখা ছাড়া আর কিছু বোঝেনি তাদের ছোট বৌদি।

ভাগ্যের লেখন কিন্তু ছিলো অন্যরকম। দল বেঁধে অফিসের বন্ধুরা বালেশ্বরের কাছে সিমলিপাল গিয়েছিলো তিনদিনের জন্যে। গায়ে জ্বর নিয়ে ফিরলো শ্যামল। সমস্ত চিকিৎসাকে ব্যর্থ করে ইহলোকের মায়া কাটালো সে। সত্যিকারের নিঃসঙ্গ হয়ে গেল মৃদুলা। পারলৌকিক কাজকর্ম মিটে গেলে তার নিজের ছেলে চেঁচামেচি, কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। কিছুতেই সে মায়ের কাছে থাকবে না। অগত্যা তাকে নিয়ে ফিরে গেলেন ওর দাদা। ক্রমশ বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন এক এক করে কে যে কোথায় গেলো তার ঠিক নেই। ঠিক যেমনটি ছিল এ বাড়িতে ঠিক তেমনই রইলো মৃদুলা আগের মতো। লোকজন নেই, বন্ধুবান্ধব নেই, এখন তাঁর সঙ্গী শুধু টেলিফোন আর টেলিভিশন। একটুকু কথা বলায় কদিন আগেও যার কৃপণতার শেষ ছিলো না। আর এখন? কথা শুরু করলে যেন ফুরোতেই চায় না।

আত্মীয়দের মধ্যে আছেন শুধু অরুণাংশু, এক সময় উপেক্ষা করলেও এখন তাঁকে বাতিল করতে পারেনি ছোটবৌদি। যাওয়া-আসা তেমন না থাকলেও টেলিফোনে নিত্য যোগাযোগ আছে তাঁদের।

(২)

তাঁর এই নতুন ঘরের বিছানায় শুলে একটা আতঙ্ক তাঁকে গ্রাস করে ফেলে। শুধু মনে হয় ঘরের নিচু সিলিংটা বুঝি আরও নিচে নেমে এসে ওঁকে পিষে ফেলবে যাঁতাকলের মতো। আজ দিন পনেরো হলো এই গ্যারাজ ঘরে সম্ভবত তাঁর জীবনের শেষ আশ্রয় হয়েছে। এর পরে রাস্তা ছাড়া আর কোথায় পাঠাবে তাঁকে? বৃদ্ধ বিপত্নীক বীতশ্রদ্ধ পুরঞ্জয়। আজ আর কোনো কিছুতেই অবাক হন না। দুই ছেলে মিলে গ্যারাজ ঘরটাকে সব আধুনিকতায় ভরে দিয়েছে। সামনে লোহার শাটারটা খুলে ফেলে নতুন দেওয়াল তুলে দরজা আর স্লাইডিং জানালা বসিয়ে দিয়েছে। ঘরে এ.সি-ও বসানো হয়েছে। ঝক্‌ঝকে ভিনাইলের মেঝে। সত্যি! সুখের যেন অন্ত নেই।

মনে মনে ভাবেন পুরঞ্জয়, স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে এই একটা বছরে অনেক কিছু বদলে গেলো। এই নিঃসঙ্গতার মাঝে মনে ভেসে আসে পুরানো দিনের কথা। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্রণতি স্কুল টিচার। তখন মাইনে কম ছিলো। দু’জনের মিলিত আয়ে সংসার চলতো কোনরকমে। তিন ঘরের ভাড়া বাড়ি। সংসারে তখন বাবা-মা ছিলেন, ছোট বোনটারও বিয়ে হয়নি। অনেক দায়-দায়িত্ব সামলে লটারিতে পাওয়া উপনগরীর এই জমিতে বাড়ি করেছিলেন তাঁরা। ছেলেদু’টো তখন ছোট। কেউই জানে না ধার-দেনা করে, সব ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী কি অবর্ণনীয় কষ্ট করে এই বাড়ি করেছিলেন। প্রথমেই দোতলা করতে পারেননি। একতলার দেনা শোধ হওয়ার পরে দোতলা করেছিলেন অনেক দিন বাদে। নিচের তলায় পুব-দক্ষিণ খোলা বাড়ির সেরা ঘরটা ওঁদের দখলে ছিলো। স্বপ্নের মতো কেটে গিয়েছিলো সেসব দিনগুলো।

এই তো সেদিন, মাস চারেক হলো প্রণতি চলে গেছে। সেদিন ছিল বড়ো ছেলের বড়ো ছেলে রূপাইয়ের জন্মদিন। সন্ধে থেকে বাড়িতে ভিড়। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের এই মজলিশে বেমানান পুরঞ্জয় দোতলার নির্জন বারান্দায় চুপচাপ বসেছিলেন। প্রণতির মৃত্যুর পরে এসব আনন্দে যোগ দিতে ভালো লাগে না তাঁর। বাড়ির কেউই তাঁকে ডাকে না, কেউই খোঁজ করে না। এসব উৎসবে আত্মীয়-স্বজন তেমন কেউ নিমন্ত্রিত হয় না।

আষাঢ়ের গুমোট গরম সত্ত্বেও বারান্দার ডেক চেয়ারে বসে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ছোটবৌমার ডাকে ঘুমের ঘোরটা কেটে যায় তাঁর। নিচে নেমে দেখেন ডাইনিং টেবলে সবাই তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, রূপাই এখনও নিচে ডাইনিং রুমে। অন্যদিন সে এসময় দোতলায় থাকে। আদরের নাতিকে দেখে স্মিত হেসে পুরঞ্জয় বললেন - ‘হ্যাপি বার্থ ডে রুপু!’

