Society, Language and Culture
সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি

(A Multidisciplinary Peer-Reviewed Journal)
A Unit of Society, Language and Culture Trust
ISSN: 2583-0341

প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা - আগস্ট, ২০২০

Poems/কবিতা

দুটি কবিতা

অশোক মুখোপাধ্যায়


[কেন জানি মনে হলো পাঠান্তে বোঝা যাবে কেন এই নান্দীমুখ। দুটি কবিতার মধ্যে আত্মসমীক্ষা আছে। যে সমীক্ষা বাচ্চা ও বুড়োর, কাঁচা ও পাকার, হয়তো বা ভেজাল ও নিভের্জালের। (১) হিবাকুশা বললেই হিরোশিমা নাগাসাকির কথা মনে আসে। এটি একটি সচেতন মনের ও সামাজিক ভাবনার কবিতা। প্রৌঢ় বয়সে, চেষ্টা করে, বহুবার কাটাকুটি করে এই উপস্থাপনা। (২) নিখিল ও কলকাতা গদ্য কবিতার আদলে লেখা। কবিতা নাকি চেতনার স্রোতস্বিনী। এই ধারণার সঙ্গে লেখাটি (কবিতা কিনা জানি না) মেলে। ব্যক্তিগত বোধ ও ভাবনার অনায়াস ও অবিরাম প্রকাশ। দু-কুড়ি বছরেরও আগে ইস্কুল ম্যগাজিনে বেরিয়েছিল এটি। তখন একাদশ ক্লাস। নিজেকে চিনব বলেই খুঁজে বার করেছি। নিতান্ত কিছু পরিবর্তন করে এই উপস্থাপনা। এই নিবেদনের পঙ্‌ক্তি-বন্ধনই মূলত একটি সমীক্ষা।]

হিবাকুশা
অশোক মুখোপাধ্যায়

মহাজাগতিক তাপ ছুঁয়ে গেছে স্থল
রক্তবমনে ভরে সাত নদী
মানুষ নিয়েছে আশ্রয় জলাশয়ে
শবদেহে ভরেছে স্রোতোবহা
কালো-জাদু বাতাসে হারায়
অভিশপ্ত দুটি লোকালয়
আকাশ-দস্যু দাঁত দিয়ে ছেঁড়ে মেঘ
ফেলে যায় ভূতলের শাপ
মারণ-শেলের যুগল-বন্দি ওরা
লিটল বয়, ফ্যাট-ম্যান,
বিলুপ্তি বলয় জুড়ে মার্কিন-নিঃশ্বাস
তম হয়ে আসে দিন
কালো বৃষ্টি আলো শুষে নেয়
হাওয়ার অকস্মাৎ বেগে
জানলা দিয়ে
ছিটকে উড়ে যায়
গুড়িয়া সাদোকা,
ভাসে আরও কচমা ছটাকেরা,
ব্যাঙের ছাতার মতো রঙিন আভায়
ঢাকে কালান্তক ধোঁয়া
চোখখাকী হারিয়েছে বোধ
উলটোমুখে শুয়ে থাকে মৃত্যু-নগর
গাছপালা পশুপাখি সাপ আর শিশু
শুধু কাঁদে কণ্ঠাগত প্রাণ
দিঙমূঢ় হাজার অনাথ
শিনিগামি নেমে এসে দেন স্নিগ্ধ চুমু;
মনের গভীরে পুরু ক্লেদ
শরীরে কোঁকড়ানো ছাল
মুখে তার করুণ উলকি
ক্ষীণ-স্বরে ডাকে
আতঙ্ক-পীড়িত চোখ
নিদ্রা-ভাঙা রাতে
দম-ছুট আপদের
শেষ প্রশ্ন জাগে
বধ্যভূমে এয়ো চাঁদ,
উনো হয়ে ভাসে।
ধ্বংসের দিকে চায় হতাদর
ক্রোধান্ধ ক্রান্তিকাল
কর্কট ক্ষালন
ভারী করে তোলে হাওয়া
নিকটের মৃত্যুও তৃপ্তি দেয় মনে
অরন্তুদ শীৎকারে ওঁচলা হয়ে থাকে
অনারোগ্য ক্ষতরোগ সঙ্গী করে বাঁচে
ওরা হিবাকুশা।
অন্য চোখে দেখে তারা,
অন্য কিছু ভাবে,
মারণ ফেলেছে শ্বাস
শঙ্খবিষে জ্বলে
জলের ভিতরে জল
স্নিগ্ধ হবে কবে
আদিত্য-উদিত দ্বীপ
লজ্জা ঢেকে রাখে
ওরা হিবাকুশা।
জীবন-যুদ্ধে শেষে হেরে
যুদ্ধহীন পৃথিবীর আবাহনে
চলে গেছে দ্বাদশী সাদোকা
চোখের লবণ জলে
ধুয়েছে আকাশ
পৃথিবী সেজেছে তাই হাজার সারসে
মিলেছে কোরাসে
হিবাকুশা।