- ‘সে তো দাদান্‌ সকালে একবার জানালে -’

- ‘সে তো ছিলো বাংলায়, এখন সাহেবি কেতায় ইংরেজিতে জানালাম’ - চেয়ারে বসতে বসতে বললেন পুরঞ্জয়। ‘কিন্তু দাদুভাই, তুমি তো এতক্ষণ নিচে থাকো না - ‘কি ব্যাপার? জন্মদিন বলে?’

- ‘ঠিক তাই। জন্মদিনে তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো বলে শুতে যেতে পারছি না। প্লিজ দাদান! না করো না কিন্তু।’

হাসিমুখে নাতির মুখের দিকে তাকান তিনি। কি আর সে চাইতে পারে! তৃতীয় প্রজন্মের প্রথম সন্তান, প্রণতির আদরের নাতি, একে তো তিনি সবকিছুই দিতে পারেন!

‘বলো না কি চাই তোমার?’ উজ্জ্বল চোখ, মুখে তাঁর বিস্তৃত হাসি।

- ‘ অনেকদিন ধরেই বলবো ভাবছি। কিন্তু বলা হচ্ছে না, পাছে তুমি কিছু মনে করো।‘

- ‘বলো না! আমি কিছুই মনে করবো না।’

- ‘তোমার ঘরটা আমায় ছেড়ে দাও দাদান্‌। আমার খুব অসুবিধে হচ্ছে। স্যার কোচিং করবেন, বন্ধুরা আসে। জায়গা নেই, তাই তোমায় বলছি -‘

- ‘ কিন্তু ওটা তো তোমার দিদাইয়ের ঘর! তাঁর সব স্মৃতি, সবকিছু তো জড়িয়ে আছে ঐ ঘরটার সাথে -‘

- ‘মায়ের স্মৃতি তো রুপুর সাথেও জড়িয়ে আছে বাবা। বড়ো ছেলে রূপাইয়ের বাবা বললে, ‘ওই ঘরে তো ও মায়ের কাছে সারাদিন থাকতো -- আর তাছাড়া বাবা তুমি একটু ভেবে দেখো, ও তো বড়ো হচ্ছে, ওকে একটা আলাদা ঘর দেওয়া উচিত -’

ছেলের কথা শুনে স্তম্ভিত পুরঞ্জয়ের দু’চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চায়। এক পলক মুখ তুলে দেখেন, সবাই ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে প্রত্যাশিত একটা উত্তরের জন্য। স্পষ্টতই বুঝতে পারেন যে, এই দাবী অগ্রাহ্য করলে কাল থেকেই এই সংসারে তাঁর অস্তিত্বটুকু তুচ্ছ হয়ে যাবে। বাকি জীবনটা তাঁকে কাটাতে হবে তাচ্ছিল্য আর অবহেলার মধ্যে। অনেক কষ্টে মুখের বিষণ্ণতা কাটিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, নিস্‌ তুই -- কালই আমি ছেড়ে দেবো ঘরটা -’

- ‘না! না! কালই ছাড়তে হবে না -’ ছোট ছেলে বললো, ‘আগে বাইরের ঘরটা সাজিয়ে গুছিয়ে দিই, তারপর তুমি ছেড়ো বাবা, তাড়া কিছু নেই -’

যাতে ওঁর বিষাদগ্রস্ত মুখটা ওরা না দেখতে পায় তাই মুখ নিচু করে কোনরকমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়েন পুরঞ্জয়।

জীবনের বাইশটা বছর কাটিয়েছেন এই ঘরে। কত স্মৃতি, কত ভালোবাসা জড়িয়ে আছে এই ঘরে। ওরা তো জানে না, শরীরের শেষ রক্তবিন্দু নিংড়ে কীভাবে তাঁরা এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন। কে জানে, প্রণতি থাকলে হয়তো প্রতিবাদ করতো, কিন্তু উনি পারছেন না, পারবেন না। আবার ঠিক ছ’মাসের মাথায় বাইরের ঘরটাও ছাড়তে হলো তাঁকে। ছোট ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, সরকারের মস্ত চাকরি করলেও বেনামে ঠিকাদারীর ব্যবসা করে বন্ধুকে সামনে রেখে। তার ক্লায়েন্ট বাড়ছে। গ্যারাজে অফিস করলে বড়ো বড়ো ক্লায়েন্টদের কাছে মান থাকে না। তাই পুরঞ্জয়কে আবার ঘর ছাড়তে হলো ছেলের সম্মান বাঁচাতে।