 

নিখিল ও কলকাতা
অশোক মুখোপাধ্যায়

ঘুরপথ। পথে ঘোরা।
স্থির নয়, নির্দিষ্ট নয়, লক্ষ্য নয়। হাওয়ার সঙ্গে পাক খায়।
কেবল ঘোরা। পৃথিবী জুড়ে কেবল ঘোরা। ঘোড়া নয়।
অর্থাৎ তীব্রবেগে ছোটা নয়। অর্থাৎ পায়ের ’পরে পা নয়, ঘাড়ের পরেও ঘাড় নয়।
পথের পরেও পথ।
হাঁটার পরেও হাঁটা। মনের অলিতে গলিতে হাঁটা।
মনের মধ্যে মন বন্ধ। ঘরের মধ্যে হাওয়া।
আস্তেসুস্থে হাঁটা। সংসারীর হাঁটা।
কলকাতা সংসারী নয়। কলকাতা বিবাগী।
বিবাগীর কোলে বক। বকের কোলে পায়রা।
পায়রার কোলে যুবতী। যুবতীর কোলে যুবক।
কলকাতার কোলে পৃথিবী।
দূরাগত ওপারের ভেরী।
সূর্যের নারায়ণী তাপ।
দুপুরের নির্জনতা। নির্জনতায় লোকজন।
লোকজনে ধোঁয়া। ধোঁয়ার ভিতরে তামাকু পুড়ে যায়।
নিখিল।
নিখিল বিশ্ব নয়। নিখিল চরাচর নয়।
আকারের মধ্যে নিরাকার।
নিখিল আকার আবার নিরাকার।
নিখিল ও কলকাতা।
স্পর্ধায় নিখিল দৃপ্ত।
কলকাতা ও নিখিল।
দুর্বলতায় নিখিল জবুথবু।
নিখিলের মনে পড়ে ক্লান্ত পায়ে পিতামহের পথ হাঁটা।
কলকাতার রাস্তা জুড়ে পিতা পিতামহের পদধূলি
তুলে নিতে হয়।
নিখিল তুলে নেয় এবং ছিটকে পড়ে যায়।
চোখ উলটে। হাত উলটে।
নভশ্চক্ষুঃ নিখিল।
পিতা, পিতামহরা নেমে এসে দাঁড়ান শিয়রে।
অস্ফুট আদেশ নেমে আসে, যৌবন বন্ধক রাখো নিখিল।
নিখিল কর্জ দেয়।
অত্যায়ত চেয়ে থাকে। ভিজে আসে চোখ।
কলকাতার ফুসফুস হাঁকুপাঁকু করে।
মঙ্গলগ্রহের দিকে উড়ে যায়।
নিখিলকে ফেলে যায়।
প্রবৃদ্ধ নিখিল নিজের যৌবন ফেরত নেবে বলে নিষণ্ণ হয়ে থাকে।
আর বাকি সব কলকাতা তখন উড়ে চলে গেছে।